মাহে রমজানে সদাচরণ ও পরোপকারিতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজানের রোজা পালন বা সিয়াম সাধনা মুসলমানদের পারস্পরিক ইহসান, পরোপকারিতা, সহানুভূতি ও অপরের প্রতি সহমর্মিতা ও মমত্ববোধ প্রকাশ করার শিক্ষা দেয়। ‘ইহসান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সুন্দর ব্যবহার, উত্তম আচরণ, ভালোভাবে সম্পাদন, কষ্ট লাঘব প্রভৃতি। ইসলামের পরিভাষায় কারও সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, তার উপকার সাধন করা এবং তার প্রতি উদার আচরণ করার নামই ইহসান। মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা, স্নেহ-মায়া-মমতা, ভালোবাসা, সৌজন্য, দয়া-দাক্ষিণ্য ও বদান্যতা প্রদর্শন করাকে ইহসান বা পরোপকারিতা বলা হয়। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলার প্রতি ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য উত্তমরূপে সম্পাদন করাও ইহসান। এই ইহসান মানবচরিত্রের অমূল্য সম্পদ। ইহসান ও পরোপকারিতা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা দান করেছে। ইহসানের মতো মহৎ গুণ ব্যতীত প্রকৃত ঈমানদার হওয়া যায় না। ইবাদতের চূড়ান্ত পর্যায় হলো ইহসান। রমজান মাসে মাসব্যাপী রোজার প্রশিক্ষণ মানুষকে পুণ্য ও ইহসানের দিকে পরিচালিত করে। ধনী রোজাদার ব্যক্তি রোজা রাখার মধ্য দিয়ে গরিবের ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা, দুঃখ ও বেদনা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন। রোজার দ্বারা গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। ফলে প্রকৃত রোজাদার মুমিন বান্দার অন্তর বিগলিত হয়ে যায় এবং তিনি দরিদ্রের প্রতি ইহসান বা দয়া প্রদর্শন করেন।
রোজা এমন একটি বাধ্যতামূলক নিয়মতান্ত্রিক ইবাদত, যা ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে এবং এতে সামাজিক একতা প্রকাশ পায়। সবাই একসঙ্গে ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা অনুভব করে এবং পারস্পরিক অনুভূতির দ্বারা দয়া-মায়া ও সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়। আর দয়া-দাক্ষিণ্য ও পরোপকারিতা থেকে মানুষের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা অর্জিত হয় এবং ধনী রোজাদার ব্যক্তি গরিব-দুস্থদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পারস্পরিক স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার দিক থেকে ঈমানদারদের উদাহরণ হলো একটি দেহের মতো। এর একটি অঙ্গ যদি ব্যথাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে কাতর হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম)
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ইহসানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মাহে রমজানে রোজা মানুষকে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, অতিথি, দুস্থ, এতিম সবার সঙ্গে পরোপকার, সহানুভূতি ও অপরের প্রতি মমত্ববোধ ও সৌজন্যমূলক আচরণ করার শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ইহসান কর, কেননা আল্লাহ ইহসানকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৯৫) আল্লাহ তাআলা আরও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তোমরা পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করবে, নিকট আত্মীয়দের, এতিম-মিসকিনদের, নিকটস্থ প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীদের, বন্ধুবান্ধব ও পথিকদের প্রতিও সুন্দর ব্যবহার করবে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩২)
ইহসানের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। ইহসান অবলম্বনকারী রোজাদার ব্যক্তিদের আল্লাহ পছন্দ করেন। তাই মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইহসান ও পরোপকারিতার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, সে জন্য মাহে রমজানের মতো অন্যান্য সময়ও স্বীয় ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, জ্ঞানবুদ্ধি, শারীরিক শক্তি, মুখের কথা দ্বারা, মোটকথা যেকোনো উপায়ে মানুষ একে অন্যের প্রতি ইহসান প্রদর্শন করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজে যদি একে অপরের প্রতি ইহসান ও দয়া প্রদর্শন করা না হয়, তাহলে অশান্তি সৃষ্টি হবে। মানবসমাজ ছাড়াও প্রাণী, উদ্ভিদ, কীট-পতঙ্গের প্রতিও ইহসান করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, তাহলে আকাশের অধিবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি ইহসান করবেন।’ (তিরমিজি)
ইহসান ও পরোপকারিতার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তির মানসিক ও নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হয়। আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে সিয়াম সাধনার জন্য ইহসান দরকার। ইহসানই মানুষকে সৃষ্টিজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। মাহে রমজান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশা করলে অবশ্যই নিঃস্ব-নিরীহ দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের প্রতি ইহসান করা বাঞ্ছনীয়। তাই রমজান মাসে রোজাদারদের অধীনস্থ কর্মচারী, চাকর-বাকরদের দায়িত্ব ও কাজের বোঝা কমিয়ে দেওয়া উচিত। তাদের প্রতি সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত ও অমানবিক। কারণ এতে তাদের রোজা রাখতে কষ্ট হতে পারে। তাই কঠিন ও সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপিয়ে যাতে তাদের অধিক কষ্ট দেওয়া না হয়, এ দিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। রমজান মাসে অধস্তনদের প্রতি ইহসান করলে সে দয়া-মায়া প্রদর্শন কিয়ামতের দিন তার জন্য মুক্তির কারণ হবে। মাহে রমজানে ইহসান ও পরোপকারিতার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা ইহকাল ও পরকালে অশেষ কল্যাণ দান করবেন। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কী হতে পারে?’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ৬০)
রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে ইহসান ও পরোপকারিতার মতো তাকওয়া, সবর, আদল প্রভৃতি সদ্গুণাবলি সৃষ্টি হয়ে থাকে। স্বভাবতই মানুষ একে অপরের স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসা লাভ করতে চায়। মানুষ পারস্পরিক ইহসান প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যের স্নেহ ও ভালোবাসা লাভ করতে পারে। পক্ষান্তরে মানুষ যদি একে অপরের প্রতি দুর্ব্যবহার, গালমন্দ, পরচর্চা, পরনিন্দা, অসদাচরণ করে, তাহলে ভালোবাসা অর্জনের পরিবর্তে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। সামাজিক অনাচার, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা রোধে পরোপকারের কোনো বিকল্প নেই—এটাই ইসলামের মহান শিক্ষা। তাই হাদিসে বলা হয়েছে, রোজা একটি ঢালের ন্যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি রোজা পালন করবে, ঝগড়া-বিবাদ থেকে তার বিরত থাকা উচিত। কেউ তাকে গালিগালাজ করলে বা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতে উদ্যত হলে পরিষ্কারভাবে তার বলে দেওয়া উচিত, ‘আমি রোজাদার’।
এভাবে মাহে রমজান আমাদের ইহসান ও পরোপকারিতার শিক্ষা দেয়। পরোপকার রোজাদার মুমিন বান্দার অন্যতম সৎগুণ। সে গুণটির সমাজে বড়ই অভাব দেখা যায়। রোজার বরকতে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ এবং পারস্পরিক হূদ্যতা সৃষ্টি হয়। মাহে রমজানে পরোপকারী ও ইহসানকারী যে শুধু অপরের উপকার সাধন করেন তা-ই নয়, বরকত দ্বারা তিনি নিজেও উপকৃত হন। কেননা ইহসান করলে পরস্পরের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সমাজে সবাই মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যদি (অপরের প্রতি) ইহসান (উপকার) কর, তাহলে যেন তোমাদের নিজেদের প্রতিই ইহসান করলে, আর যদি তোমরা অপরের অনিষ্ট সাধন কর, তাহলে তোমাদেরও অনিষ্ট হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭)
সুতরাং মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ এবং সমাজে সুখ-শান্তি, স্নেহ-মায়া-মমতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পারস্পরিক ইহসান ও পরোপকারিতার মহৎ গুণটি আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার মধ্যে দান করুন। যাঁরা এ সাধনায় রত থাকেন, তাঁরা একদিকে যেমন আল্লাহর ইবাদতের স্বাদ লাভ করতে সক্ষম হন, অন্য দিকে আল্লাহর বান্দাদের প্রতিও অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে থাকেন। রোজাদারদের যাঁর যেমন সামর্থ্য, আসুন তাই নিয়ে সাধ্যমতো এতিম-মিসকিনদের পাশে দাঁড়াই। সমাজের সহায়-সম্বলহীন বাস্তুহারা মানুষগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াই। আমরা যাঁরা অবস্থাসম্পন্ন এবং নিরাপদে আছি চলুুন, সব রোজাদার মিলেমিশে দেশের অসহায় ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষের প্রতি ইহসান ও পরোপকার করে তাদের দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে যাই।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.