অরণ্যে রোদন-লাখ টাকার বাগান ও দুই টাকার ছাগল by আনিসুল হক
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্প্রতি দুটি লেখা বেরিয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গণ্য করার যে আহ্বান সফরে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন, একটা খবরের বিষয় হলো সেটা।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর এই প্রতিবেদন (২৮ সেপ্টেম্বর ২০১০) থেকে আরেকটা হূদয়-জুড়ানো তথ্য অবগত হলাম—আশ্চর্য যে আমি এই খবরটা এত দিন জানতামই না যে, এ বছর পয়লা বৈশাখের আগে ইউনেসকোর একটা জরিপে পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে বাংলা ভাষা। বাংলার পরে স্প্যানিশ আর ডাচ্ পেয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মধুর ভাষার স্থান। সেই সূত্রে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, ‘পৃথিবীর মধুরতম ভাষাটির কি জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবেও নির্বাচিত হওয়া উচিত নয়? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শনিবারে নিউইয়র্কে বিপুলসংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা আর গৌরবোজ্জ্বল সাহিত্যিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম “অফিশিয়াল” ভাষা বানানোর আবেদন জানান।’
বাংলা পৃথিবীর ৩০ কোটি মানুষের ভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা এটা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, এ ছাড়া আসাম-ত্রিপুরা অঞ্চলের বহু লোক বাংলায় কথা বলে।
বর্তমানে ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, চীনা, রুশ আর স্প্যানিশ—এই ছয়টা ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তবে ইংরেজি আর ফরাসিই কার্যত জাতিসংঘের দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহূত হয়।
আমরা—পৃথিবীর ৩০ কোটি বাংলাভাষী মানুষ—নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার এই আবেদনকে সমর্থন করব। এই আবেদন জাতিসংঘে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাব তাঁকে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর দ্বিতীয় লেখাটার শিরোনাম হলো: বাংলাদেশ আর ‘বাস্কেট কেস’ নয়। উপশিরোনাম হলো: পাকিস্তান তার সাবেক প্রদেশের কাছে শিখতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা (২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০)।
এই রচনাটিতে বলা হয়েছে, হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে যে দেশটাকে বাস্কেট কেস বলেছিলেন, তাকে এখন আর তা বলা যাবে না। শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সংবর্ধনা সভায় প্রেসিডেন্ট ওবামা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কার লাভ করার জন্য। এশিয়া আর আফ্রিকার ছয়টি দেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে দারিদ্র্য দূর ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা-নারী উন্নয়ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় এই পুরস্কার অর্জন করেন।
ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল বলছে, বাংলাদেশের গর্ব করার কারণ আছে। তারা গত তিন বছর ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি অর্জন করেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ১২.৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে গত বছর, এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশটার সাফল্য উল্লেখযোগ্য, ১৯৭০-এর দিকে যেখানে একজন নারীর সন্তানসংখ্যা ছিল গড়ে ছয়জন, এখন সেটা গড়ে তিনজন।
বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের তুলনা করা হয়েছে ওই রচনায়। বলা হয়েছে, পাকিস্তান তার আয়ের বড় অংশ একজন শিক্ষকের পেছনে ব্যয় না করে একজন সৈনিকের পেছনে ব্যয় করতে পছন্দ করে, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সবচেয়ে পরিচিত দুজন জাতীয় নায়কের মধ্যে তুলনা করলে ব্যাপারটা সহজেই বোঝা যাবে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি গ্রামীণ নারীদের বিতরণ করছেন ক্ষুদ্রঋণ। আর পাকিস্তানের নায়ক হলেন ড. আবদুল কাদির খান, যিনি লিবিয়া, ইরান আর উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচার করেছেন। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে সেকুলার, ধর্মীয়ভাবে মুসলিম আর সংস্কৃতির দিক থেকে বাঙালি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে এই ব্যাপারগুলো জটিল। বাংলাদেশ জঙ্গি মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, এসবের প্রশংসা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
