সপ্তাহের হালচাল-পাবনার ভাবনা থেকে মুক্তির পথ কী by আব্দুল কাইয়ুম
পাবনার জেলা প্রশাসকসহ অন্য কর্মকর্তাদের বদলির আদুেশ দেওয়া হয়েছে। আর অন্যদিকে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা জেলা প্রশাসকের অপসারণ দাবি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো।
এর অর্থ দাঁড়াল এই যে, সরকারদলীয় ব্যক্তিদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত না করলে ফল ভোগ করতে হবে। তাহলে প্রশাসন কীভাবে কাজ করবে?
পাবনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ এবং ডিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহারের খবরটি রোববার ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য আসতে শুরু করে। প্রথম মন্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মাহমুদুল হাসান লিখেছেন, পাবনার ভাবনা থেকে জাতি মুক্তি চায়। এ মন্তব্যের মধ্যে যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি আছে কৌতুক। সে জন্যই কথাটি শিরোনামে ব্যবহার করা হয়েছে। দুঃখ লাগে, যখন দেখি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে দুই অঙুল উঁচিয়ে বিজয়চিহ্ন দেখান। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।
প্রথম আলোর অনলাইনের ওই খবরে ১১ জনের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। মনসুর আহমেদ বলেছেন, অবশেষে একটা ভালো সিদ্ধান্ত। আরেকজন পাঠক লিখেছেন, ‘এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে সরকারের কাছে অনুরোধ, এ ধরনের অতি উৎসাহী প্রেমিকেরা তাকে ডুবিয়েছিল। এরা সব সময় সব সরকারের আমলেই এ ধরনের কাজ করে থাকে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে যেন এদের অ্যানার্জি আরও বেশি বাড়ে। এদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া না হলে অন্যরা সাইজ হবে না। আরও বেশি উৎসাহ পাবে।’ মো. শফিকুল ভুঁইয়া কৌতুক করে লিখেছেন, ‘কী আশ্চর্য, সরকারি দলের লোকের এত উদারতা! কর্মসূচি প্রত্যাহার, থানা থেকে জেলে, তবুও চুপ! মনে হয় নিউইয়র্ক থেকে ইঙ্গিত এসেছে, থাম বাপ, আমি আসছি, সব ঠিক হয়ে যাবে, আপাতত যা জেলে। এসেই বের করে নেব।’
সেদিন সকালে সাংবাদিক ও কলাম লেখক এবিএম মূসার সঙ্গে কথা হয়। এ ধরনের অন্যায়-অনিয়মের ব্যাপারে তিনি কখনো ছেড়ে কথা বলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, কী হচ্ছে দেশে। তিনি বললেন, মোগল আমলে বাংলায় ছিল বারোভুঁইয়ার শাসন, এখন চলছে শত ভুঁইয়ার শাসন!
অভিযুক্ত ২১ জনের জামিন নামঞ্জুর করে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়েছে। হয়তো তাঁরা দ্রুতই জামিন পাবেন। এটা কোনো অজামিনযোগ্য অভিযোগ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন তাঁদের ধরল না বা ধরতে পারল না? কেন আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো? পুলিশ বা প্রশাসনকে যদি ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে হয়, তাহলে অরাজকতার আর বাকি থাকে কী? এর দায় নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের।
নিয়োগ-বদলি নিয়ে যে সরকারদলীয় লোকদের জোরজবরদস্তি চলছে, তা দেখে ও শুনে জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারও হতভম্ব। তাঁর ভাষায়, ‘কোথায় যে কী হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। আল্লাহ জানে, আসলে কী হচ্ছে।’ বিগত ১৮ মাসে নয় হাজার পদে নিয়োগ স্থগিত হয়ে গেছে। এর একটি কারণ রাজনৈতিক চাপ। পাবনায় নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নিলে তাদের আপত্তি কেন? ছাত্রলীগ-যুবলীগের কোনো প্রার্থী থাকলে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি কেন? জেলা প্রশাসক কি বাধা দিয়েছিলেন? পরীক্ষার হলে হামলা ও ভাঙচুর, কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করার মতো জঘন্য কাজ তারা করতে গেল কেন? তাদের সরকারের মুখে তারাই চুনকালি মাখছে।
নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ পুরোনো। ভুক্তভোগীরা বলেন, সামান্য অফিস সহকারী পদে নিয়োগ লাভের জন্য তিন-চার লাখ টাকা দিতে হয়। সেটা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত একটি অংশ পায়। এ জন্যই এত হাঙ্গামা। পাবনার ঘটনা কেন এমন বিধ্বংসী রূপ নিল তা তদন্তের দাবি রাখে। যেহেতু জেলা প্রশাসন আক্রান্ত হয়েছে এবং পুলিশ প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল, তাই ঘটনার পরপরই ডিআইজি ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। ঘটনার নয় দিন পর প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক পাবনায় গেছেন। তাঁরা তো প্রথম দিনেই সেখানে যেতে পারতেন। কেন ঘটনাপ্রবাহকে অবনতির দিকে যেতে দিলেন? এই বিলম্বিত উদ্যোগ সরকার ও দলের ক্ষতি করেছে। দেশের ক্ষতি তো হয়েছেই।
প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই। এটা কি ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি করার কোনো কারণ হতে পারে? এই ডিজিটাল যুগে কেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? এর একটি কারণ হতে পারে, দলের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কেউ উদ্যোগ নিতে চান না। সবাই মুখে বলেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলবে; কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় চলছে দলের স্বার্থে। কোনো মন্ত্রী যদি বলেন, কাজটা খারাপ হয়েছে, তাহলে দলের মধ্যে তাঁর কথা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দলের মধ্যে তিনি হয়তো কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। দলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে কে চায়?
তবে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা এ ধরনের অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পাবনায়ও তাঁরা আছেন। তাঁরা মিছিল করে হামলা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কথা বলেছেন। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এরাই আশীর্বাদ। এটুকুও যদি না থাকত, তাহলে হয়তো সরকারি দল হিসেবে আস্থা রাখার কোনো জায়গা থাকত না। ইতিমধ্যে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। বিগত নির্বাচনের সময় যা ছিল তার চেয়ে অনেক কম। গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি এর একটি কারণ বটে। কিন্তু সরকারি দলের আচরণও এ জন্য কম দায়ী নয়। তবে এখনো যে প্রায় ৫০ শতাংশ সমর্থন টিকে আছে, তা হয়তো দলের মধ্যে সচেতন ওই অংশের কারণে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সব সময় একধরনের উদ্ধত মনোভাব কাজ করে। আওয়ামী লীগ তার ব্যতিক্রম নয়। হয়তো তাদের মধ্যে একটু বাড়াবাড়িই রয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে একবার ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয় যে তাদের কর্মীরা একসঙ্গে মিলে অবৈধ রেশন কার্ড উদ্ধারে কাজ করবে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু হলো অভিযান। সে সময় নির্ধারিত কম দামে চাল-গম-তেল-সাবান প্রভৃতি সরবরাহ করা হতো রেশন কার্ডে। মাথাপিছু সবার একটা করে রেশন কার্ড থাকার কথা। কিন্তু প্রভাবশালীরা অবৈধ রেশন কার্ডের দুর্নীতি শুরু করলেন। অভিযানটি ছিল এদেরই বিরুদ্ধে। ফলে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা রুখে দাঁড়ালেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং পুলিশসদস্যরা হামলার শিকার হলেন। সরকারি দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপের কাছে কেউ টিকতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত অভিযান থেমে গেল। ছাত্রলীগের সৎ কর্মীরাও চুপ মেরে গেলেন। কারণ নেতাদের বিরুদ্ধে তাঁরা কী করবেন? এসব ঘটনার পরিণতি কী হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি।
এখন সেই ’৭৩ সাল না। আর সেই ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগও নেই। নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দলের বিকাশ হয়েছে। গণতন্ত্র এগিয়ে নেওয়ার যে সুযোগ দেশে সৃষ্টি হয়েছে, তার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের অনেক সম্ভাবনা এখনো আছে। সে ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু গতানুগতিক ধারায় তা হবে না। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে।
পাবনার ঘটনাটিই ধরা যাক। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হামলা ও কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার নজিরবিহীন ঘটনা নিশ্চয়ই ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু পাবনার জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তারা যে সুধীজনদের সঙ্গে বৈঠকের সময় কান্নাকাটি শুরু করলেন, সেটা কি ঠিক হয়েছে? তাঁদের মন ভেঙে গেছে, সেটা সত্য। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে তাঁরা ঘটিয়েছেন, সেটা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর সঙ্গে যায় কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ একদিকে যেমন তাঁরা সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক করতে পারেন, আবার অন্যদিকে তাঁরা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না, যা সমাজের চোখে অশোভনীয়। এখন আবেগে কেঁদে ফেলাকে কোন খাতে ধরা হবে? অবশ্য এইচ টি ইমাম বলেছেন, জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন যে তাঁরা কাঁদেননি। এটা যদি জেলা প্রশাসক বলে থাকেন, তাহলে কিছু করার নেই। শুধু প্রশ্ন ওঠে, চোখের পানি একবার বেরোনোর পর সেই পানি তিনি চোখে আবার ঢোকাবেন কীভাবে?
কিন্তু এটাও ভেবে দেখা দরকার, জেলা প্রশাসকের মামলার আসামি ধরতে যদি পুলিশ গরজ না দেখায়, তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন? এ জন্য একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ের কথা আমাদের সংবিধানে আছে। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সংসদে আইনের দ্বারা এই পদ প্রতিষ্ঠার কথা। ১৯৮০ সালে আইনও করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি ন্যায়পাল নিয়োগ দেবেন, এই বিধান করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি কার্যকর করা হয়নি। অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া দরকার। তবে তিনি যদি সকলের আস্থাভাজন না হন, বা নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করার সুযোগ না পান, অথবা সরকার যদি তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ না দেয়, তাহলে লাভ হবে না। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংসদের আইনে ন্যায়পাল কাজ করছেন। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো পাবনার কর্মকর্তারা অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়ার একটা আইনসম্মত জায়গা পেতেন; সুধীজনদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের আশ্রয় নিতে হতো না।
তবে প্রশাসনের চেয়ে বরং মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব দলীয় ন্যায়পাল থাকা বেশি দরকার। একজন প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও দলের সর্বপর্যায়ে গ্রহণযোগ্য কোনো নেতাকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। প্রশ্ন উঠতে পারে, নেতারা কিছু করতে না চাইলে ন্যায়পাল কী করবেন? এখানে একটা ব্যাপার আছে। নেতারা কেন ব্যবস্থা নিতে পারেন না বা চান না? যাঁরা অন্যায়ের প্রতিকার চান না তাঁদের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু যাঁরা কিছু করতে চান, তাঁরা তো দলে কোণঠাসা হওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারেন না। দলের যদি একজন ন্যায়পাল থাকতেন, তাহলে পাবনার ওই দায়িত্বশীল অংশ তাঁর শরণাপন্ন হতে পারত।
দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, এই সত্য মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এবং ব্যবস্থাটি ত্রুটি-দুর্বলতা সত্ত্বেও কাজ দিচ্ছে। এমনকি যে বিএনপি প্রথমাবধি এ ব্যবস্থার বিরোধী ছিল, তারাও এখন বলছে, সংবিধান সংশোধনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেওয়া যাবে না। একই নীতি অনুসরণে আমরা বলব, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইলেও যদি দল সামলাতে না পারে, তাহলে সামলানোর ভারটা ন্যায়পালকে দিন। একটা নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠুক।
তবে সেই ন্যায়পালকে ফোঁসফাঁস করার ক্ষমতা দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
পাবনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ এবং ডিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহারের খবরটি রোববার ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য আসতে শুরু করে। প্রথম মন্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মাহমুদুল হাসান লিখেছেন, পাবনার ভাবনা থেকে জাতি মুক্তি চায়। এ মন্তব্যের মধ্যে যেমন উদ্বেগ আছে, তেমনি আছে কৌতুক। সে জন্যই কথাটি শিরোনামে ব্যবহার করা হয়েছে। দুঃখ লাগে, যখন দেখি অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে দুই অঙুল উঁচিয়ে বিজয়চিহ্ন দেখান। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।
প্রথম আলোর অনলাইনের ওই খবরে ১১ জনের মন্তব্য ছাপা হয়েছে। মনসুর আহমেদ বলেছেন, অবশেষে একটা ভালো সিদ্ধান্ত। আরেকজন পাঠক লিখেছেন, ‘এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে সরকারের কাছে অনুরোধ, এ ধরনের অতি উৎসাহী প্রেমিকেরা তাকে ডুবিয়েছিল। এরা সব সময় সব সরকারের আমলেই এ ধরনের কাজ করে থাকে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে যেন এদের অ্যানার্জি আরও বেশি বাড়ে। এদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া না হলে অন্যরা সাইজ হবে না। আরও বেশি উৎসাহ পাবে।’ মো. শফিকুল ভুঁইয়া কৌতুক করে লিখেছেন, ‘কী আশ্চর্য, সরকারি দলের লোকের এত উদারতা! কর্মসূচি প্রত্যাহার, থানা থেকে জেলে, তবুও চুপ! মনে হয় নিউইয়র্ক থেকে ইঙ্গিত এসেছে, থাম বাপ, আমি আসছি, সব ঠিক হয়ে যাবে, আপাতত যা জেলে। এসেই বের করে নেব।’
সেদিন সকালে সাংবাদিক ও কলাম লেখক এবিএম মূসার সঙ্গে কথা হয়। এ ধরনের অন্যায়-অনিয়মের ব্যাপারে তিনি কখনো ছেড়ে কথা বলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, কী হচ্ছে দেশে। তিনি বললেন, মোগল আমলে বাংলায় ছিল বারোভুঁইয়ার শাসন, এখন চলছে শত ভুঁইয়ার শাসন!
অভিযুক্ত ২১ জনের জামিন নামঞ্জুর করে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়েছে। হয়তো তাঁরা দ্রুতই জামিন পাবেন। এটা কোনো অজামিনযোগ্য অভিযোগ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন তাঁদের ধরল না বা ধরতে পারল না? কেন আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো? পুলিশ বা প্রশাসনকে যদি ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে হয়, তাহলে অরাজকতার আর বাকি থাকে কী? এর দায় নিতে হবে ক্ষমতাসীনদের।
নিয়োগ-বদলি নিয়ে যে সরকারদলীয় লোকদের জোরজবরদস্তি চলছে, তা দেখে ও শুনে জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারও হতভম্ব। তাঁর ভাষায়, ‘কোথায় যে কী হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। আল্লাহ জানে, আসলে কী হচ্ছে।’ বিগত ১৮ মাসে নয় হাজার পদে নিয়োগ স্থগিত হয়ে গেছে। এর একটি কারণ রাজনৈতিক চাপ। পাবনায় নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নিলে তাদের আপত্তি কেন? ছাত্রলীগ-যুবলীগের কোনো প্রার্থী থাকলে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি কেন? জেলা প্রশাসক কি বাধা দিয়েছিলেন? পরীক্ষার হলে হামলা ও ভাঙচুর, কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করার মতো জঘন্য কাজ তারা করতে গেল কেন? তাদের সরকারের মুখে তারাই চুনকালি মাখছে।
নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ বেশ পুরোনো। ভুক্তভোগীরা বলেন, সামান্য অফিস সহকারী পদে নিয়োগ লাভের জন্য তিন-চার লাখ টাকা দিতে হয়। সেটা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত একটি অংশ পায়। এ জন্যই এত হাঙ্গামা। পাবনার ঘটনা কেন এমন বিধ্বংসী রূপ নিল তা তদন্তের দাবি রাখে। যেহেতু জেলা প্রশাসন আক্রান্ত হয়েছে এবং পুলিশ প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল, তাই ঘটনার পরপরই ডিআইজি ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল। ঘটনার নয় দিন পর প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক পাবনায় গেছেন। তাঁরা তো প্রথম দিনেই সেখানে যেতে পারতেন। কেন ঘটনাপ্রবাহকে অবনতির দিকে যেতে দিলেন? এই বিলম্বিত উদ্যোগ সরকার ও দলের ক্ষতি করেছে। দেশের ক্ষতি তো হয়েছেই।
প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই। এটা কি ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি করার কোনো কারণ হতে পারে? এই ডিজিটাল যুগে কেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? এর একটি কারণ হতে পারে, দলের লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কেউ উদ্যোগ নিতে চান না। সবাই মুখে বলেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলবে; কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় চলছে দলের স্বার্থে। কোনো মন্ত্রী যদি বলেন, কাজটা খারাপ হয়েছে, তাহলে দলের মধ্যে তাঁর কথা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দলের মধ্যে তিনি হয়তো কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। দলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে কে চায়?
তবে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা এ ধরনের অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পাবনায়ও তাঁরা আছেন। তাঁরা মিছিল করে হামলা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কথা বলেছেন। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এরাই আশীর্বাদ। এটুকুও যদি না থাকত, তাহলে হয়তো সরকারি দল হিসেবে আস্থা রাখার কোনো জায়গা থাকত না। ইতিমধ্যে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। বিগত নির্বাচনের সময় যা ছিল তার চেয়ে অনেক কম। গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য প্রভৃতি এর একটি কারণ বটে। কিন্তু সরকারি দলের আচরণও এ জন্য কম দায়ী নয়। তবে এখনো যে প্রায় ৫০ শতাংশ সমর্থন টিকে আছে, তা হয়তো দলের মধ্যে সচেতন ওই অংশের কারণে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সব সময় একধরনের উদ্ধত মনোভাব কাজ করে। আওয়ামী লীগ তার ব্যতিক্রম নয়। হয়তো তাদের মধ্যে একটু বাড়াবাড়িই রয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে একবার ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয় যে তাদের কর্মীরা একসঙ্গে মিলে অবৈধ রেশন কার্ড উদ্ধারে কাজ করবে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু হলো অভিযান। সে সময় নির্ধারিত কম দামে চাল-গম-তেল-সাবান প্রভৃতি সরবরাহ করা হতো রেশন কার্ডে। মাথাপিছু সবার একটা করে রেশন কার্ড থাকার কথা। কিন্তু প্রভাবশালীরা অবৈধ রেশন কার্ডের দুর্নীতি শুরু করলেন। অভিযানটি ছিল এদেরই বিরুদ্ধে। ফলে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা রুখে দাঁড়ালেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং পুলিশসদস্যরা হামলার শিকার হলেন। সরকারি দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপের কাছে কেউ টিকতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত অভিযান থেমে গেল। ছাত্রলীগের সৎ কর্মীরাও চুপ মেরে গেলেন। কারণ নেতাদের বিরুদ্ধে তাঁরা কী করবেন? এসব ঘটনার পরিণতি কী হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি।
এখন সেই ’৭৩ সাল না। আর সেই ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগও নেই। নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দলের বিকাশ হয়েছে। গণতন্ত্র এগিয়ে নেওয়ার যে সুযোগ দেশে সৃষ্টি হয়েছে, তার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের অনেক সম্ভাবনা এখনো আছে। সে ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু গতানুগতিক ধারায় তা হবে না। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে।
পাবনার ঘটনাটিই ধরা যাক। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হামলা ও কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার নজিরবিহীন ঘটনা নিশ্চয়ই ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু পাবনার জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তারা যে সুধীজনদের সঙ্গে বৈঠকের সময় কান্নাকাটি শুরু করলেন, সেটা কি ঠিক হয়েছে? তাঁদের মন ভেঙে গেছে, সেটা সত্য। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে তাঁরা ঘটিয়েছেন, সেটা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর সঙ্গে যায় কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ একদিকে যেমন তাঁরা সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক করতে পারেন, আবার অন্যদিকে তাঁরা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না, যা সমাজের চোখে অশোভনীয়। এখন আবেগে কেঁদে ফেলাকে কোন খাতে ধরা হবে? অবশ্য এইচ টি ইমাম বলেছেন, জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন যে তাঁরা কাঁদেননি। এটা যদি জেলা প্রশাসক বলে থাকেন, তাহলে কিছু করার নেই। শুধু প্রশ্ন ওঠে, চোখের পানি একবার বেরোনোর পর সেই পানি তিনি চোখে আবার ঢোকাবেন কীভাবে?
কিন্তু এটাও ভেবে দেখা দরকার, জেলা প্রশাসকের মামলার আসামি ধরতে যদি পুলিশ গরজ না দেখায়, তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন? এ জন্য একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ের কথা আমাদের সংবিধানে আছে। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সংসদে আইনের দ্বারা এই পদ প্রতিষ্ঠার কথা। ১৯৮০ সালে আইনও করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি ন্যায়পাল নিয়োগ দেবেন, এই বিধান করা হয়েছে। কিন্তু আইনটি কার্যকর করা হয়নি। অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া দরকার। তবে তিনি যদি সকলের আস্থাভাজন না হন, বা নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করার সুযোগ না পান, অথবা সরকার যদি তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ না দেয়, তাহলে লাভ হবে না। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংসদের আইনে ন্যায়পাল কাজ করছেন। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো পাবনার কর্মকর্তারা অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়ার একটা আইনসম্মত জায়গা পেতেন; সুধীজনদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের আশ্রয় নিতে হতো না।
তবে প্রশাসনের চেয়ে বরং মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব দলীয় ন্যায়পাল থাকা বেশি দরকার। একজন প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও দলের সর্বপর্যায়ে গ্রহণযোগ্য কোনো নেতাকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। প্রশ্ন উঠতে পারে, নেতারা কিছু করতে না চাইলে ন্যায়পাল কী করবেন? এখানে একটা ব্যাপার আছে। নেতারা কেন ব্যবস্থা নিতে পারেন না বা চান না? যাঁরা অন্যায়ের প্রতিকার চান না তাঁদের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু যাঁরা কিছু করতে চান, তাঁরা তো দলে কোণঠাসা হওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারেন না। দলের যদি একজন ন্যায়পাল থাকতেন, তাহলে পাবনার ওই দায়িত্বশীল অংশ তাঁর শরণাপন্ন হতে পারত।
দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, এই সত্য মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এবং ব্যবস্থাটি ত্রুটি-দুর্বলতা সত্ত্বেও কাজ দিচ্ছে। এমনকি যে বিএনপি প্রথমাবধি এ ব্যবস্থার বিরোধী ছিল, তারাও এখন বলছে, সংবিধান সংশোধনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেওয়া যাবে না। একই নীতি অনুসরণে আমরা বলব, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইলেও যদি দল সামলাতে না পারে, তাহলে সামলানোর ভারটা ন্যায়পালকে দিন। একটা নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠুক।
তবে সেই ন্যায়পালকে ফোঁসফাঁস করার ক্ষমতা দিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments