সমঝোতার সুযোগ by স্বপন দাশগুপ্ত

বাবরি মসজিদ নিয়ে বৃহস্পতিবার এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে বিশ্লেষকেরা দেখেছেন বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে। এখানে দুই ভারতীয় সাংবাদিকের বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হলো। লেখা দুটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন ফারুক ওয়াসিফ
সরলভাবে বললে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায়ের মূল তাৎপর্য হলো, তা রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ


বিষয়ে এর আগের মামলার রায়কে উল্টে দিয়েছে। ফাইজাবাদ জেলা আদালতের বিচারক এফ এ এ শামিয়ের ১৮৮৮ সালে রায় দেন: ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে হিন্দুদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত ভূমিতে মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি ৩৫৬ বছর আগে ঘটায় বঞ্চনার প্রতিকারে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিন সদস্যের আদালতের দুজন বিচারকই শামিয়েরের রায়কে অস্বীকার করে রায় দেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, যেহেতু ১৫২৮ সালে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মিত হয়েছে, সেহেতু এই মসজিদ ধর্মতাত্ত্বিকভাবে বৈধ নয়। সুতরাং, তাঁরা অযোধ্যার বেশির ভাগ হিন্দুর বিশ্বাস অনুযায়ী বিতর্কিত স্থানটির মালিক হিসেবে তাঁদেরই স্বীকার করে নিয়েছেন। হাইকোর্ট জায়গাটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেও বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের স্থানে যে রামলালা প্রতিমা স্থাপিত হয়েছে, তা সেখানেই থাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেন।
রায়টি অপ্রত্যাশিত ছিল। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেক্যুলার মহলসহ মুসলিম নেতাদের আশা ছিল, আদালত সংবিধানের মহিমা ও আইনের আপসহীনতা প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু আদালত ১৯৪৯ সালে মসজিদের ভেতরে প্রতিমা স্থাপন এবং ১৯৯২ সালে নাটকীয়ভাবে মসজিদটি ধ্বংস করাকে পরোক্ষভাবে বৈধতাই দিলেন। বাবরি মসজিদ ১৫২৮ সাল থেকেই ধর্মীয় স্থান না হয়ে থাকলে তা ধ্বংসকারী কর সেবক ও বিজেপির অপরাধ ধর্মস্থান ধ্বংসের বদলে একটি মধ্যযুগীয় স্থাপত্য ধ্বংসের অপরাধে পর্যবসিত হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে অবধারিতভাবেই সুপ্রিম কোর্টে আপিল হবে। সেক্যুলার মহলসহ মুসলমানেরা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের দাবি, রামের জন্মভূমি আফগানিস্তান বা অন্য কোথাও এবং বাবরি মসজিদের কাঠামো ফাঁকা পাথুরে জমিতেই নির্মিত হয়েছে। তাহলেও উচ্চ আদালত স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও ভারতের সরকারি প্রত্নবিদদের মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
এ রায় থেকে ভেবে নেওয়া ভুল হবে যে এতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের জোরই কায়েম হলো বা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার পথই খুলে গেল। এটা অতিমূল্যায়ন। হিন্দু শিবির এখন পর্যন্ত সংযম দেখিয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো খুশি যে আদালত তাদের মূল যুক্তি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের এই খুশি তারা গোপন রাখছে। কারণ তারা জানে, ভারত এখন ১৯৯০-এর দশকের মতো সংঘাতের পথে যেতে রাজি নয়। বিজেপির জন্য এই পথ নেওয়া বুমেরাং হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ভাবছে, হিন্দু ভারতের সবচেয়ে দৃশ্যমান মুখচ্ছবি হিসেবে এই রায় তাদের মুখই উজ্জ্বল করেছে। উত্তেজনার পথে তারা এ অর্জন নষ্ট করতে চাইবে না।
কোনো সন্দেহ নেই যে, উভয় পক্ষেই এমন লোক আছে যারা প্রতিপক্ষের সম্পূর্ণ পরাজয় আর নিজেদের সম্পূর্ণ জয় চায়। কয়েক দিন আগেও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা দাবি করেছেন, অযোধ্যা পৌরসভার মধ্যে কোনো মসজিদ থাকতে পারবে না। এ রকম হীন দৃষ্টিভঙ্গি দেশের জন্য খুব ক্ষতিকর। এ ধরনের চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে পড়লে হিন্দুদের বর্তমান নৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানটিরই ক্ষতি হবে।
মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ওঠানো হলেও এই রায়কে সমঝোতার সুযোগ হিসেবে নেওয়া উচিত। বিতর্কিত জায়গাটিতে তিন ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত বিচারিক আবিষ্কার মনে হলেও এর বাস্তব তাৎপর্য অনেক বড়। এটা উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সম্মানজনক বন্দোবস্তের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু—গর্ভগৃহ—স্থানীয় হিন্দুদের অধিকারে এলে ওই সম্পত্তির কিছু অংশ মুসলমান সম্প্রদায়কে মসজিদ বা অন্য কিছু বানানোর জন্য দেওয়া হলে তাদের কোনো অভিযোগ থাকা উচিত নয়। হিন্দুধর্মীয় নেতারা যদি মুসলিম সম্প্রদায়কে আদালতের বাইরে সমঝোতার জন্য আহ্বান জানান, তাহলে সেটা তাঁদের উদারতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। সংখ্যালঘুদের বড় অংশও একে স্বাগত জানাবে।
যারা বিভিন্ন বঞ্চনার জন্য নিজেদের পরাজিত মনে করছে, দ্রুত তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তাদের দুুঃখের প্রতিকার করা উচিত। অনেক রাজনীতিবিদকেই পাওয়া যাবে যাঁরা প্রচার করবেন, উচ্চ আদালতের রায় সংখ্যালঘুদের ওপর বাজে প্রভাব ফেলবে। তাঁরা ভুলে যান, ১৯৯১ সালের ধর্মীয় পীঠস্থান আইনের কারণে আর অযোধ্যা-ধরনের বিবাদ জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়।
এ ধরনের চিন্তাভাবনা বিপজ্জনক। সংখ্যালঘুদের মন এমনিতেই নাজুক অবস্থায় থাকে এবং সহজেই সেই মনে দাগ ফেলা যায়। এ জন্যই হিন্দুদের বিজয়ের গর্ব বাদ দিয়ে উদারতা ও মহানুভবতা দেখানো উচিত। হিন্দুরা যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে মন্দির এলাকায় মসজিদ স্থাপনের আমন্ত্রণ জানায়, তাহলে সেটা হবে অভিনন্দনযোগ্য কাজ।
হিন্দুদের জন্য অযোধ্যা রায় গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। কিন্তু একে যেন মুসলমানদের বিরাট পরাজয় হিসেবে দেখা না হয়। এই রায়ের মাধ্যমেই ভারতের সমস্যাসংকুল এক ইতিহাসের সমাপ্তি হোক এবং নতুন বিভেদ আর না জন্মাক।
স্বপন দাশগুপ্ত: ভারতীয় সাংবাদিক। ভারতের দি টেলিগ্রাফ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।

No comments

Powered by Blogger.