বিশেষ সাক্ষাৎকার-রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমের বিরোধ গণতন্ত্রের জন্য উপকারী by সাখাওয়াত আলী খান

সাখাওয়াত আলী খানের জন্ম ঢাকায়, ১৯৪১ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬২ সালে স্নাতক ও পরের বছর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা, ১৯৭০ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।


সাংবাদিকতা ও রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি প্রায় এক দশক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং দুই পর্বে প্রায় পাঁচ বছর বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলারসহ গণযোগাযোগ-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রথম আলো  কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে সাংসদেরা কয়েকটি সংবাদপত্রের সংবাদ ও মন্তব্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। পাবনায় সরকারপন্থী লোকজনের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরোধের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা বললেন, সংবাদমাধ্যম এ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করেছে। আপনার কি মনে হয় সংবাদমাধ্যমের আচরণে অতিরঞ্জন বা বস্তুনিষ্ঠতার অভাব দেখা যাচ্ছে?
সাখাওয়াত আলী খান  একেকটা সমাজে সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নানাভাবে। আমাদের সমাজের কোনো অংশেই সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। যাঁদের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়, তাঁরা এখনো সে রকম সহনশীল হয়ে উঠতে পারেননি। অতি সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলোর কথা আপনি বললেন, আমার মনে হয় না সেসব সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে অতিরঞ্জন হয়েছে। যেটুকু লেখালেখি হয়েছে, এটুকু সহ্য করার মতো সহনশীলতাও তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এটা আস্তে আস্তে হবে; আমি একেবারে নিরাশ নই। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে ইতিহাস, তাতে আমাদের এই প্রশিক্ষণের পর্বটা এখনো পার হয়নি, এখনো আমরা যেন অনেকটা শিক্ষানবিশির পর্যায়েই আছি।
প্রথম আলো  সব সরকারের আমলেই দেখা যায়, ক্ষমতাসীনেরা সংবাদমাধ্যমের সংবাদে মাঝেমধ্যেই ক্ষুব্ধ হন। এটা কেন ঘটে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে রাজনীতিকদের ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কি?
সাখাওয়াত আলী খান  সংবাদপত্রের দায়িত্ব কী, তাদের কাছ থেকে কী ধরনের আচরণ আশা করা যায়—এসব সম্পর্কে সাংসদদের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। ফলে কখনো কিছু তাঁদের বিরুদ্ধে গেলেই তাঁরা মনে করেন যে এটা দেশের জন্য খুব ক্ষতিকর। এটা সব সরকারের আমলেই দেখা যায়। সরকারও অনেক সময় বলতে চায়, মিডিয়া তাদের বিরুদ্ধে লিখছে। বিভিন্ন দলের সরকার আমরা দেখেছি, মাঝখানে সামরিক, আধাসামরিক, সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট সরকারও আমরা দেখেছি। সব আমলেই কমবেশি একই রকমের অভিযোগ আমরা লক্ষ করেছি। এ রকম বিরোধপূর্ণ অবস্থা কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি আছে; আমাদের এখানেই প্রথম দেখা গেল, এ রকম মোটেই নয়। তবে কোনো কোনো দেশে এর মাত্রা আমাদের দেশের মতো এতটা নয়। আমরা যেমন খুব অল্পতেই বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ি, অন্যান্য দেশে এ রকম হয় না। তবে পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিক পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত আছে।
প্রথম আলো  প্রবল স্বভাবের, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাজনীতিকও?
সাখাওয়াত আলী খান  হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে এমন ঘটেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে এই বিরোধাত্মক সম্পর্ক, যা কখনো কখনো সাংঘর্ষিকও হয়ে ওঠে—এটাকে গণতন্ত্রের জন্য অস্বাভাবিক বা নেতিবাচক বলে আমি মনে করি না; বরং আমি মনে করি, এই বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক গণতন্ত্রের জন্য উপকারীই বটে। কারণ, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক একদম গলাগলি, মাখামাখি—এটা আশা করা যায় না। কারণ, দুটোর ধরনই আলাদা। সংবাদমাধ্যম হচ্ছে ওয়াচডগের মতো; ওয়াচডগের কাজ তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুলত্রুটি বের করা। এতে আপত্তি করার তো কিছু দেখি না।
প্রথম আলো  কিন্তু তাঁরা তো আপত্তি করেন। কখনো কখনো এমন ভীতিকর বার্তাও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিতে চান, যেন বাড়াবাড়ি করা না হয়। তাঁরা কি সংবাদমাধ্যমের ওয়াচডগের ভূমিকাটাই মেনে নিতে পারেন না? হয়তো তাঁরা মনে করেন, তাঁদের কাজকর্মের ওপর নজরদারি করার অধিকার কারও নেই, যেহেতু জনগণ তাঁদের নির্বাচিত করেছেন?
সাখাওয়াত আলী খান  আমি প্রথমেই যেটা বললাম, সহনশীলতার মাত্রা অর্জন করার জন্য যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ দরকার, সেটাতে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি। একটা দেশ তৈরি হলো, যেখানে বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এখানে আমরা বহুদিক থেকেই পিছিয়ে ছিলাম। শুধু রাজনীতিতে নয়, লেখাপড়ায়, সংস্কৃতিতে, শিল্পে—সব দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। তো সেখান থেকে আমরা এখন যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, এই যেমন, আপনি প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি—এটাও একটা উন্নতি বলেই আমি মনে করি। আগে তো এসব আলোচনাই হতো না; যার যার কথা সে বলে যাচ্ছে, কারও কথা কেউ শুনছে না। এখন তো এক পক্ষ বলছে অন্য পক্ষ শুনছে, তার প্রতিক্রিয়া করছে—এসব তো ভালো লক্ষণ। সে জন্যই আমার মনে হয় এসব ঘটনা উন্নতিরই লক্ষণ বলা যায়।
প্রথম আলো  সংসদেরা পাঁচ বছর পর পর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ধরে নেন, সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব ম্যান্ডেট জনগণ তাঁদের দিয়েছেন, আর নতুন করে জনমত যাচাই করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সংবাদমাধ্যম প্রতিদিন জনগণের দরজায় হাজির হয়, কোনো বিষয়ে জনগণের মতামত কী, তার প্রতিফলন ঘটে সংবাদমাধ্যমে। এভাবে সংবাদমাধ্যমে জনগণের যে প্রতিনিধিত্ব ঘটে, সাংসদেরা তো সেটাকে কাজে লাগিয়ে জনগণের আশা-প্রত্যাশার অনুকূলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন...?
সাখাওয়াত আলী খান  আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলেছেন। সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিকেরা যে পরস্পরের পরিপূরক—এই অবস্থানটা দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে। বিরোধিতা করার জন্যই এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরোধিতা করবে—এ রকম কোনো ব্যাপার এখানে নেই। আপনি ঠিকই বলেছেন, যেসব বিষয়ে রাজনীতিকেরা জনগণের দোরে দোরে গিয়ে খোঁজ নিতে পারছেন না, সেসব বিষয়ে প্রায়ই জনমতের প্রতিফলন সংবাদমাধ্যমে ঘটে। কিন্তু তাঁরা হয়তো ভাবতে পারেন যে তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, তাঁরা যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন, সংবাদমাধ্যমের চেয়ে তাঁরা বেশি জানেন—এ রকম তাঁরা মনে করতেই পারেন। তাঁদেরও নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। এটা সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
প্রথম আলো  সংবাদমাধ্যমের নিজেরও তো দায়িত্বশীলতার একটা ব্যাপার আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু ঘাটতি আছে কি না?
সাখাওয়াত আলী খান  আছে আছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে এ দেশে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি আছে। তবে সে ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানের অনেক পার্থক্য আছে। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে, অনুশীলনের পার্থক্য আছে। কখনো কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র যে সীমা ছাড়িয়ে যায় না, তা বলা যাবে না। সৎ সংবাদকর্মীদের কখনো কখনো অস্বস্তি বোধ করতে হয় তাঁদের অন্য সহকর্মীদের আচরণে বা কাজকর্মে। কারণ, একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়ের যেকোনো একজন সদস্যের যেকোনো ধরনের দায়িত্বহীন কাজের দায় এসে পড়ে গোটা পেশার ওপরেই। কখনো কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে না। এসব আচরণের দায় পুরো সংবাদমাধ্যমের ওপর পড়ে। আরেকটি বিষয় এখানে ভালো নয়, সেটা হলো, সংবাদপত্র-জগতের দুটি প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের মধ্যেও অনেক সময় অনেক কথা লেখা হয়। এটা কিন্তু জনসাধারণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপার নয়; বরং দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিয়ে লেখালেখি। আমার মনে হয়, এটা পরিহার করা উচিত। কারণ, এসব করতে করতেই অতিরঞ্জন চলে আসে, তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাইয়ের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে, সেখানেই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো ঘটে। সাংবাদিকতার সুস্থ অনুশীলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথম আলো  তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে, তথ্য কমিশন গঠিত হয়েছে, তারপর চলে গেছে প্রায় ২০ মাস। কিন্তু এ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে না। আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিটি তথ্য প্রদান ইউনিটে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করার কথা। কিন্তু সেই কাজটা হয়েছে খুবই সামান্য। তথ্য কমিশনেও বেশি লোকে আপিল করেননি যে তাঁরা তথ্য চেয়ে পাননি। এ অবস্থা কেন?
সাখাওয়াত আলী খান  আমলাতন্ত্র জনগণকে তথ্য জানাতে কখনো রাজি ছিল না; শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই। এটা হলো প্রথম কথা। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণই এ রকম ছিল—তাঁদের বলে দেওয়া হতো, এটা গোপন করতে হবে, এটা জনগণকে জানানো যাবে না। ভালো কথা যে আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে। এ উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে অনেক মানুষের অবদান আছে, কিছু মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামও আছে, সাংবাদিকদেরও কিছু অবদান আছে। এটাকে অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই আইনের প্রয়োগটা কেমন হবে, এটা একটা ভাবনার বিষয়। যেমন, তথ্য কমিশন নিজেই খুব ভালোভাবে জানে না যে তাদের কাজটা, দায়িত্বটা কী রকম হবে। কেউ হয়তো বলেন যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা তাঁদের কাজ। বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা চিঠি দিয়ে বলেছেন যে আপনার তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করুন। কিন্তু কর্তৃপক্ষগুলো সেটা করছে না, সে ক্ষেত্রে তথ্য কমিশন কী করবে? তথ্য কমিশনের লোকবলও অত্যন্ত সীমিত। সেখানে গণমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধিত্ব দেখছি না।
প্রথম আলো  তথ্য অধিকার আইন সব নাগরিকের তথ্য জানার আইন, সাংবাদিকদের জন্য কোনো বিশেষ আইন নয়; সে জন্য হয়তো তথ্য কমিশনে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়নে সংবাদমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে।
সাখাওয়াত আলী খান  গণমাধ্যমের খুব বড় একটা ভূমিকা আছে। সমাজের সব লোকেরই কমবেশি ভূমিকা আছে। শিক্ষিত মহল, আমরা যাদের নাগরিক সমাজ বলি, সবাই মিলে আমরা যখন মানুষকে বোঝাতে পারব যে এ রকম একটা আইন আছে এবং সেটা আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে অবশ্যই কিছু মানুষ এগিয়ে আসবেন। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনধারণের মৌলিকতম সমস্যাগুলো এত গভীরে যে, তাদের ভাবনা এখনো এ পর্যায়ে আসেনি যে, তথ্য পাচ্ছে না বলে তারা কষ্ট পাচ্ছে। অন্ন পাচ্ছি না বলে, চাকরি পাচ্ছি না বলে কষ্ট পাচ্ছি—এই হচ্ছে অধিকাংশ মানুষের ভাবনা। কিন্তু অন্ন ও চাকরির সঙ্গে তথ্য পাওয়ার অধিকার যে সরাসরি সম্পৃক্ত, এটা বুঝতে একটু সময় লাগবে।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
সাখাওয়াত আলী খান  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.