মানুষের মুখ-পরের জায়গা পরের জমি by কিঙ্কর আহ্সান

এখানে মস্ত আকাশ, মস্ত নদী আর নদীর ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে মস্ত একটা সেতু। সে সেতুতে লোকজনের যাতায়াত নেই বললেই চলে। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে শ্বেত হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো অসংখ্য কচি মেঘ। রোদের তীব্রতা এতই বেশি যে সূর্যের দিকে তাকানোই দায়। অসহ্য নীরবতা। বড্ড বেশি সবুজ চারদিকে।


শহুরে মানুষ বলে হয়তো চোখে লাগছে খুব। গাছের পাতার ফাঁক থেকে একটু পরপর ডেকে উঠছে দু-একটি পাখি। জায়গাটার নাম দোহারিকা। জনবসতি কিছুটা কম এখানে। তাই সেতুর নিচে গাছপালা আর আগাছাগুলো বেড়ে উঠেছে ইচ্ছামতো। সাপখোপের ভয় আছে। গুইসাপের কমতি নেই। সামান্য সময়ের মধ্যেই দেখা গেল কয়েকটি। তাই এসব এড়ানোর জন্য হুশহুশ শব্দ করে এগোতে লাগলাম গন্ত্যবের দিকে। পথজুড়ে ইটের কুচি বিছানো। কাছেই চোখে পড়ল করাতকলটা। আকারে ছোট। দোতলা চালের ওপর তেরছাভাবে পড়ছে রোদ। টের পাচ্ছি, কাটা কাঠ থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত ঘ্রাণ। পরিচয় হলো মিলের কর্মচারী ফারুখ হোসেনের সঙ্গে। চেহারায় তার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। আধময়লা একটা কাপড় জড়ানো গায়ে। দুপুরের খাওয়ার পাট চুকেছে কিছুক্ষণ আগে। মোটা চালের ভাত আর শজনে দিয়ে খাওয়া হয়েছে পেট পুরে। আয়োজন করা হচ্ছিল ভাতঘুমের। আমি আসায় ভেস্তে গেল তা। তিনি তবুও বিরক্ত হলেন না। আয়েশ করে গল্প শুরু করলেন। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন নিজের জীবনের কথাগুলো। বললেন সুখ আর দুঃখের কথা।
ফারুখ হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরায়। বাড়ির পাশেই মস্ত জঙ্গল। সেখানে কাঠবাদাম কুড়াতেন। দস্যি ছেলে ছিলেন তিনি। তবে কাজের প্রতি মনোযোগ ছিল সব সময়। শৈশব থেকেই কাঠের কাজ করতেন। বাবা ছিলেন তাঁর একমাত্র ওস্তাদ। অনেক সাধনা আর পরিশ্রমের পর তিনি ভালো কারিগর হতে পেরেছেন। গাফিলতি করেননি কখনো। শৈশবটা মন্দ ছিল না। খিদের কষ্ট ছাড়া আর কোনো কষ্ট মনে পড়ে না সে সময়ের স্মৃতিতে। কাঠের কাজের বায়না নিয়ে যেতে হতো নানা জায়গায়। শুরুতে ভালোই লাগত। পরিচয় হতো নতুন নতুন জায়গা আর নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে। ‘তহন শইলে তাকত (শক্তি) আছিল। কেয়ার করি নাইকা কিছু। অখন আর ভালা লাগে না। বাড়ির লাইগা মন পোড়ে,’ আফসোস করে বলছিলেন তিনি। মনটা এখন ঘরকুনো হয়ে গেছে। বউ আর সন্তানদের কথা মনে পড়ে খুব। তবে উপায় নেই। পেটের আগুন না নিভলে সবকিছুই অর্থহীন। দোহারিকায় সেতু হওয়ার পর কাঠের কাজ বেড়েছে কিছুটা। ধীরে ধীরে বসবাসের জন্য এক-দুজন করে ভিড় করছে মানুষ। কাজের জন্যই এত দূরে এসেছেন ফারুখ হোসেন। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। তাদের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। দুশ্চিন্তা হয়। এত সবের মধ্য দিয়েও ধুঁকে ধুঁকে চলেই যাচ্ছে জীবনটা। অনেকগুলো বছরই তো পার করলেন। কোনো কিছুই থেমে থাকে না। তবে এ বয়সে কাজ আর টানে না। ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটাতে ইচ্ছে করে সময়গুলো। বলতে বলতে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। কথা বলা থামিয়ে লুকাতে চেষ্টা করেন নিজের কষ্টগুলো।
বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই এ জায়গায়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা কাঠ কাটার একঘেয়ে কাজ। তারপর বিশ্রাম। নদীর তীরে গিয়ে বসে থাকেন তখন। এক-আধটু গল্প করা হয় অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে। বিকেলে পাড় ঘেঁষে যায় কিছু বালুভর্তি ট্রলার। তারই কোনো একটায় চড়ে বসে মাঝেমধ্যে ঘুরে আসা হয় কিছুটা দূর। রাত নামলেই ফুরিয়ে যায় সব কাজ। চোখে ঘুম আসে না সহজে। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো মনে পড়ে। ভালোই আছে, সুখে আছে তারা—প্রতিমুহূর্তে এমনই সান্ত্বনা দেন নিজেকে। কান্না পায় তখন। মনটা উদাসী হয়। কেন আসা এই পৃথিবীতে, কদিনের এ পৃথিবীতে করা পাপগুলোর কি কোনো ক্ষমা আছে—এমন হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে মনে। মনটা তখন কই কই যে যায়, তা ঠাওর করতে পারেন না এই বৃদ্ধ লোকটি। তাঁর জীবনটা কচুরিপানার মতো। খালি ভেসে ভেসে যায়। কোথাও থিতু হওয়ার জো নেই।
আচমকাই খেয়াল হলো সময় হয়েছে বাড়ি ফেরার। কিছুটা পথ এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে গেলেন তিনি। পল্লিগীতি পছন্দ খুব ফারুখ হোসেনের। নিজের গানের গলাটাও খারাপ নয়। আমাদের শোনানোর জন্য কি না জানি না, ফেরার পথে কেঁদে কেঁদে গেয়ে উঠলেন, ‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।’ সে সুর, গান দূর থেকে দূরে অনেকক্ষণ ধরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কানে...।

No comments

Powered by Blogger.