বাংলা কবিতার নক্ষত্রপুরুষ by শাহীন রেজা
'অরণ্য সমুদ্র থেকে ধ্বনি ওঠে গগনে গগনে পুষ্পিত শরীরে আমি হাত রাখি যখন তৃষ্ণায় প্রাচীন অগি্নর মতো উৎক্ষিপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায় অযুত নক্ষত্র দেখি গলে যায় আমার চুম্বনে'
অযুত
নক্ষত্রকে চুম্বনের শক্তি দিয়ে যিনি তরলে পরিণত করতে পারেন, তিনি কি শুধুই
কবি_ শুধুই রক্ত-মাংসের শরীরের একজন? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে হৃদয় থেকে যে
উত্তর আসে, তা শুধু শ্রবণের জন্য নয়, উপলব্ধির বিষয়ও বটে। বলছিলাম ফজল
শাহাবুদ্দীনের কথা, যার কবিতা তিনি নিজেই অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন বারবার_
আর তিল তিল করে স্থাপন করেছেন কঠোর-কোমলে মেশানো এক সুরম্য প্রাসাদ, যার
অধীশ্বর শুধু তিনি_ আর কেউ নন।
কবিতা যদি উপলব্ধির বিষয় হয়, তবে সেখানে ফজল নিঃসন্দেহে এক মহান কারিগর; আর যদি তা শুধু শ্রবণের হয়, তাতেও তার সাবলীলতা একান্তভাবে দৃশ্যমান।
সতীর্থরা যখন প্রেমে মত্ত, তখন তিনি নারীকে অতিক্রম করে হাত বাড়িয়েছেন নিসর্গে আর তারপর তার স্থিতি পরম পূজনীয় বিধাতায়। ঈশ্বরবাদে স্থিত ফজল শাহাবুদ্দীন নিজেকে শনাক্ত করেন একজন দ্রুতগামী অশ্বারোহী হিসেবে, যিনি আকাশবিহীন আকাশের দিকে বিশাল আলোর আবর্তে ক্রমধাবমান। জন্ম থেকে নিজ সত্তায় এক গভীর ক্রন্দনধ্বনি নিয়ে পরিণতির দিকে অগ্রসরমান এই কবি তার সমাপ্তি খোঁজেন মৃত্যুহীনতায়। তার তেত্রিশ লক্ষতম জন্মদিনের আকুতি তাই একটুও বেমানান না হয়ে বরঞ্চ আরও আলোময় এবং প্রাণময়।
তার শান্তি সমর্পণে। একান্ত ইবাদতের মতো এই সমর্পণ তার কবিতার একটি প্রধান সুর। সুন্দরের কাছে, পবিত্রতার কাছে এই সমর্পণ কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের এক বিরল-বিচিত্র অধ্যায়। এ অধ্যায় যিনি যতটা স্পর্শ করেছেন, তিনি ততটাই মোহিত ও আবিষ্ট হয়েছেন।
চিরকালের সন্ধ্যাকে শরীরে মেখে অনন্তের যাত্রী ফজলের একান্ত চিরস্নান যেন সেই ঘ্রাণ সরোবরে, যেখানে প্রদীপ নেভানো আলোয় মন্থিত তার স্বপ্ন-সময়ের একান্ত রাত্রিগুলো।
ফজল জাগতিক ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম এবং প্রজননের সঙ্গে মিশে থাকতে চান চিরকালের শব্দসঙ্গীতের মতো। স্বপ্নাশ্রয়ী ফজল শাহাবুদ্দীন স্বপ্ন দেখতেও ভালোবাসেন। ভালোবাসেন স্বপ্নাকাশে নক্ষত্র হয়ে, মেঘ হয়ে ভেসে থাকতে। ফজলের অস্তিত্বে এবং স্মৃতিতে চিরউন্মুখ তার সেই নারী, যার জন্য বৃষ্টিময় দিনে তার এই আকুল আকুতি, এই নিবিড় প্রেমোচ্চারণ_
'তোকে মনে পড়ে এই বৃষ্টিভরা দিনে তুই এক অগি্নময় স্মৃতি
আমার অস্তিত্বে একা উন্মথিত দুর্লভ প্রতীতি অধুনা প্রাচীনে।'
এই কবির একান্ত বিশ্বাস_ পৃথিবীর সকল কবিই একা_ যেমন সকল মানুষ। এই একাকিত্বই তাকে টেনে নিয়ে গেছে শব্দরাজ্যে_ দিয়েছে নিঃসঙ্গতা নির্মাণের মতো অসংখ্য কাব্য ক্যানভাস।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে কাব্যযাত্রী ফজল বহু কবিতাগ্রন্থের জনক। ৬০ বছরব্যাপী কাব্যজীবনে তার নিমগ্নতা তাকে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধ এক কাব্যজগৎ। এ জগৎ আলোহীন অন্ধকারহীন অথচ প্রবল ধ্বনিময়। এ জগতে যেমন আছে সুন্দরের প্রসব-বেদনা, তেমনি ধূসর ধরিত্রীর তীব্র তীক্ষষ্ট আর্তনাদ।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতাগ্রন্থের নামগুলোও যেমন এক-একটি কবিতা। 'সানি্নধ্যের আর্তনাদ', 'আততায়ী সূর্যাস্ত', 'অন্তরীক্ষে অরণ্য', 'আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর' কিংবা 'তৃষ্ণার অগি্নতে একা'র মধ্য দিয়ে যে ফজলের যাত্রা, তা এখন চূড়ান্তের পথে। ১৯৩৬ থেকে ২০১৩_ জীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শুধু কবিতার ঘোরে আচ্ছন্ন ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য একুশে এবং বাংলা একাডেমী পদক লাভ করলেও কারাবরণ করেছেন একটি গদ্য রচনার জন্য, যা তার জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি কবিতার এই নক্ষত্রপুরুষ পা রাখছেন ৭৭-এ। জন্মদিনে কবিকে এক আকাশ শুভেচ্ছা।
