দাহকালের কথা-পরবাস by মাহমুদুজ্জামান বাবু
পূর্ণিমা রাত। শরীরে জোছনা মেখে ১৫ জন মানুষ উবু হয়ে বসে আছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। অরণ্যের মাঝখানেই সীমান্ত। ও পাশে আমেরিকা। এ পাশে মেক্সিকো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানব পাচারকারী দালালের হাত ধরে তারা সাত দিন আগে এই এলাকায় জড়ো হয়েছে। তাদের সবারই গন্তব্য তথাকথিত স্বর্গরাজ্য আমেরিকায়।
আমেরিকা মানে ডলার। ডলার মানে সুখ। সেই সুখ অধরা হয়ে অপেক্ষা করছে সীমান্তের ওপারে। দালালেরা বলেছে, রাত গাঢ় হলে সীমান্তরক্ষীরা পাহারায় অসতর্ক হবে। ঠিক তখনই দৌড় দিতে হবে ঊর্ধ্বশ্বাসে। ও পাশে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসো। সেখানে বসে থাকবে এই দালালদের বন্ধু অন্য দালাল। ওদের হাত ধরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে নিউইয়র্ক শহরে। নিউইয়র্ক যেতে চাওয়া এই ১৫ জনের দলে তিনজন বাঙালি। এদেরই একজনের নাম জয়নাল। এই জয়নালের মুখে গল্পটি শুনেছিলাম গত এপ্রিল মাসে নিউইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনের এক সন্ধ্যায়।
জয়নালের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। জমি বিক্রির ২২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল দালালদের হাতে। বিশ্বস্ত দালাল। কারণ, প্রায়ই সে মানব পাচার করে পৌঁছে দেয় বিভিন্ন দেশে। সেখানে পৌঁছে উৎফুল্ল লোকজন নিকটাত্মীয়ের কাছে সংবাদ পাঠায়, পৌঁছে গেছি। জয়নাল ও আরও তিনজন প্রথমে পৌঁছাল কলকাতায়। কলকাতা থেকে মস্কো। মস্কো থেকে লাতিন আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। অপরিচিত একদল মানব পাচারকারীর হাতে গিয়ে পড়ল তিন বঙ্গসন্তান। বহুকাল আগে আফ্রিকা থেকে কালো মানুষকে কিনে নিত শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা ‘দাস’ হিসেবে। পশুর চেয়েও অধম ছিল তাদের জীবন। চাবুকের কষাঘাতে, দাসসুলভ সেই জীবনে কালো মানুষের হাহাকার, কান্না নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস, সংগীত, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তা পড়ে, শুনে ও দেখে পৃথিবীর কত মানুষ চোখের জল ফেলেছে। এল সালভাদরে জয়নালরা মুখোমুখি হলো সেই জীবনের। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা জয়নালকে বাধ্য করা হলো ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করতে। সারা দিন কাজ শেষে রাতের গভীরে গুমরে গুমরে কান্না। সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট আর লুকিয়ে রাখা দুই হাজার আমেরিকান ডলার একমাত্র সম্বল। সঙ্গে অন্য দুজনের কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই; দালালেরা এল সালভাদরে পৌঁছে দেওয়ার আগেই সেসব হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যেই এক দিন যোগাযোগ হয়ে গেল আরেকজন দালালের সঙ্গে। শেষ সম্বল দুই হাজার ডলার বিনিময় হলো, সঙ্গী দুজন আর চোখের জল এল সালভাদরে রেখে জয়নাল বহু পথ ঘুরে পৌঁছাল কলম্বিয়ায়। ঢাকা থেকে উড়াল দেওয়ার পর পাঁচ মাস চলে গেছে মহাকালের গর্ভে। বাড়িতে জানানো হয়নি কিছুই। কী-ই বা জানানোর আছে! কলম্বিয়ায় এসে শোনা গেল দুঃসংবাদ; ওদের যাওয়ার পথ মেক্সিকো হয়ে। মেক্সিকোর সীমান্তে এখন অনেক কড়া নজরদারি। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ আছে। তাহলে? আবার অপেক্ষা। পেটের খাবার জোগাড় করতে জয়নাল দালালের পরামর্শে ভিড়ে গেল মাদক পাচারকারীদের দলে। এক রাত এখানে তো, অন্য রাত ওখানে। বাড়তি উদ্বেগ, পুলিশের ধাওয়া। দুঃসহ সেই জীবন কাটাল জয়নাল আরও দুই মাস। তারপর সেখান থেকে মেক্সিকো।
দালালেরা বলেছিল, একটা পূর্ণিমা রাত এলে রওনা দিতে হবে। তো, পূর্ণিমা রাতে জোছনার নিচে উবু হয়ে বসে আছে ১৫ জন মানুষ। সংকেতের অপেক্ষা। ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। হূৎপিণ্ডের দ্রুতলয় ধাক্কা ছাড়া মগজে আর কোনো ছন্দ নেই। আর একটু পরই আমেরিকা। আমেরিকা মানে ছোট বোনের বিয়ে। বাবার হাসিমুখ। সংসারে রঙিন বেলুনের ওড়াউড়ি। হঠাৎ কানে ভেসে এল হালকা শিসের শব্দ। জয়নাল দেখল, বসে থাকা সঙ্গীরা দৌড় শুরু করেছে গভীর জঙ্গলের দিকে। চলতে চলতে তৈরি হওয়া একটা সরু পথ জোছনার আলোতে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন। দৌড় দৌড় দৌড়। আর তখনই শুরু হলো অবিরাম গুলির বৃষ্টি। মাথা নিচু করে কোমর বাঁকিয়ে দুপেয়ে পশুর মতো করে একদল মানুষ জোছনার আলোতে দৌড়াচ্ছে দিগ্বিদিক, গুলির কান ফাটানো শব্দ ছাপিয়ে উঠছে তাদের আর্তস্বর, যেন তাদের তাড়া করেছে হিংস্র শ্বাপদ, তাদের থেমে যাওয়ার কিংবা পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। এ যেন জ্যা থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো, যার কখনো পেছনে ফেরা হবে না আর।
জয়নালরা ১৫ জন দৌড় দিয়েছিল। আমেরিকার ভূখণ্ডে পৌঁছেছিল পাঁচজন। বাকিরা কোথায়? আমার এই প্রশ্নে জয়নাল নির্বিকার বলেছিল, হয়তো মরে গেছে। অথবা ফিরে গেছে মেক্সিকোয়। নিউইয়র্কে পৌঁছানোর টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল ভিক্ষা করে। একটা দীর্ঘ পথ, মৃত্যুভয়, আর বিচিত্র জীবনযাপনের সকাল, দুপুর, রাত কি তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলেছে? এতগুলো টাকা দিয়ে দেশেই তো অনেক কিছু করা যেত—আমার এমন মন্তব্যে নিউইয়র্কে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী জয়নাল পাথরের চোখে চার্চ ম্যাকডোনাল্ড পাতাল রেল স্টেশনের নিচে নামার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনো উত্তর মেলেনি। তবে কি জয়নাল নিরুপায় হয়ে এই ভ্রমণে গেছে?
