সরকার চলছে ‘গণ্ডগোলে হরিবোল’-এর মতো by মঈনুল আলম

প্রধানমন্ত্রীর একই দিনে মুখের কথা ও কাজের মধ্যে দুই মেরুর বৈপরীত্য অনেককেই বিস্মিত ও লজ্জিত করেছে। পুলিশ সপ্তাহ ২০১৩-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, তার সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে না।
এই নীতিতে তারা বিশ্বাসও করেন না। এ ঘোষণা দেয়ার পর একই অনুষ্ঠানে তিনি রাষ্ট্রপতির পুলিশ (সেবা) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত করলেন উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর অনন্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে!

পদকপ্রাপ্ত হারুনের কৃতিত্বটা আরো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে এই বলে, বিরোধী দলের ওই বিােভ ভেঙে দেয়ার জন্য পুলিশ অফিসার হারুন (নাম উচ্চারণ করতে আবেগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাকরোধ হয়ে গেল ণকালের জন্য) ‘তার কর্তব্যের বাইরে গিয়ে নিজের উদ্যোগে কাজ করার জন্য’। কাজটি অবশ্য ছিল বিরোধী দলের সংসদের চিফ হুইপকে প্রকাশ্যে পেটানো, শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলে তাকে উদোম করে ফেলা ও দুর্বৃত্তের মতো তাকে তাড়া করে এক অট্টালিকার ভেতর থেকে গ্রেফতার করে আনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, হারুনকে রাষ্ট্রপতির এই পদক দেয়ার ব্যাপারে তার এই কর্মকাণ্ডটি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

হায়রে মুখবাজিসর্বস্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! সংসদের একজন চিফ হুইপকে পুলিশ কর্তৃক পেটানোর ‘কৃতিত্ব’ বর্ণনা করতে গিয়ে তার এ কথাটি মনে এলো না যে তিনি নিজেও একজন সংসদ সদস্য (যদিও এখনো তার দলের চিফ হুইপ হতে পারেননি)। তার মনে এ প্রশ্ন এলো না যে টিভিতে দেশবাসী যখন বারবার দেখেছে কিভাবে একজন পুলিশ জাতীয় সংসদের একজন মাননীয় সদস্যকে পেটাচ্ছে তখন দেশবাসীর চোখে জাতীয় সংসদের সম্মান, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের আর কীই বা অবশিষ্ট থাকে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথাটি মনে এলো না যে এখন থেকে যেকোনো পুলিশ সুযোগ পেলেই কারণে-অকারণে তার কর্তব্যের বাইরে গিয়ে যেকোনো সংসদ সদস্যকে পেটাতে ইতস্তত বোধ করবে না এবং এ জন্য পুলিশসেবা পদক পাওয়ার আশাও করতে পারে! এই ঢাকা মহানগরীতে একজন রিকশাওয়ালাকে ‘এই ব্যাটা রিকশাওয়ালা, যাবি?’ বলে ডেকে দেখেন অন্য রিকশাওয়ালারা কিভাবে আপনার দিকে তেড়ে আসে! রিকশাওয়ালাদের এই আপন মর্যাদাবোধের দ্বারা তাদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করার বাধ্যতা তারা আদায় করতে পেরেছেন যাত্রীদের কাছ থেকে। এখন রিকশাকে ডাকতে হয় ‘এই রিকশা, যাবেন?’ বলে। সাধারণ রিকশাচালকের তার অবস্থান সম্পর্কে যে আত্মমর্যাদাবোধ আছে, মহাজোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীÑ যিনি সংসদ সদস্য হওয়ার অধিকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পেরেছেনÑ সংসদ সদস্যের অবস্থান সম্পর্কে সেই আত্মমর্যাদাবোধও দেখাতে পারলেন না। মহাজোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নমুনা থেকে ‘মহাজোট’ সরকারের গুণগত নমুনার ধারণা পাওয়া যায়।

কোনো পুলিশের কর্তব্যের অতিরিক্ত কর্মকাণ্ড করাকে বিশেষত অ্যাকশন বা শক্তি প্রয়োগ করাকে লিগ্যাল টার্মে বলা হয় অ্যাক্সেসিভ ফোর্স বা মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ। এই পুলিশ অ্যাক্সেস আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ভারতসহ প্রায় সব দেশে। বাংলাদেশেও এটা দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল এবং এ কারণে অনেক পুলিশ ডিসিপ্লিন থাকার সুযোগ ভোগ করেছে। আর এখন মহাজোট সরকারের শাসনে বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্র্তা কর্তব্যের বাইরে গিয়ে অ্যাক্সেস করে সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের চিফ হুইপকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে উদোম করে লাঞ্ছিত করে রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুলিশ কৃতিত্ব সেবা পদক পেলেন! উল্টো উটের পিঠে চড়ে চলছে মহাজোট সরকার!

বস্তুত বঙ্গবন্ধু-তনয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সরকার চলছে যেন ‘গণ্ডগোলে হরিবোল’-এর মতো করে। সরকারে কে কী বলছে, কে কী করছে, তার কোনো সমন্বয় নেই, নেই কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা জনগণের সামনে। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে মতাসীন দলের এক একজন এক এক সময় যেন ‘বল হরি, হরিবোল’ ধ্বনি তুলে জানান দিচ্ছে মিছিলের সম্মুখগতি অব্যাহত আছে, অবশ্য শ্মশানের দিকে তো বটেই।

গণ্ডগোলে হরিবোলের নমুনা দেখা যাক। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আগে জানান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফর করাকালে হঠাৎ প্রকাশ করা হলো রাশিয়া থেকে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার যুদ্ধসরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি স্বার করেছেন প্রধানমন্ত্রী মস্কোয়। এমন আকস্মিক ও আগে জানান ব্যতিরেকে এই চুক্তি স্বারে দেশে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই ও জনশক্তি উন্নয়ন মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বললেন, রাশিয়া থেকে এই অস্ত্র ক্রয়চুক্তি স্বারের প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়নি।

তার এ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ সরকার করেনি। তারপর হঠাৎ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে ‘হরিবোল’ ধ্বনি তোলার মতো করে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়চুক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিলেন চুক্তির গুণ বর্ণনা করে! প্রশ্ন হলোÑ বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী কি সরাসরি কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র ক্রয় ব্যাপারে চুক্তি, আলোচনা ও চূড়ান্ত করতে পারে? সামরিক বাহিনীগুলো দেশরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনী। তারা সরকার নয়। সামরিক বাহিনীগুলোর ওপরে রয়েছে দেশরা মন্ত্রণালয়, যা হচ্ছে সরকারের একটি অংশ। কিন্তু রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়চুক্তির ব্যাপারে দেশরা মন্ত্রণালয় যেন চুপ হয়ে আছে! সামরিক বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে দেশরা মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি ছিল বলে উল্লিখিত হয়নি। তাহলে রাশিয়া থেকে অস্ত্র ক্রয়চুক্তি স্বার কি ‘গরু ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার’ মতো কোনো কর্মকাণ্ড হয়েছে?

আরো প্রশ্ন এসে যায়, হাসিনা সরকারের হঠাৎ এত বিপুল যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের জরুরি তাগিদ পড়ল কেন? বাংলাদেশকে ঘিরে রয়েছে তো কারো ঠাকুরদা, কারো দাদাদের দেশ ভারত। এ দেশ হঠাৎ বাংলাদেশকে আক্রমণ করে বসবে এটা পাগলাগারদের বদ্ধতম পাগলও কল্পনা করবে না, বিশ্বাস করা তো দূরের কথা। এত বিপুল যুদ্ধাস্ত্র বাংলাদেশে রাখার মতো অস্ত্রাগারের সংস্থানও তো নেই। তাহলে শেখ হাসিনা সরকার কি চীনকে নাকাল করার জন্য দাদাদের দেশকে পাশে নিয়ে তিব্বত আক্রমণের চিন্তা করছেন? বল হরি, হরিবোল! নাকি এ দেশের ভেতরেই বড় ধরনের একটি সামরিক অভিযান…! নাহ্, ব্যাপারটি ভাবাই যায় না। বল হরি, হরিবোল!

আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখ্য নেতা ও মুখপাত্র মাহবুব-উল আলম হানিফ এসবের মধ্যে দাবি করেছেন মহাজোট সরকারের চার বছরের শাসনে সব সাফল্য, একটিও ব্যর্থতা নেই। এটা দাবি করার পরেই তিনি বললেন, ‘তবে আমাদের সাফল্যের বার্তা আমরা জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এটাই আমাদের একমাত্র ব্যর্থতা।’

পৌঁছাবেন কী করে? মহাজোটের চার বছরের শাসনে বেপরোয়া দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লোপাট, গুম, হত্যা, ধর্ষণ ও অনর্গল মিথ্যাচারের ধ্বনিতে যে জনসাধারণের কান ঝালাপালা ও মন সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে তাদের কাছে সরকারের সাফল্যের সুবাতাস বিশ্বাসযোগ্য হবে? বল হরি, হরিবোল!

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী

moyeenlalam@hotmail.com
       

No comments

Powered by Blogger.