জাতপাতের উর্ধে লালনের জীবনদর্শন আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক- _সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রবিবার সকাল এগারোটায় গড়িয়াহাটের ফ্যাটে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথা বলছিলেন। দশতলার ওপর ফ্যাট। জানালা দিয়ে দেখা যায়
বহুদূর বিস্তৃত কলকাতা শহর। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে জানলার বাইরে
তাকাচ্ছিলেন সুনীলদা।
প্রশ্ন : সুনীলদা, আপনার 'মনের
মানুষ' উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় একটি সিনেমা
তৈরি হচ্ছে। 'মনের মানুষ'-এ আপনি লালন ফকিরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করেছেন।
আপনি এই সময় হঠাৎ লালনকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন কেন?
সুনীল : লালনের জীবন সম্পর্কে তথ্য খুব কমই পাওয়া, যেটুকু তথ্য পেয়েছি তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে লিখেছি। এভাবে লালন ফকিরকে নিয়ে লেখার একটা কারণ আছে। স্বাধীনতা বা দেশভাগের পর থেকেই একটা ব্যাপার ঘটল, দেখা গেল দুই দেশের বেশিরভাগ মানুষ আর মানুষ নেই, তারা হিন্দু বা মুসলমান হয়ে গেছে। এই জাতপাতের ভেদাভেদ আজও ঘুচল না। সেইজন্য আমার মনে হয়েছিল লালনের জাতপাতের উর্ধে যে জীবনদর্শন সেটা আজকের যুগেও খুব প্রাসঙ্গিক। 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।' লালনের এসব গান শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছে জাতের নামে এখনও যে হানাহানি তার প্রতিপৰ হিসেবে লালন ফকির খুব উপযোগী।
প্রশ্ন : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রেৰাপটে আপনি 'সেই সময়' লিখেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসকে উপজীব্য করারও কি কোন বিশেষ কারণ ছিল?
সুনীল : হঁ্যা। বহুদিন ধরে আমার মনে হতো যে একটা নির্দিষ্ট সময়কে বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইউরোপের রেনেসাঁর আদলে বাংলাতেও একটা সময়কালকে রেনেসাঁ নাম দেয়া হয়। কিন্তু আমার ধারণা কোন সংস্কৃতিতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটলে সংস্কৃতির সর্বসত্মরে একটা পরিবর্তনের প্রবণতা আসে। ঊনবিংশ শতকের বাংলায় সেটা হয়নি। দু'একটা সামাজিক সংস্কার এবং কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হলেই নবজাগরণ হয়ে যায় বলে আমার মনে হয় না। সঙ্গীত, চিত্রকলা কোথাও কোন রেনেসাঁজনিত প্রভাব লৰ্য করা যায়নি। কোন সর্বজন গ্রাহ্য ধর্মেরও প্রবর্তন করা যায়নি। ব্রাহ্মধর্ম শুধু সমাজের এলিট অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল কিন্তু গরিব খেটে খাওয়া মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে এমন কোন ধর্মমতের কথা সে সময় কেউ ভাবেনি। হিন্দু ধর্ম এদিকে চিরকালই সঙ্কুচিত। যে কোন মানুষকে হিন্দু ধর্মে স্থান দেয়া হয় না। তুলনায় মুসলমান হয়ে যাওয়া বা খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া অনেক সহজ। যেমন আমেরিকার কালো মানুষেরা দলে দলে খ্রিস্টান হয়েছেন। হিন্দুদের শোষিত নিম্নবর্গের মানুষ মুসলমান হয়েছেন কিন্তু কোন নিচুতলার মানুষ ব্রাহ্ম হওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি। ফলে ঊনবিংশ শতকে রেনেসাঁর ব্যাপারটাকে আমার আদৌ রেনেসাঁ বলে মেনে নিতে অসুবিধে হয়েছে। তাই আমি ওই সময় সম্পর্কে আমার যে ধারণা সেটাকে 'সেই সময়'-এ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। আমার ধারণা ওইসময় কোন নবজাগরণ ঘটেইনি।
প্রশ্ন : আপনি আপনার কিছু উপন্যাসে, ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের বিসত্মৃত প্রসঙ্গ এনেছেন। আপনার 'প্রথম আলো'য় আপনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ খালি গায়ে সুইমিং কসটিউম পরে গঙ্গার পাড়ে শুয়ে আছেন। আপনার এই বর্ণনায় রৰণশীল রবীন্দ্রভক্তরা খুব রেগে দিয়েছিলেন। তাঁরা আপনার লেখার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনি কি রবীন্দ্রনাথকে অত সংৰিপ্ত পোশাকে দেখেছিলেন? এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য যদি কিছু বলেন।
সুনীল : না, রবীন্দ্রনাথকে সাঁতারের পোশাকে আমি বাসত্মব-চৰে দেখিনি তো বটেই। কিন্তু হয়েছিল কী, রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছেন এবং বিলেতে তখন একরকম নতুন ডিজাইনের সুইম-ট্রাঙ্ক খুব জনপ্রিয় ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতে খুব ভালবাসতেন। তো সাঁতার তো আর মানুষ জোব্বা পরে কাটে না, জাঙিয়া পরেই কাটে। ফলে রবীন্দ্রনাথ সংৰিপ্ত পোশাক পরে সাঁতার কাটছেন এতে অবাসত্মব কিছু নেই। আমি যেটা বাড়তি যোগ করেছিলাম সেটা হলো জাঙিয়ার রঙটা আমি লিখেছিলাম, 'রবীন্দ্রনাথ একটা নীল রঙের সুইম-ট্রাঙ্ক পরেছেন।' এই নীল রঙটা আমার কল্পনা।
প্রশ্ন : অনেক সমালোচক, গবেষক লিখেছেন যে 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসে মূল তিনটি ডায়মেনশন আছে_মানেন এসব?
সুনীল : হঁ্যা, তিনটে ডায়মেনশন। তার মধ্যে একটা হলো দেশ বিভাগের পর বাংলা যে পূর্বে আর পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে গেল সেটা। আবার পৃথিবীতে যে প্রাচ্য দুনিয়া এবং পাশ্চাত্য দুনিয়ার পার্থক্যটা সেটাও এক অর্থে পূর্ব-পশ্চিম। কিন্তু তৃতীয় ভাব যেটা তা হলো মানুষেরই মনের মধ্যে একটা সূর্যোদয় এবং সূর্যাসত্ম আছে। মনের পূর্ব এবং পশ্চিম।
প্রশ্ন : সাহিত্যের সবকটি শাখায় আপনি কলম ধরেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, কবিতা। এরমধ্যে সাহিত্যের কোন শাখায় লিখতে পারলে আপনার সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি আসে?
সুনীল : কবিতা। কিন্তু কবিতা লেখার অলস অবসরের খুবই অভাব। তবুও অপেৰা করি কখন একটা কবিতা লেখার সময় পাবো।
প্রশ্ন : সুনীলদা, পঞ্চাশ বছর আগে আপনার কৃত্তিবাস পত্রিকা তরম্নণ কবিদের মূল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, আজও কৃত্তিবাস তরম্নণ কবিদের মুখপত্র। তরম্নণ লেখকদের নিয়ে একটা লিটিল ম্যাগাজিনের এত দীর্ঘ সাফল্যের রহস্য আছে কিছু?
সুনীল : রহস্য কিনা জানি না, তবে কৃত্তিবাসে যত লেখা ছাপা হয় তার প্রত্যেকটা লাইন আমি পড়ি। তারপর আর একটা ব্যাপার কিছুদিন ধরে আমি ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি_এটা হওয়ার পর থেকে আমার মনে হলো যে আমি কি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলে গেলাম? এভাবে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকলে কবিতার একেবারে নতুন ধারার সঙ্গে সংযোগ রাখা কঠিন হলেও হতে পারে। তাই আমি কৃত্তিবাসে সবসময় নবীন লেখকদের প্রাধান্য দিয়েছি। কৃত্তিবাসে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা থাকে পিছনে, সামনে থাকে নতুন, সদ্য লিখতে আসা তরম্নণ-তরম্নণীদের কবিতা।
প্রশ্ন : সুনীলদা, সাহিত্য একাডেমির যে দায়িত্ব সেখানে সভাপতি হিসেবে আপনাকে কী কী করতে হয়?
সুনীল : সে খুব বিসত্মৃত কাজ। সংৰেপে বলা যাবে না। পনেরোটি ভাষা নিয়ে কাজ হয়। একভাষার কবি লেখকদের সঙ্গে অন্য ভাষার লেখকদের যোগাযোগ করানো হয় ফলে বিভিন্ন প্রদেশে কোন ভাষায় কী লেখা হচ্ছে তা আদান প্রদান হয়। এছাড়া সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে লেখকদের উৎসাহিত করা হয়।
প্রশ্ন : এইভাবে বড় বড় দায়িত্ব সামলে 'নীললোহিত'-এর মতো কাজকর্মহীন চরিত্ররা কী করে উঠে আসতে পারে?
সুনীল : আমি যখন 'নীললোহিত' লিখি তখন আমার বয়স হয়ে যায় সাতাশ। যে বয়েসে আমি নিজে পাহাড়ে-জঙ্গলে চলে যেতাম যখন তখন। যেমন, যখন আমি ছোটদের লেখা লিখি তখন আমার বয়স হয়ে যায় বারো বছর।
প্রশ্ন : এখানকার পত্র-পত্রিকায় আমরা পড়লাম যে সম্প্রতি বাংলাদেশের ফরিদপুরে আপনার জন্মভিটে দেখতে গিয়েছিলেন। আপনার অভিজ্ঞতা যদি কিছু শেয়ার করেন।
সুনীল : এটা আসলে যেটা হয়েছিল যে আমি প্রথমে যেতে চাইনি। তারপর রেজ্জাক হাওলদার বলে কানাডা প্রবাসী একটি ছেলে আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে। তখন আমায় যেতে হলো। গিয়ে যেটা দেখলাম আমার শৈশবের গ্রামের যে ছবি আমার মনে ছিল তার থেকে জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। বদলে তো যাবেই এত বছরে। সেটাই তো উচিত। কিন্তু কোন প্রিয় স্মৃতির ছবিকে যদি অন্যরকম দেখি তাহলে মনে একটা সূক্ষ্ম বিষাদ আসে।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আনত্মরিকতা কোথায় বেশি?
সুনীল : ও-বাংলায়। যদিও আমার ধারণা দুই বাংলাতেই সাহিত্যের পাঠক অনেক বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্য নিয়ে যে উন্মাদনা, যে ভালবাসা তার তুলনা সারা পৃথিবীতে খুব কম দেখেছি।
প্রশ্ন : আজকের মতো শেষ প্রশ্ন। নীরাকে নিয়ে কোথাও পালালেন। কোথায় যাবেন? কোন বিশেষ জায়গা?
সুনীল : সে তোমাকে বলে গেলে আর পালানোর কী মানে হয়? তাই না?
সুনীল : লালনের জীবন সম্পর্কে তথ্য খুব কমই পাওয়া, যেটুকু তথ্য পেয়েছি তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে লিখেছি। এভাবে লালন ফকিরকে নিয়ে লেখার একটা কারণ আছে। স্বাধীনতা বা দেশভাগের পর থেকেই একটা ব্যাপার ঘটল, দেখা গেল দুই দেশের বেশিরভাগ মানুষ আর মানুষ নেই, তারা হিন্দু বা মুসলমান হয়ে গেছে। এই জাতপাতের ভেদাভেদ আজও ঘুচল না। সেইজন্য আমার মনে হয়েছিল লালনের জাতপাতের উর্ধে যে জীবনদর্শন সেটা আজকের যুগেও খুব প্রাসঙ্গিক। 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।' লালনের এসব গান শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছে জাতের নামে এখনও যে হানাহানি তার প্রতিপৰ হিসেবে লালন ফকির খুব উপযোগী।
প্রশ্ন : ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রেৰাপটে আপনি 'সেই সময়' লিখেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসকে উপজীব্য করারও কি কোন বিশেষ কারণ ছিল?
সুনীল : হঁ্যা। বহুদিন ধরে আমার মনে হতো যে একটা নির্দিষ্ট সময়কে বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইউরোপের রেনেসাঁর আদলে বাংলাতেও একটা সময়কালকে রেনেসাঁ নাম দেয়া হয়। কিন্তু আমার ধারণা কোন সংস্কৃতিতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ ঘটলে সংস্কৃতির সর্বসত্মরে একটা পরিবর্তনের প্রবণতা আসে। ঊনবিংশ শতকের বাংলায় সেটা হয়নি। দু'একটা সামাজিক সংস্কার এবং কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হলেই নবজাগরণ হয়ে যায় বলে আমার মনে হয় না। সঙ্গীত, চিত্রকলা কোথাও কোন রেনেসাঁজনিত প্রভাব লৰ্য করা যায়নি। কোন সর্বজন গ্রাহ্য ধর্মেরও প্রবর্তন করা যায়নি। ব্রাহ্মধর্ম শুধু সমাজের এলিট অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল কিন্তু গরিব খেটে খাওয়া মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে এমন কোন ধর্মমতের কথা সে সময় কেউ ভাবেনি। হিন্দু ধর্ম এদিকে চিরকালই সঙ্কুচিত। যে কোন মানুষকে হিন্দু ধর্মে স্থান দেয়া হয় না। তুলনায় মুসলমান হয়ে যাওয়া বা খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া অনেক সহজ। যেমন আমেরিকার কালো মানুষেরা দলে দলে খ্রিস্টান হয়েছেন। হিন্দুদের শোষিত নিম্নবর্গের মানুষ মুসলমান হয়েছেন কিন্তু কোন নিচুতলার মানুষ ব্রাহ্ম হওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি। ফলে ঊনবিংশ শতকে রেনেসাঁর ব্যাপারটাকে আমার আদৌ রেনেসাঁ বলে মেনে নিতে অসুবিধে হয়েছে। তাই আমি ওই সময় সম্পর্কে আমার যে ধারণা সেটাকে 'সেই সময়'-এ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। আমার ধারণা ওইসময় কোন নবজাগরণ ঘটেইনি।
প্রশ্ন : আপনি আপনার কিছু উপন্যাসে, ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের বিসত্মৃত প্রসঙ্গ এনেছেন। আপনার 'প্রথম আলো'য় আপনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ খালি গায়ে সুইমিং কসটিউম পরে গঙ্গার পাড়ে শুয়ে আছেন। আপনার এই বর্ণনায় রৰণশীল রবীন্দ্রভক্তরা খুব রেগে দিয়েছিলেন। তাঁরা আপনার লেখার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনি কি রবীন্দ্রনাথকে অত সংৰিপ্ত পোশাকে দেখেছিলেন? এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য যদি কিছু বলেন।
সুনীল : না, রবীন্দ্রনাথকে সাঁতারের পোশাকে আমি বাসত্মব-চৰে দেখিনি তো বটেই। কিন্তু হয়েছিল কী, রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছেন এবং বিলেতে তখন একরকম নতুন ডিজাইনের সুইম-ট্রাঙ্ক খুব জনপ্রিয় ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতে খুব ভালবাসতেন। তো সাঁতার তো আর মানুষ জোব্বা পরে কাটে না, জাঙিয়া পরেই কাটে। ফলে রবীন্দ্রনাথ সংৰিপ্ত পোশাক পরে সাঁতার কাটছেন এতে অবাসত্মব কিছু নেই। আমি যেটা বাড়তি যোগ করেছিলাম সেটা হলো জাঙিয়ার রঙটা আমি লিখেছিলাম, 'রবীন্দ্রনাথ একটা নীল রঙের সুইম-ট্রাঙ্ক পরেছেন।' এই নীল রঙটা আমার কল্পনা।
প্রশ্ন : অনেক সমালোচক, গবেষক লিখেছেন যে 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসে মূল তিনটি ডায়মেনশন আছে_মানেন এসব?
সুনীল : হঁ্যা, তিনটে ডায়মেনশন। তার মধ্যে একটা হলো দেশ বিভাগের পর বাংলা যে পূর্বে আর পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে গেল সেটা। আবার পৃথিবীতে যে প্রাচ্য দুনিয়া এবং পাশ্চাত্য দুনিয়ার পার্থক্যটা সেটাও এক অর্থে পূর্ব-পশ্চিম। কিন্তু তৃতীয় ভাব যেটা তা হলো মানুষেরই মনের মধ্যে একটা সূর্যোদয় এবং সূর্যাসত্ম আছে। মনের পূর্ব এবং পশ্চিম।
প্রশ্ন : সাহিত্যের সবকটি শাখায় আপনি কলম ধরেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, কবিতা। এরমধ্যে সাহিত্যের কোন শাখায় লিখতে পারলে আপনার সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি আসে?
সুনীল : কবিতা। কিন্তু কবিতা লেখার অলস অবসরের খুবই অভাব। তবুও অপেৰা করি কখন একটা কবিতা লেখার সময় পাবো।
প্রশ্ন : সুনীলদা, পঞ্চাশ বছর আগে আপনার কৃত্তিবাস পত্রিকা তরম্নণ কবিদের মূল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, আজও কৃত্তিবাস তরম্নণ কবিদের মুখপত্র। তরম্নণ লেখকদের নিয়ে একটা লিটিল ম্যাগাজিনের এত দীর্ঘ সাফল্যের রহস্য আছে কিছু?
সুনীল : রহস্য কিনা জানি না, তবে কৃত্তিবাসে যত লেখা ছাপা হয় তার প্রত্যেকটা লাইন আমি পড়ি। তারপর আর একটা ব্যাপার কিছুদিন ধরে আমি ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি_এটা হওয়ার পর থেকে আমার মনে হলো যে আমি কি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলে গেলাম? এভাবে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকলে কবিতার একেবারে নতুন ধারার সঙ্গে সংযোগ রাখা কঠিন হলেও হতে পারে। তাই আমি কৃত্তিবাসে সবসময় নবীন লেখকদের প্রাধান্য দিয়েছি। কৃত্তিবাসে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা থাকে পিছনে, সামনে থাকে নতুন, সদ্য লিখতে আসা তরম্নণ-তরম্নণীদের কবিতা।
প্রশ্ন : সুনীলদা, সাহিত্য একাডেমির যে দায়িত্ব সেখানে সভাপতি হিসেবে আপনাকে কী কী করতে হয়?
সুনীল : সে খুব বিসত্মৃত কাজ। সংৰেপে বলা যাবে না। পনেরোটি ভাষা নিয়ে কাজ হয়। একভাষার কবি লেখকদের সঙ্গে অন্য ভাষার লেখকদের যোগাযোগ করানো হয় ফলে বিভিন্ন প্রদেশে কোন ভাষায় কী লেখা হচ্ছে তা আদান প্রদান হয়। এছাড়া সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে লেখকদের উৎসাহিত করা হয়।
প্রশ্ন : এইভাবে বড় বড় দায়িত্ব সামলে 'নীললোহিত'-এর মতো কাজকর্মহীন চরিত্ররা কী করে উঠে আসতে পারে?
সুনীল : আমি যখন 'নীললোহিত' লিখি তখন আমার বয়স হয়ে যায় সাতাশ। যে বয়েসে আমি নিজে পাহাড়ে-জঙ্গলে চলে যেতাম যখন তখন। যেমন, যখন আমি ছোটদের লেখা লিখি তখন আমার বয়স হয়ে যায় বারো বছর।
প্রশ্ন : এখানকার পত্র-পত্রিকায় আমরা পড়লাম যে সম্প্রতি বাংলাদেশের ফরিদপুরে আপনার জন্মভিটে দেখতে গিয়েছিলেন। আপনার অভিজ্ঞতা যদি কিছু শেয়ার করেন।
সুনীল : এটা আসলে যেটা হয়েছিল যে আমি প্রথমে যেতে চাইনি। তারপর রেজ্জাক হাওলদার বলে কানাডা প্রবাসী একটি ছেলে আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে। তখন আমায় যেতে হলো। গিয়ে যেটা দেখলাম আমার শৈশবের গ্রামের যে ছবি আমার মনে ছিল তার থেকে জায়গাটা অনেক বদলে গেছে। বদলে তো যাবেই এত বছরে। সেটাই তো উচিত। কিন্তু কোন প্রিয় স্মৃতির ছবিকে যদি অন্যরকম দেখি তাহলে মনে একটা সূক্ষ্ম বিষাদ আসে।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আনত্মরিকতা কোথায় বেশি?
সুনীল : ও-বাংলায়। যদিও আমার ধারণা দুই বাংলাতেই সাহিত্যের পাঠক অনেক বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্য নিয়ে যে উন্মাদনা, যে ভালবাসা তার তুলনা সারা পৃথিবীতে খুব কম দেখেছি।
প্রশ্ন : আজকের মতো শেষ প্রশ্ন। নীরাকে নিয়ে কোথাও পালালেন। কোথায় যাবেন? কোন বিশেষ জায়গা?
সুনীল : সে তোমাকে বলে গেলে আর পালানোর কী মানে হয়? তাই না?
No comments