রাষ্ট্র ও সেকুলারিজম by মুসা মোহাম্মদ
সেকুলারিজম কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, যদিও এখনকার একদল রাজনীতিবিদ
রাজনীতিতে টেনে এনে এটাকে আদর্শ বা দর্শন হিসাবে তুলে ধরতে চাচ্ছেন।
কোনো জাতির সংবিধানে যতই পাকাপোক্তভাবে সেকুলারিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকুক না কেন, সে দেশ বা জাতি সেকুলার নয়।
এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া এবং এখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নয়। কারণ সমাজতন্ত্রীরা কেবল সমাজতন্ত্র ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ গ্রহণ করতে রাজি নয়। এসব দেশে সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের কবলে পড়ে অসংখ্য মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা ও মন্দির গোয়াল ঘর, অস্ত্রাগার ও পানশালায় পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বর্তমান একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও সেকুলার নয়। সে দেশের প্রেসিডেন্টকে শপথ অনুষ্ঠানকালে পবিত্র বাইবেল হাতে নিয়ে শপথ করতে হয়। একইভাবে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই প্রটেস্ট্যান্টপন্থী খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হতে হয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্র। কিন্তু সে দেশের বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই হিন্দুধর্মের প্রতি পক্ষপাতপুষ্ট এক চিত্র। দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারত সরকার কোটি কোটি রুপি ব্যয় করে। ভারতের হাজার হাজার হিন্দু আশ্রম সরকারের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। কিন্তু সে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ উপলক্ষে ভারত সরকার কোন অর্থ ব্যয় করে না। পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতের মতো একতরফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দৃষ্টান্ত বিরল। দুটি রাজ্য ছাড়া ভারতের আর কোথাও মুসলমানদের গরু কোরবানি করতে দেয়া হয় না।
এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম পালনে কখনো বাধার সম্মুখীন হন না। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। ইসলাম ধর্মে মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু ও বৌদ্ধদের দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করতে ও তা নিয়ে শোভাযাত্রা করতে কখনো এসব দেশে বাধা দেয়া হয় না। শূকর প্রতিপালন ও খাওয়া এবং মদপানে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বাধা দেয়া হয় না।
অতএব ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সেকুলারিজম গ্রহণের মোটেই প্রয়োজন নেই। কারণ সরাসরি কুরআন মজিদেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মবিশ্বাস বজায় রাখার এবং উপাসনা, আরাধনা করার ব্যাপক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। যেখানে আমার ধর্মই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে অবাধ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সেখানে ধর্মের প্রতি অনীহা ও উদাসীনতা সৃষ্টিকারী সেকুলারিজমের মতো একটি মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করার মোটেই প্রয়োজন নেই।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ‘ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ জাতিকে সামনে এগিয়ে নেবে’ বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি জরিপ করিয়ে দেখেছেন কি যে, দেশের কতজন মুসলমান সেকুলারিজমে বিশ্বাস করে? তাছাড়া আমাদের ধর্মীয় নেতারা তো কখনো তাদের ওয়াজ মাহফিলে, জুমার খুৎবায় অন্য ধর্মের প্রতি উসকানিমূলক কথা বলেন না। তাছাড়া যারা এ দেশে ইসলামি আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করেন তারাও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলেন না। এটা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরাট উদাহরণ।
প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্য করেছেন যে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুনর্জাগরণ সূচিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ যারা ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, তাদের ৮০ ভাগই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দেশের (তুরস্কের) জনগোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ত্যাগ করেছেন। মিসর ও তিউনিশিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। মরক্কোতে অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামি সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বাদশাহর পৃষ্ঠাপোষকতায়। মালয়েশিয়া শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামি আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সৌদি আরবে আগে থেকেই ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক আইনকানুন পরিচালিত হচ্ছে। লিবিয়াতেও পরিবর্তন এসেছে। মুসলমানদের সব দেশেই শোনা যাচ্ছে ইসলামি জীবনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পদধ্বনি।
এই অবস্থায় বাংলাদেশেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ দেশের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকতে চাইলে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের নাস্তিক্যবাদী সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম পালনে অনীহা সৃষ্টিকারী সেকুলারিজম অবশ্যই বর্জন করতে হবে। পৃথিবী এই দুটি মতবাদ বর্জন করছে। ওই সব মতবাদে মুসলমানদের কোনো মুক্তি নেই, বরং তাতে তাদের ঈমান হারা হওয়ারই প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
সমাজতন্ত্র কোনো নৈতিক দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি করে না, বরং একদল নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্বৈরাচারী শাসক তৈরি করে। রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দিয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে শাসনকার্য পরিচালনা করে সে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে।
কামাল পাশার মুসলিম তুরস্কে সেকুলারিজম : কামাল পাশা তুরস্কে ক্ষমতাসীন হয়েই দেশের সংবিধানে সেকুলারিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে দেশে সর্বস্তর থেকে ইসলামের নামনিশানা মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করেন এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষা বাদ দেন। আইন পাস করে মুসলমানদের দাড়ি রাখা, ফেজ টুপি পরা, নারীদের ইসলামসম্মত শালীন পোশাক পরা এবং ১৪ বছর বয়সের আগে কুরআন পাঠ শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ করেন।
কামাল পাশা পাশ্চাত্যের পোশাক এবং মাথায় হ্যাট পরাও বাধ্যতামূলক করেন। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে মসজিদ নির্মাণও নিষিদ্ধ করেন। লেখায় ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামি শরিয়তের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরাও নিষিদ্ধ করা হয়। এ কারণে তুরস্কে হাজারে একজন মুসলমানও দাড়িওয়ালা দেখা যায় না। বর্তমান ইসলামি আদর্শমুখী সরকারের জন্য সেকুলারিজম এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেকুলারিজম হলো রাষ্ট্র, নীতি, শিক্ষা ইত্যাদিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদ। যিনি সেকুলারিজমে বিশ্বাস করেন তিনি রাষ্ট্র, নীতি, শিক্ষা ইত্যাদিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি। সেকুলারিস্টদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এই মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এর কিছু প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এতে মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর পাঠ্যক্রম থেকে আরবি-ইসলামি বিষয়ক ৩০০ নম্বর কমিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে পার্থিব ৩০০ নম্বরের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের লক্ষ্য যে ধর্মহীনতাÑ এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ ড. ইসমাঈল রাযী আল ফারুকী (ভূতপূর্ব প্রফেসর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, ‘স্পষ্টতই ইসলামি সমাজব্যবস্থা হচ্ছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সমাজের সব কর্মকাণ্ডকে ধর্মের সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে রাখতে চায়। অধিকতর সাম্প্রতিককালের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলছে, ধর্ম থেকে উদ্ভূত মূল্যগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ-নির্ধারণের বিরোধিতা তার লক্ষ্য। কেননা উৎস হিসেবে ধর্মকে পাশ্চাত্য জগত বিশ্বাসের অযোগ্য বলে গণ্য করে’ (আত-তাওহীদ, বাংলা অনু. পৃ-৮৬)।
ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ জনসমক্ষে তুলে ধরতে লোকসভায় দাঁড়িয়ে ১৯৬৬ সালে বলেছিলেন : Secularism is a sneer and a delusion, it is a fraud and a deception. Secularism! thy name is hypocrisy, thy name is treachery, thy name is corruption, thy name is nepotism and favouritism, thy name is dirt, filth and abomination, thy name is wan top encroachment upon the fundamental rights of the citizens, exploitation of weaker people, using them as pawns on the political chessboard by the powers that be in the land for aggrandizement, thy name is exploitation of the minorities, particularly of the religious Muslims minority, the spoliation and ruination of the Muslim minority, all in the name of the security of the state, all in the name of the sovereignty of the state.
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিম উম্মাহর জন্য ঈমান ও আমল বিধ্বংসী একটি মতবাদ। সমগ্র পৃথিবীর একজন ইসলামি পণ্ডিতও আজ পর্যন্ত ফতোয়া দেননি যে, মুসলমানদের এই মতবাদ গ্রহণ করা জায়েজ। এমনকি বাংলাদেশের একজন বিদগ্ধ ও প্রথিতযশা আলেমও এই মতবাদের অনুকূলে অভিমত ব্যক্ত করেননি, বরং এর বিরুদ্ধেই অভিমত দিয়েছেন। অতএব সেকুলারিজম ঈমানদার মুসলমানেরা কখনো গ্রহণ করতে পারে না।
লেখক : গবেষক
এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া এবং এখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নয়। কারণ সমাজতন্ত্রীরা কেবল সমাজতন্ত্র ব্যতীত অন্য কোনো মতবাদ গ্রহণ করতে রাজি নয়। এসব দেশে সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের কবলে পড়ে অসংখ্য মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা ও মন্দির গোয়াল ঘর, অস্ত্রাগার ও পানশালায় পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বর্তমান একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও সেকুলার নয়। সে দেশের প্রেসিডেন্টকে শপথ অনুষ্ঠানকালে পবিত্র বাইবেল হাতে নিয়ে শপথ করতে হয়। একইভাবে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই প্রটেস্ট্যান্টপন্থী খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হতে হয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত সাংবিধানিকভাবে সেকুলার রাষ্ট্র। কিন্তু সে দেশের বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই হিন্দুধর্মের প্রতি পক্ষপাতপুষ্ট এক চিত্র। দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারত সরকার কোটি কোটি রুপি ব্যয় করে। ভারতের হাজার হাজার হিন্দু আশ্রম সরকারের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। কিন্তু সে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ উপলক্ষে ভারত সরকার কোন অর্থ ব্যয় করে না। পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতের মতো একতরফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দৃষ্টান্ত বিরল। দুটি রাজ্য ছাড়া ভারতের আর কোথাও মুসলমানদের গরু কোরবানি করতে দেয়া হয় না।
এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম পালনে কখনো বাধার সম্মুখীন হন না। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। ইসলাম ধর্মে মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু ও বৌদ্ধদের দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করতে ও তা নিয়ে শোভাযাত্রা করতে কখনো এসব দেশে বাধা দেয়া হয় না। শূকর প্রতিপালন ও খাওয়া এবং মদপানে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বাধা দেয়া হয় না।
অতএব ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সেকুলারিজম গ্রহণের মোটেই প্রয়োজন নেই। কারণ সরাসরি কুরআন মজিদেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মবিশ্বাস বজায় রাখার এবং উপাসনা, আরাধনা করার ব্যাপক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। যেখানে আমার ধর্মই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে অবাধ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সেখানে ধর্মের প্রতি অনীহা ও উদাসীনতা সৃষ্টিকারী সেকুলারিজমের মতো একটি মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করার মোটেই প্রয়োজন নেই।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ‘ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ জাতিকে সামনে এগিয়ে নেবে’ বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি জরিপ করিয়ে দেখেছেন কি যে, দেশের কতজন মুসলমান সেকুলারিজমে বিশ্বাস করে? তাছাড়া আমাদের ধর্মীয় নেতারা তো কখনো তাদের ওয়াজ মাহফিলে, জুমার খুৎবায় অন্য ধর্মের প্রতি উসকানিমূলক কথা বলেন না। তাছাড়া যারা এ দেশে ইসলামি আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করেন তারাও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলেন না। এটা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক বিরাট উদাহরণ।
প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্য করেছেন যে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুনর্জাগরণ সূচিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ যারা ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, তাদের ৮০ ভাগই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দেশের (তুরস্কের) জনগোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ত্যাগ করেছেন। মিসর ও তিউনিশিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। মরক্কোতে অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামি সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বাদশাহর পৃষ্ঠাপোষকতায়। মালয়েশিয়া শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামি আদর্শের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সৌদি আরবে আগে থেকেই ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক আইনকানুন পরিচালিত হচ্ছে। লিবিয়াতেও পরিবর্তন এসেছে। মুসলমানদের সব দেশেই শোনা যাচ্ছে ইসলামি জীবনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পদধ্বনি।
এই অবস্থায় বাংলাদেশেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ দেশের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকতে চাইলে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের নাস্তিক্যবাদী সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম পালনে অনীহা সৃষ্টিকারী সেকুলারিজম অবশ্যই বর্জন করতে হবে। পৃথিবী এই দুটি মতবাদ বর্জন করছে। ওই সব মতবাদে মুসলমানদের কোনো মুক্তি নেই, বরং তাতে তাদের ঈমান হারা হওয়ারই প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
সমাজতন্ত্র কোনো নৈতিক দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি করে না, বরং একদল নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্বৈরাচারী শাসক তৈরি করে। রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দিয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে শাসনকার্য পরিচালনা করে সে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে।
কামাল পাশার মুসলিম তুরস্কে সেকুলারিজম : কামাল পাশা তুরস্কে ক্ষমতাসীন হয়েই দেশের সংবিধানে সেকুলারিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে দেশে সর্বস্তর থেকে ইসলামের নামনিশানা মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করেন এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষা বাদ দেন। আইন পাস করে মুসলমানদের দাড়ি রাখা, ফেজ টুপি পরা, নারীদের ইসলামসম্মত শালীন পোশাক পরা এবং ১৪ বছর বয়সের আগে কুরআন পাঠ শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ করেন।
কামাল পাশা পাশ্চাত্যের পোশাক এবং মাথায় হ্যাট পরাও বাধ্যতামূলক করেন। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে মসজিদ নির্মাণও নিষিদ্ধ করেন। লেখায় ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামি শরিয়তের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরাও নিষিদ্ধ করা হয়। এ কারণে তুরস্কে হাজারে একজন মুসলমানও দাড়িওয়ালা দেখা যায় না। বর্তমান ইসলামি আদর্শমুখী সরকারের জন্য সেকুলারিজম এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেকুলারিজম হলো রাষ্ট্র, নীতি, শিক্ষা ইত্যাদিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদ। যিনি সেকুলারিজমে বিশ্বাস করেন তিনি রাষ্ট্র, নীতি, শিক্ষা ইত্যাদিকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি। সেকুলারিস্টদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এই মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এর কিছু প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এতে মাদরাসা শিক্ষার উচ্চতর পাঠ্যক্রম থেকে আরবি-ইসলামি বিষয়ক ৩০০ নম্বর কমিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে পার্থিব ৩০০ নম্বরের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের লক্ষ্য যে ধর্মহীনতাÑ এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ ড. ইসমাঈল রাযী আল ফারুকী (ভূতপূর্ব প্রফেসর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, ‘স্পষ্টতই ইসলামি সমাজব্যবস্থা হচ্ছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সমাজের সব কর্মকাণ্ডকে ধর্মের সম্ভাব্য নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে রাখতে চায়। অধিকতর সাম্প্রতিককালের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলছে, ধর্ম থেকে উদ্ভূত মূল্যগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ-নির্ধারণের বিরোধিতা তার লক্ষ্য। কেননা উৎস হিসেবে ধর্মকে পাশ্চাত্য জগত বিশ্বাসের অযোগ্য বলে গণ্য করে’ (আত-তাওহীদ, বাংলা অনু. পৃ-৮৬)।
ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা সৈয়দ বদরুদ্দোজা ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ জনসমক্ষে তুলে ধরতে লোকসভায় দাঁড়িয়ে ১৯৬৬ সালে বলেছিলেন : Secularism is a sneer and a delusion, it is a fraud and a deception. Secularism! thy name is hypocrisy, thy name is treachery, thy name is corruption, thy name is nepotism and favouritism, thy name is dirt, filth and abomination, thy name is wan top encroachment upon the fundamental rights of the citizens, exploitation of weaker people, using them as pawns on the political chessboard by the powers that be in the land for aggrandizement, thy name is exploitation of the minorities, particularly of the religious Muslims minority, the spoliation and ruination of the Muslim minority, all in the name of the security of the state, all in the name of the sovereignty of the state.
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিম উম্মাহর জন্য ঈমান ও আমল বিধ্বংসী একটি মতবাদ। সমগ্র পৃথিবীর একজন ইসলামি পণ্ডিতও আজ পর্যন্ত ফতোয়া দেননি যে, মুসলমানদের এই মতবাদ গ্রহণ করা জায়েজ। এমনকি বাংলাদেশের একজন বিদগ্ধ ও প্রথিতযশা আলেমও এই মতবাদের অনুকূলে অভিমত ব্যক্ত করেননি, বরং এর বিরুদ্ধেই অভিমত দিয়েছেন। অতএব সেকুলারিজম ঈমানদার মুসলমানেরা কখনো গ্রহণ করতে পারে না।
লেখক : গবেষক
No comments