প্রশাসনে গতিহীনতা by এ এম এম শওকত আলী
প্রশাসনে গতিহীনতার বিষয়টি অতীতের তুলনায় বর্তমানে অধিকতর আলোচিত বিষয়। অতীতে সরকারের অভ্যন্তরীণ সভায় এ ধরনের আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল।
বর্তমানে বিষয়টি প্রকাশ্যে উচ্চ পর্যায়ের সরকারী নীতিনির্ধারকরা বারংবার
উল্লেখ করছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ
করেছেন। সর্বশেষ পরিকল্পনা একাডেমীর রজতজয়নত্মি উদ্বোধনের দিনেও তিনি
প্রকল্প বাসত্মবায়নের শম্বুক গতির বিষয়টি উলেস্নখ করেছেন। প্রশাসনে
গতিহীনতার বিষয়টি এখন বাসত্মবতা, যা উপেৰা করা সমীচীন হবে না। উলিস্নখিত
একাডেমীর সভায় প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আইন
প্রণয়নের পদৰেপের কথাও বলেছেন।
যে কোন নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনে দুইটি অঙ্গ বিদ্যমান। এক, রাজনৈতিক। দুই, প্রশাসনিক। রাজনৈতিক অঙ্গের প্রধান দায়িত্ব হলো জনকল্যাণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লৰ্যে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান এবং সে নির্দেশনা যাতে নির্ধারিত সময়ে বাসত্মবায়িত হয় তার জন্য সচেষ্ট হওয়া ও কার্যকরী পদৰেপ নিশ্চিত করা। প্রশাসনে বিভিন্ন পর্যায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রধান দায়িত্ব হলো অনুমোদিত প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দ্রম্নত বাসত্মবায়ন ও সম্পন্ন করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, দুইটি অঙ্গেরই সমান গুরম্নত্ব। কোন একটির নিষ্ক্রিয়তা বা দৰতার অভাব হলেই গতিহীনতা থাকা স্বাভাবিক। এ কথা অবশ্য উলেস্নখ করতেই হয় যে, দু'টি অঙ্গেরই কোন কোন ৰেত্রে গতিহীনতা পরিলৰিত হলে প্রধানমন্ত্রীকেই এ গতিশীলতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি সে বিষয়েই সচেষ্ট। না হলে একাধিক বার গতিহীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন না। এ জন্যই তিনি মন্ত্রীসহ সচিবদের এ বিষয়ে অধিকতর যত্নবান হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। পত্রিকানত্মরে জানা যায়, মন্ত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, এক বছরই শিৰনবিশি সময় যথেষ্ট। কিন্তু এ সম্পর্কে মন্ত্রী রদবদলের বিষয়টি পরিলৰিত হয়নি। তাহলে কি তিনি এ ৰেত্রে সন্তুষ্ট? অন্যদিকে প্রশাসনের অন্য অঙ্গের শীর্ষ কর্মকর্তাদের রদবদল পরিলৰিত হচ্ছে। তাহলে কি অনুমান করা সম্ভব যে, এ অঙ্গেই গতিহীনতার মাত্রা অধিকতর। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে যে, একমাত্র কর্মকর্তাদের বদলি করেই গতিহীনতা নির্মূল করা সম্ভব নয়। যদি গতিহীনতার জন্য কোন কর্মকর্তা দায়ী হন তাহলে বদলিকৃত মন্ত্রণালয় বা বিভাগে অর্থাৎ ৰেত্রবিশেষে একই গতিহীনতা বজায় থাকবে। ঘন ঘন বদলি যে কোন কর্মকর্তাকে দ্রম্নত সিদ্ধানত্ম গ্রহণে নিরম্নৎসাহিত করে। এ জন্য প্রয়োজন দু'টি অঙ্গের বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি প্রধানত রাজনৈতিক অঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে এ পর্যায়ে অদৰতার অভিযোগ কেন বার বার উত্থাপিত হচ্ছে? এ ৰেত্রে অনুমান করা সম্ভব যে, কর্মকর্তাদের নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি বর্তমানেও ত্রম্নটিমুক্ত নয়। যদি অন্ধ আনুগত্যই পদোন্নতি ও পদায়নের একমাত্র নির্ণায়ক হয়, তাহলে প্রশাসনে গতিহীনতা কোন দিনই সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে না।
এ ৰেত্রে আরেকটি বিষয় গুরম্নত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে সরকারী চাকরিতে প্রবেশের নির্বাচন। বলাবাহুল্য, অনভিপ্রেত পদৰেপ ছাড়াও বর্তমান বিধি অত্যনত্ম ত্রম্নটিপূর্ণ। কারণ, নির্বাচনের ৰেত্রে নির্ধারিত কোটাকেই অধিকতর প্রাধান্য দেয়া হয়। অতীতে একাধিক বার পিএসসি এ বিষয়ে সংস্কারমূলক প্রসত্মাব দেয়া সত্ত্বেও কোন সরকারই সে প্রসত্মাব সমর্থন করেনি।
সচিবালয়ের সচিব ব্যতীত উচ্চতর পদে প্রবেশের জন্যও কোটা প্রথা চালু রয়েছে। বর্তমান সরকারের জন্য এ প্রথা উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছে। ১৯৮৯ সালে কোটামুক্ত ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংস্কারমূলক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও তা বানচাল করা হয়। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এ প্রথা অব্যাহত রাখার সপৰে সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারণে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ উপকমিটি কোটামুক্ত উন্মুক্ত প্রথা বর্জন করে কোটাভিত্তিক পদোন্নতির সুপারিশ করে, যা সামান্য রদবদল করে এখনও অব্যাহত রয়েছে। অতীতে বর্তমান সরকার কতর্ৃক গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০০) বর্জনকৃত প্রথা চালু করার সপৰে মত দিলেও তা বাসত্মবায়ন করা হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান তা হলো কোন সরকারই সময় সময় সংস্কার বিষয়ক সুপারিশ বাসত্মবায়ন করেনি।
এ ৰেত্রে সামরিক সরকারের অনীহা বোধগম্য। এ ধরনের সরকার কখনও বেসামরিক প্রশাসনকে দৰতা অর্জনে আগ্রহী ছিল না। কারণ, ঐ ধরনের সরকার বেসামরিক প্রশাসনকে আজ্ঞাবহ দাস হিসাবেই গণ্য করত। তবে ১৯৯১ পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলো কেন একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়। যে বিষয়টি উপলব্ধি করা সম্ভব তা হলো রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা, প্রশাসনে কর্মরত সবাই তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবে অথবা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গুরম্নত্বপূর্ণ নয়। যে করতে চাইবে না তাকে হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা অপেৰাকৃত কম গুরম্নত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। ৰেত্রবিশেষে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ২৫ বছর পূর্ণ হলে কোন কারণ প্রদর্শন না করেই চাকরিচু্যত করা হয়। ভদ্র ভাষায় যাকে বলা হয় সরকারী নির্দেশে অবসর গ্রহণ।
এ প্রক্রিয়া চক্রাকারে দৃশ্যমান। ভিন্ন মতাবলম্বীর সরকার যদি চাকরিচু্যত করে তখন পরবর্তী সরকার স্বতঃসিদ্ধভাবেই বিশ্বাস করে চাকরিচু্যত কর্মকর্তাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে অথবা তাদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হয়েছে। এজন্য গ্রহণ করা হয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা। তবে এ কথাও সত্যি যে, এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা উচ্চ আদালতের রায়ের বলে পরবর্তীতে নিযুক্তি লাভ করেছেন। এ ৰেত্রে দোষের কিছু নেই। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টা আদালত বা প্রশাসনিক ট্রাইবু্যনালের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় না কেন? একমাত্র কারণ হতে পারে চূড়ানত্ম রায় প্রকাশের ৰেত্রে আদালতের দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলা পরিচালনার অত্যধিক ব্যয় যা সব কর্মকতার জন্য বহন করা সম্ভব হয় না।
প্রকল্প বাসত্মবায়নের গতিহীনতার বিষয়ে প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়াও যুক্ত। প্রকল্প বাসত্মবায়ন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার জন্য কাজে না হলেও কথায় সব সরকারই কম বেশি সচেষ্ট। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনের গতিশীলতা কখনও কোন সরকার বিশেস্নষণ করে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেনি। প্রকল্প অনুমোদন গতিশীল হলে প্রকল্প বাসত্মবায়নও কম বেশি গতিশীল হবে। এ বিষয়ে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিকল্পনা কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কমিশন কতর্ৃক নির্ধারিত ছকেই প্রকল্প ধারণাপত্র সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত হয়। একটি আনত্মঃমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীৰা-নিরীৰার পর ধারণাপত্রটি কমিশনে পাঠানো হয়। এর পরবর্তী ধাপ হলো প্রাক-একনেক সভা, কিন্তু তার পূর্বে সংশিস্নষ্ট নথি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ওঠানামা করে। কমিশনের সংশিস্নষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অনুমোদন দেয়ার পর প্রাক-একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জুড়ে দেয়া হয় অনেক শর্ত। অনেক ৰেত্রেই পুনরায় প্রেরণ করা হয় সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ে। দীর্ঘসূত্রতা কিভাবে পরিহার করা যায় সেদিকে কোন দৃষ্টি দেয়া হয় না।
মন্ত্রণালয়ে কর্মরত সব কর্মকর্তার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিও গতিহীনতাকে সুসংহত করে। সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রম্নত সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয় না। যা হয় তা হলো ফাইল চালাচালি। যে সমসত্ম সিদ্ধানত্ম গ্রহণে সচিবালয় নির্দেশিকা অথবা সরকারী কার্য সম্পাদনবিধির আওতায় সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তা ৰমতাবান, অধিকাংশ ৰেত্রে তিনি নিরাপত্তার জন্য নথিটি উপরে পাঠিয়ে দেন। উর্ধতন কর্মকর্তাও এ প্রবণতাকে উৎসাহিত করেন। নিরম্নৎসাহিত করলে তিনি যেন ৰমতাসীন হয়ে যাবেন। গতিশীলতার জন্য প্রয়োজন নিরম্নৎসাহিত করা।
নীতি সংক্রানত্ম বিষয় ব্যতীত কোন নথি সচিব বা মন্ত্রী পর্যায়ে না পাঠানোর যে স্বতঃসিদ্ধ প্রক্রিয়া ছিল তা যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে এখন অচল হয়ে গেছে। এৰেত্রেও প্রয়োজন রয়েছে রাজনৈতিক অর্থাৎ মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মন্ত্রী বা সচিব যদি সর্বৰেত্রেই সিদ্ধানত্ম প্রদানে আগ্রহী হন তাহলে গতিহীনতাকে নিয়ম বলেই ধরে নিতে হবে। কর্মকর্তাদের ৰেত্রে আরও একটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। তাহলো অনেক সচিব বা অতিরিক্ত সচিব অভিযোগ করেন, অধসত্মন পর্যায়ে সিদ্ধানত্মের বিষয়ে হাঁ বা না সিদ্ধানত্মের কোন উলেস্নখ থাকে না, যদিও সচিবালয় নির্দেশিকায় এর স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে। অর্থাৎ এ ধরনের অধসত্মন কর্মকর্তারা দায়িত্বশীল নন। কিন্তু এ ধরনের মানসিতার জন্য কখনও সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাকে সতর্ক এবং ৰেত্রবিশেষে বিধি অনুযায়ী তিরস্কারও করা হয় না। এ প্রতিষ্ঠিত রীতি রম্নটিন প্রক্রিয়ায় মেনে নিলে প্রশাসনে গতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে গতিহীনতার মূল কারণ একাধিক। এক, বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রমের সমন্বয়ের অভাব। সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক। এ জন্য প্রতিষ্ঠিত কাঠামো অনেকাংশে দুর্বল। যিনি বা যাঁরা এ মনোভাব পোষণ করেন তাঁরা ভুলে যান, প্রশাসন হচ্ছে এক এবং অবিভাজ্য। কোন এক বিভাগের দুর্বলতা এ প্রশাসনকেই দুর্বল করে। দুই, এমপি ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব। তিন, এমপি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব। এর ফলে অধিকাংশ স্থানে প্রশাসন অনেকটা স্থবির। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদই এর প্রমাণ বহন করে। এখন পর্যনত্ম সরকার চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব অবসানের লৰ্যে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
৭ মার্চ, ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
যে কোন নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনে দুইটি অঙ্গ বিদ্যমান। এক, রাজনৈতিক। দুই, প্রশাসনিক। রাজনৈতিক অঙ্গের প্রধান দায়িত্ব হলো জনকল্যাণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লৰ্যে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান এবং সে নির্দেশনা যাতে নির্ধারিত সময়ে বাসত্মবায়িত হয় তার জন্য সচেষ্ট হওয়া ও কার্যকরী পদৰেপ নিশ্চিত করা। প্রশাসনে বিভিন্ন পর্যায়ে নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রধান দায়িত্ব হলো অনুমোদিত প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দ্রম্নত বাসত্মবায়ন ও সম্পন্ন করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, দুইটি অঙ্গেরই সমান গুরম্নত্ব। কোন একটির নিষ্ক্রিয়তা বা দৰতার অভাব হলেই গতিহীনতা থাকা স্বাভাবিক। এ কথা অবশ্য উলেস্নখ করতেই হয় যে, দু'টি অঙ্গেরই কোন কোন ৰেত্রে গতিহীনতা পরিলৰিত হলে প্রধানমন্ত্রীকেই এ গতিশীলতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি সে বিষয়েই সচেষ্ট। না হলে একাধিক বার গতিহীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন না। এ জন্যই তিনি মন্ত্রীসহ সচিবদের এ বিষয়ে অধিকতর যত্নবান হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। পত্রিকানত্মরে জানা যায়, মন্ত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, এক বছরই শিৰনবিশি সময় যথেষ্ট। কিন্তু এ সম্পর্কে মন্ত্রী রদবদলের বিষয়টি পরিলৰিত হয়নি। তাহলে কি তিনি এ ৰেত্রে সন্তুষ্ট? অন্যদিকে প্রশাসনের অন্য অঙ্গের শীর্ষ কর্মকর্তাদের রদবদল পরিলৰিত হচ্ছে। তাহলে কি অনুমান করা সম্ভব যে, এ অঙ্গেই গতিহীনতার মাত্রা অধিকতর। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে যে, একমাত্র কর্মকর্তাদের বদলি করেই গতিহীনতা নির্মূল করা সম্ভব নয়। যদি গতিহীনতার জন্য কোন কর্মকর্তা দায়ী হন তাহলে বদলিকৃত মন্ত্রণালয় বা বিভাগে অর্থাৎ ৰেত্রবিশেষে একই গতিহীনতা বজায় থাকবে। ঘন ঘন বদলি যে কোন কর্মকর্তাকে দ্রম্নত সিদ্ধানত্ম গ্রহণে নিরম্নৎসাহিত করে। এ জন্য প্রয়োজন দু'টি অঙ্গের বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি প্রধানত রাজনৈতিক অঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে এ পর্যায়ে অদৰতার অভিযোগ কেন বার বার উত্থাপিত হচ্ছে? এ ৰেত্রে অনুমান করা সম্ভব যে, কর্মকর্তাদের নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি বর্তমানেও ত্রম্নটিমুক্ত নয়। যদি অন্ধ আনুগত্যই পদোন্নতি ও পদায়নের একমাত্র নির্ণায়ক হয়, তাহলে প্রশাসনে গতিহীনতা কোন দিনই সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে না।
এ ৰেত্রে আরেকটি বিষয় গুরম্নত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে সরকারী চাকরিতে প্রবেশের নির্বাচন। বলাবাহুল্য, অনভিপ্রেত পদৰেপ ছাড়াও বর্তমান বিধি অত্যনত্ম ত্রম্নটিপূর্ণ। কারণ, নির্বাচনের ৰেত্রে নির্ধারিত কোটাকেই অধিকতর প্রাধান্য দেয়া হয়। অতীতে একাধিক বার পিএসসি এ বিষয়ে সংস্কারমূলক প্রসত্মাব দেয়া সত্ত্বেও কোন সরকারই সে প্রসত্মাব সমর্থন করেনি।
সচিবালয়ের সচিব ব্যতীত উচ্চতর পদে প্রবেশের জন্যও কোটা প্রথা চালু রয়েছে। বর্তমান সরকারের জন্য এ প্রথা উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছে। ১৯৮৯ সালে কোটামুক্ত ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংস্কারমূলক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও তা বানচাল করা হয়। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এ প্রথা অব্যাহত রাখার সপৰে সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারণে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ উপকমিটি কোটামুক্ত উন্মুক্ত প্রথা বর্জন করে কোটাভিত্তিক পদোন্নতির সুপারিশ করে, যা সামান্য রদবদল করে এখনও অব্যাহত রয়েছে। অতীতে বর্তমান সরকার কতর্ৃক গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০০) বর্জনকৃত প্রথা চালু করার সপৰে মত দিলেও তা বাসত্মবায়ন করা হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান তা হলো কোন সরকারই সময় সময় সংস্কার বিষয়ক সুপারিশ বাসত্মবায়ন করেনি।
এ ৰেত্রে সামরিক সরকারের অনীহা বোধগম্য। এ ধরনের সরকার কখনও বেসামরিক প্রশাসনকে দৰতা অর্জনে আগ্রহী ছিল না। কারণ, ঐ ধরনের সরকার বেসামরিক প্রশাসনকে আজ্ঞাবহ দাস হিসাবেই গণ্য করত। তবে ১৯৯১ পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলো কেন একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়। যে বিষয়টি উপলব্ধি করা সম্ভব তা হলো রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা, প্রশাসনে কর্মরত সবাই তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবে অথবা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গুরম্নত্বপূর্ণ নয়। যে করতে চাইবে না তাকে হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা অপেৰাকৃত কম গুরম্নত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। ৰেত্রবিশেষে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ২৫ বছর পূর্ণ হলে কোন কারণ প্রদর্শন না করেই চাকরিচু্যত করা হয়। ভদ্র ভাষায় যাকে বলা হয় সরকারী নির্দেশে অবসর গ্রহণ।
এ প্রক্রিয়া চক্রাকারে দৃশ্যমান। ভিন্ন মতাবলম্বীর সরকার যদি চাকরিচু্যত করে তখন পরবর্তী সরকার স্বতঃসিদ্ধভাবেই বিশ্বাস করে চাকরিচু্যত কর্মকর্তাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে অথবা তাদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হয়েছে। এজন্য গ্রহণ করা হয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা। তবে এ কথাও সত্যি যে, এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা উচ্চ আদালতের রায়ের বলে পরবর্তীতে নিযুক্তি লাভ করেছেন। এ ৰেত্রে দোষের কিছু নেই। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টা আদালত বা প্রশাসনিক ট্রাইবু্যনালের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় না কেন? একমাত্র কারণ হতে পারে চূড়ানত্ম রায় প্রকাশের ৰেত্রে আদালতের দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলা পরিচালনার অত্যধিক ব্যয় যা সব কর্মকতার জন্য বহন করা সম্ভব হয় না।
প্রকল্প বাসত্মবায়নের গতিহীনতার বিষয়ে প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়াও যুক্ত। প্রকল্প বাসত্মবায়ন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার জন্য কাজে না হলেও কথায় সব সরকারই কম বেশি সচেষ্ট। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনের গতিশীলতা কখনও কোন সরকার বিশেস্নষণ করে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেনি। প্রকল্প অনুমোদন গতিশীল হলে প্রকল্প বাসত্মবায়নও কম বেশি গতিশীল হবে। এ বিষয়ে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিকল্পনা কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কমিশন কতর্ৃক নির্ধারিত ছকেই প্রকল্প ধারণাপত্র সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত হয়। একটি আনত্মঃমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীৰা-নিরীৰার পর ধারণাপত্রটি কমিশনে পাঠানো হয়। এর পরবর্তী ধাপ হলো প্রাক-একনেক সভা, কিন্তু তার পূর্বে সংশিস্নষ্ট নথি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ওঠানামা করে। কমিশনের সংশিস্নষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অনুমোদন দেয়ার পর প্রাক-একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। জুড়ে দেয়া হয় অনেক শর্ত। অনেক ৰেত্রেই পুনরায় প্রেরণ করা হয় সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ে। দীর্ঘসূত্রতা কিভাবে পরিহার করা যায় সেদিকে কোন দৃষ্টি দেয়া হয় না।
মন্ত্রণালয়ে কর্মরত সব কর্মকর্তার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিও গতিহীনতাকে সুসংহত করে। সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রম্নত সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হয় না। যা হয় তা হলো ফাইল চালাচালি। যে সমসত্ম সিদ্ধানত্ম গ্রহণে সচিবালয় নির্দেশিকা অথবা সরকারী কার্য সম্পাদনবিধির আওতায় সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তা ৰমতাবান, অধিকাংশ ৰেত্রে তিনি নিরাপত্তার জন্য নথিটি উপরে পাঠিয়ে দেন। উর্ধতন কর্মকর্তাও এ প্রবণতাকে উৎসাহিত করেন। নিরম্নৎসাহিত করলে তিনি যেন ৰমতাসীন হয়ে যাবেন। গতিশীলতার জন্য প্রয়োজন নিরম্নৎসাহিত করা।
নীতি সংক্রানত্ম বিষয় ব্যতীত কোন নথি সচিব বা মন্ত্রী পর্যায়ে না পাঠানোর যে স্বতঃসিদ্ধ প্রক্রিয়া ছিল তা যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে এখন অচল হয়ে গেছে। এৰেত্রেও প্রয়োজন রয়েছে রাজনৈতিক অর্থাৎ মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মন্ত্রী বা সচিব যদি সর্বৰেত্রেই সিদ্ধানত্ম প্রদানে আগ্রহী হন তাহলে গতিহীনতাকে নিয়ম বলেই ধরে নিতে হবে। কর্মকর্তাদের ৰেত্রে আরও একটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। তাহলো অনেক সচিব বা অতিরিক্ত সচিব অভিযোগ করেন, অধসত্মন পর্যায়ে সিদ্ধানত্মের বিষয়ে হাঁ বা না সিদ্ধানত্মের কোন উলেস্নখ থাকে না, যদিও সচিবালয় নির্দেশিকায় এর স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে। অর্থাৎ এ ধরনের অধসত্মন কর্মকর্তারা দায়িত্বশীল নন। কিন্তু এ ধরনের মানসিতার জন্য কখনও সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাকে সতর্ক এবং ৰেত্রবিশেষে বিধি অনুযায়ী তিরস্কারও করা হয় না। এ প্রতিষ্ঠিত রীতি রম্নটিন প্রক্রিয়ায় মেনে নিলে প্রশাসনে গতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে গতিহীনতার মূল কারণ একাধিক। এক, বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রমের সমন্বয়ের অভাব। সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক। এ জন্য প্রতিষ্ঠিত কাঠামো অনেকাংশে দুর্বল। যিনি বা যাঁরা এ মনোভাব পোষণ করেন তাঁরা ভুলে যান, প্রশাসন হচ্ছে এক এবং অবিভাজ্য। কোন এক বিভাগের দুর্বলতা এ প্রশাসনকেই দুর্বল করে। দুই, এমপি ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব। তিন, এমপি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দ্বন্দ্ব। এর ফলে অধিকাংশ স্থানে প্রশাসন অনেকটা স্থবির। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদই এর প্রমাণ বহন করে। এখন পর্যনত্ম সরকার চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব অবসানের লৰ্যে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
৭ মার্চ, ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments