ভারতের অসংখ্য বাঁধের বিরূপ প্রভাব- শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশে সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম by শফিউল আযম
ভারতের দেয়া অসংখ্য বাঁধ বাংলাদেশে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব
বাঁধ বাংলাদেশের নদীসহ পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে সঙ্কুচিত করছে।
ফলে
নদীর গতিপথ পরিবর্তন, কৃষি ও মানবস্বাস্থ্যসহ সার্বিক পরিবেশ মারাত্মক
হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মওসুমে সার্বিক সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে
আশঙ্কা করেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের
কর্মকর্তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুন নেছা জানান, ভারত শুধু পদ্মা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধই নয়, বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে। এর কারণে বাংলাদেশের ৮০টি নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ছাড়া আরো ১০০টি নদী মৃতপ্রায়। এ বছর খরা মওসুমে এসব নদীর অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এর প্রভাবে এসব নদীর সাথে যুক্ত অসংখ্য খালবিল এখনই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোস্তাফিজার রহমান জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধকোটি সেচযন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে আছে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপসহ ছয় ধরনের টিউবওয়েল। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ভূ-উপরিস্থ পানি সেচের জন্য রয়েছে লো-লিফটসহ যান্ত্রিক পাম্প ও সনাতনপদ্ধতির নানাবিধ সেচপদ্ধতি। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। এসব সেচযন্ত্র প্রায় দেড় কোটি হেক্টরে বছরের বিভিন্ন সময় পানি সরবরাহ করে।
জানা যায়, এক যুগের ব্যবধানে দেশে সেচযন্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেচের জমি বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর। এসব সেচযন্ত্র প্রত্য ও পরোভাবে দেশের বড় নদী, শাখানদী, উপশাখা ও প্রশাখাগুলোর সাথে যুক্ত অসংখ্য খাল, হাওর, বিল প্রভৃতির পানির উৎস থেকে পানি সরবরাহ করে। ফলে যেকোনো নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা মানেই সরাসরি ওই নদীকেন্দ্রিক সেচব্যবস্থার ওপর আঘাত হানা। ভারতের এই নদী রাজনীতি প্রত্যভাবে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে অচল করার েেত্র প্রভাব ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
গঙ্গা নদীর উজানে ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত অধিক হারে পানি প্রত্যাহারে সেচব্যবস্থার ওপর এর ভয়ানক প্রভাব পড়েছে। এ দিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে এসব এলাকার হাজার হাজার নলকূপে পানি উঠছে না বললেই চলে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, শুধু বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোতে ভারতের বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের লাখ লাখ হেক্টর কৃষি ফসল, পরিবেশ, হাজার হাজার কলকারখানা, ২৫০ প্রজাতির মাছ ও নৌপথ হুমকির মুখে।
প্রকৌশলী কামরুন নেছা এ প্রতিনিধিকে আরো জানান, ভারত ফারাক্কার পর তিস্তা-মহানন্দা নদীর উজানে আরো একটি বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৮৬ সালে। এ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ১৪টি নদী বিলীনের পথে। তিস্তা-মহানন্দা অববাহিকায় হাজার হাজার হেক্টর জমি আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়ে। এমন বহু নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করছে।
প্রধান নদীগুলোর ওপর নির্মিত বাঁধগুলো হচ্ছেÑ তিস্তা নদীর ওপর জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধ, শিলিগুড়ির কাছে মহানন্দা নদীতে নির্মিত মহানন্দা ব্যারাজ, নদীয়া জেলার করিমপুরে জলঙ্গী নদীর ওপর নির্মিত রেগুলেটর ও ক্রস বাঁধ, কুড়িগ্রামের বিপরীতে দেওয়ানগঞ্জে জিনজিরাম নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ, জকিগঞ্জের বিপরীতে কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত গ্রোয়েন, গোমতি নদীর ওপর মাথারানীতে নির্মিত বাঁধ, খোয়াই নদীতে চাকমাঘাট বাঁধ, মনু নদীতে নির্মিত কাঞ্চনবাড়ী বাঁধ, পুনর্ভবা নদীতে নির্মিত কোমরডাঙ্গা বাঁধ প্রভৃতি। এসব বাঁধের যে তি তা ফারাক্কা বাঁধের তির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গঙ্গা অববাহিকায় বাস করে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ। গঙ্গার দুই তীরে ২৯টি প্রথম শ্রেণীর শহর রয়েছে। প্রতিটি শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণীর শহর রয়েছে ২৩টি। শহরগুলোর প্রতিটির জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ। এ ছাড়া ৫০ হাজার কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহর রয়েছে ৪৮টি। উত্তর প্রদেশের কানপুরে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ‘লব-কুশ ব্যারাজ’। এই বাঁধ দিয়ে ভারত প্রতিদিন ১৯ হাজার মিলিয়ন লিটার পানি সরিয়ে নিচ্ছে।
নদীর গতিপথে বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে প্রকৌশলী কামরুন নেছা বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নদীর চলমান প্রবাহ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যেকোনো প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হলে এর একটি প্রভাব পড়বেই। নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হলে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। স্বল্পমেয়াদি প্রভাবকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এগুলো প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান। যেমন নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদীতে চর জেগে ওঠা, নদীতে মাছের বিচরণ কমে যাওয়া, নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে নৌচলাচলে বিঘœ সৃষ্টি, নদীতে ঘন ঘন বাঁক সৃষ্টি, নদীর পানির স্বচ্ছতা হ্রাস, নদীতে দূষণ বেড়ে যাওয়া, নদীকেন্দ্রিক সেচকাজ ব্যাহত হওয়া, নদীতে অতিরিক্ত পলি জমা ও বালুর প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া প্রভৃতি।
অন্য দিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর তি হয় অপূরণীয়। এসব প্রভাব অনেক সময় সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় না। এগুলোর তিকর প্রভাব দীর্ঘ সময় পর বোঝা যায়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থাকে নির্বিকার। কিন্তু এসব প্রভাব মানুষ, প্রাণী, গাছপালা, পরিবেশ, মাটির জন্য হুমকিস্বরূপ। তিকর এসব প্রভাবের মধ্যে রয়েছে নদী মরে যাওয়া বা শীর্ণকায় হয়ে পড়া, নদীবাহিত বিশাল এলাকা পতিত ও অনুর্বর হয়ে পড়া, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, নদীতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদী অববাহিকায় বিদ্যমান ছোট ছোট একুইফার বন্ধ হয়ে যাওয়া, মাছের প্রজনন নষ্ট হয়ে মাছের আকাল দেখা দেয়া, অন্যান্য জলজ প্রাণী যেমন কুমির, ঘড়িয়াল, জলহস্তি প্রভৃতি বিলুপ্ত হওয়া, তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ ও ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া, ভূমির রূপ পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো: সরওয়ার জাহান সজল বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তা করতে হবে। কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ভারত গঙ্গায় বহু বাঁধ নির্মাণ করে উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচ প্রকল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা ও তার শাখা অনেক নদীই শুকিয়ে গেছে। নদী তীরের জনবসতিগুলো পানি সঙ্কটে হুমকির মুখে। নৌপরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। পদ্মা অববাহিকায় অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতা (জিকে) সেচ প্রকল্প বন্ধ প্রায়।
ড. মো: সরওয়ার জাহান আরো বলেন, বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত পানির উৎসগুলোর প্রায় সব ক’টিতেই ভারত বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ আটকে দিয়েছে। এসব নদনদীর মূল উৎসগুলো প্রধানত হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। কিছু আছে অন্যান্য পাহাড়ে। মূল নদী ও উপনদীতে বাঁধ দেয়ায় বাংলাদেশের অসংখ্য পানির উৎস চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পদ্মার প্রধান শাখানদী হলো মাথাভাঙ্গা, কুমার, বড়াল, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ। প্রশাখা হলো মধুমতি, পশুর, কপোতা। উপনদী একটি মহানন্দা। মহানন্দা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায় পদ্মায় মিলিত হয়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুষ্ক মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন েেত্র পদ্মা নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পদ্মা নদীর সেই গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুন নেছা জানান, ভারত শুধু পদ্মা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধই নয়, বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে। এর কারণে বাংলাদেশের ৮০টি নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ছাড়া আরো ১০০টি নদী মৃতপ্রায়। এ বছর খরা মওসুমে এসব নদীর অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এর প্রভাবে এসব নদীর সাথে যুক্ত অসংখ্য খালবিল এখনই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোস্তাফিজার রহমান জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধকোটি সেচযন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে আছে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপসহ ছয় ধরনের টিউবওয়েল। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ভূ-উপরিস্থ পানি সেচের জন্য রয়েছে লো-লিফটসহ যান্ত্রিক পাম্প ও সনাতনপদ্ধতির নানাবিধ সেচপদ্ধতি। এগুলোর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। এসব সেচযন্ত্র প্রায় দেড় কোটি হেক্টরে বছরের বিভিন্ন সময় পানি সরবরাহ করে।
জানা যায়, এক যুগের ব্যবধানে দেশে সেচযন্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেচের জমি বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর। এসব সেচযন্ত্র প্রত্য ও পরোভাবে দেশের বড় নদী, শাখানদী, উপশাখা ও প্রশাখাগুলোর সাথে যুক্ত অসংখ্য খাল, হাওর, বিল প্রভৃতির পানির উৎস থেকে পানি সরবরাহ করে। ফলে যেকোনো নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা মানেই সরাসরি ওই নদীকেন্দ্রিক সেচব্যবস্থার ওপর আঘাত হানা। ভারতের এই নদী রাজনীতি প্রত্যভাবে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে অচল করার েেত্র প্রভাব ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
গঙ্গা নদীর উজানে ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত অধিক হারে পানি প্রত্যাহারে সেচব্যবস্থার ওপর এর ভয়ানক প্রভাব পড়েছে। এ দিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে এসব এলাকার হাজার হাজার নলকূপে পানি উঠছে না বললেই চলে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, শুধু বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোতে ভারতের বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশের লাখ লাখ হেক্টর কৃষি ফসল, পরিবেশ, হাজার হাজার কলকারখানা, ২৫০ প্রজাতির মাছ ও নৌপথ হুমকির মুখে।
প্রকৌশলী কামরুন নেছা এ প্রতিনিধিকে আরো জানান, ভারত ফারাক্কার পর তিস্তা-মহানন্দা নদীর উজানে আরো একটি বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৮৬ সালে। এ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ১৪টি নদী বিলীনের পথে। তিস্তা-মহানন্দা অববাহিকায় হাজার হাজার হেক্টর জমি আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়ে। এমন বহু নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করছে।
প্রধান নদীগুলোর ওপর নির্মিত বাঁধগুলো হচ্ছেÑ তিস্তা নদীর ওপর জলপাইগুড়ির গজলডোবা বাঁধ, শিলিগুড়ির কাছে মহানন্দা নদীতে নির্মিত মহানন্দা ব্যারাজ, নদীয়া জেলার করিমপুরে জলঙ্গী নদীর ওপর নির্মিত রেগুলেটর ও ক্রস বাঁধ, কুড়িগ্রামের বিপরীতে দেওয়ানগঞ্জে জিনজিরাম নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ, জকিগঞ্জের বিপরীতে কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত গ্রোয়েন, গোমতি নদীর ওপর মাথারানীতে নির্মিত বাঁধ, খোয়াই নদীতে চাকমাঘাট বাঁধ, মনু নদীতে নির্মিত কাঞ্চনবাড়ী বাঁধ, পুনর্ভবা নদীতে নির্মিত কোমরডাঙ্গা বাঁধ প্রভৃতি। এসব বাঁধের যে তি তা ফারাক্কা বাঁধের তির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গঙ্গা অববাহিকায় বাস করে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ। গঙ্গার দুই তীরে ২৯টি প্রথম শ্রেণীর শহর রয়েছে। প্রতিটি শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণীর শহর রয়েছে ২৩টি। শহরগুলোর প্রতিটির জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ। এ ছাড়া ৫০ হাজার কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহর রয়েছে ৪৮টি। উত্তর প্রদেশের কানপুরে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে ‘লব-কুশ ব্যারাজ’। এই বাঁধ দিয়ে ভারত প্রতিদিন ১৯ হাজার মিলিয়ন লিটার পানি সরিয়ে নিচ্ছে।
নদীর গতিপথে বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে প্রকৌশলী কামরুন নেছা বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নদীর চলমান প্রবাহ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। যেকোনো প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হলে এর একটি প্রভাব পড়বেই। নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হলে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। স্বল্পমেয়াদি প্রভাবকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এগুলো প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান। যেমন নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদীতে চর জেগে ওঠা, নদীতে মাছের বিচরণ কমে যাওয়া, নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে নৌচলাচলে বিঘœ সৃষ্টি, নদীতে ঘন ঘন বাঁক সৃষ্টি, নদীর পানির স্বচ্ছতা হ্রাস, নদীতে দূষণ বেড়ে যাওয়া, নদীকেন্দ্রিক সেচকাজ ব্যাহত হওয়া, নদীতে অতিরিক্ত পলি জমা ও বালুর প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া প্রভৃতি।
অন্য দিকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর তি হয় অপূরণীয়। এসব প্রভাব অনেক সময় সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় না। এগুলোর তিকর প্রভাব দীর্ঘ সময় পর বোঝা যায়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থাকে নির্বিকার। কিন্তু এসব প্রভাব মানুষ, প্রাণী, গাছপালা, পরিবেশ, মাটির জন্য হুমকিস্বরূপ। তিকর এসব প্রভাবের মধ্যে রয়েছে নদী মরে যাওয়া বা শীর্ণকায় হয়ে পড়া, নদীবাহিত বিশাল এলাকা পতিত ও অনুর্বর হয়ে পড়া, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, নদীতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া, ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নদী অববাহিকায় বিদ্যমান ছোট ছোট একুইফার বন্ধ হয়ে যাওয়া, মাছের প্রজনন নষ্ট হয়ে মাছের আকাল দেখা দেয়া, অন্যান্য জলজ প্রাণী যেমন কুমির, ঘড়িয়াল, জলহস্তি প্রভৃতি বিলুপ্ত হওয়া, তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ ও ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া, ভূমির রূপ পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো: সরওয়ার জাহান সজল বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তা করতে হবে। কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। ভারত গঙ্গায় বহু বাঁধ নির্মাণ করে উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচ প্রকল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা ও তার শাখা অনেক নদীই শুকিয়ে গেছে। নদী তীরের জনবসতিগুলো পানি সঙ্কটে হুমকির মুখে। নৌপরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। পদ্মা অববাহিকায় অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতা (জিকে) সেচ প্রকল্প বন্ধ প্রায়।
ড. মো: সরওয়ার জাহান আরো বলেন, বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত পানির উৎসগুলোর প্রায় সব ক’টিতেই ভারত বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ আটকে দিয়েছে। এসব নদনদীর মূল উৎসগুলো প্রধানত হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। কিছু আছে অন্যান্য পাহাড়ে। মূল নদী ও উপনদীতে বাঁধ দেয়ায় বাংলাদেশের অসংখ্য পানির উৎস চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পদ্মার প্রধান শাখানদী হলো মাথাভাঙ্গা, কুমার, বড়াল, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়াল খাঁ। প্রশাখা হলো মধুমতি, পশুর, কপোতা। উপনদী একটি মহানন্দা। মহানন্দা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায় পদ্মায় মিলিত হয়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুষ্ক মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন েেত্র পদ্মা নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পদ্মা নদীর সেই গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
No comments