দূরদেশ-ব্যর্থতার দায় শুধু দল নয়, গোটা দেশকেই বইতে হবে by আলী রীয়াজ
পাবনায় সরকারি দলের কর্মীদের হাতে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর এ ঘটনার পর সমাজের সর্বস্তরের মানুষই তার প্রতিবাদ করেছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও এ ঘটনার সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ
করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ২১ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশন দেন। অন্যদিকে সেখানকার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব নিয়ে লেখালেখি, গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তৃতা-বিবৃতি, আলোচনা-বিতর্কে অংশগ্রহণকারীরা কেউই এ ধরনের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেননি। কেউই বলেননি যে তিনি এমন ঘটনায় খুবই অবাক হয়েছেন। আমার কাছে এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা যখন ঘোষণা করেন, দেশের কমিউনিটি সার্ভিস ক্লিনিকের সাড়ে ১৩ হাজার চাকরি কেবল আওয়ামী লীগের ‘পরীক্ষিত’ কর্মীদের দেওয়া হবে, তখনো যতটা ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে, ততটা বিস্ময় সৃষ্টি হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারি দলের কর্মীদের আচার-আচরণ থেকে কম-বেশি সবাই অনুমান করছিলেন যে তাঁরা কেবল দলের ভেতরে আত্মঘাতী সংঘর্ষেই যুক্ত থাকবেন না। প্রথমে নিজের দলের কর্মীদের ওপর চড়াও হওয়া দিয়ে শুরু হলেও অবৈধভাবে টেন্ডার দখল, জমিজমা দখল, সরকারি অর্থ ভাগবাটোয়ারা ইত্যাদিতে তাঁরা জড়িয়ে পড়েন। এটা কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল যে তাঁরা প্রশাসনের স্থায়ী পদগুলো দখল করতে চাইবেন অথবা সেগুলো নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ভর্তি-বাণিজ্যে’ সাফল্যের পর তাঁদের ‘যৌক্তিক পদক্ষেপ’ই হচ্ছে সরকারি চাকরি।
আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীদের এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও তাণ্ডবের সমালোচনা করার সময় গত ২০ মাসে সবাই দলের নেতৃত্বকে হুঁশিয়ার করেছেন। কিন্তু দলের নেতারা, বিশেষত শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁদের মৃদু ভর্ৎসনা করলেও কোনো অবস্থায়ই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। উপরন্তু নেতাদের আচরণ থেকে কর্মীরা এ রকম কাজে উৎসাহই পেয়েছেন। পাবনার ঘটনার দুই দিন পর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টার মন্তব্য এ ধরনের কার্যকলাপকে বৈধতাই দেয়।
শুধু তা-ই নয়, সরকারি দলের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তারা অন্যদের সামান্যতম সমালোচনা ও ভিন্নমত শুনতে আগ্রহী নয়। সংসদে সরকারি দলের সদস্যরা সংবাদমাধ্যম নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় সাংবাদিকদের ও গণমাধ্যমকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তা দলের কর্মীদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা স্পষ্ট বার্তা। সংসদে আলোচনা করার সময় সাংসদেরা সেটা ভুলে গিলেয়ছিলেন কি না জানি না, তবে অসহিষ্ণু আচরণকে উৎসাহিত করার দায় থেকে তাঁরা মুক্ত হতে পারেন না। পাবনার ঘটনা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার মন্তব্য ও সংসদে কয়েকজন সদস্যের মন্তব্য আলাদা ঘটনা; কিন্তু এসব ঘটনা থেকে সরকারি দলের আচরণের যে প্যাটার্নটি প্রকাশিত হচ্ছে, তা গত ২০ মাসের আচরণ থেকে ভিন্ন নয়। বরং উত্তরোত্তর স্পষ্ট হচ্ছে যে সরকারি দল সংসদে তাদের বড় আকার ও বিরোধী দলের অনুপস্থিতিকে যেকোনো কাজ করার লাইসেন্স হিসেবে মনে করছে। সংবাদমাধ্যম নিয়ে সংসদের আলোচনায় এবং অন্যান্য সুযোগেও সরকারি দলের নেতারা (এবং বিরোধীদলীয় নেতারা) এ কথা বলেন যে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’র উত্থানের জন্য গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও অন্যরা দায়ী। এ ধরনের অভিযোগ থেকে স্পষ্ট যে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন, ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কী ছিল এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পরিকল্পিত নির্বাচন দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনত। সেই রাজনৈতিক সংকটের পেছনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা স্মরণে না রাখলে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না—কাগজে-কলমে যা-ই লেখা থাকুক না কেন। সরকারি দলের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে বেশি, সংসদে তাদের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাতে তাদের দায়িত্ব বেড়েছে আরও বেশি। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। সংসদে অংশগ্রহণ না করা সংবিধান সংশোধনের সরকারি উদ্যোগে তাদের অনীহা এবং অন্যান্য মন্তব্য কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না। সংসদের কার্যকারিতার অর্থ এই নয় যে সংসদ নিয়মিতভাবে অধিবেশন সম্পন্ন করে।
পাবনার ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের পরামর্শ দিয়েছেন কোনো গুরুতর সমস্যা হলে তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার জন্য। তাঁর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান ও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত হস্তক্ষেপের পদ্ধতি হিসেবেই আওয়ামী লীগের নেতা এ পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবতা বিবেচনায় কথাটি হয়তো সত্য যে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দলের কর্মীদের সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা যায় না। কিন্তু সরকার, দল ও গণতন্ত্র—কোনো কিছুর জন্যই এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা আশা করি বুঝতে পারেন, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশাসন ও দল তাঁদের জন্যই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। রূঢ় শোনালেও বলা দরকার যে বিএনপির নেতারাও এ রকম এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল পরিচালনার পক্ষেই। তার সর্বশেষ প্রমাণ হলো দলের স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক সভা। দুই দিন ধরে আলাপ-আলোচনা শেষে সংসদে যাওয়া না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের চেয়ারপারসনের হাতে তুলে দিয়েছেন। সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৫৮ দিনের অধিবেশনে ১১৪ দিনই তাঁরা যোগ দেননি। খালেদা জিয়া সাকল্যে মাত্র পাঁচ দিন সংসদে গেছেন।
পাবনার ঘটনার পর চাকরি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকার-সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর চড়াও হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। পাবনা ও আগের বিভিন্ন ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততা, ক্ষেত্র বিশেষে পরোক্ষ উৎসাহ জোগানোর পরিণতি হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। গত ২০ মাসের ইতিহাস থেকে অনুমান করতে পারি, ভবিষ্যতে সংবাদপত্রে আমরা আরও এ ধরনের ঘটনার খবর দেখতে পাব। সরকারি দলের কর্মীদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে, তার ফলাফল কেবল যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বইতে হবে তা নয়, দেশের সবাইকেই তার মাশুল গুনতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মনে রাখা দরকার, দেশের দৈনন্দিন শাসন ছাড়াও তাঁরা দুটি বড় কাজে হাত দিয়েছেন—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সংবিধান সংশোধন। এ দুটি কাজের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও বিরোধিতাকারীদের সংখ্যা খুব কম নয়। তদুপরি এ দুই কাজেই কোনো রকম ভুলত্রুটি হলে সমর্থকদের মধ্যেও সংশয় ও সন্দেহ দেখা দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সমাজ খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করছে। এ দুই পদক্ষেপের সঙ্গে দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রশ্ন জড়িত। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে দুটি বড় দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার যদি তাদের সমর্থন ও বৈধতা হারায়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সংবিধান সংশোধনের কাজে মারাত্মক ক্ষতি হবে। সাধারণ নাগরিকেরা যেকোনো সরকারকে সমর্থন করে, যখন সে তার দৈনন্দিন জীবনে সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট থাকে। সরকার যদি তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনো তাগিদ বোধ না করে, তবে তাদের সমর্থনে ভাটা পড়বে—যার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট। এ পরিস্থিতিতে তাদের অন্য সুদূরপ্রসারী কাজগুলো কেবল অসম্পূর্ণই থাকবে তা নয়, বিতর্কিতও হয়ে পড়বে। আর বর্তমান সরকারের সেই ব্যর্থতার পরিণতি কেবল আওয়ামী লীগই বইবে না, বাংলাদেশকেই বইতে হবে। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এজাতীয় ঘটনাকে সামান্য ঘটনা বলে মনে করবেন না, এসবের সুদূরপ্রসারী ফল কী, তা ভেবে দেখবেন এবং তাঁদের আচার-আচরণে তার প্রকাশ ঘটাবেন।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীদের এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও তাণ্ডবের সমালোচনা করার সময় গত ২০ মাসে সবাই দলের নেতৃত্বকে হুঁশিয়ার করেছেন। কিন্তু দলের নেতারা, বিশেষত শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁদের মৃদু ভর্ৎসনা করলেও কোনো অবস্থায়ই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। উপরন্তু নেতাদের আচরণ থেকে কর্মীরা এ রকম কাজে উৎসাহই পেয়েছেন। পাবনার ঘটনার দুই দিন পর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টার মন্তব্য এ ধরনের কার্যকলাপকে বৈধতাই দেয়।
শুধু তা-ই নয়, সরকারি দলের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তারা অন্যদের সামান্যতম সমালোচনা ও ভিন্নমত শুনতে আগ্রহী নয়। সংসদে সরকারি দলের সদস্যরা সংবাদমাধ্যম নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় সাংবাদিকদের ও গণমাধ্যমকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তা দলের কর্মীদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা স্পষ্ট বার্তা। সংসদে আলোচনা করার সময় সাংসদেরা সেটা ভুলে গিলেয়ছিলেন কি না জানি না, তবে অসহিষ্ণু আচরণকে উৎসাহিত করার দায় থেকে তাঁরা মুক্ত হতে পারেন না। পাবনার ঘটনা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার মন্তব্য ও সংসদে কয়েকজন সদস্যের মন্তব্য আলাদা ঘটনা; কিন্তু এসব ঘটনা থেকে সরকারি দলের আচরণের যে প্যাটার্নটি প্রকাশিত হচ্ছে, তা গত ২০ মাসের আচরণ থেকে ভিন্ন নয়। বরং উত্তরোত্তর স্পষ্ট হচ্ছে যে সরকারি দল সংসদে তাদের বড় আকার ও বিরোধী দলের অনুপস্থিতিকে যেকোনো কাজ করার লাইসেন্স হিসেবে মনে করছে। সংবাদমাধ্যম নিয়ে সংসদের আলোচনায় এবং অন্যান্য সুযোগেও সরকারি দলের নেতারা (এবং বিরোধীদলীয় নেতারা) এ কথা বলেন যে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য তথাকথিত ‘তৃতীয় শক্তি’র উত্থানের জন্য গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও অন্যরা দায়ী। এ ধরনের অভিযোগ থেকে স্পষ্ট যে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন, ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কী ছিল এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পরিকল্পিত নির্বাচন দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনত। সেই রাজনৈতিক সংকটের পেছনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা স্মরণে না রাখলে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না—কাগজে-কলমে যা-ই লেখা থাকুক না কেন। সরকারি দলের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে বেশি, সংসদে তাদের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাতে তাদের দায়িত্ব বেড়েছে আরও বেশি। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। সংসদে অংশগ্রহণ না করা সংবিধান সংশোধনের সরকারি উদ্যোগে তাদের অনীহা এবং অন্যান্য মন্তব্য কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না। সংসদের কার্যকারিতার অর্থ এই নয় যে সংসদ নিয়মিতভাবে অধিবেশন সম্পন্ন করে।
পাবনার ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের পরামর্শ দিয়েছেন কোনো গুরুতর সমস্যা হলে তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার জন্য। তাঁর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান ও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত হস্তক্ষেপের পদ্ধতি হিসেবেই আওয়ামী লীগের নেতা এ পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবতা বিবেচনায় কথাটি হয়তো সত্য যে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দলের কর্মীদের সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা যায় না। কিন্তু সরকার, দল ও গণতন্ত্র—কোনো কিছুর জন্যই এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য ও ইতিবাচক নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা আশা করি বুঝতে পারেন, এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশাসন ও দল তাঁদের জন্যই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। রূঢ় শোনালেও বলা দরকার যে বিএনপির নেতারাও এ রকম এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল পরিচালনার পক্ষেই। তার সর্বশেষ প্রমাণ হলো দলের স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক সভা। দুই দিন ধরে আলাপ-আলোচনা শেষে সংসদে যাওয়া না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের চেয়ারপারসনের হাতে তুলে দিয়েছেন। সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৫৮ দিনের অধিবেশনে ১১৪ দিনই তাঁরা যোগ দেননি। খালেদা জিয়া সাকল্যে মাত্র পাঁচ দিন সংসদে গেছেন।
পাবনার ঘটনার পর চাকরি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকার-সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর চড়াও হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। পাবনা ও আগের বিভিন্ন ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততা, ক্ষেত্র বিশেষে পরোক্ষ উৎসাহ জোগানোর পরিণতি হচ্ছে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। গত ২০ মাসের ইতিহাস থেকে অনুমান করতে পারি, ভবিষ্যতে সংবাদপত্রে আমরা আরও এ ধরনের ঘটনার খবর দেখতে পাব। সরকারি দলের কর্মীদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে, তার ফলাফল কেবল যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বইতে হবে তা নয়, দেশের সবাইকেই তার মাশুল গুনতে হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মনে রাখা দরকার, দেশের দৈনন্দিন শাসন ছাড়াও তাঁরা দুটি বড় কাজে হাত দিয়েছেন—যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সংবিধান সংশোধন। এ দুটি কাজের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও বিরোধিতাকারীদের সংখ্যা খুব কম নয়। তদুপরি এ দুই কাজেই কোনো রকম ভুলত্রুটি হলে সমর্থকদের মধ্যেও সংশয় ও সন্দেহ দেখা দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সমাজ খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করছে। এ দুই পদক্ষেপের সঙ্গে দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রশ্ন জড়িত। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে দুটি বড় দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার যদি তাদের সমর্থন ও বৈধতা হারায়, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সংবিধান সংশোধনের কাজে মারাত্মক ক্ষতি হবে। সাধারণ নাগরিকেরা যেকোনো সরকারকে সমর্থন করে, যখন সে তার দৈনন্দিন জীবনে সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট থাকে। সরকার যদি তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনো তাগিদ বোধ না করে, তবে তাদের সমর্থনে ভাটা পড়বে—যার লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট। এ পরিস্থিতিতে তাদের অন্য সুদূরপ্রসারী কাজগুলো কেবল অসম্পূর্ণই থাকবে তা নয়, বিতর্কিতও হয়ে পড়বে। আর বর্তমান সরকারের সেই ব্যর্থতার পরিণতি কেবল আওয়ামী লীগই বইবে না, বাংলাদেশকেই বইতে হবে। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এজাতীয় ঘটনাকে সামান্য ঘটনা বলে মনে করবেন না, এসবের সুদূরপ্রসারী ফল কী, তা ভেবে দেখবেন এবং তাঁদের আচার-আচরণে তার প্রকাশ ঘটাবেন।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments