রাজনীতির মৃত্যু নেই বেলাল বেগ
ব্যক্তি ও সমাজের ক্রমাগত মঙ্গলের জন্য
রাজনীতির আবির্ভাব হয়েছে। মানবকল্যাণের অবিরাম সংগ্রাম থেকে ছিটকে পড়লে কি
হয় তা রবীন্দ্রনাথ থেকে উপমা নিয়ে বলা যায়' ''যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না
পারে, সহস্র শৈবাল ধাম বাঁধে আসি তারে।
'' আবার রাজনীতির স্রোত শক্তিশালী থাকলে, তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে সকল অন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সমাজে ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আমাদের চিরসৃজনশীল, চিরঅস্থির বাঙালী জীবনে রাজনীতির এই ভাঙ্গাগড়া আমরা বহুবার দেখেছি। মধ্যযুগে 'মাৎস্যন্যায়' পরিস্থিতি থেকে গণতান্ত্রিক উপায়ে বেরিয়ে আসার পর শীত-বর্ষার নদীর মতো আমাদের রাজনৈতিক জীবনের স্রোত আজও প্রবাহমান। প্রবল পরাক্রানত্ম ব্র্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইন্ধনে পরিচালিত 'সাম্প্র্রদায়িকতা' ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও, বাঙালীর রাজনৈতিক শক্তি ১৯৫২ সালে আবার বর্ষার প্রমত্ত নদীর মতো দুর্বার জেগে ওঠে। তারই অবিরাম উত্তুঙ্গ তরাঙ্গাঘাতে বাঙালী স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন করেছে। স্বাধীনতা বাঙালীর রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের বেলাভূমিতে পদার্পণ করার পর বাঙালী জাতি এবার নিজেদের ভাল থাকার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরম্ন করল।
বাঙালীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক চিনত্মাগুলোর ম্যাগনাকার্টার নাম 'একুশ দফা'। ষাটের দশকে ঐ ম্যাগনাকার্টা এগারো দফা ও ছয় দফায় রূপানত্মরিত হয়েছিল। ঐ ল্যগুলোর বাসত্মবায়ন বন্ধ করার জন্যই পাকিসত্মান বাংলাদেশের জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম সুযোগেই বাঙালী তার স্বপ্নগুলোকে চিরকালের আদর্শ হিসেবে রাষ্ট্রের সংবিধানে অনত্মভর্ুক্ত করে নিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শত্রম্নরা জাতির পৃষ্ঠদেশে আবার ছুরিকাঘাত করলে, বাঙালী আরও একবার তার স্বপ্নের কপথ থেকে ছিটকে পড়ে। হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জামায়াত-বিএনপির ঐ অমঙ্গুলে ও পশ্চাতমুখী রাজনীতি অচিরেই জনগণ কতর্ৃক প্রত্যাখ্যাত হবে বলে এখন আশা করা যাচ্ছে। ওটি হলে, আবারও চারপাশে প্রগতির রাজনীতির শত ফুল ফুটবে। তারই আগমনী বার্তা হায়দার আকবর খান রনোর নতুন রাজনৈতিক পদচারণা। প্রগতিশীল রাজনীতির পোড়খাওয়া রাজনীতিক, হায়দার আকবর খান রনো গত কয়েক যুগের তথাকথিত চীনপন্থা ছেড়ে তথাকথিত মস্কোপন্থীদের দলে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিনত্মা ও ব্যবস্থাপনার েেত্র ১৯৭৫-এর 'একদলীয় শাসন' ধারণাটি ছিল সর্বশেষ। পাকিসত্মানী আমলের প্রায় শুরম্নু থেকে মহাত্মা মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত কমিউনিস্ট পার্টি গোপন সংগঠন হিসেবে কাজ করত। ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। দ্রম্নত উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা বিচার করে দল বিলুপ্ত করে কমিউনিস্টরা বাকশালেও যোগ দিয়েছিল। ভাগ্যিস! বাকশাল আলোর মুখ দেখেনি। বাকশাল কায়েম হলে শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অবিচল সংকল্প সুবিধাবাদের এলোমেলো বাতাসে উড়ে যেত অনেক আগে। বামপন্থী রাজনীতির অনুসারীগণ তাদের ত্যাগ-তিতিা, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও মেধা-মননশীলতার জন্য জনগণের কাছ থেকে আনত্মরিক শ্রদ্ধা ও প্রশংসা সব সময় পেয়ে এসেছে। তবে তাদের কখনই মতায় দেখতে চায়নি জনগণ। দলগুলোও মতায় যাবার প্রবল ইচ্ছা বা শক্তি প্রদর্শন করেনি। নেপথ্যে থেকে তারা রাজনীতির বিভিন্ন স্রোতের গতি-প্রকৃতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেণ এবং সাধ্যমতে সঠিক পথে চলায় সাহায্য করে চলেছে। উগ্রপন্থী ছাড়া বাকি বামপন্থীদের রাজনীতিতে নৈতিকতা থাকায় জনগণ দলে দলে তাদের পতাকাতলে যোগ না দিলেও, মনোযোগ দিয়ে তাদের বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধির চেষ্টা করত। স্বাধীনতাত্তোরকালে নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে এ েেত্রও বামপন্থীরা জনগণের মনোযোগ থেকে আরও অনেক দূরে সরে গেছে।
স্বাধীনতাত্তোর পরিস্থিতি মূল্যায়নে বামপন্থীরা খুব স্বচ্ছ ধ্যান-ধারণা তুলে ধরতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকে 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে একদল নিজেরা নিজেদের আন্দামানে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য অপ্রস্তুত, রক্তাক্ত, ত-বিত বাংলাদেশ যখন বিপর্যসত্ম দশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় মরীয়া, সিরাজ শিকদারগণ বিপস্নবের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন; ছাত্র ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরম্নদ্ধে জঙ্গী মিছিলে বের হয়েছিল। বাসত্মবতা অনুধাবন করে কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য পরবর্তীকালে জাতীয় বুর্জোয়া নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও চার শীর্ষ আওয়ামী নেতাকে হত্যা করে, একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি গোপনে বাংলাদেশের দখল নিয়ে নিলে, বাংলাদেশে রাজনীতির বিকাশ রম্নদ্ধ হয়ে যায়। জাতীয় বুর্জোয়াকে আবারও স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরম্নদ্ধারের সংগ্রামে নামতে হয়। তাদের বিরম্নদ্ধে এ সময় এক দল বামপন্থীও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সাপ্রদায়িক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল। চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সমর্থন না পেলে সেদিন জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে নাকই গলাতে পারতেন না। জাসদ, বাসদ ইত্যাদি নামের দলগুলোও বামচিনত্মার নামে আরও অনেক আবর্জনা তৈরি করেছিল।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিপস্নবমুখী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া ও চীনের তাত্তি্বক দ্বন্দ্বের জের হিসেবে নিজেদের ভেতর বিভক্তির জন্ম দিল। দ্বিখ-িত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো মতিয়া-মেননের ছাত্র ইউনিয়ন, ভাসানী-মোজাফফরের ন্যাপ, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সময় বাজারে যে বিদ্রূপটি চালু হয়েছিল_'মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকাতে ছাতা ধরে' তার তাৎপর্য এতকাল পরে এখন বোঝা যাচ্ছে। বাসত্মবতার কঠিন আলোকে মেনন ও মতিয়া এবং তাঁদের সহযোদ্ধাদের অনেকে এখন চৌদ্দ দল নামের বড় ছাতার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। ( চীন-মস্কোতে বৃষ্টির সময়ে ঢাকায় ছাতা না ধরলে এখন কি হতে পারত, পাঠক একবার ভেবে দেখেন)।
মেঘে মেঘে বেলা এখন অনেক হয়ে গেছে। অগি্নকন্যা মতিয়া চৌধুরী এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাপি্নক রাশেদ খান মেননের মুখে বয়সের বলিরেখা ক্রমশ গভীর হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সকল পেশার মানুষ এবং সকল প্রতিষ্ঠানের ভাল-মন্দের ৩৮ বছরের রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। ধর্মান্ধতা ও পশ্চাদপদতার অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, আইনের শাসনের কথা জোরালো হচ্ছে। মানুষ 'নষ্ট'র বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে, তাকাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আর ক'দিন পরে সাম্প্র্রদায়িকতার কুজ্ঝটিকা কেটে গেলে, শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী, জ্ঞানভিত্তিক, কর্মময়, আনন্দময় এবং পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের ডাক এসে যাবে প্রতিটি নাগরিকের কাছে। ইতোমধ্যে বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে কম্পিউটার, টেলিভিশন, রেডিও, পত্র-পত্রিকা, গৃহফোন, সেলফোন, প্রকাশনা-শিল্পের বিপুল বিসত্মার এবং বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা, মহাজাগতিক আকর্ষণের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনেও জাগরনের জোয়ার আনতে শুরম্নু করেছে। সে সর্বাধুনিক সমাজ গড়ে তোলার প্রস্তুতিই হবে প্রকৃত রাজনীতিকদের এখনকার কাজ। আমার বিশ্বাস, হায়দার আকবর খান রনোরা সে উদ্দেশ্যেই নিজেদের অতীত দুর্বলতাগুলো ঝেড়ে ফেলে কমিউনিস্ট চিনত্মার মানুষের পুনঃসংঘবদ্ধ করার চেষ্টায় কাজে নেমেছেন। প্রগতিশীল মানুষগুলো সমাজের দায়িত্ব নিক, এটা কিন্তু সকল মানুষের অনত্মরের কথা।
তবে তার আগে কয়টি কথা :
সমাজ দেহ থেকে পঁচাত্তরে ঢুকিয়ে দেয়া সমসত্ম বিষ সম্পূর্ণভাবে বের করে দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীসহ, সকল রাজনৈতিক ও সামরিক হত্যাকা-ের বিচার হতে হবে; স্বাধীনতার শত্রম্নু হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে তার মূলসহ উপড়ে ফেলতে হবে
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে তাত্তি্বক রাজনীতির বাইরে ১৮ বছরের নিম্নবয়স্কদের জন্য সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করতে হবে।
নানা কারণে কমিউনিস্ট নামের সেই জাদু আর নেই। কমিউনিজম হয়তো এখন সমাজ বিজ্ঞানের জাদুঘরে ঠাই পেয়েছে কিন্তু বেঁচে আছে তার অমর অয় মানবমুক্তির আদর্শ: 'প্রত্যেকে তার সাধ্যমতো দেবে আর প্রয়োজন মতো পাবে।' এই আদর্শের মশাল আলোকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিতেই একটি নতুন পার্টি দাঁড় করাতে হবে যেটি উপযুক্ত, দ, প্রশিতি নেতাকর্মী নিয়ে ভবিষ্যতে মতায় যাবার প্রস্তুতি নেবে। স্বাধীনতাত্তোর উচ্ছৃঙ্খল ও ষড়যন্ত্রমূলক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সাংঘার্ষিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে মতায় থাকা, সর্ববিধ কলঙ্কে কলঙ্কিত জাতীয় বুর্জোয়া দলগুলোর অপরাধী চেহারা জনগণ আর বেশি দিন দেখতে চাইবে না বলেই তাদের স্থলাভিষিক্ত হবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগোতে হবে। আর বিপস্নবের বুলি নয়, এখন চাই সমঅধিকার ও জ্ঞানভিত্তিক জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটাকে কেউ সোনার বাংলা বলতে চাইলে বলুক।
আমাদের চিরসৃজনশীল, চিরঅস্থির বাঙালী জীবনে রাজনীতির এই ভাঙ্গাগড়া আমরা বহুবার দেখেছি। মধ্যযুগে 'মাৎস্যন্যায়' পরিস্থিতি থেকে গণতান্ত্রিক উপায়ে বেরিয়ে আসার পর শীত-বর্ষার নদীর মতো আমাদের রাজনৈতিক জীবনের স্রোত আজও প্রবাহমান। প্রবল পরাক্রানত্ম ব্র্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইন্ধনে পরিচালিত 'সাম্প্র্রদায়িকতা' ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও, বাঙালীর রাজনৈতিক শক্তি ১৯৫২ সালে আবার বর্ষার প্রমত্ত নদীর মতো দুর্বার জেগে ওঠে। তারই অবিরাম উত্তুঙ্গ তরাঙ্গাঘাতে বাঙালী স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন করেছে। স্বাধীনতা বাঙালীর রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের বেলাভূমিতে পদার্পণ করার পর বাঙালী জাতি এবার নিজেদের ভাল থাকার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরম্ন করল।
বাঙালীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক চিনত্মাগুলোর ম্যাগনাকার্টার নাম 'একুশ দফা'। ষাটের দশকে ঐ ম্যাগনাকার্টা এগারো দফা ও ছয় দফায় রূপানত্মরিত হয়েছিল। ঐ ল্যগুলোর বাসত্মবায়ন বন্ধ করার জন্যই পাকিসত্মান বাংলাদেশের জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম সুযোগেই বাঙালী তার স্বপ্নগুলোকে চিরকালের আদর্শ হিসেবে রাষ্ট্রের সংবিধানে অনত্মভর্ুক্ত করে নিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শত্রম্নরা জাতির পৃষ্ঠদেশে আবার ছুরিকাঘাত করলে, বাঙালী আরও একবার তার স্বপ্নের কপথ থেকে ছিটকে পড়ে। হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত জামায়াত-বিএনপির ঐ অমঙ্গুলে ও পশ্চাতমুখী রাজনীতি অচিরেই জনগণ কতর্ৃক প্রত্যাখ্যাত হবে বলে এখন আশা করা যাচ্ছে। ওটি হলে, আবারও চারপাশে প্রগতির রাজনীতির শত ফুল ফুটবে। তারই আগমনী বার্তা হায়দার আকবর খান রনোর নতুন রাজনৈতিক পদচারণা। প্রগতিশীল রাজনীতির পোড়খাওয়া রাজনীতিক, হায়দার আকবর খান রনো গত কয়েক যুগের তথাকথিত চীনপন্থা ছেড়ে তথাকথিত মস্কোপন্থীদের দলে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিনত্মা ও ব্যবস্থাপনার েেত্র ১৯৭৫-এর 'একদলীয় শাসন' ধারণাটি ছিল সর্বশেষ। পাকিসত্মানী আমলের প্রায় শুরম্নু থেকে মহাত্মা মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত কমিউনিস্ট পার্টি গোপন সংগঠন হিসেবে কাজ করত। ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। দ্রম্নত উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা বিচার করে দল বিলুপ্ত করে কমিউনিস্টরা বাকশালেও যোগ দিয়েছিল। ভাগ্যিস! বাকশাল আলোর মুখ দেখেনি। বাকশাল কায়েম হলে শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অবিচল সংকল্প সুবিধাবাদের এলোমেলো বাতাসে উড়ে যেত অনেক আগে। বামপন্থী রাজনীতির অনুসারীগণ তাদের ত্যাগ-তিতিা, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও মেধা-মননশীলতার জন্য জনগণের কাছ থেকে আনত্মরিক শ্রদ্ধা ও প্রশংসা সব সময় পেয়ে এসেছে। তবে তাদের কখনই মতায় দেখতে চায়নি জনগণ। দলগুলোও মতায় যাবার প্রবল ইচ্ছা বা শক্তি প্রদর্শন করেনি। নেপথ্যে থেকে তারা রাজনীতির বিভিন্ন স্রোতের গতি-প্রকৃতি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেণ এবং সাধ্যমতে সঠিক পথে চলায় সাহায্য করে চলেছে। উগ্রপন্থী ছাড়া বাকি বামপন্থীদের রাজনীতিতে নৈতিকতা থাকায় জনগণ দলে দলে তাদের পতাকাতলে যোগ না দিলেও, মনোযোগ দিয়ে তাদের বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধির চেষ্টা করত। স্বাধীনতাত্তোরকালে নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে এ েেত্রও বামপন্থীরা জনগণের মনোযোগ থেকে আরও অনেক দূরে সরে গেছে।
স্বাধীনতাত্তোর পরিস্থিতি মূল্যায়নে বামপন্থীরা খুব স্বচ্ছ ধ্যান-ধারণা তুলে ধরতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকে 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে একদল নিজেরা নিজেদের আন্দামানে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য অপ্রস্তুত, রক্তাক্ত, ত-বিত বাংলাদেশ যখন বিপর্যসত্ম দশা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় মরীয়া, সিরাজ শিকদারগণ বিপস্নবের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন; ছাত্র ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরম্নদ্ধে জঙ্গী মিছিলে বের হয়েছিল। বাসত্মবতা অনুধাবন করে কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য পরবর্তীকালে জাতীয় বুর্জোয়া নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও চার শীর্ষ আওয়ামী নেতাকে হত্যা করে, একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি গোপনে বাংলাদেশের দখল নিয়ে নিলে, বাংলাদেশে রাজনীতির বিকাশ রম্নদ্ধ হয়ে যায়। জাতীয় বুর্জোয়াকে আবারও স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরম্নদ্ধারের সংগ্রামে নামতে হয়। তাদের বিরম্নদ্ধে এ সময় এক দল বামপন্থীও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সাপ্রদায়িক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল। চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সমর্থন না পেলে সেদিন জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে নাকই গলাতে পারতেন না। জাসদ, বাসদ ইত্যাদি নামের দলগুলোও বামচিনত্মার নামে আরও অনেক আবর্জনা তৈরি করেছিল।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিপস্নবমুখী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া ও চীনের তাত্তি্বক দ্বন্দ্বের জের হিসেবে নিজেদের ভেতর বিভক্তির জন্ম দিল। দ্বিখ-িত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো মতিয়া-মেননের ছাত্র ইউনিয়ন, ভাসানী-মোজাফফরের ন্যাপ, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সময় বাজারে যে বিদ্রূপটি চালু হয়েছিল_'মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকাতে ছাতা ধরে' তার তাৎপর্য এতকাল পরে এখন বোঝা যাচ্ছে। বাসত্মবতার কঠিন আলোকে মেনন ও মতিয়া এবং তাঁদের সহযোদ্ধাদের অনেকে এখন চৌদ্দ দল নামের বড় ছাতার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। ( চীন-মস্কোতে বৃষ্টির সময়ে ঢাকায় ছাতা না ধরলে এখন কি হতে পারত, পাঠক একবার ভেবে দেখেন)।
মেঘে মেঘে বেলা এখন অনেক হয়ে গেছে। অগি্নকন্যা মতিয়া চৌধুরী এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাপি্নক রাশেদ খান মেননের মুখে বয়সের বলিরেখা ক্রমশ গভীর হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সকল পেশার মানুষ এবং সকল প্রতিষ্ঠানের ভাল-মন্দের ৩৮ বছরের রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। ধর্মান্ধতা ও পশ্চাদপদতার অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, আইনের শাসনের কথা জোরালো হচ্ছে। মানুষ 'নষ্ট'র বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে, তাকাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। আর ক'দিন পরে সাম্প্র্রদায়িকতার কুজ্ঝটিকা কেটে গেলে, শোষণমুক্ত, সাম্যবাদী, জ্ঞানভিত্তিক, কর্মময়, আনন্দময় এবং পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের ডাক এসে যাবে প্রতিটি নাগরিকের কাছে। ইতোমধ্যে বিশ্বসভ্যতার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে কম্পিউটার, টেলিভিশন, রেডিও, পত্র-পত্রিকা, গৃহফোন, সেলফোন, প্রকাশনা-শিল্পের বিপুল বিসত্মার এবং বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা, মহাজাগতিক আকর্ষণের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনেও জাগরনের জোয়ার আনতে শুরম্নু করেছে। সে সর্বাধুনিক সমাজ গড়ে তোলার প্রস্তুতিই হবে প্রকৃত রাজনীতিকদের এখনকার কাজ। আমার বিশ্বাস, হায়দার আকবর খান রনোরা সে উদ্দেশ্যেই নিজেদের অতীত দুর্বলতাগুলো ঝেড়ে ফেলে কমিউনিস্ট চিনত্মার মানুষের পুনঃসংঘবদ্ধ করার চেষ্টায় কাজে নেমেছেন। প্রগতিশীল মানুষগুলো সমাজের দায়িত্ব নিক, এটা কিন্তু সকল মানুষের অনত্মরের কথা।
তবে তার আগে কয়টি কথা :
সমাজ দেহ থেকে পঁচাত্তরে ঢুকিয়ে দেয়া সমসত্ম বিষ সম্পূর্ণভাবে বের করে দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীসহ, সকল রাজনৈতিক ও সামরিক হত্যাকা-ের বিচার হতে হবে; স্বাধীনতার শত্রম্নু হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে তার মূলসহ উপড়ে ফেলতে হবে
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে তাত্তি্বক রাজনীতির বাইরে ১৮ বছরের নিম্নবয়স্কদের জন্য সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করতে হবে।
নানা কারণে কমিউনিস্ট নামের সেই জাদু আর নেই। কমিউনিজম হয়তো এখন সমাজ বিজ্ঞানের জাদুঘরে ঠাই পেয়েছে কিন্তু বেঁচে আছে তার অমর অয় মানবমুক্তির আদর্শ: 'প্রত্যেকে তার সাধ্যমতো দেবে আর প্রয়োজন মতো পাবে।' এই আদর্শের মশাল আলোকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিতেই একটি নতুন পার্টি দাঁড় করাতে হবে যেটি উপযুক্ত, দ, প্রশিতি নেতাকর্মী নিয়ে ভবিষ্যতে মতায় যাবার প্রস্তুতি নেবে। স্বাধীনতাত্তোর উচ্ছৃঙ্খল ও ষড়যন্ত্রমূলক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সাংঘার্ষিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে মতায় থাকা, সর্ববিধ কলঙ্কে কলঙ্কিত জাতীয় বুর্জোয়া দলগুলোর অপরাধী চেহারা জনগণ আর বেশি দিন দেখতে চাইবে না বলেই তাদের স্থলাভিষিক্ত হবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগোতে হবে। আর বিপস্নবের বুলি নয়, এখন চাই সমঅধিকার ও জ্ঞানভিত্তিক জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটাকে কেউ সোনার বাংলা বলতে চাইলে বলুক।
No comments