ভুলে যাওয়া জহির রায়হান- আত্মপক্ষ by এবনে গোলাম সামাদ
জহির রায়হানের সাথে ১৯৭১ সালের আগে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। তবে আমি তার
নামকরা ছায়াছবি জীবন থেকে নেয়া দেখেছিলাম রাজশাহী শহরের কোনো
প্রেক্ষাগৃহে।
ছবিটা
আমার মোটামুটি ভালো লেগেছিল। তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালে
কলকাতায় ১৩/১, পাম এভিনিউতে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে। মৈত্রেয়ী দেবীকেও
আমি আগে চিনতাম না। তবে তার নাম শুনেছিলাম। তিনি একাধারে ছিলেন সাহিত্যিক,
অন্য দিকে ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে তিনি ছিলেন
রবীন্দ্রনাথের মতো আদি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। মৈত্রেয়ী দেবীর যখন বয়স অল্প,
তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার
সম্বন্ধ নিয়ে একসময় পত্রপত্রিকায় হয়েছিল কিছু আলোচনা। আমি রাজশাহীর
কোনো লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকা পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম সেসব কথা। মৈত্রেয়ী
দেবীর একটি বই আছে, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। আমি তার সেই গ্রন্থটির সঙ্গে
পরিচিত ছিলাম। মৈত্রেয়ী দেবী মনে করতেন, দেশ কেবল মাটি নয়, দেশ একটি
‘আইডিয়া’ বা ‘ভাব’। মৈত্রেয়ী দেবী মনে করতেন ভারতের ঘোষিত নীতি হলো,
‘অসাম্প্রদায়িকতা’। এই অসাম্প্রদায়িকতার ভাবকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে।
না হলে ভারত থাকবে খণ্ডিত হয়ে। পূর্ণতা পেতে পারবে না। তিনি ভারতে
হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গড়েছিলেন ‘কাউন্সিল ফর প্রমশন অব
কম্যুনাল হারমনি’(সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ) নামে একটি সমিতি।
মৈত্রেয়ী দেবী মনে করতেন পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তার মূলে আছে, পূর্ব
পাকিস্তানের মানুষের মনে মুক্ত বুদ্ধির জাগরণ। এটা কেবলই একটি রাজনৈতিক
স্বার্থের সঙ্ঘাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নয়। পাকিস্তান-পরবর্তী পরিস্থিতিকে
উপলব্ধি করতে হলে সেখানকার মানুষের এই নবজাগরণের স্বরূপকে বিবেচনায় নিতে
হবে। জহির রায়হান মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে কার সূত্র ধরে গিয়েছিলেন, আমি
তা জানি না। তবে আমি গিয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের
সূত্র ধরে। তিনি আমাকে বলেন, মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বেশ
কিছুসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। সেখানে হয় নানা বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক
আলোচনা। আমি সেখানে গেলে ভালো লাগবে। পেতে পারব একটি ভিন্ন পরিবেশ।
রায়হান হঠাৎ আমাকে বলেন, কলকাতায় এসে খুব অসুবিধায় পড়েছেন। আমি তাকে
থাকার কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি না। আমার এক ভাই কলকাতায় ভারত
সরকারের অধীনে ভালো চাকরি করতেন। আমি আমার ভাইকে বলে অস্থায়ীভাবে জহির
রায়হানের একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম কয়েক সপ্তাহের জন্য।
এরপর রায়হান নিজের থাকার ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পেরেছিলেন। কলকাতা আমার
অপরিচিত শহর ছিল না। ছেলেবেলায় এই শহরে আমি অনেকবার এসেছি। রায়হানের
কাছেও কলকাতা অপরিচিত শহর ছিল না। তিনি কলকাতায় ১৯৪৭ সালের আগে স্কুলে
পড়েছেন। তবে ১৯৭১-এ হঠাৎ কলকাতায় গিয়ে পড়েছিলেন কিছুটা অসুবিধায়। আমি
ছিলাম আমার ভাইয়ের কাছে। তাই কলকাতায় কোনো অসুবিধায় আমাকে পড়তে হয়নি।
মার্চ মাসের পর আমি চলে যাই কলকাতায়। সেখানে ভালোই কেটেছিল আমার জীবন।
রায়হানের সাথে পরে আর আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। শুনেছিলাম তিনি ব্যস্ত
আছেন অনেক ছবি নির্মাণের কাজে।
১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। এই সরকার গঠিত হয়েছিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা নামক একটি জায়গায়। যাকে এখন বলা হয় মুজিবনগর। কিন্তু এখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাজ চলত কলকাতা শহরে। তবে বলা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী হলো মুজিবনগর। ১৯৭১-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তার ৬৪ জন কর্মচারীসহ পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে যোগ দেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে, যা ছিল কলকাতায় পাকিস্তান সরকারের ডেপুটি হাইকমিশনারের কার্যালয়, তা হয়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক যোগাযোগের মূল কেন্দ্র। ভারত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর। এ সময় কলকাতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ কেন্দ্রে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। সেখানে আমরা অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। জহির রায়হানও উপস্থিত ছিলেন। তাকে হঠাৎ বলতে শুনলাম, ‘পাকিস্তান হওয়ার সময় ভেবেছিলাম দেশ স্বাধীন হলো। এখন ভাবছি বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। জানি না, ভবিষ্যতে আবার কোনো স্বাধীনতার কথা শুনতে পাবো কি না।’ তার এই উক্তি আমার কাছে বেশ হেঁয়ালি বলে মনে হয়েছিল। জহির রায়হান কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। আর তিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন। ১২ জানুয়ারি তিনি গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। অর্থাৎ জাহির রায়হান যখন নিখোঁজ হন, তখন শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার নিয়ন্ত্রণে চলেছে সারা দেশ। বলা হয় জহির রায়হান দেশে এসে জানতে পারেন, তার বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে বিহারিরা ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে মিরপুরে। তিনি মিরপুরে ভাইকে খোঁজ করতে গিয়ে নিহত হন বিহারিদের হাতে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, মিরপুরে বিহারিরা কি তখন জহির রায়হানের মতো কাউকে হত্যা করার সামর্থ্য রাখত? আর জহির রায়হান কেনই বা বিশ্বাস করতে যাবেন যে, বিহারিরা তার ভাইকে ধরে মিরপুরে আটকে রেখেছে? তিনি তো শেখ মুজিবের কাছে গিয়ে বলতে পারতেন তার ভাইকে খুঁজে দেয়ার জন্য। তিনি শেখ মুজিবের কাছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন না। তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না। তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার তার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে করলেন না কোনো উদ্বেগ প্রকাশ। সবটাই কেমন অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। ক’দিন আগে জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দার একটি লেখা পড়লাম। পড়লাম দৈনিক পত্রিকায়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন; ৩০ জানুয়ারি ২০১৩) তিনি বলেনÑ ‘১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। এসেই তিনি জানতে পারেন তারই অগ্রজ কথাশিল্পী শহিদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। ভাইকে খুঁজতে বের হন। … শহিদুল্লাহ কায়সারকে ঢাকার প্রায় সব জায়গায় খুঁজে ব্যর্থ হন জহির রায়হান। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওই দিন জহির রায়হানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল বেলায় তিনি বাসার নিচের তলায় বসে ছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন লোক আসে। তাকে বলা হয়, শহিদুল্লাহ কায়সারসহ নিখোঁজ অনেককে মিরপুরে পাওয়া গেছে। … ভারতীয় আর্মিরা যাবে সেখানে।… নিচে কয়েকজন আর্মি অফিসার ও তার চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির অপেক্ষা করছিলেন।…’ অর্থাৎ জহির রায়হানকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাইরে। তারপর আর তিনি ফিরে আসেননি নিজ গৃহে। তাকে মিরপুরে বিহারিরা মেরে ফেলেছেÑ এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থক বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় এখন লেখা হচ্ছে, রায়হানকে হত্যা করেছিল বিহারিরা। বিহারিদের ব্যাপারে যেন নতুন করে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা-বিদ্বেষ। হতে পারে এটা আর একটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ। জহির রায়হান শুনেছি রাজনীতিতে ছিলেন চীনপন্থী। তার ভাই শহিদুল্লাহ কায়সার নাকি ছিলেন সোভিয়েতপন্থী। কিন্তু রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও দুই ভাইয়ের মাঝে ছিল গভীর সম্প্রীতি। তাই তিনি চেয়েছিলেন, তার ভাইকে খুঁজে পেতে। তাকে কারা কী কারণে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে, তা বলা যায় না। তবে অনেকে অনুমান করেন, এর পেছনে ছিল সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের চক্রান্ত। বর্তমান বাংলাদেশের সরকার পরিচালিত হচ্ছে সাবেক মস্কোপন্থীদের দ্বারা। তারা এখন প্রচার করছে জহির রায়হানকে মেরে ফেলেছে মিরপুরের বিহারিরা। কিন্তু মিরপুরের বিহারিদের কোনো বিরোধ ছিল না জহির রায়হানের সাথে। মিরপুরের বিহারিদের তখন এমন কোনো শক্তিও ছিল না যে তারা জহির রায়হানের মতো একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্র করে মিরপুরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারে। সব কিছুকেই মনে হচ্ছে একটা বড় রকমের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার অংশ হিসেবে। দেশের বর্তমান রাজনীতি এসে পড়েছে একটা বড় রকমের জটিলতারই মধ্যে। আর বর্তমান সরকার বিহারিদের বিরুদ্ধে প্রচার করে যেন কিছুটা পার পেতে চাচ্ছে এই সঙ্কট থেকে। ১৯৭১-এ আওয়ামী লীগ ছড়িয়েছিল ভয়াবহ বিহারিবিদ্বেষ। যার ফলে এ দেশে বহু বিহারি নর-নারী ও শিশুর মৃত্যু ঘটেছিল। যাকে চিহ্নিত করা চলে ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে। আবার নতুন করে বিহারিবিদ্বেষ ছড়িয়ে, তাকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ যেন চাচ্ছে এ দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নিতে। তাই আওয়ামী লীগের সমর্থক পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে জহির রায়হানকে নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলো; আর জুড়ে দেয়া হলো রায়হানকে মিরপুরের বিহারিরা হত্যা করেছে ষড়যন্ত্র করে। জহির রায়হান নিখোঁজ হন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। তাই তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছিল কি না সে সম্বন্ধেও আছে প্রশ্ন।
১৯৭২ সালে বিশ্বরাজনীতিতে চলেছিল ঠাণ্ডা লড়াই। ঠাণ্ডা লড়াই চলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ এখন আর নেই। কিন্তু বাংলাদেশে রাশিয়া যেন বিস্তার করতে চাচ্ছে তার প্রভাব প্রতিপত্তি। আর এ দেশের সাবেক সোভিয়েতপন্থীরা চাচ্ছেন রাশিয়ার সামরিক শক্তির সহায়তায় এ দেশের ক্ষমতায় স্থায়িত্ব পেতে। মস্কোপন্থীরা ছিলেন রায়হানের প্রতি বিশেষভাবেই বিদ্বিষ্ট। রায়হানের তিরধান নিয়ে তারা করতে চাচ্ছেন এখন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন রাজনীতি, যা বাংলাদেশকে একটা বড় রকমের সঙ্ঘাতের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ১৯৭১ সালে আমি কলকাতা থেকে এক সপ্তাহের জন্য বিহারের রাজধানী পাটনায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) আওয়ামী লীগের বিহারি নিধন সম্পর্কে। পাটনায় একটি হিন্দু বাঙালি পরিবারের একজন ব্যক্তি আমাকে বলেন, বাংলাদেশে বিহারি নিধন ঠিক হচ্ছে না। এর ফলে বিহারে বসবাসরত হিন্দু বাঙালিরাও পড়তে পারেন বিপদে। তাদের ওপরও বিহারিরা করতে পারে হামলা। তাই আমার মনে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে আবার যদি বিহারিদের ওপর কোনো হামলা হয়, তবে ভারতের বিহারে দেখা দিতে পারে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিহারে বসবাসরত বাঙালিরা পড়তে পারেন বিপদের মধ্যে। যেটাকে বিবেচনায় নিয়ে করা উচিত আমাদের রাজনীতি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। এই সরকার গঠিত হয়েছিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা নামক একটি জায়গায়। যাকে এখন বলা হয় মুজিবনগর। কিন্তু এখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাজ চলত কলকাতা শহরে। তবে বলা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী হলো মুজিবনগর। ১৯৭১-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তার ৬৪ জন কর্মচারীসহ পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে যোগ দেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে, যা ছিল কলকাতায় পাকিস্তান সরকারের ডেপুটি হাইকমিশনারের কার্যালয়, তা হয়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক যোগাযোগের মূল কেন্দ্র। ভারত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর। এ সময় কলকাতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ কেন্দ্রে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। সেখানে আমরা অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। জহির রায়হানও উপস্থিত ছিলেন। তাকে হঠাৎ বলতে শুনলাম, ‘পাকিস্তান হওয়ার সময় ভেবেছিলাম দেশ স্বাধীন হলো। এখন ভাবছি বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। জানি না, ভবিষ্যতে আবার কোনো স্বাধীনতার কথা শুনতে পাবো কি না।’ তার এই উক্তি আমার কাছে বেশ হেঁয়ালি বলে মনে হয়েছিল। জহির রায়হান কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। আর তিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন। ১২ জানুয়ারি তিনি গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। অর্থাৎ জাহির রায়হান যখন নিখোঁজ হন, তখন শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তার নিয়ন্ত্রণে চলেছে সারা দেশ। বলা হয় জহির রায়হান দেশে এসে জানতে পারেন, তার বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে বিহারিরা ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে মিরপুরে। তিনি মিরপুরে ভাইকে খোঁজ করতে গিয়ে নিহত হন বিহারিদের হাতে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, মিরপুরে বিহারিরা কি তখন জহির রায়হানের মতো কাউকে হত্যা করার সামর্থ্য রাখত? আর জহির রায়হান কেনই বা বিশ্বাস করতে যাবেন যে, বিহারিরা তার ভাইকে ধরে মিরপুরে আটকে রেখেছে? তিনি তো শেখ মুজিবের কাছে গিয়ে বলতে পারতেন তার ভাইকে খুঁজে দেয়ার জন্য। তিনি শেখ মুজিবের কাছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন না। তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না। তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার তার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে করলেন না কোনো উদ্বেগ প্রকাশ। সবটাই কেমন অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। ক’দিন আগে জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দার একটি লেখা পড়লাম। পড়লাম দৈনিক পত্রিকায়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন; ৩০ জানুয়ারি ২০১৩) তিনি বলেনÑ ‘১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। এসেই তিনি জানতে পারেন তারই অগ্রজ কথাশিল্পী শহিদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। ভাইকে খুঁজতে বের হন। … শহিদুল্লাহ কায়সারকে ঢাকার প্রায় সব জায়গায় খুঁজে ব্যর্থ হন জহির রায়হান। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওই দিন জহির রায়হানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল বেলায় তিনি বাসার নিচের তলায় বসে ছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন লোক আসে। তাকে বলা হয়, শহিদুল্লাহ কায়সারসহ নিখোঁজ অনেককে মিরপুরে পাওয়া গেছে। … ভারতীয় আর্মিরা যাবে সেখানে।… নিচে কয়েকজন আর্মি অফিসার ও তার চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির অপেক্ষা করছিলেন।…’ অর্থাৎ জহির রায়হানকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাইরে। তারপর আর তিনি ফিরে আসেননি নিজ গৃহে। তাকে মিরপুরে বিহারিরা মেরে ফেলেছেÑ এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থক বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় এখন লেখা হচ্ছে, রায়হানকে হত্যা করেছিল বিহারিরা। বিহারিদের ব্যাপারে যেন নতুন করে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা-বিদ্বেষ। হতে পারে এটা আর একটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ। জহির রায়হান শুনেছি রাজনীতিতে ছিলেন চীনপন্থী। তার ভাই শহিদুল্লাহ কায়সার নাকি ছিলেন সোভিয়েতপন্থী। কিন্তু রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও দুই ভাইয়ের মাঝে ছিল গভীর সম্প্রীতি। তাই তিনি চেয়েছিলেন, তার ভাইকে খুঁজে পেতে। তাকে কারা কী কারণে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে, তা বলা যায় না। তবে অনেকে অনুমান করেন, এর পেছনে ছিল সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের চক্রান্ত। বর্তমান বাংলাদেশের সরকার পরিচালিত হচ্ছে সাবেক মস্কোপন্থীদের দ্বারা। তারা এখন প্রচার করছে জহির রায়হানকে মেরে ফেলেছে মিরপুরের বিহারিরা। কিন্তু মিরপুরের বিহারিদের কোনো বিরোধ ছিল না জহির রায়হানের সাথে। মিরপুরের বিহারিদের তখন এমন কোনো শক্তিও ছিল না যে তারা জহির রায়হানের মতো একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্র করে মিরপুরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারে। সব কিছুকেই মনে হচ্ছে একটা বড় রকমের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার অংশ হিসেবে। দেশের বর্তমান রাজনীতি এসে পড়েছে একটা বড় রকমের জটিলতারই মধ্যে। আর বর্তমান সরকার বিহারিদের বিরুদ্ধে প্রচার করে যেন কিছুটা পার পেতে চাচ্ছে এই সঙ্কট থেকে। ১৯৭১-এ আওয়ামী লীগ ছড়িয়েছিল ভয়াবহ বিহারিবিদ্বেষ। যার ফলে এ দেশে বহু বিহারি নর-নারী ও শিশুর মৃত্যু ঘটেছিল। যাকে চিহ্নিত করা চলে ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে। আবার নতুন করে বিহারিবিদ্বেষ ছড়িয়ে, তাকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ যেন চাচ্ছে এ দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নিতে। তাই আওয়ামী লীগের সমর্থক পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে জহির রায়হানকে নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলো; আর জুড়ে দেয়া হলো রায়হানকে মিরপুরের বিহারিরা হত্যা করেছে ষড়যন্ত্র করে। জহির রায়হান নিখোঁজ হন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। তাই তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছিল কি না সে সম্বন্ধেও আছে প্রশ্ন।
১৯৭২ সালে বিশ্বরাজনীতিতে চলেছিল ঠাণ্ডা লড়াই। ঠাণ্ডা লড়াই চলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ এখন আর নেই। কিন্তু বাংলাদেশে রাশিয়া যেন বিস্তার করতে চাচ্ছে তার প্রভাব প্রতিপত্তি। আর এ দেশের সাবেক সোভিয়েতপন্থীরা চাচ্ছেন রাশিয়ার সামরিক শক্তির সহায়তায় এ দেশের ক্ষমতায় স্থায়িত্ব পেতে। মস্কোপন্থীরা ছিলেন রায়হানের প্রতি বিশেষভাবেই বিদ্বিষ্ট। রায়হানের তিরধান নিয়ে তারা করতে চাচ্ছেন এখন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন রাজনীতি, যা বাংলাদেশকে একটা বড় রকমের সঙ্ঘাতের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ১৯৭১ সালে আমি কলকাতা থেকে এক সপ্তাহের জন্য বিহারের রাজধানী পাটনায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) আওয়ামী লীগের বিহারি নিধন সম্পর্কে। পাটনায় একটি হিন্দু বাঙালি পরিবারের একজন ব্যক্তি আমাকে বলেন, বাংলাদেশে বিহারি নিধন ঠিক হচ্ছে না। এর ফলে বিহারে বসবাসরত হিন্দু বাঙালিরাও পড়তে পারেন বিপদে। তাদের ওপরও বিহারিরা করতে পারে হামলা। তাই আমার মনে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে আবার যদি বিহারিদের ওপর কোনো হামলা হয়, তবে ভারতের বিহারে দেখা দিতে পারে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিহারে বসবাসরত বাঙালিরা পড়তে পারেন বিপদের মধ্যে। যেটাকে বিবেচনায় নিয়ে করা উচিত আমাদের রাজনীতি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments