হাত পাখায় লেখা পাকিস্তান জিন্দাবাদ কর্তার সিং দুগাল by অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী
মেয়েটির আসল নাম রাম রাখি। এখন অবশ্য ওর নাম রাখা হয়েছে আল্লা রাখি। আগে ডাকা হতো রাখি নামে, এখনো এসই নাম ধরে ডাকা হয়। সেই ভয়াবহ রাতে যখন দামামা বাজল,
সেস্নাগানের শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল, আকাশ কাঁপল, বল্লম ঝলসে উঠল, মাটি
কাঁপল, রাখি লাফিয়ে বিছানা ছাড়ল। আধ-ঘুমনত্ম রাখি বাড়ির সীমানা দেয়াল বেয়ে
উপরে উঠল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচে। মাঠঘাট পেরিয়ে গ্রামের বাইরে একটা
ডোবাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
সারা রাত সেখানেই ছিল। গ্রামের দিকে গোলাগুলির শব্দে রাখির কান বধির হয়ে আসছে। তারপরও স্বজনদের চিৎকার ও সাহায্যের আবেদন তার কানে পৌঁছেছে। খুব কাছের মানুষদের হতাশা ও বিলাপের শব্দও সে শুনছে।
তারপর সব শব্দ মিলিয়ে গেল। এবার মৃত্যুর নীরবতা।
পরদিন সকালে অন্যসব দিনের মতই নিত্যকার কাজকর্ম নিয়ে গ্রাম জমে উঠল। গরম্নর গলায় বাঁধা ঘন্টার সুরধ্বনি ভেসে এল। ঘাস খেতে মাঠে যাবার পথে গরম্নগুলোর একটা অন্যটাকে ধাক্কা দিল। গরম্নগাড়ির পাশিয়ান চাকার ঘষটানিতে বিকট সুর সৃষ্টি হল।
আকাশে আবার আগের মত দল বাঁধা পাখিদের উড়াউড়ি। মুয়াজ্জিন নামাজের আযান দিলেন। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাঠা ফেটে ঘি বানানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে।
ভোর হতেই রাখি লুকোবার গোপন জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। হেঁটে হেঁটে এগোল মুসলমান প্রতিবেশীদের বাড়ির দিকে। এরা হাসছে, কথা বলছে। কিন্তু রাখিকে দেখা মাত্র মুহূর্তেই সবাই থ হয়ে গেল।
মেয়েরা ভাবল, তাহলে কি রাখির মৃতদেহ জেগে উঠেছে?
পুরম্নষরা ভাবল, এ কি ভোজবাজি! তারা কি সবাই প্রতারিত হচ্ছে?
যুবক শেরবাজ মহাখাপ্পা। চোখে তার রক্ত জমছে, ক্রোধে স্নায়ুতন্ত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে। চারপেয়ের নিচ থেকে কুড়াল বের করে রাখির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শেরবাজ দেখল তার মা আর বোন এই কাফির মেয়েটিকে আগলে রেখেছে। অসহায় অবস্থায় সে ফিরে এল।
তখন থেকেই শের বাজ ভেবে আসছে_ এই মেয়েটির ৰতি করার কথা সে ভাবতে পারল কেমন করে?
কুড়ালটি বরাবরই তাকে এই নির্মমতার কথা মনে করিয়ে দিল। যতবারই এজন্য লজ্জিত বোধ করেছে, ভেবেছে কুড়ালটা সবচেয়ে কাছের কূপটিকে ফেলে দেবে। রাখিকে হত্যা করার জন্য শেরবাজ যেখানে ছুটে গিয়েছিল, সেখানেই বিয়ের পিঁড়ি পেতে রাখি বসে থাকে ঘন্টার পর ঘণ্টা। ঠিক যেভাবে বসে থাকত তার শাশুড়ি এবং যৌবনে এ শাশুড়ির শাশুড়ি।
অন্ধ ক্রোধে একদিন সে রাখিকে জবাই করতে ছুটেছিল আর পরদিনই তাকে বিয়ে করে বউ হিসেবে তুলে নিয়ে আসে, জীবনে মরণে তাকে ভালোবাসার অঙ্গীকার করে। সে সব সময়ই রাখিকে পছন্দ করে বসেছে। ছোটবেলায় তাদের গলিতে রাখিকে নিয়ে এক সাথে খেলেছে। যখন রাখি বড় হয়ে উঠেছে, শেরবাজ তার জন্য অনেক গানও গেয়েছে। বছরের পর বছর এই মেয়েটি স্বপ্নে তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কেমন করেই না সে আমের ঘন বাগানে নিজেকে লুকিয়ে রেখে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা তার পানি আনতে যাওয়া ও ফিরে আসা অনুসরণ করেছে।
শেরবাজের সাথে বিয়ের পর রাখি নিজেকে সবার প্রিয়জনে পরিণত করে। শাশুড়ি তাকে বিশেষভাবে পছন্দ করে। প্রতিদিন সকালে সে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে, গরম্ন ছাগল খাওযাচ্ছে, গরম্নর দুধ দোহাচ্ছে, কুয়া থেকে পানি আনছে এবং গোটা পরিবারের জন্য রান্নাবান্না করছে। দুপুরের খাবারের পর যখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে রাখি তখন প্রতিবেশী মেয়েদের সেলাই ঐ এম্রয়ডারি, পড়া ও লেখা শেখাচ্ছে। বাড়িঘর পরিষ্কার ও ঝকঝকে রাখছে, গার্হস্থ্য কোন বিষয়ে শাশুড়িকে চিনত্মা করার সুযোগই দিচ্ছে না, ছোটবড় সব দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে।
গ্রামের সকলেই বিস্ময়ে তাকে দেখেছে। সবার সাথেই তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। নাচে গানে তার কাছাকাছি কেউ নেই। কারো চোখের পীড়া, রাখি তার চোখে লাগিয়ে দিল এক চিমটি কলিরিয়াম, চোখ সেরে গেল। কারো জ্বর তো রাখি এমন একটা সুরম্নয়া খাওযার পরামর্শ দিল, রোগী ভাল হয়ে গেল। তার রান্নার রেসিপির প্রসিদ্ধি গ্রামজুড়ে। তরম্নণীরা যারা তাদের জীবনের গোপন কথাটি জানাতে চায় তাদের সবার পছন্দ রাখি; বিশ্বাস করার মত সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। পিপুল গাছের নিচে দোলনায় বসে রাখি অবাক হয়ে ভাবছে যেখানে মানুষের জন্ম, যেখানে বড় হয়েছে সেই গ্রাম ছেড়ে মানুষ চলে যায় কেমন করে। খালের স্বচ্ছ পানি নিজের মুখমন্ডলে ছিটাতে গিয়ে ভাবে মানুষ কেমন করে তার চুলো ও চালের কথা ভুলে থাকে। রাখি সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটে আর ভাবে তার গ্রামের মত এমন উর্বর স্থান কী পৃথিবীর কোথাও আছে? সে অনুভব করে পূর্ণাঙ্গভাবে বেড়ে ওঠা গ্রামের গাছগুলো যারা চলে গেছে তাদের প্রতীৰায় আছে। তাদের অনুপস্থিতিতে রাসত্মাঘাট নিঃসঙ্গ। দেবদেবীরা ভক্তদের আহ্বান জানাচ্ছে যেন তারা ফিরে এসে তাদের অর্ঘ্য নিবেদন করে।
একদিন একজন পাকিসত্মানি রাজনৈতিক নেতা তাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে যায়। রাখি তার জন্য এক স্মরণীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে। তারা ফুলের মালায় তার নালা ভরে দেয় তার চলার পথে ছড়িয়ে রাখে গোলাপের কুঁড়ি। আর 'পাকিসত্মান জিন্দাবাদ' সেস্নাগান দিতে দিতে তাদের কণ্ঠস্বর।
রাখি সুখী, বেশ সুখী। প্রশানত্মির মধ্যে দিন, সপ্তাহ ও মাস কেটে যায়। হঠাৎ এক বন্ধুর বাড়িতে যাবার সময় একদিন সে ডাক শোনে, 'এই রাখি!' পর মুহূর্তে সে নিজেকে আবিষ্কার করে তার ভাইয়ের বাহুবন্ধনে।
রাখি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দু'জনেই অনন্দাশ্রম্ন বর্ষণ করল, একজন অন্যজনকে দীর্ঘৰণ ধরে জড়িয়ে রাখল। এতদিন পর ভাইকে পেয়ে রাখি শিশুর মত কাঁদল। তাদের পাশে একদিন আগন্তুক যে অপেৰা করছে তা রাখির চোখেও পড়েনি। তাকে পুলিশ অফিসারদের মত মনে হচ্ছে।
অতিথিদের তার বাড়িতে আসার কথা বলার আগেই তার ভাই আগন্তুককে বলল, 'এটা আমার বোন রাখি, তাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে হবে।' একটু দেরিতে হলে তীৰ্নস্বরে রাখি জিজ্ঞেস করল, 'কিন্তু কোথায়?' নিজের গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে তার নেই। অজানা অচেনা জায়গায় সে যাবে না।
যে রাসত্মায় সে খেলেছে, বড় হয়েছে তা ছেড়ে যাবে কেমন করে? যে মাঠে ছুটে বেড়িয়েছে, প্রেম ও আনন্দের গান গেয়েছে তা ত্যাগ করবে কিভাবে? যেখানে বান্ধবীদের সাথে নিত্য সাৰাৎ করেছে, হৃদয়ের গোপন কথা ভাগাভাগি করেছে সেই জায়গাটা ছেড়ে যাবে?
সন্ধ্যায় মহিষ দোহানোর কাজটা সেরে মার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে_ এই মহিষকে ফেলে সে কোথাও যাবে না। আঙ্গুর বাগানে পানি দেবার সময় গাছের কাছে জবান দিয়েছে পাকা আঙ্গুর সে খাবেই। গরম্নর কানে কানে বলেছে আগামী বসনত্মে বাছুর দেখতে চাই। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে কেঁদে ওঠে, 'এটা আমার ঘর, আমি ও এ ঘর ছেড়ে যেতে পারব না।'
রাত হলে পশ্চিমা বাতাস বইতে শুরম্ন করে। আঙ্গিনায় বসে চাঁদের আলোয় তার মুগ্ধতা বেড়ে যায়। এ জীবনে যত সাধু ও দরবেশের সাথে দেখা হয়েছে সাহায্যের জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করে। দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় যে ডোবাতে লাফিয়ে পড়ত, কেউ খুঁজে পেত না, সেই ডোবাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এখন তা কেমন করে করবে?
তার জরায়ুতে শেরবাজের অমূল্য উপহার। এটাকে নিয়ে কি করে লাফিয়ে পড়বে?
রাখি বার বার তাকে জিজ্ঞেস করেছে, 'শেরবাজ তোমার কুড়ালের কি হল?'
মোড়লের বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই হতবুদ্ধ হয়ে শেরবাজ সেই যে শুয়ে আছে, শুয়েই আছে। একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। এক দানা খাবারও খায়নি। রাখি আবার বলল, শেরবাজ তোমার সাথে থাকার জন্য আমি এমন একশত ভাই ছেড়ে আসতে পারি।'
কিন্তু শেরবাজ নিশ্চুপ, তার চোখ অশ্রম্ন ভরভর। রাখি শেষ পর্যনত্ম বলল, শেরবাজ চল, এখান থেকে পালিয়ে যাই।'
মনে হচ্ছে শেরবাজের প্রচ- জ্বর। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।
সে কী-ই বা বলবে। মোড়ল সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, রাখি জন্মগ্রহণ করেছে হিন্দুর ঘরে। তার মা-বাবা সব ছেড়ে হিন্দুসত্মানে চলে গেছে, রাখিকেও তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
দেশ ভাগের দাঙ্গায় যারা ধর্মানত্মরিত হয়েছে সব বাতিল হয়ে গেছে। রাখিকে অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে, যাতে তার বিনিময়ের একটি অপহৃত মুসলমান মেয়েকে ভারত থেকে পাকিসত্মানে আনা যায়। এটি সরকারের সিদ্ধানত্ম। পাকিসত্মানের জন্য এটুকু আত্মত্যাগ করতেই হবে।
কি করবে শেরবাজ জানে না। আর একবার অজ্ঞান হবার জন্যই তার জ্ঞান ফিরল। পরদিন ভোর না হতেই তাদের আঙ্গিনায় একটি জিপ প্রবেশ করল। গাড়িতে সশস্ত্র পুলিশ দেখে রাখি চিৎকার করে কাঁদতে শুরম্ন করল, "আমি যাব না। আমি কখনও আমার গ্রাম ছেড়ে যাব না। নাম বদলালে কী এসে যায়? এটা আমার দেশ। এই উঠান আমার, আমি সন্ধ্যায় ঝাট দেই। এই গাছপালা আমার। আমি সকাল-সন্ধ্যায় পানি ঢালি। এই রাসত্মা আমার, আমি ছোটবেলা থেকেই এখানে েখলাধুলা করছি।"
তার চোখে অশ্রম্নধারা। "শেরবাজ, তুমি কথা বলছ না কেন?'
কাতর হয়ে স্বামীকে বলল, 'তুমি একটা কথাও বলছ না কেন? আমার পেটে তোমার সনত্মান, একে নিয়ে আমি কি করব?" রাখি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
শেরবাজ আর রাখি তাদের রম্নমে। মোড়ল ব্যাপারটা আর একবার ভাবল, গ্রামের মুরম্নবি্বদের সাথে আলোচনা হল। কথা হল পুলিশ অফিসারের সাথে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটা সরকারের সিদ্ধানত্ম, তা মানতেই হবে। প্রিয় দেশ পাকিসত্মানের জন্য কোন ত্যাগই বড় কিছু নয়।
তারপর দরজা খুলে গেল। রাখি সামনে পেছনে শেরবাজখান। রাখি ধনী মানুষদের বিয়ের পোশাকে সেজেছে। তার যা আছে সব অলঙ্কার পরেছে। তাকে এভাবে দেখে সকলেই সত্মম্ভিত।
রাখি গাড়িতে বসামাত্র শেরবাজ খান এক ট্রাঙ্ক ভর্তি তার পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য জিনিস গাড়িতে তুলে দিল। আবার গিয়ে নিয়ে এল একটা পাত্র, যার গায়ে খোদাই করা তার নাম_ শেরবাজ খান। শেষবার ছুটে গিয়ে রাখির জন্য নিয়ে এল একটি পাটের হাত পাখা যার গায়ে রাখি নিজ হাতে নকশিকর্ম করে লিখেছে "পাকিসত্মান জিন্দাবাদ।"
সারা রাত সেখানেই ছিল। গ্রামের দিকে গোলাগুলির শব্দে রাখির কান বধির হয়ে আসছে। তারপরও স্বজনদের চিৎকার ও সাহায্যের আবেদন তার কানে পৌঁছেছে। খুব কাছের মানুষদের হতাশা ও বিলাপের শব্দও সে শুনছে।
তারপর সব শব্দ মিলিয়ে গেল। এবার মৃত্যুর নীরবতা।
পরদিন সকালে অন্যসব দিনের মতই নিত্যকার কাজকর্ম নিয়ে গ্রাম জমে উঠল। গরম্নর গলায় বাঁধা ঘন্টার সুরধ্বনি ভেসে এল। ঘাস খেতে মাঠে যাবার পথে গরম্নগুলোর একটা অন্যটাকে ধাক্কা দিল। গরম্নগাড়ির পাশিয়ান চাকার ঘষটানিতে বিকট সুর সৃষ্টি হল।
আকাশে আবার আগের মত দল বাঁধা পাখিদের উড়াউড়ি। মুয়াজ্জিন নামাজের আযান দিলেন। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাঠা ফেটে ঘি বানানোর শব্দও শোনা যাচ্ছে।
ভোর হতেই রাখি লুকোবার গোপন জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। হেঁটে হেঁটে এগোল মুসলমান প্রতিবেশীদের বাড়ির দিকে। এরা হাসছে, কথা বলছে। কিন্তু রাখিকে দেখা মাত্র মুহূর্তেই সবাই থ হয়ে গেল।
মেয়েরা ভাবল, তাহলে কি রাখির মৃতদেহ জেগে উঠেছে?
পুরম্নষরা ভাবল, এ কি ভোজবাজি! তারা কি সবাই প্রতারিত হচ্ছে?
যুবক শেরবাজ মহাখাপ্পা। চোখে তার রক্ত জমছে, ক্রোধে স্নায়ুতন্ত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে। চারপেয়ের নিচ থেকে কুড়াল বের করে রাখির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শেরবাজ দেখল তার মা আর বোন এই কাফির মেয়েটিকে আগলে রেখেছে। অসহায় অবস্থায় সে ফিরে এল।
তখন থেকেই শের বাজ ভেবে আসছে_ এই মেয়েটির ৰতি করার কথা সে ভাবতে পারল কেমন করে?
কুড়ালটি বরাবরই তাকে এই নির্মমতার কথা মনে করিয়ে দিল। যতবারই এজন্য লজ্জিত বোধ করেছে, ভেবেছে কুড়ালটা সবচেয়ে কাছের কূপটিকে ফেলে দেবে। রাখিকে হত্যা করার জন্য শেরবাজ যেখানে ছুটে গিয়েছিল, সেখানেই বিয়ের পিঁড়ি পেতে রাখি বসে থাকে ঘন্টার পর ঘণ্টা। ঠিক যেভাবে বসে থাকত তার শাশুড়ি এবং যৌবনে এ শাশুড়ির শাশুড়ি।
অন্ধ ক্রোধে একদিন সে রাখিকে জবাই করতে ছুটেছিল আর পরদিনই তাকে বিয়ে করে বউ হিসেবে তুলে নিয়ে আসে, জীবনে মরণে তাকে ভালোবাসার অঙ্গীকার করে। সে সব সময়ই রাখিকে পছন্দ করে বসেছে। ছোটবেলায় তাদের গলিতে রাখিকে নিয়ে এক সাথে খেলেছে। যখন রাখি বড় হয়ে উঠেছে, শেরবাজ তার জন্য অনেক গানও গেয়েছে। বছরের পর বছর এই মেয়েটি স্বপ্নে তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কেমন করেই না সে আমের ঘন বাগানে নিজেকে লুকিয়ে রেখে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা তার পানি আনতে যাওয়া ও ফিরে আসা অনুসরণ করেছে।
শেরবাজের সাথে বিয়ের পর রাখি নিজেকে সবার প্রিয়জনে পরিণত করে। শাশুড়ি তাকে বিশেষভাবে পছন্দ করে। প্রতিদিন সকালে সে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে, গরম্ন ছাগল খাওযাচ্ছে, গরম্নর দুধ দোহাচ্ছে, কুয়া থেকে পানি আনছে এবং গোটা পরিবারের জন্য রান্নাবান্না করছে। দুপুরের খাবারের পর যখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে রাখি তখন প্রতিবেশী মেয়েদের সেলাই ঐ এম্রয়ডারি, পড়া ও লেখা শেখাচ্ছে। বাড়িঘর পরিষ্কার ও ঝকঝকে রাখছে, গার্হস্থ্য কোন বিষয়ে শাশুড়িকে চিনত্মা করার সুযোগই দিচ্ছে না, ছোটবড় সব দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছে।
গ্রামের সকলেই বিস্ময়ে তাকে দেখেছে। সবার সাথেই তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। নাচে গানে তার কাছাকাছি কেউ নেই। কারো চোখের পীড়া, রাখি তার চোখে লাগিয়ে দিল এক চিমটি কলিরিয়াম, চোখ সেরে গেল। কারো জ্বর তো রাখি এমন একটা সুরম্নয়া খাওযার পরামর্শ দিল, রোগী ভাল হয়ে গেল। তার রান্নার রেসিপির প্রসিদ্ধি গ্রামজুড়ে। তরম্নণীরা যারা তাদের জীবনের গোপন কথাটি জানাতে চায় তাদের সবার পছন্দ রাখি; বিশ্বাস করার মত সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। পিপুল গাছের নিচে দোলনায় বসে রাখি অবাক হয়ে ভাবছে যেখানে মানুষের জন্ম, যেখানে বড় হয়েছে সেই গ্রাম ছেড়ে মানুষ চলে যায় কেমন করে। খালের স্বচ্ছ পানি নিজের মুখমন্ডলে ছিটাতে গিয়ে ভাবে মানুষ কেমন করে তার চুলো ও চালের কথা ভুলে থাকে। রাখি সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটে আর ভাবে তার গ্রামের মত এমন উর্বর স্থান কী পৃথিবীর কোথাও আছে? সে অনুভব করে পূর্ণাঙ্গভাবে বেড়ে ওঠা গ্রামের গাছগুলো যারা চলে গেছে তাদের প্রতীৰায় আছে। তাদের অনুপস্থিতিতে রাসত্মাঘাট নিঃসঙ্গ। দেবদেবীরা ভক্তদের আহ্বান জানাচ্ছে যেন তারা ফিরে এসে তাদের অর্ঘ্য নিবেদন করে।
একদিন একজন পাকিসত্মানি রাজনৈতিক নেতা তাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে যায়। রাখি তার জন্য এক স্মরণীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে। তারা ফুলের মালায় তার নালা ভরে দেয় তার চলার পথে ছড়িয়ে রাখে গোলাপের কুঁড়ি। আর 'পাকিসত্মান জিন্দাবাদ' সেস্নাগান দিতে দিতে তাদের কণ্ঠস্বর।
রাখি সুখী, বেশ সুখী। প্রশানত্মির মধ্যে দিন, সপ্তাহ ও মাস কেটে যায়। হঠাৎ এক বন্ধুর বাড়িতে যাবার সময় একদিন সে ডাক শোনে, 'এই রাখি!' পর মুহূর্তে সে নিজেকে আবিষ্কার করে তার ভাইয়ের বাহুবন্ধনে।
রাখি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দু'জনেই অনন্দাশ্রম্ন বর্ষণ করল, একজন অন্যজনকে দীর্ঘৰণ ধরে জড়িয়ে রাখল। এতদিন পর ভাইকে পেয়ে রাখি শিশুর মত কাঁদল। তাদের পাশে একদিন আগন্তুক যে অপেৰা করছে তা রাখির চোখেও পড়েনি। তাকে পুলিশ অফিসারদের মত মনে হচ্ছে।
অতিথিদের তার বাড়িতে আসার কথা বলার আগেই তার ভাই আগন্তুককে বলল, 'এটা আমার বোন রাখি, তাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে হবে।' একটু দেরিতে হলে তীৰ্নস্বরে রাখি জিজ্ঞেস করল, 'কিন্তু কোথায়?' নিজের গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে তার নেই। অজানা অচেনা জায়গায় সে যাবে না।
যে রাসত্মায় সে খেলেছে, বড় হয়েছে তা ছেড়ে যাবে কেমন করে? যে মাঠে ছুটে বেড়িয়েছে, প্রেম ও আনন্দের গান গেয়েছে তা ত্যাগ করবে কিভাবে? যেখানে বান্ধবীদের সাথে নিত্য সাৰাৎ করেছে, হৃদয়ের গোপন কথা ভাগাভাগি করেছে সেই জায়গাটা ছেড়ে যাবে?
সন্ধ্যায় মহিষ দোহানোর কাজটা সেরে মার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে_ এই মহিষকে ফেলে সে কোথাও যাবে না। আঙ্গুর বাগানে পানি দেবার সময় গাছের কাছে জবান দিয়েছে পাকা আঙ্গুর সে খাবেই। গরম্নর কানে কানে বলেছে আগামী বসনত্মে বাছুর দেখতে চাই। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে কেঁদে ওঠে, 'এটা আমার ঘর, আমি ও এ ঘর ছেড়ে যেতে পারব না।'
রাত হলে পশ্চিমা বাতাস বইতে শুরম্ন করে। আঙ্গিনায় বসে চাঁদের আলোয় তার মুগ্ধতা বেড়ে যায়। এ জীবনে যত সাধু ও দরবেশের সাথে দেখা হয়েছে সাহায্যের জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করে। দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় যে ডোবাতে লাফিয়ে পড়ত, কেউ খুঁজে পেত না, সেই ডোবাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এখন তা কেমন করে করবে?
তার জরায়ুতে শেরবাজের অমূল্য উপহার। এটাকে নিয়ে কি করে লাফিয়ে পড়বে?
রাখি বার বার তাকে জিজ্ঞেস করেছে, 'শেরবাজ তোমার কুড়ালের কি হল?'
মোড়লের বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই হতবুদ্ধ হয়ে শেরবাজ সেই যে শুয়ে আছে, শুয়েই আছে। একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। এক দানা খাবারও খায়নি। রাখি আবার বলল, শেরবাজ তোমার সাথে থাকার জন্য আমি এমন একশত ভাই ছেড়ে আসতে পারি।'
কিন্তু শেরবাজ নিশ্চুপ, তার চোখ অশ্রম্ন ভরভর। রাখি শেষ পর্যনত্ম বলল, শেরবাজ চল, এখান থেকে পালিয়ে যাই।'
মনে হচ্ছে শেরবাজের প্রচ- জ্বর। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।
সে কী-ই বা বলবে। মোড়ল সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, রাখি জন্মগ্রহণ করেছে হিন্দুর ঘরে। তার মা-বাবা সব ছেড়ে হিন্দুসত্মানে চলে গেছে, রাখিকেও তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
দেশ ভাগের দাঙ্গায় যারা ধর্মানত্মরিত হয়েছে সব বাতিল হয়ে গেছে। রাখিকে অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে, যাতে তার বিনিময়ের একটি অপহৃত মুসলমান মেয়েকে ভারত থেকে পাকিসত্মানে আনা যায়। এটি সরকারের সিদ্ধানত্ম। পাকিসত্মানের জন্য এটুকু আত্মত্যাগ করতেই হবে।
কি করবে শেরবাজ জানে না। আর একবার অজ্ঞান হবার জন্যই তার জ্ঞান ফিরল। পরদিন ভোর না হতেই তাদের আঙ্গিনায় একটি জিপ প্রবেশ করল। গাড়িতে সশস্ত্র পুলিশ দেখে রাখি চিৎকার করে কাঁদতে শুরম্ন করল, "আমি যাব না। আমি কখনও আমার গ্রাম ছেড়ে যাব না। নাম বদলালে কী এসে যায়? এটা আমার দেশ। এই উঠান আমার, আমি সন্ধ্যায় ঝাট দেই। এই গাছপালা আমার। আমি সকাল-সন্ধ্যায় পানি ঢালি। এই রাসত্মা আমার, আমি ছোটবেলা থেকেই এখানে েখলাধুলা করছি।"
তার চোখে অশ্রম্নধারা। "শেরবাজ, তুমি কথা বলছ না কেন?'
কাতর হয়ে স্বামীকে বলল, 'তুমি একটা কথাও বলছ না কেন? আমার পেটে তোমার সনত্মান, একে নিয়ে আমি কি করব?" রাখি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
শেরবাজ আর রাখি তাদের রম্নমে। মোড়ল ব্যাপারটা আর একবার ভাবল, গ্রামের মুরম্নবি্বদের সাথে আলোচনা হল। কথা হল পুলিশ অফিসারের সাথে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটা সরকারের সিদ্ধানত্ম, তা মানতেই হবে। প্রিয় দেশ পাকিসত্মানের জন্য কোন ত্যাগই বড় কিছু নয়।
তারপর দরজা খুলে গেল। রাখি সামনে পেছনে শেরবাজখান। রাখি ধনী মানুষদের বিয়ের পোশাকে সেজেছে। তার যা আছে সব অলঙ্কার পরেছে। তাকে এভাবে দেখে সকলেই সত্মম্ভিত।
রাখি গাড়িতে বসামাত্র শেরবাজ খান এক ট্রাঙ্ক ভর্তি তার পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য জিনিস গাড়িতে তুলে দিল। আবার গিয়ে নিয়ে এল একটা পাত্র, যার গায়ে খোদাই করা তার নাম_ শেরবাজ খান। শেষবার ছুটে গিয়ে রাখির জন্য নিয়ে এল একটি পাটের হাত পাখা যার গায়ে রাখি নিজ হাতে নকশিকর্ম করে লিখেছে "পাকিসত্মান জিন্দাবাদ।"
No comments