যুক্তির নয়, বিশ্বাসের জয় by সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন
বাবরি মসজিদ নিয়ে বৃহস্পতিবার এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে বিশ্লেষকেরা দেখেছেন বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে। এখানে দুই ভারতীয় সাংবাদিকের বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হলো। লেখা দুটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন ফারুক ওয়াসিফ
এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষৌ বেঞ্চ বাবরি মসজিদ রায়ে বিচারিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষৌ বেঞ্চ বাবরি মসজিদ রায়ে বিচারিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
অযোধ্যার এক টুকরো জমি নিয়ে দীর্ঘ আইনি বিবাদের মীমাংসা তাঁরা করেছেন ‘হিন্দুদের বিশ্বাস ও ভক্তি’র ভিত্তিতে, যে বিশ্বাস যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ ও যাচাইযোগ্য নয়।
পরিহাস হলো, এটা করতে গিয়ে তাঁরা অসাবধানে সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতে অস্ত্র জুগিয়েছেন, যারা সেই একই ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’র কথা বলে খোলাখুলি ভারতীয় আইন ও সংবিধানের বিরোধিতা করে আসছে। ১৯৯২ সালে, বিবাদপূর্ণ জমির ওপর ৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের এই বিরোধিতার স্পর্ধা চরমে ওঠে। ভারতের আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই বর্বরতা, দখল ও অনুপ্রবেশের ঘটনার নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই ঘটনার ১৮ বছর পরে, যারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, তাদের ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’কে আইনসংগত করে নিয়ে ভারত আবার সেই পাপের পুনরাবৃত্তি করল।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিজ্ঞ বিচারক সুধীর আগরওয়াল, এস ইউ খান ও ধরমবীর শর্মা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের তলায় ১৯৪৯ সালে চুপিসারে যে রামলালার (শিশু রাম) মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, ‘হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী’ সেটাই দেবতা রামের ‘জন্মস্থান’। তাঁদের মতে, এ কারণেই ওই বিতর্কিত ভূমির ওপর হিন্দুদের দাবি রয়েছে।
আদালত যাদের ‘হিন্দু’ বলেছেন, তারা সত্যিই কারা এবং কীভাবে আদালত তাদের সত্যিকার বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন, সেই প্রশ্ন সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আইনের চোখে এ রকম ধর্মীয় বিশ্বাস ও মিথকে আইনি যুক্তি ও বাস্তব তথ্যের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া অদ্ভুত। তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস লিখেছিলেন ষোলো শতকের অযোধ্যায় বসে। কিন্তু রামের জন্মস্থানের বিষয়ে তিনি কিছুই না বললেও ৫০০ বছর পরে আদালত সেই জন্মস্থানটি এত নিশ্চিত করে চিহ্নিত করেন কীভাবে? আদালত আজ যে ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’র কথা বলছেন, সেটা কিন্তু জোরদার হয়ে উঠেছে মাত্র আশির দশক থেকে, যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ‘জন্মস্থান’কে মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে।
ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় অনেক কিছুতেই বিশ্বাস করে। কিন্তু আইনের চোখে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা ‘বিশ্বাস’-এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। ‘বিশ্বাস’ আইন নয়। কিংবা কোনো তথাকথিত ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন বর্তমানের কোনো বিচার দিয়েও করা যায় না। ১৯৯৩ সালে নরসীমা রাওয়ের সরকার প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানতে চায় বাবরি মসজিদের স্থানে কোনো হিন্দু মন্দির ছিল কি না। আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিতে অমত করেন। কিন্তু এখন আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা বিদ্যমান মামলার বেলায় প্রযোজ্য নয়।
এ রকম একটি প্রশ্ন হলো: ‘কথিত হিন্দু মন্দির ধ্বংসের স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল কি না।’ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আদালত ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) ওই স্থান খনন করার জন্য নিযুক্ত করে। ২০০৩ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সেই খনন সম্পন্ন হয়। অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, এএসআই সিদ্ধান্ত দেয়: সেখানকার মাটির নিচে ‘বিরাট এক হিন্দু মন্দিরের কাঠামো’ রয়েছে। কিন্তু ভারতের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ এই সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেন।
অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতোই ভারতের বহু স্থানেই নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য আগের আমলের স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় হিন্দু মন্দির বানানো হয়েছে, হিন্দু মন্দিরের জায়গায় মসজিদ তৈরি হয়েছে আবার মসজিদ ভেঙে মন্দিরও বানানো হয়েছে। অতএব, ষোলো শতকে একটি মন্দির ভেঙে যদি একটি মসজিদ বানানো হয়েও থাকে, একুশ শতকে এসে তার কি আইনি প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে? কোথায় দাগ টানব যে, এ সময়ের পরে ভাঙা হলে তা অবৈধ আর আগে হলে বৈধ? এমনকি যদি ধরেও নেওয়া হয়, মসজিদের নিচে হিন্দু মন্দির থাকার দাবিটি সঠিক, তাহলেও কি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যাবে যে মসজিদ নির্মাণকারীরাই মন্দিরটি ধ্বংস করেছিল?
উত্তেজনা সৃষ্টি করে ধ্বংসসাধন এবং তারপর আদালতের দ্বারা বৈধকরণের এই নজির ভবিষ্যতে অন্যান্য মসজিদকেও মন্দির বানাতে উৎসাহিত করতে পারে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় আসা এবং তার সুফললাভের কার্যকারিতাও এ থেকে প্রমাণিত হলো।
উনিশ শতক থেকেই মুসলিমরা বাবরি মসজিদে আর হিন্দুরা মসজিদের প্রাঙ্গণে নির্মিত রাম ছবুত্রে পাশাপাশি প্রার্থনা করে এসেছে। কিন্তু এই ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটে ১৯৪৯ সালে, যখন রাজনৈতিকভাবে উত্তেজিত একদল ব্যক্তি মসজিদের ভেতরে রামলালা মূর্তি স্থাপন করে। তখন থেকে উভয় সম্প্রদায়ই এখানে প্রবেশের সুযোগ হারায়, যদিও ১৯৮৬ থেকে হিন্দুদের মূর্তিটি দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমান রায়ে স্থানটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করার যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, তা ১৯৪৯-এর আগের অবস্থাকেই একভাবে বহাল রাখল। কিন্তু যে যুক্তিতে তা করা হলো তা ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। এখন সুপ্রিম কোর্ট যদি এই রায় সংশোধন না করেন, তাহলে এই রায় ইতিহাসে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেই বিবেচিত হবে।
সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন: ভারতীয় সাংবাদিক। ভারতের দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
পরিহাস হলো, এটা করতে গিয়ে তাঁরা অসাবধানে সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতে অস্ত্র জুগিয়েছেন, যারা সেই একই ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’র কথা বলে খোলাখুলি ভারতীয় আইন ও সংবিধানের বিরোধিতা করে আসছে। ১৯৯২ সালে, বিবাদপূর্ণ জমির ওপর ৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের এই বিরোধিতার স্পর্ধা চরমে ওঠে। ভারতের আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই বর্বরতা, দখল ও অনুপ্রবেশের ঘটনার নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই ঘটনার ১৮ বছর পরে, যারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, তাদের ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’কে আইনসংগত করে নিয়ে ভারত আবার সেই পাপের পুনরাবৃত্তি করল।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিজ্ঞ বিচারক সুধীর আগরওয়াল, এস ইউ খান ও ধরমবীর শর্মা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের তলায় ১৯৪৯ সালে চুপিসারে যে রামলালার (শিশু রাম) মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, ‘হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী’ সেটাই দেবতা রামের ‘জন্মস্থান’। তাঁদের মতে, এ কারণেই ওই বিতর্কিত ভূমির ওপর হিন্দুদের দাবি রয়েছে।
আদালত যাদের ‘হিন্দু’ বলেছেন, তারা সত্যিই কারা এবং কীভাবে আদালত তাদের সত্যিকার বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন, সেই প্রশ্ন সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আইনের চোখে এ রকম ধর্মীয় বিশ্বাস ও মিথকে আইনি যুক্তি ও বাস্তব তথ্যের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া অদ্ভুত। তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস লিখেছিলেন ষোলো শতকের অযোধ্যায় বসে। কিন্তু রামের জন্মস্থানের বিষয়ে তিনি কিছুই না বললেও ৫০০ বছর পরে আদালত সেই জন্মস্থানটি এত নিশ্চিত করে চিহ্নিত করেন কীভাবে? আদালত আজ যে ‘বিশ্বাস’ ও ‘ভক্তি’র কথা বলছেন, সেটা কিন্তু জোরদার হয়ে উঠেছে মাত্র আশির দশক থেকে, যখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ‘জন্মস্থান’কে মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে।
ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় অনেক কিছুতেই বিশ্বাস করে। কিন্তু আইনের চোখে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা ‘বিশ্বাস’-এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। ‘বিশ্বাস’ আইন নয়। কিংবা কোনো তথাকথিত ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন বর্তমানের কোনো বিচার দিয়েও করা যায় না। ১৯৯৩ সালে নরসীমা রাওয়ের সরকার প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানতে চায় বাবরি মসজিদের স্থানে কোনো হিন্দু মন্দির ছিল কি না। আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিতে অমত করেন। কিন্তু এখন আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা বিদ্যমান মামলার বেলায় প্রযোজ্য নয়।
এ রকম একটি প্রশ্ন হলো: ‘কথিত হিন্দু মন্দির ধ্বংসের স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল কি না।’ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আদালত ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) ওই স্থান খনন করার জন্য নিযুক্ত করে। ২০০৩ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সেই খনন সম্পন্ন হয়। অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, এএসআই সিদ্ধান্ত দেয়: সেখানকার মাটির নিচে ‘বিরাট এক হিন্দু মন্দিরের কাঠামো’ রয়েছে। কিন্তু ভারতের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ এই সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেন।
অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতোই ভারতের বহু স্থানেই নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য আগের আমলের স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় হিন্দু মন্দির বানানো হয়েছে, হিন্দু মন্দিরের জায়গায় মসজিদ তৈরি হয়েছে আবার মসজিদ ভেঙে মন্দিরও বানানো হয়েছে। অতএব, ষোলো শতকে একটি মন্দির ভেঙে যদি একটি মসজিদ বানানো হয়েও থাকে, একুশ শতকে এসে তার কি আইনি প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারে? কোথায় দাগ টানব যে, এ সময়ের পরে ভাঙা হলে তা অবৈধ আর আগে হলে বৈধ? এমনকি যদি ধরেও নেওয়া হয়, মসজিদের নিচে হিন্দু মন্দির থাকার দাবিটি সঠিক, তাহলেও কি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যাবে যে মসজিদ নির্মাণকারীরাই মন্দিরটি ধ্বংস করেছিল?
উত্তেজনা সৃষ্টি করে ধ্বংসসাধন এবং তারপর আদালতের দ্বারা বৈধকরণের এই নজির ভবিষ্যতে অন্যান্য মসজিদকেও মন্দির বানাতে উৎসাহিত করতে পারে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় আসা এবং তার সুফললাভের কার্যকারিতাও এ থেকে প্রমাণিত হলো।
উনিশ শতক থেকেই মুসলিমরা বাবরি মসজিদে আর হিন্দুরা মসজিদের প্রাঙ্গণে নির্মিত রাম ছবুত্রে পাশাপাশি প্রার্থনা করে এসেছে। কিন্তু এই ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটে ১৯৪৯ সালে, যখন রাজনৈতিকভাবে উত্তেজিত একদল ব্যক্তি মসজিদের ভেতরে রামলালা মূর্তি স্থাপন করে। তখন থেকে উভয় সম্প্রদায়ই এখানে প্রবেশের সুযোগ হারায়, যদিও ১৯৮৬ থেকে হিন্দুদের মূর্তিটি দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমান রায়ে স্থানটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করার যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, তা ১৯৪৯-এর আগের অবস্থাকেই একভাবে বহাল রাখল। কিন্তু যে যুক্তিতে তা করা হলো তা ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। এখন সুপ্রিম কোর্ট যদি এই রায় সংশোধন না করেন, তাহলে এই রায় ইতিহাসে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেই বিবেচিত হবে।
সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন: ভারতীয় সাংবাদিক। ভারতের দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
No comments