আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-প্রবীণ নারীর কর্মসংস্থান ও শিক্ষা by নাজমা সিদ্দিকী
সমগ্র বিশ্বে আজ ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ পালিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘ ৬০ বছরকে বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার বয়স হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বছর বয়সী জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
চলমান সহস্রাব্দে সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয় হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২০৫০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আট থেকে বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ২০০৬ সালে মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ ছিল ৬০ বা তদূর্ধ্ব। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ১৭ শতাংশে দাঁড়াবে। এ দেশে বর্তমানে প্রবীণ জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। সাম্প্রতিককালে নারীজীবনের যেসব ক্ষেত্রে অর্জন হয়েছে, তার মধ্যে নারীর আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি একটি।
দেশের অধিকাংশ প্রবীণ বেশ কিছু মৌলিক সমস্যায় জর্জরিত। তাঁদের কঠিন সমস্যা হচ্ছে আর্থসামাজিক নিরাপত্তার অভাব। সেই সঙ্গে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার অভাব। এ দেশে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিদের দেখাশোনা করার সংস্কৃতি প্রাচীন। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে দ্রুতগতিতে আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব প্রবীণদের অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠিত হচ্ছে; এতে প্রবীণ মা-বাবাকে দেখার দায়িত্ব এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বৃদ্ধ মা-বাবা আর্থসামাজিক নিরাপত্তাবিহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী ৬০ বছরে পৌঁছানোর আগেই বার্ধক্যে উপনীত হন। পিতৃতান্ত্রিকতা এখনো বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান, ফলে নারীরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের ফলে নানা সমস্যায় পড়েন। আগে প্রবীণ নারীরা যৌথ পরিবারের সন্তানদের কাছে থেকে সেবা ও সহায়তায় অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যৌথ পরিবারের কাঠামো ভেঙে পড়ায় প্রবীণ নর-নারী, বিশেষ করে প্রবীণ নারীরা এই নিদারুণ অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের প্রায় সব কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়।
বয়স্ক নারীদের জীবনযাপনের জন্য কর্মসংস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান পাওয়া বেশ কঠিন। এর মধ্যে যতটুকু কর্মসংস্থানের উপায় রয়েছে, সেখানে রয়েছে লিঙ্গ-বিভাজন। অল্প বয়সী নারীদের কাজের সুযোগ স্বাভাবিক কারণেই অধিকতর। বয়স্ক নারীরা কাজের উপযুক্ত হলেও তাঁরা বঞ্চিত থাকেন। এ অবস্থায় বয়স্ক নারীদের যদি অবাধ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। নানা ধরনের আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্যসমস্যার সম্মুখীন হন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান।
২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব প্রবীণ সম্মেলনে বয়সীদের জন্য সমাজ গড়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব জনসংখ্যায় প্রবীণদের প্রাধান্য এবং তাঁদের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি করতে বার্ধক্যের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-কাঠামো এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো শনাক্ত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। অর্থাৎ প্রবীণ ব্যক্তিদের দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানবাধিকারবিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে প্রতিটি দেশকে এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের বৃহৎ অংশ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি প্রাপ্তির সুযোগ অনিশ্চিত, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের জন্য।
২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য সরকারিভাবে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। ১৯৭০ সাল থেকে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ পর্যায়ে বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক ২৭টি কর্মসূচি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৯৭ সালে বয়স্ক-ভাতা প্রচলন হওয়ায় বহু প্রবীণ নর-নারী কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা বোধ করছেন। এই ভাতা সেসব প্রবীণকে দেওয়া হয়, যাঁরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পান না এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। এ কথা সত্য যে, লিঙ্গবৈষম্যের কারণে পুরুষের তুলনায় নারীরা বয়স্ক-ভাতা কম পান। সম্প্রতি সরকার বিধবা-ভাতা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এ ভাতার পরিমাণ খুবই অপ্রতুল, তবু এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। বহু পরিবারে বিধবা নারীরা সন্তানদের নিয়ে আলাদা বাস করছেন। সে ক্ষেত্রে এই ভাতা নগণ্য। বিধবারা হলেন সর্বাপেক্ষা দুস্থ জনগোষ্ঠী। যখন একজন নারী বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত হন, তখন অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর সম্পদের ভাগীদার হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। অনেক বিধবা তাঁদের পুত্র বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। উল্লেখ্য, বহু বয়স্ক নারীও কম বয়সী মেয়েদের মতো পরিশ্রম করতে পারেন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতে সক্ষম। অথচ অর্থের অভাবে তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবন চালনা করতে ও পরিবারের জন্য ব্যয় করতে পারেন না। বলিভিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক নারীদের অধিকাংশকেই দৈহিক পরিশ্রম ও কষ্টকর কাজে অংশ নিতে হয়। বয়স্ক শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে তাঁরা আর্থিক সচ্ছলতাও অর্জন করতে পারছেন। ছোট ব্যবসা চালাতেও তাঁরা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারছেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বয়স্ক নারীরা শিক্ষাচর্চা ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সাক্ষরতা ও শিক্ষা-সম্বন্ধীয় জ্ঞান অর্জনের ফলে অন্যের ওপর তাঁদের নির্ভরতা কমেছে। সেই সঙ্গে তাঁরা গৃহের কাজকর্মে সাহায্য করেন এবং নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করতে পারেন।
বয়স্ক নারীদের নিয়ে উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বর্তমানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই লক্ষ্যমাত্রায় প্রবীণ নর-নারীর কথা উল্লিখিত হয়নি।
হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে একটি চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছে। হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, প্রবীণ নাগরিকেরা সমাজে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেন এবং সমাজের স্বার্থেই প্রবীণ নর-নারীকে সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে, সব বয়সী নর-নারীকে নিয়েই আমাদের সমাজ গড়তে হবে।
বয়স্ক নারীদের দিয়ে যে উন্নয়ন সম্ভব, সে সম্ভাবনা দেখা যায় বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রমে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সফলতায়। গ্রাম পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ-সহায়তায় বয়স্ক নারীরা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করতে শেখেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ লক্ষ্যে সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রবীণ নর-নারী, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এ পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রবীণ নারীদের জন্য শিক্ষা এবং আয়মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে বয়সীদের জন্য উপযুক্ত সমাজ গড়ার জাতীয় অঙ্গীকার থাকতে হবে। (সংক্ষেপিত)
নাজমা সিদ্দিকী: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে ২০০৬ সালে মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ ছিল ৬০ বা তদূর্ধ্ব। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ১৭ শতাংশে দাঁড়াবে। এ দেশে বর্তমানে প্রবীণ জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। সাম্প্রতিককালে নারীজীবনের যেসব ক্ষেত্রে অর্জন হয়েছে, তার মধ্যে নারীর আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি একটি।
দেশের অধিকাংশ প্রবীণ বেশ কিছু মৌলিক সমস্যায় জর্জরিত। তাঁদের কঠিন সমস্যা হচ্ছে আর্থসামাজিক নিরাপত্তার অভাব। সেই সঙ্গে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার অভাব। এ দেশে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিদের দেখাশোনা করার সংস্কৃতি প্রাচীন। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে দ্রুতগতিতে আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব প্রবীণদের অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠিত হচ্ছে; এতে প্রবীণ মা-বাবাকে দেখার দায়িত্ব এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বৃদ্ধ মা-বাবা আর্থসামাজিক নিরাপত্তাবিহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী ৬০ বছরে পৌঁছানোর আগেই বার্ধক্যে উপনীত হন। পিতৃতান্ত্রিকতা এখনো বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান, ফলে নারীরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের ফলে নানা সমস্যায় পড়েন। আগে প্রবীণ নারীরা যৌথ পরিবারের সন্তানদের কাছে থেকে সেবা ও সহায়তায় অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যৌথ পরিবারের কাঠামো ভেঙে পড়ায় প্রবীণ নর-নারী, বিশেষ করে প্রবীণ নারীরা এই নিদারুণ অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের প্রায় সব কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়।
বয়স্ক নারীদের জীবনযাপনের জন্য কর্মসংস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান পাওয়া বেশ কঠিন। এর মধ্যে যতটুকু কর্মসংস্থানের উপায় রয়েছে, সেখানে রয়েছে লিঙ্গ-বিভাজন। অল্প বয়সী নারীদের কাজের সুযোগ স্বাভাবিক কারণেই অধিকতর। বয়স্ক নারীরা কাজের উপযুক্ত হলেও তাঁরা বঞ্চিত থাকেন। এ অবস্থায় বয়স্ক নারীদের যদি অবাধ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। নানা ধরনের আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্যসমস্যার সম্মুখীন হন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান।
২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব প্রবীণ সম্মেলনে বয়সীদের জন্য সমাজ গড়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব জনসংখ্যায় প্রবীণদের প্রাধান্য এবং তাঁদের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি করতে বার্ধক্যের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-কাঠামো এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো শনাক্ত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। অর্থাৎ প্রবীণ ব্যক্তিদের দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানবাধিকারবিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে প্রতিটি দেশকে এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের বৃহৎ অংশ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি প্রাপ্তির সুযোগ অনিশ্চিত, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের জন্য।
২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য সরকারিভাবে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। ১৯৭০ সাল থেকে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ পর্যায়ে বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক ২৭টি কর্মসূচি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৯৭ সালে বয়স্ক-ভাতা প্রচলন হওয়ায় বহু প্রবীণ নর-নারী কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা বোধ করছেন। এই ভাতা সেসব প্রবীণকে দেওয়া হয়, যাঁরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পান না এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। এ কথা সত্য যে, লিঙ্গবৈষম্যের কারণে পুরুষের তুলনায় নারীরা বয়স্ক-ভাতা কম পান। সম্প্রতি সরকার বিধবা-ভাতা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এ ভাতার পরিমাণ খুবই অপ্রতুল, তবু এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। বহু পরিবারে বিধবা নারীরা সন্তানদের নিয়ে আলাদা বাস করছেন। সে ক্ষেত্রে এই ভাতা নগণ্য। বিধবারা হলেন সর্বাপেক্ষা দুস্থ জনগোষ্ঠী। যখন একজন নারী বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত হন, তখন অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর সম্পদের ভাগীদার হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। অনেক বিধবা তাঁদের পুত্র বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। উল্লেখ্য, বহু বয়স্ক নারীও কম বয়সী মেয়েদের মতো পরিশ্রম করতে পারেন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতে সক্ষম। অথচ অর্থের অভাবে তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবন চালনা করতে ও পরিবারের জন্য ব্যয় করতে পারেন না। বলিভিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক নারীদের অধিকাংশকেই দৈহিক পরিশ্রম ও কষ্টকর কাজে অংশ নিতে হয়। বয়স্ক শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে তাঁরা আর্থিক সচ্ছলতাও অর্জন করতে পারছেন। ছোট ব্যবসা চালাতেও তাঁরা পারদর্শী হয়ে উঠতে পারছেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বয়স্ক নারীরা শিক্ষাচর্চা ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সাক্ষরতা ও শিক্ষা-সম্বন্ধীয় জ্ঞান অর্জনের ফলে অন্যের ওপর তাঁদের নির্ভরতা কমেছে। সেই সঙ্গে তাঁরা গৃহের কাজকর্মে সাহায্য করেন এবং নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করতে পারেন।
বয়স্ক নারীদের নিয়ে উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বর্তমানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই লক্ষ্যমাত্রায় প্রবীণ নর-নারীর কথা উল্লিখিত হয়নি।
হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল এ বিষয়ে একটি চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছে। হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, প্রবীণ নাগরিকেরা সমাজে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেন এবং সমাজের স্বার্থেই প্রবীণ নর-নারীকে সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে, সব বয়সী নর-নারীকে নিয়েই আমাদের সমাজ গড়তে হবে।
বয়স্ক নারীদের দিয়ে যে উন্নয়ন সম্ভব, সে সম্ভাবনা দেখা যায় বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রমে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সফলতায়। গ্রাম পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ-সহায়তায় বয়স্ক নারীরা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করতে শেখেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ লক্ষ্যে সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রবীণ নর-নারী, বিশেষ করে প্রবীণ নারীদের চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এ পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের উন্নয়নের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রবীণ নারীদের জন্য শিক্ষা এবং আয়মূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে বয়সীদের জন্য উপযুক্ত সমাজ গড়ার জাতীয় অঙ্গীকার থাকতে হবে। (সংক্ষেপিত)
নাজমা সিদ্দিকী: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments