পদ্মা সেতু প্রকল্প-রেল রেখেই সেতু by টিটু দত্ত গুপ্ত ও আবুল কাশেম
সড়ক ও রেলের ব্যবস্থা রেখেই পদ্মা সেতুর
অর্থনৈতিক সমীক্ষা করা হয়েছে। এখন খরচ কমাতে রেল বাদ দিলে সেতুর
দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। ভবিষ্যতে
রেলের জন্য আলাদা সেতু করতে হলে ব্যয় যেমন বাড়বে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহও
তেমনই ব্যাহত হবে।
তাই রেলপথের ব্যবস্থা রেখেই পদ্মা সেতু
তৈরিতে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারও এখন সেই পথে হাঁটছে। তবে খরচ
কমানোর বিষয়টি মুখ্য হওয়ায় এখন নকশা কাটছাঁটের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এক
সপ্তাহের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত করার জন্য কাজও শুরু করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের নীতিনির্ধারক ও পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্তরা এমন তথ্যই
জানিয়েছেন। আর সেতুর অর্থায়নসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল
আবদুল মুহিত আজ সোমবার জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেবেন বলেও জানা গেছে।
পদ্মা সেতুতে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নের বিষয়ে সরাসরি জড়িত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অর্ধেক (রেল ছাড়া) কাজ করতে চাই না। আমাদের ইচ্ছা পুরোটাই করা। সে মোতাবেকই নকশা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সোমবার বিবৃতি দেবেন। তখনই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।'
পদ্মা সেতুর যে চূড়ান্ত প্রস্তাব বিশ্বব্যাংক অনুমোদন করেছিল, তাতে বলা আছে, সেতু তৈরি হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্য অংশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব কমবে। সড়ক ও নৌপথের পাশাপাশি রেলপথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গেও এ অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ১.৭ শতাংশ। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে বছরে ১ শতাংশ হারে। মংলা বন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে। তখন চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। পদ্মা সেতু ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারবে। সেতুর যে চূড়ান্ত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি হয়েছিল, তাতে এসব সম্ভাবনার কথা বলা আছে।
কিন্তু ২৯০ কোটি ডলারের বৃহৎ এ সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক এবং সহ-অর্থায়নকারী অন্যান্য সংস্থা বাদ যাওয়ায় সরকার এখন খরচ কমিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মরিয়া। এর জন্য রেল বাদ দিয়ে কেবল সড়ক সেতু তৈরির চিন্তা হয়েছিল। এর পেছনে যুক্তি ছিল, পদ্মা সেতুর নির্ধারিত স্থানে নদীর দুই পাশে রেল সংযোগ নেই। ফলে সেতুতে রেল রাখা হলেও তা কাজে লাগবে না। এর আগে নদীর দুই তীরে ৩০৮ কিলোমিটার রেলপথ বসাতে হবে। আনুষঙ্গিক আরো স্থাপনাসহ খরচ পড়বে দেড় শ কোটি ডলার। রেলওয়ের এ-সংক্রান্ত যে চারটি প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো শুরুই হয়নি। তাই রেল বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছিল সরকার। তবে এখন সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনা হলো, ভবিষ্যতে নতুন করে রেল সেতু তৈরি করা হলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবার এখন সড়ক সেতু করে পরে তাতে রেল যোগ করতে গেলেও খরচ বাড়বে। তাই অন্তত এখন সেতুতে রেল সংযোগের পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সরকার। তবে দুই পাড়ে সংযোগ রেলপথ নির্মাণের চিন্তা আপাতত নেই।
সাবেক একজন যোগাযোগমন্ত্রীসহ নদী গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, পদ্মা সেতুর নকশা থেকে রেলপথ মুছে ফেলা ঠিক হবে না। তাঁরা বলেছেন, যমুনা সেতুর মূল নকশায় যে ভুল করা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যাতে এ ক্ষেত্রে না হয়। মূল নকশায় না থাকায় পরে যমুনা সেতুর মূল কাঠামোর বাইরে রেল সেতু যুক্ত করতে হয়েছে। পদ্মা সেতুর মূল নকশায়ও রেলপথের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে যেকোনো সময় চাইলে রেল সংযোগ চালু করা যায়।
পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণ হয় ২০০৪ সালে। সেই সময় একটি নকশাও প্রণীত হয়। তখন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'সেই নকশায়ও রেল অন্তর্ভুক্ত ছিল। যমুনা সেতুর ভুলের কথা মাথায় রেখে আমি মূল নকশায় রেলপথ রাখার ওপর জোর দিয়েছিলাম। ব্যবস্থা থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের পক্ষে যখন সম্ভব হবে, রেলপথ বসিয়ে নেব। এটি খুব ভালো নকশা। সরকার তো সেই নকশাও কাজে লাগাতে পারে। সেটিও তো বাইরের বিশেষজ্ঞ দিয়ে করানো।'
তখন সেতু নির্মাণের খরচের হিসাব ধরা হয়েছিল ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। আগের নকশাটি অনুসরণ করলে পদ্মা সেতুর খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে বলে মনে করেন সাবেক এই যোগাযোগমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০০০ সালে। জাইকার অর্থায়নে ২০০৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাপানেরই একটি প্রতিষ্ঠান। খরচ ধরা হয় ১২০ কোটি ডলার। সেই সময়ের নকশায়ও চার লেনের সড়ক সেতুতে রেলপথ রাখা হয়েছিল। প্রস্থ ছিল ২৫ মিটার। নদীভাঙনে সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার বেড়ে যাওয়ায় ২০০৯ সালে খরচ ধরা হয় ১৯৪ কোটি ডলার। এর পরে করা চূড়ান্ত নকশায় খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৮ কোটি ডলার। ২০১০ সালে বিস্তৃত নকশায় প্রাক্কলিত খরচ দেখানো হয় ২৪১ কোটি ডলার। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত প্রস্তাবে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে।
২০০৫ সালে করা নকশায় দেখা যায়, সেখানে এক্সট্রাডোজ সেতুতে একক রেলপথ বসানোর ব্যবস্থা ছিল। এরপর ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় রেলপথের আদলে ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর সংযুক্ত করায় সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। সে কারণে খরচ বেড়ে যায়। রেলপথের ব্যবস্থা রেখেই সরকার এখন সেতু করতে চাচ্ছে। নকশা সংশোধন করে খরচ কমানো যায় কি না তাও দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের একজন বলেছেন, খরচ একটু বেশি হলেও সেতুতে রেলপথের ব্যবস্থা রাখা উচিত। কারণ ভবিষ্যতে যদি আলাদা রেলসেতু তৈরির প্রয়োজন পড়ে তাহলে খরচ বাড়বে আরো অনেক বেশি।
পুরকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী অবশ্য বলেন, আজকাল রেলসেতু ইস্পাত কাঠামোয় নির্মিত হয়। ভবিষ্যতে যদি নদীতে আলাদা রেলসেতু তৈরি করতে হয়, তাহলে ইস্পাত কাঠামোয় করলে খরচ কম হবে।
তবে একই নদীতে কাছাকাছি দুটি সেতু তৈরি সমর্থন করেন না নদী গবেষকরা। ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল অর্থের কথা ভাবলে হবে না, নদীর প্রবাহের কথাও মাথায় রাখতে হবে। একাধিক সেতু বানিয়ে নদী মেরে ফেলা যাবে না। নকশাটি এমনভাবে করা উচিত, যাতে আলাদা আরেকটি স্থাপনা নদীতে করতে না হয়। আপাতত রেলপথ কাজে না লাগলেও ভবিষ্যতে যাতে একই সেতু দিয়ে রেলপথ টানা যায়, তার ব্যবস্থা রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধু সেতুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মূল নকশায় না থাকায় পরে এক পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে রেলপথ। ফলে প্রাণভয়ে সেতু পার হতে হয় ট্রেনযাত্রীদের।
এ গবেষক বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির সময় নদী শাসন করে যমুনার প্রশস্ততা ৯ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এশিয়ার গবেষকরা চান, নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রেখেই যা করা দরকার করা। আর ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের গবেষকরা নদী শাসনের নামে নদীকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতেও পিছপা হন না। নতুন আর কোনো সেতু তৈরি করে পদ্মার ওপর চাপ না বাড়ানোর পরামর্শ ওই নদী গবেষকের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্বব্যাংকসহ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কয়েকটি নকশা তৈরি ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন নকশা অনুযায়ীই সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যার নিচ দিয়ে চলবে রেল আর ওপর দিয়ে গাড়ি। গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংক যখন ঋণপ্রস্তাব স্থগিত করে, তখন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিদ্যমান নকশা বাদে অন্য নকশায় কম খরচে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন, দৃষ্টিনন্দন এই নকশা বাদ দিলে সেতু নির্মাণের খরচ অনেকটাই কমে যাবে। সে রকম নকশাও আছে। তবে খরচ আরো কমাতে আগেরগুলোর বদলে নতুন করে নকশা তৈরি করা হচ্ছে।
রেলপথের ব্যবস্থা রেখে কম খরচের সেতুর নকশা করতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে দিন কয়েক আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বুয়েট ও সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও। এরই মধ্যে নকশা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নতুন নকশা প্রণয়নের জন্য এই তিন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এরই মধ্যে বৈঠক করেছে। পদ্মা সেতুর বিদ্যমান কয়েকটি নকশা নিয়ে সেখানে পর্যালোচনা করা হয়েছে। চলতি মাসের প্রথমার্ধেই সম্ভাব্য কয়েকটি নকশা সরকারের হাতে আসবে বলে জানিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
পদ্মা সেতুর নতুন নকশা তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা নকশা পর্যালোচনা করে দেখব, এটিতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেই চলবে, নাকি নতুন নকশা করতে হবে।'
পদ্মা সেতুতে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নের বিষয়ে সরাসরি জড়িত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অর্ধেক (রেল ছাড়া) কাজ করতে চাই না। আমাদের ইচ্ছা পুরোটাই করা। সে মোতাবেকই নকশা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সোমবার বিবৃতি দেবেন। তখনই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।'
পদ্মা সেতুর যে চূড়ান্ত প্রস্তাব বিশ্বব্যাংক অনুমোদন করেছিল, তাতে বলা আছে, সেতু তৈরি হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্য অংশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব কমবে। সড়ক ও নৌপথের পাশাপাশি রেলপথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গেও এ অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ১.৭ শতাংশ। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে বছরে ১ শতাংশ হারে। মংলা বন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে। তখন চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। পদ্মা সেতু ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারবে। সেতুর যে চূড়ান্ত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি হয়েছিল, তাতে এসব সম্ভাবনার কথা বলা আছে।
কিন্তু ২৯০ কোটি ডলারের বৃহৎ এ সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক এবং সহ-অর্থায়নকারী অন্যান্য সংস্থা বাদ যাওয়ায় সরকার এখন খরচ কমিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মরিয়া। এর জন্য রেল বাদ দিয়ে কেবল সড়ক সেতু তৈরির চিন্তা হয়েছিল। এর পেছনে যুক্তি ছিল, পদ্মা সেতুর নির্ধারিত স্থানে নদীর দুই পাশে রেল সংযোগ নেই। ফলে সেতুতে রেল রাখা হলেও তা কাজে লাগবে না। এর আগে নদীর দুই তীরে ৩০৮ কিলোমিটার রেলপথ বসাতে হবে। আনুষঙ্গিক আরো স্থাপনাসহ খরচ পড়বে দেড় শ কোটি ডলার। রেলওয়ের এ-সংক্রান্ত যে চারটি প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো শুরুই হয়নি। তাই রেল বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছিল সরকার। তবে এখন সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনা হলো, ভবিষ্যতে নতুন করে রেল সেতু তৈরি করা হলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবার এখন সড়ক সেতু করে পরে তাতে রেল যোগ করতে গেলেও খরচ বাড়বে। তাই অন্তত এখন সেতুতে রেল সংযোগের পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সরকার। তবে দুই পাড়ে সংযোগ রেলপথ নির্মাণের চিন্তা আপাতত নেই।
সাবেক একজন যোগাযোগমন্ত্রীসহ নদী গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, পদ্মা সেতুর নকশা থেকে রেলপথ মুছে ফেলা ঠিক হবে না। তাঁরা বলেছেন, যমুনা সেতুর মূল নকশায় যে ভুল করা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি যাতে এ ক্ষেত্রে না হয়। মূল নকশায় না থাকায় পরে যমুনা সেতুর মূল কাঠামোর বাইরে রেল সেতু যুক্ত করতে হয়েছে। পদ্মা সেতুর মূল নকশায়ও রেলপথের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে যেকোনো সময় চাইলে রেল সংযোগ চালু করা যায়।
পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণ হয় ২০০৪ সালে। সেই সময় একটি নকশাও প্রণীত হয়। তখন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'সেই নকশায়ও রেল অন্তর্ভুক্ত ছিল। যমুনা সেতুর ভুলের কথা মাথায় রেখে আমি মূল নকশায় রেলপথ রাখার ওপর জোর দিয়েছিলাম। ব্যবস্থা থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের পক্ষে যখন সম্ভব হবে, রেলপথ বসিয়ে নেব। এটি খুব ভালো নকশা। সরকার তো সেই নকশাও কাজে লাগাতে পারে। সেটিও তো বাইরের বিশেষজ্ঞ দিয়ে করানো।'
তখন সেতু নির্মাণের খরচের হিসাব ধরা হয়েছিল ১১ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা। আগের নকশাটি অনুসরণ করলে পদ্মা সেতুর খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে বলে মনে করেন সাবেক এই যোগাযোগমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০০০ সালে। জাইকার অর্থায়নে ২০০৪ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাপানেরই একটি প্রতিষ্ঠান। খরচ ধরা হয় ১২০ কোটি ডলার। সেই সময়ের নকশায়ও চার লেনের সড়ক সেতুতে রেলপথ রাখা হয়েছিল। প্রস্থ ছিল ২৫ মিটার। নদীভাঙনে সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার বেড়ে যাওয়ায় ২০০৯ সালে খরচ ধরা হয় ১৯৪ কোটি ডলার। এর পরে করা চূড়ান্ত নকশায় খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৮ কোটি ডলার। ২০১০ সালে বিস্তৃত নকশায় প্রাক্কলিত খরচ দেখানো হয় ২৪১ কোটি ডলার। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত প্রস্তাবে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে।
২০০৫ সালে করা নকশায় দেখা যায়, সেখানে এক্সট্রাডোজ সেতুতে একক রেলপথ বসানোর ব্যবস্থা ছিল। এরপর ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের কথা মাথায় রেখে ভারতীয় রেলপথের আদলে ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডর সংযুক্ত করায় সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। সে কারণে খরচ বেড়ে যায়। রেলপথের ব্যবস্থা রেখেই সরকার এখন সেতু করতে চাচ্ছে। নকশা সংশোধন করে খরচ কমানো যায় কি না তাও দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের একজন বলেছেন, খরচ একটু বেশি হলেও সেতুতে রেলপথের ব্যবস্থা রাখা উচিত। কারণ ভবিষ্যতে যদি আলাদা রেলসেতু তৈরির প্রয়োজন পড়ে তাহলে খরচ বাড়বে আরো অনেক বেশি।
পুরকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী অবশ্য বলেন, আজকাল রেলসেতু ইস্পাত কাঠামোয় নির্মিত হয়। ভবিষ্যতে যদি নদীতে আলাদা রেলসেতু তৈরি করতে হয়, তাহলে ইস্পাত কাঠামোয় করলে খরচ কম হবে।
তবে একই নদীতে কাছাকাছি দুটি সেতু তৈরি সমর্থন করেন না নদী গবেষকরা। ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল অর্থের কথা ভাবলে হবে না, নদীর প্রবাহের কথাও মাথায় রাখতে হবে। একাধিক সেতু বানিয়ে নদী মেরে ফেলা যাবে না। নকশাটি এমনভাবে করা উচিত, যাতে আলাদা আরেকটি স্থাপনা নদীতে করতে না হয়। আপাতত রেলপথ কাজে না লাগলেও ভবিষ্যতে যাতে একই সেতু দিয়ে রেলপথ টানা যায়, তার ব্যবস্থা রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধু সেতুর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মূল নকশায় না থাকায় পরে এক পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে রেলপথ। ফলে প্রাণভয়ে সেতু পার হতে হয় ট্রেনযাত্রীদের।
এ গবেষক বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির সময় নদী শাসন করে যমুনার প্রশস্ততা ৯ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এশিয়ার গবেষকরা চান, নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রেখেই যা করা দরকার করা। আর ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের গবেষকরা নদী শাসনের নামে নদীকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতেও পিছপা হন না। নতুন আর কোনো সেতু তৈরি করে পদ্মার ওপর চাপ না বাড়ানোর পরামর্শ ওই নদী গবেষকের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্বব্যাংকসহ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কয়েকটি নকশা তৈরি ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন নকশা অনুযায়ীই সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যার নিচ দিয়ে চলবে রেল আর ওপর দিয়ে গাড়ি। গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংক যখন ঋণপ্রস্তাব স্থগিত করে, তখন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিদ্যমান নকশা বাদে অন্য নকশায় কম খরচে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন, দৃষ্টিনন্দন এই নকশা বাদ দিলে সেতু নির্মাণের খরচ অনেকটাই কমে যাবে। সে রকম নকশাও আছে। তবে খরচ আরো কমাতে আগেরগুলোর বদলে নতুন করে নকশা তৈরি করা হচ্ছে।
রেলপথের ব্যবস্থা রেখে কম খরচের সেতুর নকশা করতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে দিন কয়েক আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বুয়েট ও সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও। এরই মধ্যে নকশা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নতুন নকশা প্রণয়নের জন্য এই তিন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এরই মধ্যে বৈঠক করেছে। পদ্মা সেতুর বিদ্যমান কয়েকটি নকশা নিয়ে সেখানে পর্যালোচনা করা হয়েছে। চলতি মাসের প্রথমার্ধেই সম্ভাব্য কয়েকটি নকশা সরকারের হাতে আসবে বলে জানিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
পদ্মা সেতুর নতুন নকশা তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা নকশা পর্যালোচনা করে দেখব, এটিতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেই চলবে, নাকি নতুন নকশা করতে হবে।'
No comments