আমার এই মনে হওয়াটা সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে দেখে। সেই যখন ছাত্রজীবনে শিক্ষানীতির সুষ্ঠু বিধান চেয়ে স্লোগানমুখর পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, কিংবা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বুকের উঠোন সাম্যবাদের বিশ্বাসে, তখন বাংলাদেশে শাসকেরা মানুষকে ধমক দিতেন, ক্ষমতার রক্তচক্ষু রাঙাতেন এবং নিজেরাই নিজেদের স্তুতি করতেন। আর আমরা দেশের বাকি মানুষেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। সেই অবস্থা এখনো আছে। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই কানই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দেশের অন্যতম প্রধান কানের চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত অনেক যত্ন নিয়ে সেই কানের চিকিৎসা করলেও স্বাচিপের (আওয়ামীপন্থী সংগঠন) নেতারা প্রাণ গোপালের কান বরাবর মারমুখী হাত তুলে ফেললেন। গণমাধ্যমের প্রতি আইন প্রণেতাদের হুমকি, বেসামরিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের হাপুস নয়নে কান্না, আর রাজনীতির নামে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার এই স্বদেশে আজকাল খুব পরবাসী লাগে। আমাদের স্বদেশ কোথায়? মানুষের?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
Che21c@yahoo.com
জয়নালের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। জমি বিক্রির ২২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল দালালদের হাতে। বিশ্বস্ত দালাল। কারণ, প্রায়ই সে মানব পাচার করে পৌঁছে দেয় বিভিন্ন দেশে। সেখানে পৌঁছে উৎফুল্ল লোকজন নিকটাত্মীয়ের কাছে সংবাদ পাঠায়, পৌঁছে গেছি। জয়নাল ও আরও তিনজন প্রথমে পৌঁছাল কলকাতায়। কলকাতা থেকে মস্কো। মস্কো থেকে লাতিন আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। অপরিচিত একদল মানব পাচারকারীর হাতে গিয়ে পড়ল তিন বঙ্গসন্তান। বহুকাল আগে আফ্রিকা থেকে কালো মানুষকে কিনে নিত শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা ‘দাস’ হিসেবে। পশুর চেয়েও অধম ছিল তাদের জীবন। চাবুকের কষাঘাতে, দাসসুলভ সেই জীবনে কালো মানুষের হাহাকার, কান্না নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস, সংগীত, চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তা পড়ে, শুনে ও দেখে পৃথিবীর কত মানুষ চোখের জল ফেলেছে। এল সালভাদরে জয়নালরা মুখোমুখি হলো সেই জীবনের। উচ্চমাধ্যমিক পাস করা জয়নালকে বাধ্য করা হলো ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করতে। সারা দিন কাজ শেষে রাতের গভীরে গুমরে গুমরে কান্না। সবুজ রঙের বাংলাদেশের পাসপোর্ট আর লুকিয়ে রাখা দুই হাজার আমেরিকান ডলার একমাত্র সম্বল। সঙ্গে অন্য দুজনের কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই; দালালেরা এল সালভাদরে পৌঁছে দেওয়ার আগেই সেসব হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যেই এক দিন যোগাযোগ হয়ে গেল আরেকজন দালালের সঙ্গে। শেষ সম্বল দুই হাজার ডলার বিনিময় হলো, সঙ্গী দুজন আর চোখের জল এল সালভাদরে রেখে জয়নাল বহু পথ ঘুরে পৌঁছাল কলম্বিয়ায়। ঢাকা থেকে উড়াল দেওয়ার পর পাঁচ মাস চলে গেছে মহাকালের গর্ভে। বাড়িতে জানানো হয়নি কিছুই। কী-ই বা জানানোর আছে! কলম্বিয়ায় এসে শোনা গেল দুঃসংবাদ; ওদের যাওয়ার পথ মেক্সিকো হয়ে। মেক্সিকোর সীমান্তে এখন অনেক কড়া নজরদারি। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ আছে। তাহলে? আবার অপেক্ষা। পেটের খাবার জোগাড় করতে জয়নাল দালালের পরামর্শে ভিড়ে গেল মাদক পাচারকারীদের দলে। এক রাত এখানে তো, অন্য রাত ওখানে। বাড়তি উদ্বেগ, পুলিশের ধাওয়া। দুঃসহ সেই জীবন কাটাল জয়নাল আরও দুই মাস। তারপর সেখান থেকে মেক্সিকো।
দালালেরা বলেছিল, একটা পূর্ণিমা রাত এলে রওনা দিতে হবে। তো, পূর্ণিমা রাতে জোছনার নিচে উবু হয়ে বসে আছে ১৫ জন মানুষ। সংকেতের অপেক্ষা। ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। হূৎপিণ্ডের দ্রুতলয় ধাক্কা ছাড়া মগজে আর কোনো ছন্দ নেই। আর একটু পরই আমেরিকা। আমেরিকা মানে ছোট বোনের বিয়ে। বাবার হাসিমুখ। সংসারে রঙিন বেলুনের ওড়াউড়ি। হঠাৎ কানে ভেসে এল হালকা শিসের শব্দ। জয়নাল দেখল, বসে থাকা সঙ্গীরা দৌড় শুরু করেছে গভীর জঙ্গলের দিকে। চলতে চলতে তৈরি হওয়া একটা সরু পথ জোছনার আলোতে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন। দৌড় দৌড় দৌড়। আর তখনই শুরু হলো অবিরাম গুলির বৃষ্টি। মাথা নিচু করে কোমর বাঁকিয়ে দুপেয়ে পশুর মতো করে একদল মানুষ জোছনার আলোতে দৌড়াচ্ছে দিগ্বিদিক, গুলির কান ফাটানো শব্দ ছাপিয়ে উঠছে তাদের আর্তস্বর, যেন তাদের তাড়া করেছে হিংস্র শ্বাপদ, তাদের থেমে যাওয়ার কিংবা পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। এ যেন জ্যা থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো, যার কখনো পেছনে ফেরা হবে না আর।
জয়নালরা ১৫ জন দৌড় দিয়েছিল। আমেরিকার ভূখণ্ডে পৌঁছেছিল পাঁচজন। বাকিরা কোথায়? আমার এই প্রশ্নে জয়নাল নির্বিকার বলেছিল, হয়তো মরে গেছে। অথবা ফিরে গেছে মেক্সিকোয়। নিউইয়র্কে পৌঁছানোর টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল ভিক্ষা করে। একটা দীর্ঘ পথ, মৃত্যুভয়, আর বিচিত্র জীবনযাপনের সকাল, দুপুর, রাত কি তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলেছে? এতগুলো টাকা দিয়ে দেশেই তো অনেক কিছু করা যেত—আমার এমন মন্তব্যে নিউইয়র্কে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী জয়নাল পাথরের চোখে চার্চ ম্যাকডোনাল্ড পাতাল রেল স্টেশনের নিচে নামার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনো উত্তর মেলেনি। তবে কি জয়নাল নিরুপায় হয়ে এই ভ্রমণে গেছে?
আমার এই মনে হওয়াটা সাম্প্রতিক বাংলাদেশকে দেখে। সেই যখন ছাত্রজীবনে শিক্ষানীতির সুষ্ঠু বিধান চেয়ে স্লোগানমুখর পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, কিংবা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বুকের উঠোন সাম্যবাদের বিশ্বাসে, তখন বাংলাদেশে শাসকেরা মানুষকে ধমক দিতেন, ক্ষমতার রক্তচক্ষু রাঙাতেন এবং নিজেরাই নিজেদের স্তুতি করতেন। আর আমরা দেশের বাকি মানুষেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। সেই অবস্থা এখনো আছে। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই কানই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। দেশের অন্যতম প্রধান কানের চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত অনেক যত্ন নিয়ে সেই কানের চিকিৎসা করলেও স্বাচিপের (আওয়ামীপন্থী সংগঠন) নেতারা প্রাণ গোপালের কান বরাবর মারমুখী হাত তুলে ফেললেন। গণমাধ্যমের প্রতি আইন প্রণেতাদের হুমকি, বেসামরিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের হাপুস নয়নে কান্না, আর রাজনীতির নামে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার এই স্বদেশে আজকাল খুব পরবাসী লাগে। আমাদের স্বদেশ কোথায়? মানুষের?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
Che21c@yahoo.com
No comments