গোধূলির ছায়াপথে-কবিকেও একলা বাড়ি ফিরতে হয় by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
শ্রাবণের দিন গত হলে এর বিলীয়মান স্পর্শের কথা কারও মনে পড়বে—হারিয়ে যায় যখন চিরতরে রিমিঝিমি শব্দস্পর্শের অন্তর্গত মায়াবী দিন। পল্লিগ্রামে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটার আবির্ভাব শব্দ করে। ঘন হয়ে ওঠে শিরশির করে ওঠা অনুভূতির রোমকূপগুলো। কান খাড়া করে শোনে সর্বক্ষণ বৃষ্টি-নূপুরের ধ্বনিতরঙ্গ।
সুদূরের প্রলেপ মাখানো ছেলে ভোলানো ছড়া—‘ওপারেতে কালো রঙ বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম’ চোখের সামনে বিস্তারিত।
বৈশাখে রূপসী, শ্রাবণে তা-ই হয় আদর মাখানো ঘন কালো বৃষ্টির হাত—হিমপ্রবাহের মতো বৃষ্টি। ভোর থেকে আরেক ঝরঝর বৃষ্টি, হেমন্তের। বহুদূর হিমালয়ের পাহাড় থেকে শীতকে ডেকে আনতে গেছে যে বৃষ্টি। অল্প শীত, চাদর নেই, লেপ নেই। নিজেকে আপন করে জড়িয়ে শিরশির তার আহ্বান।
আশ্বিনের আকাশের দিকে তাকান নির্বোধ কবি। তাঁদের হাতে যেন আর কোনো কাজ নেই। হীরকের মতো দাঁত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে আকাশ, যেখানে লুকিয়ে সম্ভাবনার ঝড়, তার দিকেই তাকিয়ে কবি মেলে ধরেন কল্পনার সুরভি। আত্মার কালিমায় ধূসর জীবনের পাণ্ডুলিপি ওই তো দেখা যায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে সজ্জায়িত মেঘপুঞ্জে। কোথাও মিল কোথাও অমিল, ভাবতেই মেঘেরা রং বদলায়, যেমনটি জীবনে। ভাবতে ভাবতেই বেলা ফুরিয়ে এল। কদিন আগে পঞ্চম জন্মদিন, পরদিন পঞ্চাশ আর আজ সত্তর। বেলা গুটিয়ে নেয় ভরা ভাদর-আশ্বিনের মেঘ। এরপর অর্থের অনর্থ ভাবনা ডুবিয়ে ছাড়ে আরেক পৃথিবীর গহ্বরে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ভাবনাগুলো স্বপ্নের দিকে। তারপর যা হয়ে থাকে, তা-ই। সিঁড়ি প্রত্যাহূত। ভাদ্র-আশ্বিনের বৃষ্টিতে তবু স্বপ্নদের আঁকড়ে ধরে কবি, ভুলতে চেষ্টা করে হাঁ করে গিলতে আসা অভাবদের; অন্তত আজকের মতো তাদের ছুটিতে বাড়ি পাঠিয়েছে। ভাবনাগুলো কখনো ছাতা, কখনো বর্ষাতি নিয়ে শেষ বাসে উঠে পড়ে। কবিকেও একলা বাড়ি ফিরতে হয়।
কবিদের রাজসন্নিকটবর্তী হওয়া নিয়ে পুরোনো তর্ক। কোনো কোনো কবি কাছে এসে পাবেন বিদেশ সফরের মহার্ঘ টিকিট। আবার একসময়কার বঙ্গভবন-আশ্রয়ী কবিরা পেলেন কিছু গঞ্জনা। খালি হাতে মালাটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সব কবি। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যেখানে যেতেন, আগেই পাঠাতেন সুনামগঞ্জের পরাক্রান্ত গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরীর ৫০ জনের নৃত্যগীত দল। এক অনুষ্ঠানেই ভারতকে চিনে নিত বিদেশিরা। মানিকগঞ্জের মমতাজ ও তৎসঙ্গে ৫০ জন যখন নিউইয়র্কে বাংলা লোকগানের রূপটি পরিবেশন করবেন, বিদেশিরা অনায়াসেই বাংলাদেশকে চিনে নেবে। সেদিনের জন্য অপেক্ষমাণ রইলাম। স্বাধীন লেখক-শিল্পীরা শুধু মালাটি নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
শ্রাবণে বৃষ্টির ঢলে শহরের ময়লা নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। দিনে দিনে বেড়েছে ময়লা; মনের ময়লার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কেউ জানতে পারে না, চকিত আশ্বিনের ঝড় এসেছে ময়লা সাফ করতে। শুকনো খড়কুটো বৈশাখ পারেনি উড়িয়ে দিতে, রয়ে গেল কোথাও পাতার ফাঁকে ফাঁকে। লাঠি নিয়ে হাঁটতেন যাঁরা, তাঁরাও কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন। তাই ভয়, কোন সময় এই আশ্বিনের ঝড়ে সমর্পিত হন বর্ষীয়ান কবিরা। আজ সকালে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করলাম। যাঁরা চলে যান, তাঁদের পদচিহ্ন খুঁজে মেলা ভার; দু-একজন কুলীন কবি ছাড়া, যাঁরা রেখে যান নিঃশ্বাসের মতোই পবিত্র কিছু চরণ। কিন্তু যেতেই হবে। কবিকেও বাড়ি ফিরতে হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ অবয়বেই নয়, অন্তর্লীন কবিব্যক্তিত্বের সমাহার। শেষ দেখায় বললাম, তাঁর মাথার হ্যাটটি কেশরাজিকেই আড়াল করেনি, আড়াল করেছে পরিচয়। কিছুই বললেন না, হাসলেন। ধরিয়ে দিলেন তাঁর শ্রাবণ জন্মদিনে প্রকাশিত ক্রোড়পত্র। ২০ ভাদ্র, ১৪১৭ মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অগ্রাহ্যের শিকার যিনি, নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বের দরজা পেরিয়ে সম্মানে ভূষিত তিনি। ‘সত্যের মত বদমাশ’, ‘শুদ্ধতম কবি’ সময়ের আয়নায় স্বকীয় আলোকে বিভাসিত। ভাদ্র-আশ্বিনে কবিকে ডাক দিই। স্বাধীন লেখকেরা শুধু মালাটি নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
বৈশাখে রূপসী, শ্রাবণে তা-ই হয় আদর মাখানো ঘন কালো বৃষ্টির হাত—হিমপ্রবাহের মতো বৃষ্টি। ভোর থেকে আরেক ঝরঝর বৃষ্টি, হেমন্তের। বহুদূর হিমালয়ের পাহাড় থেকে শীতকে ডেকে আনতে গেছে যে বৃষ্টি। অল্প শীত, চাদর নেই, লেপ নেই। নিজেকে আপন করে জড়িয়ে শিরশির তার আহ্বান।
আশ্বিনের আকাশের দিকে তাকান নির্বোধ কবি। তাঁদের হাতে যেন আর কোনো কাজ নেই। হীরকের মতো দাঁত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে আকাশ, যেখানে লুকিয়ে সম্ভাবনার ঝড়, তার দিকেই তাকিয়ে কবি মেলে ধরেন কল্পনার সুরভি। আত্মার কালিমায় ধূসর জীবনের পাণ্ডুলিপি ওই তো দেখা যায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে সজ্জায়িত মেঘপুঞ্জে। কোথাও মিল কোথাও অমিল, ভাবতেই মেঘেরা রং বদলায়, যেমনটি জীবনে। ভাবতে ভাবতেই বেলা ফুরিয়ে এল। কদিন আগে পঞ্চম জন্মদিন, পরদিন পঞ্চাশ আর আজ সত্তর। বেলা গুটিয়ে নেয় ভরা ভাদর-আশ্বিনের মেঘ। এরপর অর্থের অনর্থ ভাবনা ডুবিয়ে ছাড়ে আরেক পৃথিবীর গহ্বরে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ভাবনাগুলো স্বপ্নের দিকে। তারপর যা হয়ে থাকে, তা-ই। সিঁড়ি প্রত্যাহূত। ভাদ্র-আশ্বিনের বৃষ্টিতে তবু স্বপ্নদের আঁকড়ে ধরে কবি, ভুলতে চেষ্টা করে হাঁ করে গিলতে আসা অভাবদের; অন্তত আজকের মতো তাদের ছুটিতে বাড়ি পাঠিয়েছে। ভাবনাগুলো কখনো ছাতা, কখনো বর্ষাতি নিয়ে শেষ বাসে উঠে পড়ে। কবিকেও একলা বাড়ি ফিরতে হয়।
কবিদের রাজসন্নিকটবর্তী হওয়া নিয়ে পুরোনো তর্ক। কোনো কোনো কবি কাছে এসে পাবেন বিদেশ সফরের মহার্ঘ টিকিট। আবার একসময়কার বঙ্গভবন-আশ্রয়ী কবিরা পেলেন কিছু গঞ্জনা। খালি হাতে মালাটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সব কবি। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যেখানে যেতেন, আগেই পাঠাতেন সুনামগঞ্জের পরাক্রান্ত গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরীর ৫০ জনের নৃত্যগীত দল। এক অনুষ্ঠানেই ভারতকে চিনে নিত বিদেশিরা। মানিকগঞ্জের মমতাজ ও তৎসঙ্গে ৫০ জন যখন নিউইয়র্কে বাংলা লোকগানের রূপটি পরিবেশন করবেন, বিদেশিরা অনায়াসেই বাংলাদেশকে চিনে নেবে। সেদিনের জন্য অপেক্ষমাণ রইলাম। স্বাধীন লেখক-শিল্পীরা শুধু মালাটি নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
শ্রাবণে বৃষ্টির ঢলে শহরের ময়লা নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। দিনে দিনে বেড়েছে ময়লা; মনের ময়লার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কেউ জানতে পারে না, চকিত আশ্বিনের ঝড় এসেছে ময়লা সাফ করতে। শুকনো খড়কুটো বৈশাখ পারেনি উড়িয়ে দিতে, রয়ে গেল কোথাও পাতার ফাঁকে ফাঁকে। লাঠি নিয়ে হাঁটতেন যাঁরা, তাঁরাও কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন। তাই ভয়, কোন সময় এই আশ্বিনের ঝড়ে সমর্পিত হন বর্ষীয়ান কবিরা। আজ সকালে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করলাম। যাঁরা চলে যান, তাঁদের পদচিহ্ন খুঁজে মেলা ভার; দু-একজন কুলীন কবি ছাড়া, যাঁরা রেখে যান নিঃশ্বাসের মতোই পবিত্র কিছু চরণ। কিন্তু যেতেই হবে। কবিকেও বাড়ি ফিরতে হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ অবয়বেই নয়, অন্তর্লীন কবিব্যক্তিত্বের সমাহার। শেষ দেখায় বললাম, তাঁর মাথার হ্যাটটি কেশরাজিকেই আড়াল করেনি, আড়াল করেছে পরিচয়। কিছুই বললেন না, হাসলেন। ধরিয়ে দিলেন তাঁর শ্রাবণ জন্মদিনে প্রকাশিত ক্রোড়পত্র। ২০ ভাদ্র, ১৪১৭ মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অগ্রাহ্যের শিকার যিনি, নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বের দরজা পেরিয়ে সম্মানে ভূষিত তিনি। ‘সত্যের মত বদমাশ’, ‘শুদ্ধতম কবি’ সময়ের আয়নায় স্বকীয় আলোকে বিভাসিত। ভাদ্র-আশ্বিনে কবিকে ডাক দিই। স্বাধীন লেখকেরা শুধু মালাটি নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
No comments