বলা হয়েছে, ‘৪০ বছর আগে বন্যাপ্রবণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করতে হলে খুব বড় আশাবাদীও বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরত না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তুলনামূলক ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কম জন্মহার আর আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতাক্ষম অর্থনীতি দিয়ে বাংলাদেশই শেষ হাসিটা হাসছে।’
বাংলাদেশে আমরা যে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো আছি, তা বোঝার জন্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল পড়তে হয় না। ও আমরা এমনিতেই জানি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমরা শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী; জঙ্গিপনার স্থান এই দেশে নেই। এই দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, আর এ দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফি সাধকদের দ্বারা, আমাদের কাছে ইসলাম মানে শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা-সাম্য আমাদের প্রধান চেতনা। বাঙালি বলে, মানুষ বলে পরিচয় দিতে আমরা গৌরব বোধ করি। আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়। আর আমাদের আছে মহান একুশের চেতনা, আছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাষা, আর সেই ভাষা যেমন আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়, আমাদের বেপথু হতে দেয় না, ঠিক তেমনি আমরা অন্য সবার মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করি। একুশে আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ভালো করছি। আরও ভালো করব। আমাদের কৃষকেরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এত অল্প জমিতে তারা যে পরিমাণ ফসল ফলাচ্ছেন, তা পৃথিবীবাসীর শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারে সহজেই। আমরা তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ভালো করছি, কোটা পদ্ধতির অবসানের পরে আরও ভালো করেছি। আমাদের প্রবাসী জনশক্তি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কমতে দেয়নি কখনো। আমরা আরও ভালো করব, যদি আমরা চারটা বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করতে পারি। ১. বিদ্যুৎ, ২. জ্বালানি, ৩. যোগাযোগ, ৪. আইনশৃঙ্খলা। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য সরকার অনেকগুলো প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আশা করি, সেসব বাস্তবায়িত হবে সময় থাকতে থাকতেই, আর আমরা তার সুফল যেমন দেখব দৈনন্দিন জীবনে, তেমনি দেখব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার দেশপ্রেম, সততা ও দক্ষতার পরিচয় দেবে, পরিচয় দেবে দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতার, এটা আমরা সব সময়ই চাইব। যোগাযোগব্যবস্থা অবশ্যই ভালো করতে হবে। যেমন ঢাকার যানজট দূর করতে হবে, তেমনি চট্টগ্রাম-মংলার মতো সমুদ্রবন্দর আর স্থলবন্দরগুলোকে আধুনিক ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে এসব বন্দরের যোগাযোগের কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে রেল যোগাযোগ, নৌ যোগাযোগের ওপরে জোর দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানত গাড়ি উৎপাদকদের চাপে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা খুব ভালোভাবে গড়ে তোলা হয়। এখন সেটাকে মনে করা হচ্ছে পরিবেশবিরোধী। আর বলা হচ্ছে, তুমি রাস্তার সংখ্যা যতই বাড়াও না কেন, গাড়ির সংখ্যা সব সময়ই রাস্তার পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। কাজেই যানজট হবেই। ওরা রেলের ওপর জোর কম দেওয়ায় এখন পস্তাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটাকে সংক্ষিপ্ত ও আধুনিক করা হোক, নতুন মহাসড়কের পাশাপাশি আধুনিক রেল সংযোগ চালু হোক। ঢাকার আশপাশের জেলা থেকেও মানুষ যেন দ্রুতগামী রেলগাড়িতে চড়ে যাতায়াত করতে পারে।
এই সবই কঠিন কাজ, ব্যয়সাপেক্ষ, আর সময়সাপেক্ষ। বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও নানা মুনির নানা মত। কিন্তু যে বিষয়ে কোনোই বিতর্ক নেই, তা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। দেশকে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজমুক্ত করা। প্রশাসনকে চাপমুক্তভাবে কাজ করতে দেওয়া। আর এই কাজ করতে যত না তহবিল দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নির্দেশনা ও উদ্যোগ। আমরা টাকা ফেললেও আজই ঢাকার নিচে ভূগর্ভস্থ রেল চালু করতে পারব না, চাইলেই ঢাকা-চট্টগ্রাম বৈদ্যুতিক রেলগাড়ি চলবে না। কিন্তু একটা জিনিস চাইলে অল্প দিনেই করা সম্ভব। তা হলো সরকারি দল বা ছাত্রসংগঠন বা তার সহযোগী সংগঠনের পরিচয় দিয়ে বেআইনি কার্যকলাপ চালানো বন্ধ করা।
অথচ এটাই এখন দেশের মানুষের প্রধান মাথাব্যথা। প্রথম আলোর ওয়েব পাতায় গিয়ে যে কেউ যেকোনো সময় দেখতে পারেন, সবচেয়ে পঠিত আর সবচেয়ে আলোচিত খবর কোনটা। ছাত্রলীগের ছেলেরা পুলিশকে মেরেছে, পুলিশ মামলাও করেনি, পাবনায় প্রশাসন অসহায়, এই সব খবর সবচেয়ে বেশি পাঠক পড়ছেন এবং তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে আমাদের প্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা লেখা প্রথম আলোর এই পাতায় লিখেছিলেন। শূন্য দিয়ে গুণ করা। যত বড় সংখ্যাই হোক, শূন্য দিয়ে গুণ করলে তার ফল শূন্যই হয়। তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যত ভালো কাজই করুক, দলীয় কর্মীদের সন্ত্রাস তার পুরো কৃতিত্বকে শূন্য দিয়ে গুণ করে শূন্য বানিয়ে দেয়। তা-ই হয়েছিল আসলে। নইলে ওই আমলেও সরকার ও প্রশাসন আওয়ামী লীগ খারাপ চালায়নি। কয়েকজন কুখ্যাত লোকের জন্য পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছিল।
এবারও সরকার পরিচালনার কাজটা আওয়ামী লীগ খারাপ করছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের বা সহযোগী সংগঠনের স্বার্থান্বেষী কিছু নেতা-কর্মীর অপকর্মের জন্য সব ভালো উদ্যোগও মাঠে মারা যেতে বসেছে। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার কারণে শেখ হাসিনা যদি তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাকের মতো প্রবীণ ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়াই সরকার চালাতে পারেন, তাহলে কয়েকজন ছিঁচকে সন্ত্রাসী সরকারের সমুদয় ভালো কাজকে নস্যাৎ করে দেওয়ার যে মহড়া সারা দেশে চালিয়ে যাচ্ছে, তা কেন দমন করা যাবে না? বাংলা একটা লোকগান আছে, ‘আমার লাখ টাকার বাগান খাইল দুই টাকার ছাগলে রে’। সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশে আর দেশের বাইরে কত উদ্যোগ নিচ্ছে, হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলছে, স্বাধীনতার মূলধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কঠিন ঐতিহাসিক দায়িত্ব তার কাঁধে, এই যে কর্মতৎপরতার বাগানটা, তা কি দুই টাকার ছাগলেই খেয়ে শেষ করবে? এটা কেন সরকার ও নেতারা হতে দেবেন? আর মনে রাখতে হবে, ভোট কেবল কর্মীরা দেন না, সাধারণ মানুষ দেন, তাঁরা দল করেন না বলে সরকারি চাকরিতে জায়গা পাবেন না, এই যদি বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁরা ঘটতে দেখেন, পরের নির্বাচনে তাঁরা ঠিকই শোধ নেবেন। বরং, নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (তখন বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী) সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা যা বলেছিলেন, তা-ই হওয়া উচিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি নীতি, প্রশাসন চলবে যোগ্যতার নিরিখে, নিয়োগ-পদোন্নতি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়।
বাংলাদেশের মতো সুন্দর দেশ আর কোথায় আছে। এগিয়ে যাওয়ার সব বাস্তব শর্ত এই দেশে এখন বিরাজমান। বিশ্ব-পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল। আমাদের ভাষা নিয়ে, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নেই। আমাদের মধ্যে সেই অর্থে চরমপন্থী নেই। আমাদের মানুষের সৃজনশীলতা আর উৎপাদনশীলতা শ্রদ্ধার্হ। এই দেশটা অবশ্যই এগিয়ে যাবে। সামান্য কয়েকজন দলীয় পরিচয়বাহী ছিঁচকে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের কারণে এগিয়ে যাওয়ার এই অসামান্য সুযোগ যেন আমরা হাতছাড়া না করি—ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত বাংলাদেশবিষয়ক সুখবরগুলোর জন্য দেশবাসী ও সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে এই কথাগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
বাংলা পৃথিবীর ৩০ কোটি মানুষের ভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা এটা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, এ ছাড়া আসাম-ত্রিপুরা অঞ্চলের বহু লোক বাংলায় কথা বলে।
বর্তমানে ইংরেজি, ফরাসি, আরবি, চীনা, রুশ আর স্প্যানিশ—এই ছয়টা ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তবে ইংরেজি আর ফরাসিই কার্যত জাতিসংঘের দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহূত হয়।
আমরা—পৃথিবীর ৩০ কোটি বাংলাভাষী মানুষ—নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার এই আবেদনকে সমর্থন করব। এই আবেদন জাতিসংঘে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাব তাঁকে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর দ্বিতীয় লেখাটার শিরোনাম হলো: বাংলাদেশ আর ‘বাস্কেট কেস’ নয়। উপশিরোনাম হলো: পাকিস্তান তার সাবেক প্রদেশের কাছে শিখতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা (২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০)।
এই রচনাটিতে বলা হয়েছে, হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে যে দেশটাকে বাস্কেট কেস বলেছিলেন, তাকে এখন আর তা বলা যাবে না। শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সংবর্ধনা সভায় প্রেসিডেন্ট ওবামা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কার লাভ করার জন্য। এশিয়া আর আফ্রিকার ছয়টি দেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে দারিদ্র্য দূর ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা-নারী উন্নয়ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করায় এই পুরস্কার অর্জন করেন।
ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল বলছে, বাংলাদেশের গর্ব করার কারণ আছে। তারা গত তিন বছর ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি অর্জন করেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ১২.৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে গত বছর, এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশটার সাফল্য উল্লেখযোগ্য, ১৯৭০-এর দিকে যেখানে একজন নারীর সন্তানসংখ্যা ছিল গড়ে ছয়জন, এখন সেটা গড়ে তিনজন।
বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের তুলনা করা হয়েছে ওই রচনায়। বলা হয়েছে, পাকিস্তান তার আয়ের বড় অংশ একজন শিক্ষকের পেছনে ব্যয় না করে একজন সৈনিকের পেছনে ব্যয় করতে পছন্দ করে, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সবচেয়ে পরিচিত দুজন জাতীয় নায়কের মধ্যে তুলনা করলে ব্যাপারটা সহজেই বোঝা যাবে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি গ্রামীণ নারীদের বিতরণ করছেন ক্ষুদ্রঋণ। আর পাকিস্তানের নায়ক হলেন ড. আবদুল কাদির খান, যিনি লিবিয়া, ইরান আর উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচার করেছেন। বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে সেকুলার, ধর্মীয়ভাবে মুসলিম আর সংস্কৃতির দিক থেকে বাঙালি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে এই ব্যাপারগুলো জটিল। বাংলাদেশ জঙ্গি মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, এসবের প্রশংসা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
বলা হয়েছে, ‘৪০ বছর আগে বন্যাপ্রবণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করতে হলে খুব বড় আশাবাদীও বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরত না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তুলনামূলক ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কম জন্মহার আর আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতাক্ষম অর্থনীতি দিয়ে বাংলাদেশই শেষ হাসিটা হাসছে।’
বাংলাদেশে আমরা যে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো আছি, তা বোঝার জন্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল পড়তে হয় না। ও আমরা এমনিতেই জানি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমরা শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী; জঙ্গিপনার স্থান এই দেশে নেই। এই দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, আর এ দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফি সাধকদের দ্বারা, আমাদের কাছে ইসলাম মানে শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা-সাম্য আমাদের প্রধান চেতনা। বাঙালি বলে, মানুষ বলে পরিচয় দিতে আমরা গৌরব বোধ করি। আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়। আর আমাদের আছে মহান একুশের চেতনা, আছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাষা, আর সেই ভাষা যেমন আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়, আমাদের বেপথু হতে দেয় না, ঠিক তেমনি আমরা অন্য সবার মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করি। একুশে আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ভালো করছি। আরও ভালো করব। আমাদের কৃষকেরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এত অল্প জমিতে তারা যে পরিমাণ ফসল ফলাচ্ছেন, তা পৃথিবীবাসীর শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারে সহজেই। আমরা তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ভালো করছি, কোটা পদ্ধতির অবসানের পরে আরও ভালো করেছি। আমাদের প্রবাসী জনশক্তি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কমতে দেয়নি কখনো। আমরা আরও ভালো করব, যদি আমরা চারটা বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করতে পারি। ১. বিদ্যুৎ, ২. জ্বালানি, ৩. যোগাযোগ, ৪. আইনশৃঙ্খলা। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য সরকার অনেকগুলো প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আশা করি, সেসব বাস্তবায়িত হবে সময় থাকতে থাকতেই, আর আমরা তার সুফল যেমন দেখব দৈনন্দিন জীবনে, তেমনি দেখব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার দেশপ্রেম, সততা ও দক্ষতার পরিচয় দেবে, পরিচয় দেবে দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতার, এটা আমরা সব সময়ই চাইব। যোগাযোগব্যবস্থা অবশ্যই ভালো করতে হবে। যেমন ঢাকার যানজট দূর করতে হবে, তেমনি চট্টগ্রাম-মংলার মতো সমুদ্রবন্দর আর স্থলবন্দরগুলোকে আধুনিক ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে এসব বন্দরের যোগাযোগের কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে রেল যোগাযোগ, নৌ যোগাযোগের ওপরে জোর দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানত গাড়ি উৎপাদকদের চাপে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা খুব ভালোভাবে গড়ে তোলা হয়। এখন সেটাকে মনে করা হচ্ছে পরিবেশবিরোধী। আর বলা হচ্ছে, তুমি রাস্তার সংখ্যা যতই বাড়াও না কেন, গাড়ির সংখ্যা সব সময়ই রাস্তার পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। কাজেই যানজট হবেই। ওরা রেলের ওপর জোর কম দেওয়ায় এখন পস্তাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটাকে সংক্ষিপ্ত ও আধুনিক করা হোক, নতুন মহাসড়কের পাশাপাশি আধুনিক রেল সংযোগ চালু হোক। ঢাকার আশপাশের জেলা থেকেও মানুষ যেন দ্রুতগামী রেলগাড়িতে চড়ে যাতায়াত করতে পারে।
এই সবই কঠিন কাজ, ব্যয়সাপেক্ষ, আর সময়সাপেক্ষ। বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও নানা মুনির নানা মত। কিন্তু যে বিষয়ে কোনোই বিতর্ক নেই, তা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। দেশকে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজমুক্ত করা। প্রশাসনকে চাপমুক্তভাবে কাজ করতে দেওয়া। আর এই কাজ করতে যত না তহবিল দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নির্দেশনা ও উদ্যোগ। আমরা টাকা ফেললেও আজই ঢাকার নিচে ভূগর্ভস্থ রেল চালু করতে পারব না, চাইলেই ঢাকা-চট্টগ্রাম বৈদ্যুতিক রেলগাড়ি চলবে না। কিন্তু একটা জিনিস চাইলে অল্প দিনেই করা সম্ভব। তা হলো সরকারি দল বা ছাত্রসংগঠন বা তার সহযোগী সংগঠনের পরিচয় দিয়ে বেআইনি কার্যকলাপ চালানো বন্ধ করা।
অথচ এটাই এখন দেশের মানুষের প্রধান মাথাব্যথা। প্রথম আলোর ওয়েব পাতায় গিয়ে যে কেউ যেকোনো সময় দেখতে পারেন, সবচেয়ে পঠিত আর সবচেয়ে আলোচিত খবর কোনটা। ছাত্রলীগের ছেলেরা পুলিশকে মেরেছে, পুলিশ মামলাও করেনি, পাবনায় প্রশাসন অসহায়, এই সব খবর সবচেয়ে বেশি পাঠক পড়ছেন এবং তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলে আমাদের প্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা লেখা প্রথম আলোর এই পাতায় লিখেছিলেন। শূন্য দিয়ে গুণ করা। যত বড় সংখ্যাই হোক, শূন্য দিয়ে গুণ করলে তার ফল শূন্যই হয়। তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যত ভালো কাজই করুক, দলীয় কর্মীদের সন্ত্রাস তার পুরো কৃতিত্বকে শূন্য দিয়ে গুণ করে শূন্য বানিয়ে দেয়। তা-ই হয়েছিল আসলে। নইলে ওই আমলেও সরকার ও প্রশাসন আওয়ামী লীগ খারাপ চালায়নি। কয়েকজন কুখ্যাত লোকের জন্য পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছিল।
এবারও সরকার পরিচালনার কাজটা আওয়ামী লীগ খারাপ করছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের বা সহযোগী সংগঠনের স্বার্থান্বেষী কিছু নেতা-কর্মীর অপকর্মের জন্য সব ভালো উদ্যোগও মাঠে মারা যেতে বসেছে। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার কারণে শেখ হাসিনা যদি তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাকের মতো প্রবীণ ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়াই সরকার চালাতে পারেন, তাহলে কয়েকজন ছিঁচকে সন্ত্রাসী সরকারের সমুদয় ভালো কাজকে নস্যাৎ করে দেওয়ার যে মহড়া সারা দেশে চালিয়ে যাচ্ছে, তা কেন দমন করা যাবে না? বাংলা একটা লোকগান আছে, ‘আমার লাখ টাকার বাগান খাইল দুই টাকার ছাগলে রে’। সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশে আর দেশের বাইরে কত উদ্যোগ নিচ্ছে, হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলছে, স্বাধীনতার মূলধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কঠিন ঐতিহাসিক দায়িত্ব তার কাঁধে, এই যে কর্মতৎপরতার বাগানটা, তা কি দুই টাকার ছাগলেই খেয়ে শেষ করবে? এটা কেন সরকার ও নেতারা হতে দেবেন? আর মনে রাখতে হবে, ভোট কেবল কর্মীরা দেন না, সাধারণ মানুষ দেন, তাঁরা দল করেন না বলে সরকারি চাকরিতে জায়গা পাবেন না, এই যদি বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁরা ঘটতে দেখেন, পরের নির্বাচনে তাঁরা ঠিকই শোধ নেবেন। বরং, নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (তখন বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী) সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা যা বলেছিলেন, তা-ই হওয়া উচিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি নীতি, প্রশাসন চলবে যোগ্যতার নিরিখে, নিয়োগ-পদোন্নতি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়।
বাংলাদেশের মতো সুন্দর দেশ আর কোথায় আছে। এগিয়ে যাওয়ার সব বাস্তব শর্ত এই দেশে এখন বিরাজমান। বিশ্ব-পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল। আমাদের ভাষা নিয়ে, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নেই। আমাদের মধ্যে সেই অর্থে চরমপন্থী নেই। আমাদের মানুষের সৃজনশীলতা আর উৎপাদনশীলতা শ্রদ্ধার্হ। এই দেশটা অবশ্যই এগিয়ে যাবে। সামান্য কয়েকজন দলীয় পরিচয়বাহী ছিঁচকে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তের কারণে এগিয়ে যাওয়ার এই অসামান্য সুযোগ যেন আমরা হাতছাড়া না করি—ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত বাংলাদেশবিষয়ক সুখবরগুলোর জন্য দেশবাসী ও সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে এই কথাগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments