মিসরের গণতন্ত্র এখন হুমকির সম্মুখীন by ইদ্রিস তওফিক
সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার যখন বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
করে, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, কয়েক মাসের অনিশ্চয়তার বুঝি অবসান হবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, সেই আশা পূরণ হয়নি মানুষের।
কয়েক দশকে
রপ্ত করা দুর্নীতি ও চুরি করার অভ্যাস যাদের, তারা কিন্তু নির্মূল হয়ে
যায়নি এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। তাদেরই বিরাট একটি অংশ এখন মাথা তুলে
দাঁড়িয়েছে। পুরনো পদ্ধতি তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে যেমন লাভের ব্যাপার ছিল,
তেমনি ছিল ক্ষমতা ও ভোগের ভাণ্ডার। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে সেই সুযোগ
নেই।
সম্প্রতি মিসরে যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, এই মুহূর্তে মিসরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সরকারের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা চলতে দেওয়া যায় না। তাঁরা দেখছেন সাধারণ মানুষ ও তাদের সম্পদ কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন, রাস্তায় ভাঙচুর, লুটপাটের মতো কাজগুলো করছে কিছু দুষ্কৃতকারী, বিপথগামী তরুণ। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যথাযথ মনে করা যায় না। তবু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই এ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক শাসনেও এর প্রচলন আছে। আর এ আশঙ্কা বা সম্ভাবনার কথাই গত সপ্তাহে প্রকাশ করলেন মিসরের সামরিক বাহিনীর প্রধান।
যারা জনগণের রায়কে থোড়াই তোয়াক্কা করে, তাদের দ্বারাই এখন মিসরের গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন।
লুণ্ঠনকারীরা যখন সরকারি অফিস থেকে মাথায় করে কম্পিউটার কিংবা টেলিভিশন নিয়ে যায়, আর সেই চিত্র সংবাদমাধ্যমে বিশ্বের মানুষ দেখতে পায়, তখন মিসরের মর্যাদা বলতে আর কিছু থাকে না।
এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে জাতীয়ভিত্তিক কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আর কার্যকর নেই। তাদের নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখন চুরি, দুর্নীতির মতো নানা অভিযোগে কারাবরণ করছেন। তাঁদের অনেকেরই এখনো প্রচুর অর্থব্যয়ের সামর্থ্য রয়েছে, যাঁরা সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ইন্ধন জোগাতে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, প্রচারমাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্টের অনুসারীরাও বসে নেই। সেখানে নির্বাচিত বর্তমান প্রেসিডেন্টকে বিদ্রূপ-ঠাট্টা ও তির্যক সমালোচনা করা হচ্ছে নির্লজ্জভাবে। তারা প্রচারমাধ্যমকে এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা তাহরির স্কোয়ারের জমায়েতকে বড় করে দেখাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টাই পুরনো শাসকদের অনুসারীদের কিছু মুখের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে সেসব টেলিভিশনে। তারা সংবাদ প্রচার করছে নেতিবাচক আর টক-শো প্রচার করছে বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে। এসব দেখে যে কেউ মনে করতে পারে, মিসরের পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
টেলিভিশনগুলোর অনেক বার্তা সম্পাদককে বিপ্লবের পর সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উপস্থাপকদের প্রায় সবাই রয়ে গেছে। থেকে যাওয়া লোকজনকে ওই সময় মনে হয়েছিল, তারাও বিপ্লবকে সমর্থন করছে। সুযোগ বুঝে এখন তারা বদলে গেছে। সেসব প্রচারকর্মী নেতিবাচক সংবাদ প্রচারে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গণতন্ত্রে সুস্থ সমালোচনা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু যে মুহূর্তে ব্যক্তি আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটে, তখন তাকে গণতন্ত্রের আওতায় ফেলা কঠিন। বিপ্লবে তাহরির স্কোয়ারে আত্মাহুতি দেওয়া মানুষের কারণে দেশে গণতান্ত্রিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সুযোগকে যদি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা হয়, তা হবে দেশের জন্য মারাত্মক। তাদের মুখ থেকে এখন শোনা যায়, দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদান করতে হবে। কিন্তু স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিত হওয়ার সময় তারা এ কথাগুলো উচ্চারণ করেনি।
তবে এটাও ঠিক, দুই বছরে মানুষের মনে এক ধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছে। তারা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল, সেই আশা এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দ্রব্যমূল্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মতো কিছু চাহিদা পূরণ হয়নি এখনো। মিসরের মানুষের এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কি এটুকু সময়ই যথেষ্ট?
যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় যে অর্থনৈতিক মন্দা ছিল, তা মোকাবিলা করার জন্য তাঁকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ তাঁকে পুনর্নির্বাচিত করেছে।
প্রচারমাধ্যমগুলো এখন প্রচার করছে, দেশের উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হয়নি বর্তমান সরকারের আদর্শিক অবস্থানের কারণে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এখন জাতীয়ভিত্তিক সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মানসিকতা ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে না। জনরায় যে সরকারের ভিত্তি, তাকে টিকিয়ে রাখার দায়ও অস্বীকার করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ জনগণের বিজয় বহাল থাকবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে দেশ রক্ষা পাবে।
লেখক : ব্রিটিশ নাগরিক ও মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ইসলাম সম্পর্কিত ৯টি গ্রন্থের প্রণেতা।
দ্য ইজিপসিয়ান গ্যাজেট থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন।
সম্প্রতি মিসরে যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, এই মুহূর্তে মিসরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সরকারের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা চলতে দেওয়া যায় না। তাঁরা দেখছেন সাধারণ মানুষ ও তাদের সম্পদ কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন, রাস্তায় ভাঙচুর, লুটপাটের মতো কাজগুলো করছে কিছু দুষ্কৃতকারী, বিপথগামী তরুণ। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যথাযথ মনে করা যায় না। তবু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই এ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক শাসনেও এর প্রচলন আছে। আর এ আশঙ্কা বা সম্ভাবনার কথাই গত সপ্তাহে প্রকাশ করলেন মিসরের সামরিক বাহিনীর প্রধান।
যারা জনগণের রায়কে থোড়াই তোয়াক্কা করে, তাদের দ্বারাই এখন মিসরের গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন।
লুণ্ঠনকারীরা যখন সরকারি অফিস থেকে মাথায় করে কম্পিউটার কিংবা টেলিভিশন নিয়ে যায়, আর সেই চিত্র সংবাদমাধ্যমে বিশ্বের মানুষ দেখতে পায়, তখন মিসরের মর্যাদা বলতে আর কিছু থাকে না।
এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে জাতীয়ভিত্তিক কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আর কার্যকর নেই। তাদের নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখন চুরি, দুর্নীতির মতো নানা অভিযোগে কারাবরণ করছেন। তাঁদের অনেকেরই এখনো প্রচুর অর্থব্যয়ের সামর্থ্য রয়েছে, যাঁরা সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা তৈরিতে ইন্ধন জোগাতে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, প্রচারমাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্টের অনুসারীরাও বসে নেই। সেখানে নির্বাচিত বর্তমান প্রেসিডেন্টকে বিদ্রূপ-ঠাট্টা ও তির্যক সমালোচনা করা হচ্ছে নির্লজ্জভাবে। তারা প্রচারমাধ্যমকে এখন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা তাহরির স্কোয়ারের জমায়েতকে বড় করে দেখাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টাই পুরনো শাসকদের অনুসারীদের কিছু মুখের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে সেসব টেলিভিশনে। তারা সংবাদ প্রচার করছে নেতিবাচক আর টক-শো প্রচার করছে বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে। এসব দেখে যে কেউ মনে করতে পারে, মিসরের পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
টেলিভিশনগুলোর অনেক বার্তা সম্পাদককে বিপ্লবের পর সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উপস্থাপকদের প্রায় সবাই রয়ে গেছে। থেকে যাওয়া লোকজনকে ওই সময় মনে হয়েছিল, তারাও বিপ্লবকে সমর্থন করছে। সুযোগ বুঝে এখন তারা বদলে গেছে। সেসব প্রচারকর্মী নেতিবাচক সংবাদ প্রচারে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গণতন্ত্রে সুস্থ সমালোচনা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু যে মুহূর্তে ব্যক্তি আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটে, তখন তাকে গণতন্ত্রের আওতায় ফেলা কঠিন। বিপ্লবে তাহরির স্কোয়ারে আত্মাহুতি দেওয়া মানুষের কারণে দেশে গণতান্ত্রিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সুযোগকে যদি গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা হয়, তা হবে দেশের জন্য মারাত্মক। তাদের মুখ থেকে এখন শোনা যায়, দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদান করতে হবে। কিন্তু স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিত হওয়ার সময় তারা এ কথাগুলো উচ্চারণ করেনি।
তবে এটাও ঠিক, দুই বছরে মানুষের মনে এক ধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছে। তারা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল, সেই আশা এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দ্রব্যমূল্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মতো কিছু চাহিদা পূরণ হয়নি এখনো। মিসরের মানুষের এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কি এটুকু সময়ই যথেষ্ট?
যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় যে অর্থনৈতিক মন্দা ছিল, তা মোকাবিলা করার জন্য তাঁকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ তাঁকে পুনর্নির্বাচিত করেছে।
প্রচারমাধ্যমগুলো এখন প্রচার করছে, দেশের উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হয়নি বর্তমান সরকারের আদর্শিক অবস্থানের কারণে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এখন জাতীয়ভিত্তিক সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের মানসিকতা ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে না। জনরায় যে সরকারের ভিত্তি, তাকে টিকিয়ে রাখার দায়ও অস্বীকার করা যাবে না। ইনশাআল্লাহ জনগণের বিজয় বহাল থাকবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে দেশ রক্ষা পাবে।
লেখক : ব্রিটিশ নাগরিক ও মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ইসলাম সম্পর্কিত ৯টি গ্রন্থের প্রণেতা।
দ্য ইজিপসিয়ান গ্যাজেট থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন।
No comments