হাওর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ চাই
বাংলাদেশে
উৎপাদিত মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। মিঠাপানির মাছের একটা
বড় অংশও আমরা পেয়ে থাকি উত্তর-পূর্বাংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চার শতাধিক হাওর
থেকেই। ভাটির এ অঞ্চল লোকসাহিত্যেও সমৃদ্ধ।
হাওরের প্রাণী, হাওরের উদ্ভিদ
বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ; প্রতিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বস্তুত বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশে হাওরাঞ্চলের অবদান নিয়ে
নতুন কিছু বলার নেই। কিন্তু হাওরবাসীর প্রাপ্তি?
হাওরবাসীর একটি বড় অংশ
বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। ইজারাদার ও জোতদারের দাপটে হাওরের ধান-মাছ
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে অধরাই থেকে যায়। তারা উদয়াস্ত খেটেই চলে, ফসল ওঠে
ওয়াটার লর্ডদের ঘরে। শুকনো মৌসুমে যদিও হাওরের বুকে চলাফেরার অধিকার থাকে,
ভাসান পানির সময় সেটাও হারায় খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী। আছে দাদনের ফাঁস_ সেখান
থেকে সারাজীবনেও নিষ্কৃতি মেলে না অনেকের। উলেল্গখযোগ্য কিছু শর্ত উপস্থিত
থাকা সত্ত্বেও হাওরে শিল্পায়ন হয়নি। খনিজ সম্পদের সম্ভাবনাও রয়ে গেছে
অনুদ্ঘাটিত। ফসলের ক্ষেতে কাজ আর মাছ ধরা ছাড়া হাওরবাসীর বিকল্প কোনো
জীবিকা গড়ে ওঠেনি। পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা অবহেলিত থেকেছে। শিক্ষা,
চিকিৎসা, যোগাযোগ, অবকাঠামো, সুশাসন_ সব দিক থেকে পিছিয়ে হাওরবাসী।
এত
নেতিবাচক চিত্রের ভিড়ে আমরা আশান্বিত যে, গত বছর সরকার 'জাতীয় হাওর উন্নয়ন
মহাপরিকল্পনা' প্রণয়ন ও অনুমোদন করেছে। এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই আমরা।
হাওরের উন্নয়ন নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন যেসব দাবি জানিয়ে এসেছি, তার
উল্লেখযোগ্য অংশ এই মহাপরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে।
অনেকের মনে আছে, হাওর
বিষয়ে কর্মরত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত করতে এবং হাওরের
বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণে ২০০৮ সালের ৬ ও ৭
মার্চ ঢাকায় আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম জাতীয় হাওর সম্মেলন। হাওরাঞ্চলের
বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ওই সম্মেলনে
যোগ দিয়েছিলেন নীতিনির্ধারকরা। সম্মেলন শেষে প্রকাশিত হয়েছিল 'হাওর
ঘোষণা'। পরবর্তী পর্যায়ে বেসরকারি সংগঠনগুলোর মধ্যকার ঐক্য আরও সংহত এবং
কাজের অভিজ্ঞতায় ভবিষ্যতে হাওর বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে গঠিত হয়
হাওর অ্যাডভোকেসি পল্গাটফর্ম। যার ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে
অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় হাওর সম্মেলন। এই সম্মেলনের অঙ্গীকার ও লক্ষ্য
বাস্তবায়নে নবউদ্যমে পথচলা শুরু করেছে হাওর অ্যাডভোকেসি পল্গাটফর্ম।
নতুন
এই মঞ্চের পক্ষ থেকে আমরা দেখতে চাইব যাতে হাওর মহাপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে
বাস্তবায়ন হয়। সেই লক্ষ্যেই এ বছর বিশ্ব জলাভূমি দিবসে, ২ ফেব্রুয়ারি আমরা
একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করি এবং আসন্ন বাজেটেই মহাপরিকল্পনাটি
বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ রাখার দাবি জানাই। এই বরাদ্দ জরুরি; কারণ
হাওরবাসীর দুর্দশা আরও একটি বছরের জন্য বাড়ানো যায় না।
পেছনে ফিরে যদি
দেখি, ২০০১-২০১০ এই দশ বছরে পাঁচবার হাওরের মানুষ ফসল ঘরে তুলতে পারেনি,
যার প্রভাব পড়েছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায়। ডিসেম্বরে শুরু করে ফেব্রুয়ারির
মধ্যে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য উপযুক্ত সময়। কিন্তু এখনও সেখানে
বাঁধের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়নি। হাওরাঞ্চলের নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জরুরি
ভিত্তিতে নদী খনন ও পুনর্খনন করতে জাতীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দরকার।
হাওরাঞ্চলের ফসল সংরক্ষণে শস্য সংরক্ষণাগার নির্মাণে বাজেটে অর্থ বরাদ্দে
এখনই উদ্যোগী হতে হবে।
হাওর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাতে আসন্ন বাজেটেই
অর্থ বরাদ্দ সম্ভব হয়, সে জন্য আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দাবি তুলে ধরতে
চাই। প্রথমত, হাওরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হাওরে ভাসমান
ক্লিনিক গড়ে তুলতে জাতীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, হাওরের
উৎপাদিত বোরো ধানের আগাম মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি তার
বাজেট বক্তব্যেই ঘোষণা দিতে পারেন। এতে করে হাওরের পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর
কৃষক সমাজের দীর্ঘদিনে একটি দাবিও পূরণ হবে। হাওরের নদীভিত্তিক যোগাযোগ
ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। ধনুসহ অন্যান্য নদী খননে জাতীয় বাজেটে
অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। খাসজমিতে হাওরের দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে
হবে। হাওরের পানি নিষ্কাশনের খাল খনন ও পুনর্খনন
করতে হবে।
লেখকবৃন্দ হাওর অ্যাডভোকেসি
প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত
No comments