শাহীন রেজা : কবি ও সাহিত্য সংগঠক
কবিতা যদি উপলব্ধির বিষয় হয়, তবে সেখানে ফজল নিঃসন্দেহে এক মহান কারিগর; আর যদি তা শুধু শ্রবণের হয়, তাতেও তার সাবলীলতা একান্তভাবে দৃশ্যমান।
সতীর্থরা যখন প্রেমে মত্ত, তখন তিনি নারীকে অতিক্রম করে হাত বাড়িয়েছেন নিসর্গে আর তারপর তার স্থিতি পরম পূজনীয় বিধাতায়। ঈশ্বরবাদে স্থিত ফজল শাহাবুদ্দীন নিজেকে শনাক্ত করেন একজন দ্রুতগামী অশ্বারোহী হিসেবে, যিনি আকাশবিহীন আকাশের দিকে বিশাল আলোর আবর্তে ক্রমধাবমান। জন্ম থেকে নিজ সত্তায় এক গভীর ক্রন্দনধ্বনি নিয়ে পরিণতির দিকে অগ্রসরমান এই কবি তার সমাপ্তি খোঁজেন মৃত্যুহীনতায়। তার তেত্রিশ লক্ষতম জন্মদিনের আকুতি তাই একটুও বেমানান না হয়ে বরঞ্চ আরও আলোময় এবং প্রাণময়।
তার শান্তি সমর্পণে। একান্ত ইবাদতের মতো এই সমর্পণ তার কবিতার একটি প্রধান সুর। সুন্দরের কাছে, পবিত্রতার কাছে এই সমর্পণ কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের এক বিরল-বিচিত্র অধ্যায়। এ অধ্যায় যিনি যতটা স্পর্শ করেছেন, তিনি ততটাই মোহিত ও আবিষ্ট হয়েছেন।
চিরকালের সন্ধ্যাকে শরীরে মেখে অনন্তের যাত্রী ফজলের একান্ত চিরস্নান যেন সেই ঘ্রাণ সরোবরে, যেখানে প্রদীপ নেভানো আলোয় মন্থিত তার স্বপ্ন-সময়ের একান্ত রাত্রিগুলো।
ফজল জাগতিক ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম এবং প্রজননের সঙ্গে মিশে থাকতে চান চিরকালের শব্দসঙ্গীতের মতো। স্বপ্নাশ্রয়ী ফজল শাহাবুদ্দীন স্বপ্ন দেখতেও ভালোবাসেন। ভালোবাসেন স্বপ্নাকাশে নক্ষত্র হয়ে, মেঘ হয়ে ভেসে থাকতে। ফজলের অস্তিত্বে এবং স্মৃতিতে চিরউন্মুখ তার সেই নারী, যার জন্য বৃষ্টিময় দিনে তার এই আকুল আকুতি, এই নিবিড় প্রেমোচ্চারণ_
'তোকে মনে পড়ে এই বৃষ্টিভরা দিনে তুই এক অগি্নময় স্মৃতি
আমার অস্তিত্বে একা উন্মথিত দুর্লভ প্রতীতি অধুনা প্রাচীনে।'
এই কবির একান্ত বিশ্বাস_ পৃথিবীর সকল কবিই একা_ যেমন সকল মানুষ। এই একাকিত্বই তাকে টেনে নিয়ে গেছে শব্দরাজ্যে_ দিয়েছে নিঃসঙ্গতা নির্মাণের মতো অসংখ্য কাব্য ক্যানভাস।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে কাব্যযাত্রী ফজল বহু কবিতাগ্রন্থের জনক। ৬০ বছরব্যাপী কাব্যজীবনে তার নিমগ্নতা তাকে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধ এক কাব্যজগৎ। এ জগৎ আলোহীন অন্ধকারহীন অথচ প্রবল ধ্বনিময়। এ জগতে যেমন আছে সুন্দরের প্রসব-বেদনা, তেমনি ধূসর ধরিত্রীর তীব্র তীক্ষষ্ট আর্তনাদ।
ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতাগ্রন্থের নামগুলোও যেমন এক-একটি কবিতা। 'সানি্নধ্যের আর্তনাদ', 'আততায়ী সূর্যাস্ত', 'অন্তরীক্ষে অরণ্য', 'আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর' কিংবা 'তৃষ্ণার অগি্নতে একা'র মধ্য দিয়ে যে ফজলের যাত্রা, তা এখন চূড়ান্তের পথে। ১৯৩৬ থেকে ২০১৩_ জীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শুধু কবিতার ঘোরে আচ্ছন্ন ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য একুশে এবং বাংলা একাডেমী পদক লাভ করলেও কারাবরণ করেছেন একটি গদ্য রচনার জন্য, যা তার জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি কবিতার এই নক্ষত্রপুরুষ পা রাখছেন ৭৭-এ। জন্মদিনে কবিকে এক আকাশ শুভেচ্ছা।
শাহীন রেজা : কবি ও সাহিত্য সংগঠক
No comments