সরল গরল-প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথম ১০০ দিনের চাওয়া by মিজানুর রহমান খান
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সাফল্য কামনা করেছিলাম আগের লেখায়। কিন্তু তাঁর অগ্রাধিকার ও ক্ষেত্রগুলো কী হবে? সে সম্পর্কে আমাদের ভাবনাচিন্তা এখনই প্রকাশ করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘এখন বার ও বেঞ্চকে একত্রে কাজ করতে হবে। হাঁটলে চলবে না, আমাদের রীতিমতো দৌড়াতে হবে।’
এ মন্তব্য যথার্থ। বিচারপতি খায়রুল হক বিশ্ববরেণ্য বিচারক লর্ড ডেনিংয়ের একজন অনুরাগী বলে জানি। বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে একবার তিনি ডেনিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ‘লর্ড ডেনিং একজন গাধা’—ব্রিটিশ পত্রিকায় এ রকম শিরোনামে তাঁর রায়ের সমালোচনা বেরোয়। ডেনিং আদালত অবমাননার রুল জারি করেননি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই উদারতা দেখানো অপরিহার্য ছিল। অন্যদের সঙ্গে তাঁর এই যে তফাত, সেটাই তাঁকে বিখ্যাত করেছে। প্রধান বিচারপতি ডেনিংয়ের সঙ্গে একটা স্মৃতিচিহ্ন আজও আগলে রেখেছেন। আমরা সুপ্রিম কোর্টে ‘জুডিশিয়াল স্টেটসম্যানশিপ’ দেখতে চেয়েছিলাম। এবার আমরা তাঁর স্বাদ পেতে চাই। প্রধান নির্বাহীর প্রথম ১০০ দিনকে বলা হয় মধুচন্দ্রিমার কাল। নতুন প্রধান বিচারপতির প্রথম ১০০ দিনে যা দেখতে চাই, তার বয়ান শুরু করি।
এক. আপিল বিভাগের যথাযথ গঠন। এটি বর্তমানে আইনসম্মতভাবে চলছে না। কারণ, আইনে আছে এটি ১১ জন দিয়ে চলবে। বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব হতে হবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ। সম্ভাব্য তালিকা আগে প্রকাশ করতে হবে। আগের মতো গোপনীয়তা বজায় রাখা হলে তা আপিল বিভাগ-বর্ণিত ‘স্বচ্ছতা’কে মুলো দেখাবে। আর তা সংবিধানকে লঙ্ঘন করবে।
দুই. প্রধান বিচারপতি দুজনের শপথ পড়ানোর বিষয়ে বলেছেন, ‘এর আইনগত দিক এখনো আমরা বিচার করিনি।’ ভরসার কথা। তিনি বিচার করলে দেখবেন, পুরো ১৭ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্রপতির গেজেট মানা হয়নি। কিন্তু গেজেটের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপিল বিভাগের স্বচ্ছতার শর্ত। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একমত নই যে, দুজনকে শপথ না পড়িয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তবে তিনি (বিচারপতি ফজলুল করিম) অবশ্যই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, সেটা অন্য ক্ষেত্রে। তাঁকে যারা নিয়োগ দিয়েছিল, তারা কতটা সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল, সেটা একদিন দেশবাসী হিসাব করতে বসবে। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তকে ন্যায্যভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। সেটা না করে তেমন কাউকে অতিরিক্ত বিচারক করা হবে আরও ভয়ানক। বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার একটা অভ্যন্তরীণ বিধিব্যবস্থা গড়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে। সংবিধানে যে আইনের কথা বলা আছে, সেখানে সংসদের আইনের কথা বলা নেই। ওই রায়ের আলোকে সেই আইন তৈরি হোক।
তিন. অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রেষণ ও বদলি চরম অস্বচ্ছ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। প্রশাসন ক্যাডার আইন মন্ত্রণালয়ের দখল নিতে চেয়েছিল। তাই আইন লঙ্ঘন করে বিচার ক্যাডারের বাইরের লোককে আইনসচিব পদে বসানো হয়। এ কথা প্রধান বিচারপতির জানার কথা। নীতিগতভাবে নির্বাহী প্রকৃতির কাজে বিচারকদের প্রেষণের আমরা বিরোধী। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৪ সালে প্রথম এ বিষয়ে যে নীতি বেঁধে দেন, তা-ই আপিল বিভাগ ২০০৯ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের মামলায় চূড়ান্ত করেন। তবে কথা হলো, সমস্যা কাটেনি। আরেক ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। সেটা হলো, কোনো নীতিমালা না থাকা। প্রেষণ ও কর্মস্থল নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র নীতিমালা দরকার। এই নীতিমালা না থাকার কারণে অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। বিচারকদের প্রেষণ-সমর্থক রায় আমার জানামতে বিচারপতি খায়রুল হকই প্রথম দেন। সেই রায় পরে অনেক রায়ে সমর্থিত হয়েছে। এখন তার বাস্তবায়ন এমনভাবে নিশ্চিত হওয়া দরকার, যাতে তদবির ও মুখ দেখে খাদিম দেওয়ার সুযোগ রুদ্ধ হয়।
অধস্তন আদালতের বিচারকেরা স্বপ্ন দেখতে পারছেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এটাকে আমরা অনেক বড় সংকট মনে করি। সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকাকেন্দ্রিক পদগুলো তাঁদের বৈচারিক জীবনের বড় আকর্ষণ। কিন্তু নানা ধরনের তদবির হয়ে উঠেছে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া এবং তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। এ অবস্থাটি এক দিনে বদলানো যাবে না। তবে প্রক্রিয়াটি তো শুরু করতে হবে।
বিচারপতি ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হয়েই ১৬ মার্চ ২০১০ সুপ্রিম কোর্টের কাউকে না জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে প্রেষণে থাকা প্রায় ১০৭ জন (আইনসচিব ও রেজিস্ট্রার বাদে) বিচারককে ‘জরুরি ভিত্তিতে’ গণবদলির ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আইন মন্ত্রণালয় ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দুই দিন পর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের করণীয় জানতে চাইলাম। আইনমন্ত্রী যথার্থ বলেছিলেন, এই চিঠি তো আপিল বিভাগের রায়ের বরখেলাপ।
প্রধান বিচারপতির সেই চিঠির গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। এ রকম চিঠি লেখার বিষয়টি ছিল তাঁর একক সিদ্ধান্ত। বিধি অনুযায়ী তিনি ফুল কোর্ট বা জিএ কমিটিতে অনুমোদন করিয়ে নেননি। অনেক পরে আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে প্রেষণে থাকা মাত্র পাঁচ বিচারকের বদলির প্রস্তাব পাঠায়। অতি সম্প্রতি তা কার্যকর হয়েছে। ১০০ দিনের মধ্যে যেটা সম্ভব, তা হলো তিন বছর বা অনুরূপ নির্দিষ্ট সময়ের বেশি একই পদে বা স্থানে প্রেষণে থাকা ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়া। ব্যতিক্রম ঘটাতে চাইলে প্রধান বিচারপতি সেই সিদ্ধান্ত ফুল কোর্টে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন।
চার. জিএ কমিটি গুরুত্বপূর্ণ। কমিটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রধান বিচারপতি মানে সুপ্রিম কোর্ট নন—বড় আওয়াজ তুলেছিলাম। পরে ফুল কোর্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রধান বিচারপতি একা নন, বদলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি। এ কমিটি থেকে অনেক আগেই পদত্যাগ করেছিলেন বিচারপতি খন্দকার মুসা খালেদ। কিন্তু বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। অথচ প্রধান বিচারপতি হয়েই বিচারপতি ফজলুল করিম ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এতে একটি পদ শূন্য হয়। দ্রুততার সঙ্গে তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন। কিন্তু তিনি নতুন কাউকে আনলেন না। অনেক সময় অনেক ঘটনায় মনে হয়, আমাদের প্রধান বিচারপতিরা সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কিন্তু গণতন্ত্র মূলত সেটাই দাবি করে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর নিম্ন আদালতকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাজের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অথচ সাত মাসের বেশি সময় ধরে ওই পদটি শূন্য রাখা হলো। আশা করব, জিএ কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে। এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রেষণ ও বদলি-সংক্রান্ত চিঠি চালাচালিতে জিএ কমিটি ও ফুল কোর্টকে আস্থায় নেওয়া হবে। প্রধান বিচারপতি পারতপক্ষে জিএ কমিটি ও ফুল কোর্টকে এড়াবেন না।
পাঁচ. ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও চট্টগ্রাম দায়রা জজের পদ শূন্য রয়েছে। এই যে শূন্য থাকা, তাতে আমরা বিচারিক নয়, রাজনৈতিক প্রেতের ছায়া দেখি। গত এপ্রিলে নিয়োগ পাওয়া ১৭ বিচারকের দুজন ছিলেন জেলা জজ। সর্বজ্যেষ্ঠ জেলা জজ আবদুল গফুর ছিলেন ঢাকার জেলা জজ। তিনি কারসাজির শিকার হন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করে তাঁকে অপসারণ করেছিলেন। অবশ্য প্রশংসনীয়ভাবে সেই ভুল শুধরে পরে প্রধানমন্ত্রী তা প্রত্যাহারও করেছিলেন। এক বছরের অল্প পরই আবদুল গফুরকে ঢাকা জেলা জজ থেকে সরানো হয়েছিল। তাঁর পরিবর্তে আনা কৃষ্ণা দেবনাথ অতিরিক্ত বিচারক হন। এরপর সেখানে আসেন চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ ভবানী প্রসাদ সিংহ। দুই মাস আগে তিনি অবসরে যান। সেই থেকে ঢাকা জেলা জজ এবং তাঁর আগের চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজের পদ শূন্য। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ এ এন এম বশির উল্লাহও গত এপ্রিলে অতিরিক্ত বিচারক হন। সেই থেকে তাঁর পদও শূন্য। তাঁদের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত হওয়ার কথা জ্যেষ্ঠতা মেনে। কিন্তু সেখানেও সরকারি সংগীত বাজে। জ্যেষ্ঠতা মানা হচ্ছে না। কোনো নীতিমালাও নেই। কেন এমনটা ঘটে? সরকারের হিসাব মেলানোর স্বার্থে মূলত এমনটা ঘটে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত পদায়নের একটা ঐতিহ্য ছিল। ঢাকা জেলা জজ ও মহানগর দায়রা জজের মতো পদগুলোতে জ্যেষ্ঠ তালিকার শীর্ষ ১০ কিংবা ১৫-এর মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। অথচ এখন আমরা বিস্ময়কর সব কাণ্ডকারখানা দেখি। ঢাকা জেলা জজ পদে সরকারের একজন বিশেষ পছন্দের প্রার্থী আছেন। জ্যেষ্ঠ তালিকায় তাঁর চেয়ে ২০০ জন ওপরে আছেন। বিদায়ী ও তাঁর আগের প্রধান বিচারপতি ওই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। আমরা নীতিগতভাবে জ্যেষ্ঠতার ক্রম ডিঙানোর বিরোধী নই। কিন্তু কেন ডিঙানো হবে বা কেন হবে না, তার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা থাকতে হবে। ফাইলে নোট থাকা চাই। সরকারের প্রস্তাবে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্টকেও তা পত্রপাঠ নাকচ কিংবা গ্রহণ করলে চলবে না। তাঁকেও কারণ দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, এসব কারণ আইনের ক্লাসে ও প্রশিক্ষণে পড়াতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। এই ধারার আচানক অবসান ঘটানো সহজ নয়। তবে সে লক্ষ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করতে পারাটাই হবে বড় সাফল্য। কতিপয় কর্মস্থলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সেখানে দায়িত্ব পালনের অতিরিক্ত যোগ্যতা নির্দিষ্ট করা সম্ভব। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার পদে এখন যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা আসলে সংবিধানসম্মত হয় না। তাই কতিপয় পদের জন্য নীতিমালা জরুরি।
ছয়. সাবেক আইনসচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের মামলার বিলম্বিত রায়ের আমরা পরিণতি দেখলাম। আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন, হাবিবুল আউয়াল সচিব হবেন না। সচিব হবেন বিচারকদের কেউ। অসন্তুষ্ট আমলাযন্ত্র একহাত নিল ও নিয়ে চলেছে। বিচারকদের কাউকে সচিবের পদমর্যাদা দিতে সরকার অনাগ্রহী। ঠেকনা দিয়ে চলছে। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের জেলা জজকে ভারপ্রাপ্ত আইনসচিব করা হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি এটা একটা উপহাস। আশা করব, প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ আইনসচিব পদে একজন দক্ষ জেলা জজের নিয়োগ নিশ্চিত করবেন। প্রেষণে দীর্ঘ সময় ধরে আইন মন্ত্রণালয়সহ যে যেখানেই থাকুন, তাঁদের সরাতে অগ্রাধিকার দেবেন। তবে এটা এমন উপযুক্ত নীতির ভিত্তিতে হতে হবে, যাতে সবার মনে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধ জন্মে। কোটারি বা যান্ত্রিক বদলি—কোনোটিরই শিকার না হন।
সাত. সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য ২০০৩ সালের আচরণবিধির প্রজ্ঞাপন হয়নি। এটা কখনো বিচারকদের বিলিও করা হয়নি। এ দুটো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
আট. বহু বছর ধরে প্রধান বিচারপতির কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়ে আসছি। পত্র দিয়েছি। কখনো জবাব পাইনি। অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। ভারতের উদাহরণ দেখিয়েছি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ফরম্যাট দেওয়া আছে। সেই ফরম্যাটে সম্পদের বিবরণ আশা করি। বিচারকদের কাছে সম্পদের বিবরণী চাওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির হাতে ন্যস্ত। সেই ক্ষমতার ত্বরিত প্রয়োগ আশা করি।
নয়. ছাত্রদের মারতে পারবেন না শিক্ষকেরা। হাইকোর্টই তা বলেছেন। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ সমুন্নত রাখতে আমি প্রধান বিচারপতির আশু প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করি। এতে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ সাম্প্রতিক কালে অনেক বিশিষ্ট নাগরিক ও ডিসিদের দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। দোষী সাব্যস্ত করে কাউকে ফাঁসি দেওয়াও কিন্তু লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা অনুরূপ ব্যবহার নয়।
দশ. প্রধান বিচারপতি গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘২৭০ মিনিটে ২৪০টি মামলায় জামিন দেওয়া কি সঠিক হয়েছে?’ কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একে সঠিক বলবেন না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি তদন্ত প্রতিবেদন (প্রতি ৩৮ সেকেন্ডে একটি জামিন) প্রকাশ করেছিলাম। আমরা সবিনয়ে বলতে চাই, মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আমরা প্রশ্ন নয়, প্রতিকার চাই। উপযুক্ত প্রতিকার হয়নি বলেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতির নিজের লেখা আগাম জামিন-সংক্রান্ত একটি মাইলফলক রায় হাইকোর্টের একজন বিচারক অগ্রাহ্য করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল রায়ের কপি হাতে ছুটে গেছেন। সুফল মেলেনি।
এগারো. সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ, এমনকি অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ে একটি বড় সম্মেলন হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সম্মেলন করার নজির আছে। এ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের বাজেট, নিরীক্ষা, প্রশাসন, মামলা ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, আইনের শূন্যতা পূরণ, বিদ্যমান বিধির হালনাগাদকরণ (পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট রুলস আর কত?), বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ইত্যাদি হতে পারে আলোচনার এজেন্ডা। প্রথম ১০০ দিনে এ ধরনের সম্মেলন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফুল কোর্ট হবে ‘মিনি পার্লামেন্ট। সেখানে বিষয়ভিত্তিক সাব কমিটি থাকবে। ফুল কোর্টের ক্লান্তিকর দিনগুলো কেটে যাক’। ফুল কোর্টের সভা শেষে ব্রিফিং হোক। জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগে খোলা ফাইল গতি পাক।
লর্ড ডেনিংকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষও করি তাঁর একটি নন্দিত উক্তি দিয়ে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের জানার শতভাগ অধিকার আছে।’ কিন্তু বাস্তবে এই অধিকারের অনুশীলনই তো সমস্যা বাধায়। তাই ডেনিং আদালত অবমাননা মামলার একটি আবেদন নাকচ করে বলেন, ‘আমাকে এটা পুনর্বার বলতে দিন যে আমাদের নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় এই (আদালত অবমাননা) এখতিয়ার আমরা কখনো ব্যবহার করব না। এমনকি যারা আমাদের বিরুদ্ধে বলবে, তাদের দমনেও এটা আমরা ব্যবহার করব না। আমরা সমালোচনাকে ভয় করি না, এমনকি বিরক্তও হই না। বাজি ধরার মতো আরও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আর সেটা বাকস্বাধীনতার নিজের থেকে কম কিছুই হতে পারে না।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
এক. আপিল বিভাগের যথাযথ গঠন। এটি বর্তমানে আইনসম্মতভাবে চলছে না। কারণ, আইনে আছে এটি ১১ জন দিয়ে চলবে। বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব হতে হবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ। সম্ভাব্য তালিকা আগে প্রকাশ করতে হবে। আগের মতো গোপনীয়তা বজায় রাখা হলে তা আপিল বিভাগ-বর্ণিত ‘স্বচ্ছতা’কে মুলো দেখাবে। আর তা সংবিধানকে লঙ্ঘন করবে।
দুই. প্রধান বিচারপতি দুজনের শপথ পড়ানোর বিষয়ে বলেছেন, ‘এর আইনগত দিক এখনো আমরা বিচার করিনি।’ ভরসার কথা। তিনি বিচার করলে দেখবেন, পুরো ১৭ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়িত হয়নি। রাষ্ট্রপতির গেজেট মানা হয়নি। কিন্তু গেজেটের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপিল বিভাগের স্বচ্ছতার শর্ত। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একমত নই যে, দুজনকে শপথ না পড়িয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তবে তিনি (বিচারপতি ফজলুল করিম) অবশ্যই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, সেটা অন্য ক্ষেত্রে। তাঁকে যারা নিয়োগ দিয়েছিল, তারা কতটা সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল, সেটা একদিন দেশবাসী হিসাব করতে বসবে। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তকে ন্যায্যভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। সেটা না করে তেমন কাউকে অতিরিক্ত বিচারক করা হবে আরও ভয়ানক। বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার একটা অভ্যন্তরীণ বিধিব্যবস্থা গড়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে। সংবিধানে যে আইনের কথা বলা আছে, সেখানে সংসদের আইনের কথা বলা নেই। ওই রায়ের আলোকে সেই আইন তৈরি হোক।
তিন. অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রেষণ ও বদলি চরম অস্বচ্ছ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। প্রশাসন ক্যাডার আইন মন্ত্রণালয়ের দখল নিতে চেয়েছিল। তাই আইন লঙ্ঘন করে বিচার ক্যাডারের বাইরের লোককে আইনসচিব পদে বসানো হয়। এ কথা প্রধান বিচারপতির জানার কথা। নীতিগতভাবে নির্বাহী প্রকৃতির কাজে বিচারকদের প্রেষণের আমরা বিরোধী। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৪ সালে প্রথম এ বিষয়ে যে নীতি বেঁধে দেন, তা-ই আপিল বিভাগ ২০০৯ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের মামলায় চূড়ান্ত করেন। তবে কথা হলো, সমস্যা কাটেনি। আরেক ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। সেটা হলো, কোনো নীতিমালা না থাকা। প্রেষণ ও কর্মস্থল নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র নীতিমালা দরকার। এই নীতিমালা না থাকার কারণে অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। বিচারকদের প্রেষণ-সমর্থক রায় আমার জানামতে বিচারপতি খায়রুল হকই প্রথম দেন। সেই রায় পরে অনেক রায়ে সমর্থিত হয়েছে। এখন তার বাস্তবায়ন এমনভাবে নিশ্চিত হওয়া দরকার, যাতে তদবির ও মুখ দেখে খাদিম দেওয়ার সুযোগ রুদ্ধ হয়।
অধস্তন আদালতের বিচারকেরা স্বপ্ন দেখতে পারছেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এটাকে আমরা অনেক বড় সংকট মনে করি। সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকাকেন্দ্রিক পদগুলো তাঁদের বৈচারিক জীবনের বড় আকর্ষণ। কিন্তু নানা ধরনের তদবির হয়ে উঠেছে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া এবং তা দীর্ঘ মেয়াদে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। এ অবস্থাটি এক দিনে বদলানো যাবে না। তবে প্রক্রিয়াটি তো শুরু করতে হবে।
বিচারপতি ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হয়েই ১৬ মার্চ ২০১০ সুপ্রিম কোর্টের কাউকে না জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে প্রেষণে থাকা প্রায় ১০৭ জন (আইনসচিব ও রেজিস্ট্রার বাদে) বিচারককে ‘জরুরি ভিত্তিতে’ গণবদলির ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আইন মন্ত্রণালয় ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দুই দিন পর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের করণীয় জানতে চাইলাম। আইনমন্ত্রী যথার্থ বলেছিলেন, এই চিঠি তো আপিল বিভাগের রায়ের বরখেলাপ।
প্রধান বিচারপতির সেই চিঠির গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। এ রকম চিঠি লেখার বিষয়টি ছিল তাঁর একক সিদ্ধান্ত। বিধি অনুযায়ী তিনি ফুল কোর্ট বা জিএ কমিটিতে অনুমোদন করিয়ে নেননি। অনেক পরে আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে প্রেষণে থাকা মাত্র পাঁচ বিচারকের বদলির প্রস্তাব পাঠায়। অতি সম্প্রতি তা কার্যকর হয়েছে। ১০০ দিনের মধ্যে যেটা সম্ভব, তা হলো তিন বছর বা অনুরূপ নির্দিষ্ট সময়ের বেশি একই পদে বা স্থানে প্রেষণে থাকা ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়া। ব্যতিক্রম ঘটাতে চাইলে প্রধান বিচারপতি সেই সিদ্ধান্ত ফুল কোর্টে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন।
চার. জিএ কমিটি গুরুত্বপূর্ণ। কমিটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রধান বিচারপতি মানে সুপ্রিম কোর্ট নন—বড় আওয়াজ তুলেছিলাম। পরে ফুল কোর্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রধান বিচারপতি একা নন, বদলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি। এ কমিটি থেকে অনেক আগেই পদত্যাগ করেছিলেন বিচারপতি খন্দকার মুসা খালেদ। কিন্তু বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। অথচ প্রধান বিচারপতি হয়েই বিচারপতি ফজলুল করিম ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এতে একটি পদ শূন্য হয়। দ্রুততার সঙ্গে তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন। কিন্তু তিনি নতুন কাউকে আনলেন না। অনেক সময় অনেক ঘটনায় মনে হয়, আমাদের প্রধান বিচারপতিরা সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কিন্তু গণতন্ত্র মূলত সেটাই দাবি করে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর নিম্ন আদালতকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাজের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অথচ সাত মাসের বেশি সময় ধরে ওই পদটি শূন্য রাখা হলো। আশা করব, জিএ কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে। এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রেষণ ও বদলি-সংক্রান্ত চিঠি চালাচালিতে জিএ কমিটি ও ফুল কোর্টকে আস্থায় নেওয়া হবে। প্রধান বিচারপতি পারতপক্ষে জিএ কমিটি ও ফুল কোর্টকে এড়াবেন না।
পাঁচ. ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও চট্টগ্রাম দায়রা জজের পদ শূন্য রয়েছে। এই যে শূন্য থাকা, তাতে আমরা বিচারিক নয়, রাজনৈতিক প্রেতের ছায়া দেখি। গত এপ্রিলে নিয়োগ পাওয়া ১৭ বিচারকের দুজন ছিলেন জেলা জজ। সর্বজ্যেষ্ঠ জেলা জজ আবদুল গফুর ছিলেন ঢাকার জেলা জজ। তিনি কারসাজির শিকার হন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করে তাঁকে অপসারণ করেছিলেন। অবশ্য প্রশংসনীয়ভাবে সেই ভুল শুধরে পরে প্রধানমন্ত্রী তা প্রত্যাহারও করেছিলেন। এক বছরের অল্প পরই আবদুল গফুরকে ঢাকা জেলা জজ থেকে সরানো হয়েছিল। তাঁর পরিবর্তে আনা কৃষ্ণা দেবনাথ অতিরিক্ত বিচারক হন। এরপর সেখানে আসেন চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ ভবানী প্রসাদ সিংহ। দুই মাস আগে তিনি অবসরে যান। সেই থেকে ঢাকা জেলা জজ এবং তাঁর আগের চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজের পদ শূন্য। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ এ এন এম বশির উল্লাহও গত এপ্রিলে অতিরিক্ত বিচারক হন। সেই থেকে তাঁর পদও শূন্য। তাঁদের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত হওয়ার কথা জ্যেষ্ঠতা মেনে। কিন্তু সেখানেও সরকারি সংগীত বাজে। জ্যেষ্ঠতা মানা হচ্ছে না। কোনো নীতিমালাও নেই। কেন এমনটা ঘটে? সরকারের হিসাব মেলানোর স্বার্থে মূলত এমনটা ঘটে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত পদায়নের একটা ঐতিহ্য ছিল। ঢাকা জেলা জজ ও মহানগর দায়রা জজের মতো পদগুলোতে জ্যেষ্ঠ তালিকার শীর্ষ ১০ কিংবা ১৫-এর মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। অথচ এখন আমরা বিস্ময়কর সব কাণ্ডকারখানা দেখি। ঢাকা জেলা জজ পদে সরকারের একজন বিশেষ পছন্দের প্রার্থী আছেন। জ্যেষ্ঠ তালিকায় তাঁর চেয়ে ২০০ জন ওপরে আছেন। বিদায়ী ও তাঁর আগের প্রধান বিচারপতি ওই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। আমরা নীতিগতভাবে জ্যেষ্ঠতার ক্রম ডিঙানোর বিরোধী নই। কিন্তু কেন ডিঙানো হবে বা কেন হবে না, তার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা থাকতে হবে। ফাইলে নোট থাকা চাই। সরকারের প্রস্তাবে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্টকেও তা পত্রপাঠ নাকচ কিংবা গ্রহণ করলে চলবে না। তাঁকেও কারণ দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, এসব কারণ আইনের ক্লাসে ও প্রশিক্ষণে পড়াতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত। এই ধারার আচানক অবসান ঘটানো সহজ নয়। তবে সে লক্ষ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করতে পারাটাই হবে বড় সাফল্য। কতিপয় কর্মস্থলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সেখানে দায়িত্ব পালনের অতিরিক্ত যোগ্যতা নির্দিষ্ট করা সম্ভব। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার পদে এখন যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা আসলে সংবিধানসম্মত হয় না। তাই কতিপয় পদের জন্য নীতিমালা জরুরি।
ছয়. সাবেক আইনসচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের মামলার বিলম্বিত রায়ের আমরা পরিণতি দেখলাম। আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন, হাবিবুল আউয়াল সচিব হবেন না। সচিব হবেন বিচারকদের কেউ। অসন্তুষ্ট আমলাযন্ত্র একহাত নিল ও নিয়ে চলেছে। বিচারকদের কাউকে সচিবের পদমর্যাদা দিতে সরকার অনাগ্রহী। ঠেকনা দিয়ে চলছে। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের জেলা জজকে ভারপ্রাপ্ত আইনসচিব করা হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি এটা একটা উপহাস। আশা করব, প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ আইনসচিব পদে একজন দক্ষ জেলা জজের নিয়োগ নিশ্চিত করবেন। প্রেষণে দীর্ঘ সময় ধরে আইন মন্ত্রণালয়সহ যে যেখানেই থাকুন, তাঁদের সরাতে অগ্রাধিকার দেবেন। তবে এটা এমন উপযুক্ত নীতির ভিত্তিতে হতে হবে, যাতে সবার মনে সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধ জন্মে। কোটারি বা যান্ত্রিক বদলি—কোনোটিরই শিকার না হন।
সাত. সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য ২০০৩ সালের আচরণবিধির প্রজ্ঞাপন হয়নি। এটা কখনো বিচারকদের বিলিও করা হয়নি। এ দুটো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
আট. বহু বছর ধরে প্রধান বিচারপতির কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়ে আসছি। পত্র দিয়েছি। কখনো জবাব পাইনি। অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। ভারতের উদাহরণ দেখিয়েছি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ফরম্যাট দেওয়া আছে। সেই ফরম্যাটে সম্পদের বিবরণ আশা করি। বিচারকদের কাছে সম্পদের বিবরণী চাওয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির হাতে ন্যস্ত। সেই ক্ষমতার ত্বরিত প্রয়োগ আশা করি।
নয়. ছাত্রদের মারতে পারবেন না শিক্ষকেরা। হাইকোর্টই তা বলেছেন। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ সমুন্নত রাখতে আমি প্রধান বিচারপতির আশু প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করি। এতে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ সাম্প্রতিক কালে অনেক বিশিষ্ট নাগরিক ও ডিসিদের দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। দোষী সাব্যস্ত করে কাউকে ফাঁসি দেওয়াও কিন্তু লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা অনুরূপ ব্যবহার নয়।
দশ. প্রধান বিচারপতি গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘২৭০ মিনিটে ২৪০টি মামলায় জামিন দেওয়া কি সঠিক হয়েছে?’ কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একে সঠিক বলবেন না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি তদন্ত প্রতিবেদন (প্রতি ৩৮ সেকেন্ডে একটি জামিন) প্রকাশ করেছিলাম। আমরা সবিনয়ে বলতে চাই, মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আমরা প্রশ্ন নয়, প্রতিকার চাই। উপযুক্ত প্রতিকার হয়নি বলেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতির নিজের লেখা আগাম জামিন-সংক্রান্ত একটি মাইলফলক রায় হাইকোর্টের একজন বিচারক অগ্রাহ্য করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল রায়ের কপি হাতে ছুটে গেছেন। সুফল মেলেনি।
এগারো. সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ, এমনকি অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ে একটি বড় সম্মেলন হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সম্মেলন করার নজির আছে। এ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের বাজেট, নিরীক্ষা, প্রশাসন, মামলা ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, আইনের শূন্যতা পূরণ, বিদ্যমান বিধির হালনাগাদকরণ (পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট রুলস আর কত?), বিচার বিভাগ পৃথক্করণ ইত্যাদি হতে পারে আলোচনার এজেন্ডা। প্রথম ১০০ দিনে এ ধরনের সম্মেলন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ফুল কোর্ট হবে ‘মিনি পার্লামেন্ট। সেখানে বিষয়ভিত্তিক সাব কমিটি থাকবে। ফুল কোর্টের ক্লান্তিকর দিনগুলো কেটে যাক’। ফুল কোর্টের সভা শেষে ব্রিফিং হোক। জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগে খোলা ফাইল গতি পাক।
লর্ড ডেনিংকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষও করি তাঁর একটি নন্দিত উক্তি দিয়ে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের জানার শতভাগ অধিকার আছে।’ কিন্তু বাস্তবে এই অধিকারের অনুশীলনই তো সমস্যা বাধায়। তাই ডেনিং আদালত অবমাননা মামলার একটি আবেদন নাকচ করে বলেন, ‘আমাকে এটা পুনর্বার বলতে দিন যে আমাদের নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় এই (আদালত অবমাননা) এখতিয়ার আমরা কখনো ব্যবহার করব না। এমনকি যারা আমাদের বিরুদ্ধে বলবে, তাদের দমনেও এটা আমরা ব্যবহার করব না। আমরা সমালোচনাকে ভয় করি না, এমনকি বিরক্তও হই না। বাজি ধরার মতো আরও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আর সেটা বাকস্বাধীনতার নিজের থেকে কম কিছুই হতে পারে না।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments