ইলিয়াসের গল্পে ব্যক্তির মুখ ও মুখোশ by বজলুল করিম বাহার
বহুকাল আগে সেই প্রথম যৌবনে 'মূল্যবোধ' নিয়ে আমি একখানা নাতিদীর্ঘ
প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যার অনেকাংশ জুড়ে ছিল অসত্মিত্ববাদের দার্শনিক চেতনা।
সার্তরের এগজিস্টটেনশিয়ালিজম তখন আমাদের চিনত্মাভাবনায় এনে দিয়েছে এক নতুন
দৃষ্টিভঙ্গি।
তাই কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝেই কৌতূহলী মনের উস্কানিতে
সাহিত্যচর্চার অনুশীলন থেকে কাব্যাশ্রয়ী এই রচনাটি লিখে ফেলি। রচনার
শিরোনাম ছিল 'নীল শব ও বাসত্মবতার অনুষঙ্গ'। সে সময় 'অপরাহ্ন' নামে
প্রকাশিত একটি লিটল ম্যাগাজিনে এ রচনাটি মুদ্রিত হয়। আখতারম্নজ্জামান
ইলিয়াস এই লেখাটি পড়েছিলেন। তখন তিনি সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শেষ
পর্বের ছাত্র ছিলেন। আমরা তখন যারা বগুড়ার লেখালেখির চর্চায় নিমগ্ন থেকে
সারাণ অতৃপ্তির জ্বালানি পোড়াচ্ছিলাম, তাদের কারও কারও সঙ্গে
আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াসের প্রত্য ও পরো যোগাযোগ ছিল। আমি ছিলাম এদের
অন্যতম। ছুটি কাটাতে ইলিয়াস যখন বাড়ি আসতেন, আমরা ছুটে যেতাম তাঁর অকৃত্রিম
বিরল সানি্নধ্যের আকর্ষণে। বলাবাহুল্য, তখন ষাটের সাহিত্য আন্দোলন আমাদের
মাঝে প্রেরণা ও আবেগের এক স্বতন্ত্র মাত্রা সঞ্চার করেছে। ঢাকার তরম্নণ কবি
ও লেখকদের সঙ্গে আমাদের পরো যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'স্বার', 'কালবেলা', 'সাম্প্রতিক' প্রভৃতি লিটল
ম্যাগাজিনের প্রকাশনার সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন
ষাট দশকের সাহিত্য আন্দোলনের তরঙ্গাঘাতের প্রতি বগুড়ার তরম্নণ লেখক
প্রজন্মের চোখ খুলে দেয়ার েেত্র নেপথ্যের এক বড় ও নীরব ভূমিকা রেখেছিলেন।
ইলিয়াসকেন্দ্রিক আড্ডাকে কেন্দ্র করে আমাদের সাহিত্য প্রণোদনাপুষ্ট মনোভাব
বিসত্মৃত হতে পেরেছিল। আমাদের অনুভবে ইলিয়াস তখন সাহিত্যের েেত্র এক নতুন
দিগনত্মের উন্মোচন ঘটাতে সহায়তা করেছিলেন। কৌতূহলের প্রচলিত তরল ধারণা ও
বিশ্বাসকে তিনি ভেঙ্গে দিচ্ছিলেন। সেসব আড্ডায় আমরা অভিভূত হয়ে ল্য
করেছিলাম তাঁর বক্তব্যের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতাকে। সে সময় ইলিয়াস
আমার সেই কাব্যাশ্রয়ী, ভাবকাতুরে, আবেগমথিত ঐ রোমান্টিক লেখাটিকে এক
আশ্চর্য গুরম্নত্ব দিয়ে বলেছিলেন, 'ঐ লেখাটি নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ আছে।'
তাঁর এ কথায় প্রাথমিকভাবে আমি লজ্জিত হলেও ভেতরে ভেতরে কিছুটা যে অভিভূত
হইনি, একথা আজ নির্দ্বিধায় স্বীকার না করে উপায় নেই।
এ লেখাটির প্রসঙ্গে ইলিয়াস আমাকে কিয়ের্কেগার্ড ও সার্তরের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করে এক কৌতূহলী শিাথর্ীর জানার লিপ্সাকে উসকে দিতে পেরেছিলেন। এবং সে সঙ্গে আমার সেই রচনাধৃত কাব্যানুভূতির তরল আবেগের সঙ্গে সার্তরের বিখ্যাত উক্তি 'এগজিস্ট্যান্স ইজ প্রায়োর টু এসেন্স' বিশেস্নষণ করে এর অনত্মর্নিহিত মর্মের ভুল প্রয়োগটিকে মার্জিতভাবে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এতকাল পরে ইলিয়াসের সানি্নধ্যের প্রণোদনামূলক সেই ঘটনাটিকে স্মরণ করে আজও আমি রোমাঞ্চ অনুভব করি।
বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী লেখক জন্মেছিলেন ১২ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৩ সালে। মর্মানত্মিক হলেও সত্য যে, তাঁর অকালমৃতু্য হয়েছিল ৪ জানুযারি, ১৯৯৭ সালে। জন্মস্থান গাইবান্ধার গোটিয়া গ্রামে। পৈতৃক নিবাস ছিল বগুড়া শহরে। এই ণজন্মা লেখক জীবদ্দশায় লিখেছিলেন মাত্র চারটি গল্পগ্রন্থ ও দু'খানা উপন্যাস। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো ছিল অন্যঘরে অন্য স্বর, দুধভাতে উৎপাত, খোঁয়ারি ও দোজখের ওম। উপন্যাস দুটো ছিল চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা। তাঁর মৃতু্যর পর অপ্রকাশিত রচনাগুলো গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল। 'সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু' তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের নাম।
বাঙালী মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ইলিয়াস আমৃতু্য আক্রমণ করেছেন নানাভাবে। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নানাভাবে বিশেস্নষণ করে দেখিয়েছেন। এই মধ্যবিত্ত সমাজ কি ভয়ঙ্কর প্রাণহীন, রক্তহীন, রম্নগ্ন, ফ্যাকাশে ও জনবিচ্ছিন্ন। তিনি সমর্থ ব্যক্তির সন্ধানে এই রম্নগ্ন সমাজে খনন চালিয়েছেন অভিজ্ঞ এক সমাজবিদের মতো। তাঁর সন্ধানী তৎপরতা যে ত্রেটিতে নিবদ্ধ ছিল, তার প্রধান উপকরণই ছিল মানবজীবন। তিনি তাঁর অভিনিবেশী অন্বেষায়, বীণের সুকঠিন শৈলীতে নতুন চোখে মানুষের সমাজের পুনর্নির্মাণের একটি পথ তৈরিতে মগ্ন থেকেছিলেন। তাঁর গল্পের কাহিনীতে মাঝে মাঝে এসে যায় মধ্যবিত্ত শহুরে কোন শিতি ভদ্র মানবচরিত্র। যে মানুষটির আপাত ভদ্রতার মুখোশটিকে তিনি সপাটে টান মেরে খুলে ফেলেন আসুরিক শক্তিতে। তাঁর জাতক্রোধ মধ্যবিত্ত মায়া, মোহ, কপট স্নেহ, পিছুটান, তরল আবেগ, এমন কী শরীরী যন্ত্রণাও। মধ্যবিত্তসংহারী ক্রোধ তিনি সংবরণ করেন না। একে আক্রমণ করেন, জর্জরিত করেন যাতে আমাদের চোখে ব্যক্তি হয়ে ওঠা বা না হয়ে ওঠার বিষয়টি স্পষ্টতই ধরা পড়ে।
তখন ল্য করা যায় তার ন্যাংটো উদোম ধান্দাবাজ ও লোভী বৈশিষ্ট্যগুলো। ধর্ম, অর্থ, সংস্কৃতি, মোসাহেবী, বাহাদুরী, ভাঁড়ামো, লাম্পট্য, কৃত্রিম নৈতিকতা সব একাকার হয়ে আছে এই তথাকথিত ভদ্র ও মেকি মানুষটির মধ্যে। ইলিয়াস তাঁর লেখনীতে এই ভদ্র ব্যক্তিটিকে কখনও কোন অনুরাগ দেখাননি। তিনি আমাদের প্রত্য করান যতসব অসঙ্গতিকে। ইলিয়াস আঙ্গুল দিয়ে দেখান 'এই মধ্যবিত্ত হলো দেশবাসীর প্রতি ঔপনিবেশিক শক্তির দেয়া উপহার। উপনিবেশের মানুষ একটু ছোটই হয়, তাকে খাটো করে রাখতে না পারলে শাসক টিকে থাকে কি করে? এই খাটো হয়ে থাকার অনুগত মধ্যবিত্ত সদা গদগদ। এই দেশের ইউরোপের প্রভুদের অনুসরণে উপনিবেশের জন্ম পঙ্গু 'ব্যক্তি' ভুগছে আরবদের ব্যক্তিসর্বস্বতার ব্যারামে। তাছাড়া আমাদের এই উপনিবেশের মধ্যবিত্তের নাবালক ও বামন সনত্মান শ্রীমান ব্যক্তি বাবু চলছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, তার খোঁড়ানোকে দেখা হচ্ছিল নাচের মহড়া বলে। তা তিরিশের দশকে শ্রীমান আছাড় খেয়ে পড়েই গেলেন। তাঁর কাপড়চোপড় আর কিছুই রইল না, রোগাপটকা গতরটা উদোম হয়ে গেল। আবিভর্ূত হলো ঢাল ও তলোয়ারবিহীন শ্রীযুক্ত নিধিরাম সর্দার ন্যায়রত্ন তর্কবাগীশ মহাশয়'।
এদেশের সমাজ বাসত্মবতা, তার অর্থনীতি, ভুয়োদশর্ী রাজনীতিসহ সমসত্ম পারিপাশ্বর্িকতা জুড়েই যেন লেখক কথিত সেই জন্মপঙ্গু ব্যক্তিটিরই প্রভাব ও প্রতিপত্তি আজও বিরাজমান। এদেশের রম্নগ্ন অবয়ী সমাজের চরিত্রের প্রবণতা, মূল্যবোধ, প্রবৃত্তি, বিকার, পাশবতা, নিষ্ঠুরতা, সাম্প্রদায়িকতা, তস্করতা ও ধর্মের নামে স্বেচ্ছাচার প্রভৃতির একাত্মতা ও বিসত্মার দেখে মনে হয় ইলিয়াস এই অনিবার্য য় বার বার আমাদের আঙ্গুল দিয়ে কেন দেখাতে চেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তিটি পুরস্কার হিসেবে বরেণ্য হবেন, পূজিত হবেন, প্রভাবিত করবেন, সে ব্যক্তি বাইরে যতই ভদ্র হোন না কেন, মুখোশের অনত্মরালে এর বদমাইস, লম্পট, নিষ্ঠুর, দাঙ্গাবাজ, আলবদর কী শিবসেনা না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বযুদ্ধোত্তর অতীত আমাদের উপহার দিয়েছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা। সে ব্যক্তিস্বাধীনতা কুসংসর্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পরবতর্ীকালে ব্যক্তিসর্বস্বতায় অধপতিত করে ব্যক্তিকে একটি নিঃসঙ্গ কুতকুতে চোখওয়ালা ঘিনঘিনে শরীরে গুটিয়ে এনে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব মহাসমারোহে পালন করেছে।
লেখক ইলিয়াস এই রম্নগ্ন ব্যক্তিটিকে আমাদের কাছে শনাক্ত ও পরিচিত করার দুঃসহ প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকে সৃষ্টির জন্য যে সমাজ প্রয়োজন তার জন্য আমাদের কতদিন প্রতীায় থাকতে হবে, কে জানে? যতদিন না এই শক্তি সঞ্চয়ী নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষেরা সচেতনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতা না অর্জন করছে, ততদিন আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াস দ্রষ্টা হিসেবে, লেখক হিসেবে, সমাজবেত্তা হিসেবে আমাদের কাছে যে উপেতি থাকবেন, করম্নণা পাবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে? এ অবস্থায় খোয়াবনামা'র পোড়াদহের মাঠের সেই বহু শতকাল আগে বৈকুণ্ঠনাথের সেই স্বপ্নের মাঝে শেস্নাকের কথা মনে জাগে।
আমাদের অধিকাংশ গল্পই যখন এক অনতিক্রানত্ম সীমাবদ্ধতার ভেতর ডোবা জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, অধিকাংশ গল্পই যখন গতানুগতিক এক পানসে জীবনবোধের পাঁকের ভেতর পিচ্ছিল দেহটা নিয়ে স্বাদের ঘোলা জল আরও ঘোলা করছে, সে মুহূর্তে ইলিয়াসের গল্পগ্রন্থ 'দুধভাতে উৎপাত' মনস্ক পাঠককে জানান দিয়ে যায়, সৎ গল্প, প্রকৃত গল্প এখনও নির্মাণ করা যায় বৈকি। সে গল্পের বুৎপত্তি শিল্পের মতো, গভীর এক বোধ নিয়ে স্বঅসত্মিত্বের অভু্যদয় ঘটায়। ইলিয়াসের গল্প রম্য মেজাজে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো নয়। এ গল্পের মেজাজ যেন এক ধ্রম্নপদী চলচ্চিত্রের মতো। মন্থর। রম্ন। পাথুরে পথের মতো যার চড়াই উৎরাই। হাল্কাভাবে এ পথ অতিক্রম করা অসম্ভব প্রায়। কিংবা দুর্ভেদ্য অরণ্যের মতো বিশাল আর গভীর। অন্ধকারাচ্ছন্ন আর নিশ্ছিদ্র। এগুতে হলে নিজের মনোযোগকে দাঁড় করাতে হবে তী্ন ছুরির মতো। অন্ধকার বু্যহ ভেদ করতে পারলে অরণ্যের গভীরে বনে বাদাড়ে যে সৌন্দর্য, সবুজাভ যে দৃশ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে_ তাতে অনত্মত নিজের সেই রক্তাক্ত অভিযানকে সার্থক করে তোলার প েযথেষ্ট। ইলিয়াসের গল্প সেই অকৃত্রিম মনোযোগের গল্প। সেই অভিনিবিশের গল্প।
ইলিয়াসকে গল্পকাররূপে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার বোধ করি অপো রাখে না। নামবাচক প্রতিষ্ঠাই যদি একমাত্র ল্য বলে ধরা হয়, তাহলে প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অন্যঘরে অন্য স্বর'ই তাকে গল্পের ভুবনে সে স্থান করে দিতে পেরেছে। এর অব্যবহিত পরে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'খোঁয়ারি'র আত্মপ্রকাশ তাঁর সেই পরিচয়ের খ্যাতিকে বিসত্মৃত করেছে। বিকশিত করেছে। 'অন্যঘরে অন্য স্বর' বা খোঁয়ারির সেই এঁটো গন্ধ আজও নাকে এসে লাগে। ইলিয়াস রিয়ালিস্টিক গল্পের কথক। অথচ এ ধরনের সিরিয়াস গল্পের ভেতর, বাসত্মবতার জট যখন তুঙ্গে, ইলিয়াস কি আলতো করে সেখানে এক পোঁচ বঙ্কিমতার রং মাখিয়ে দেন। কৌতুকের কাঁটাগুলো, রঙের শলাকাগুলো থরে থরে সাজিয়ে দেন। ছোটগল্পের েেত্র এ ধরনের রীতি নজিরবিহীন। কখনও চোখে পড়েছে কি? মনে হয় না।
'দুধভাতে উৎপাত' এ কেমন নাম? এ যেন ভয়ঙ্কর খিদে পাওয়া মানুষের সম্মুখ থেকে ঝোলমাখা ভাত বা দুধ কলা মাখানো ভাতের থালাটা সরিয়ে রাখা। এ কোন ধরনের রসিকতা? যেন এক নির্মম নিষ্ঠুর শল্যবিদ মুমূষর্ু মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত-বিত অংশরোকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কেটে ফালা ফালা করে আবার আপন মনে জোড়া লাগাতে বসেছেন। ৮৬ পৃষ্ঠার এই সুদৃশ্য গল্পগ্রন্থের অবয়ব জুড়ে অনত্মভর্ুক্ত করেছেন মাত্র চারটি গল্প।
প্রথম গল্প মিলির হাতে স্টেনগান। অন্যান্য গল্পের তুলনায় একটু বড়। আমাদের দেশের সেই সবচেয়ে বড় রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর পটভূমিকে নির্বাচন করেছেন। চারদিকে শুধু অস্থিরতা আর অস্থিরতা। মূল্যবোধের সম্বিতটা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। মধ্যবিত্ত পরিবারের অংশভাক হিসেবে মিলি সেই টলোমলো অসত্মিত্বেরই স্মারক। বড় ভাই রানা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যে স্টেনগানটা একদিন সে এক মহতী যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল, আজ সেটা সে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করে। সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য তার সেই অবৈধ প্রয়াস অব্যাহত থাকে। এমনি এক সময়ে আব্বাস পাগলার সঙ্গে মিলির সাাত ঘটে। বিগত জীবনের এই স্কুল শিক উন্মাদ। আব্বাস পাগলার দেহের নোংরা পোশাকের গন্ধ মিলির কাছে হালুইকরের দোকানের নর্দমার গন্ধের মতো লাগে। মিলি সেই ঘ্রাণ শোঁকে। আব্বাস পাগলা এই নৈরাজ্যের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের কথা বলে। একটামাত্র স্টেনগান পেলে এমনকি সে নৰত্রযুদ্ধও ঠেকাতে পারে। মিলির মতো এক তরম্নণীর এ জন্যই কি আব্বাস পাগলার প্রতি এই আসক্তি? এ অকারণ আকর্ষণ।
আব্বাস পাগলার আরোগ্যের পর মিলি রানার স্টেনগানটা তার হাতে তুলে দিলে অপ্রত্যাশিত যে ঘটনায় সে বিমূঢ় হয়ে ওঠে, 'আমি ভাল হয়ে গেছি।' আব্বাস পাগলার এই পরাজয় কি মিলির চোখে মানবিকতার পরাজয়?
'দুধভাতে উৎপাত'-এর েেত্র যে প্রসঙ্গটা উঁকি দেয়, তা হলো ইলিয়াস তাঁর চর্চার েেত্র, অভ্যাসের েেত্র যেন প্রচলিত একটা ফাঁক পূরণ করেছিলেন। ইলিয়াস যেন এই প্রথম পাঠককে চাষাভূষার নিঃস্ব জীবনের ছবি উপহার দিলেন। প্রবাদের মতো আমাদের হারানো সুবর্ণ গ্রামের কথা, কৃষকদের জীবন কাহিনী নিয়ে এই প্রথম যেন তিনি লিখলেন। এর আগে কি ইলিয়াস এদের নিয়ে কোন ছবি তৈরি করেছেন? মনে পড়ে না। জয়নাবের সাধের দুখভাতে ছাইচাপা পড়ার নির্মম ঘটনা তিনি মনে করিয়ে দিলেন। সেই কতদিন আগে খাওয়া দুধভাতের বাসি গন্ধ চোখা কঞ্চির মতো পেটে ঢুকে পাকস্থলীতে খোঁচাখুঁচি শুরম্ন করলে সে উঠে দাঁড়ায়।
'পায়ের নিচে জল' নদীর ভাঙ্গনের মুখে অসহায় মানুষের ছবি। তবুও তো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি এতটুকু খাটো করেননি। বর্গাদারের চাষের 'জমি বিক্রির কথা বলা আতিকের প েএখন অসম্ভব।' ভাঙ্গনের এ অবস্থায়ও ইলিয়াস তার কৌতুকের ভাষায় বঙ্কিমতায় শরবিদ্ধ করেন, 'আর খাবো না গো। নদী এহন জিরাবা নাগছে! বেশি খালে পরে নদীর হাগা ধরবো না?' নদীর উদরাময়ের সম্ভাবনায় সবাই খুব হাসে। এ গ্রন্থের শেষ গল্প 'দখল'। গ্রন্থনার দিক থেকে এ গল্পটি একটু ব্যতিক্রম। একটু যেন অভিনব। এ গল্পের শহীদ কাজী মোহাম্মদ মোবারক হোসেন একজন বিপস্নবী ছিলেন। স্বৈরাচারী পাকিসত্মানী সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারে মোবারক হোসেন নিহত হন। মোবারক হোসেনের বাবা মোয়াজ্জেম হাসেন জোতদার শোষক শ্রেণীর। ছেলের বাঁধানো কবরটার পাশে তিনি নিজের নাম লেখা কবরটা শূন্যে রাখেন। অভিপ্রায়, মৃতু্যর পরে তাকে যেন ছেলের পাশে কবর দেয়া হয়। বিপস্নবী মোবারকের ছেলে ইকবাল, বাপের সম্পত্তির দখল থেকে বঞ্চিত হয় শরিয়তের দোহাই দিয়ে। সেই গ্রামের ভূমিহীন মানুষদের বিরম্নদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় রীবাহিনী। এমনি এক আন্দোলনের মুখে ইকবালের যে বোধোদয় হয়, 'ইকবাল লাফ দিয়ে বসে পড়ে শূন্য কবরের ওপর। _এত সোজা! মোয়াজ্জেম হোসেন ওর বিপস্নবী বাপের পাশে থাকবে এই শয়তান বুড়োটা? এই মানুষ মারা; ঠক ও শোষক শয়তান জোতদার এত সোজা। ইকবাল নিজের করবে বেশ জুৎ হয়ে বসল। বাপের যা কিছু আছে সে তো তারই প্রাপ্য! শূন্য কবরে লাশের মতো শুয়ে সে একটু একটু করে পা নাচায়। এবার মরলে এখানেই তার চিরকালের আসন হয়ে থাকবে চিরকাল।' এ এক আশ্চর্য দোলা জাগানো গল্প। উদ্বেল করা গল্প।
ইলিয়াস যেন বার বার বহমান জীবনস্রোতে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে এক দূর পালস্নার সাঁতারে নেমেছেন। কুশলী ক্রীড়াবিদের মতো তিনি আশিরপদ ভাসছেন, ভাসাচ্ছেন।
'দুধভাতে উৎপাত' গল্পকাররূপে ইলিয়াস এর মতার শিকড়কে আরও গভীরে ছড়িয়ে দিল। মনস্ক পাঠকের কাছে তার প্রতিষ্ঠার গোড়াকে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে।
তবে একটা জিজ্ঞাসা থেকে যায়। ইলিয়াস তাঁর গল্পের কাঠামোকে কেন এত কঠিন করে তোলেন? যেন পাঠককে তার গল্পের শাঁস সহজ সরলভাবে ভোগ করতে দিতে তিনি নারাজ! তাঁর গল্পের গোলাপী নির্যাস পেতে হলে পাঠককে তার আঙ্গুলে কাঁটা বিঁধাতে হয়। ৰত-বিৰত হতে হয়। এই আঘাতের কিছুটা ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পাঠককে কিছুটা সরলভাবে এগুতে দেয়ার ব্যাপারে ইলিয়াসের এই কৃপণতার প্রতি তাই অনুযোগ জন্মায়। প্রকৃত গল্পের ৰেত্রে বন্ধুরতা, উচাটন সব কিছু স্বীকার করে নিয়েই এগুতে হয়। এজন্য অনিবার্যভাবে এক ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন। ইলিয়াস হয়ত সেই তত্ত্বই কারণে-অকারণে তাঁর গল্পের ব্যাপারে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
এ লেখাটির প্রসঙ্গে ইলিয়াস আমাকে কিয়ের্কেগার্ড ও সার্তরের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করে এক কৌতূহলী শিাথর্ীর জানার লিপ্সাকে উসকে দিতে পেরেছিলেন। এবং সে সঙ্গে আমার সেই রচনাধৃত কাব্যানুভূতির তরল আবেগের সঙ্গে সার্তরের বিখ্যাত উক্তি 'এগজিস্ট্যান্স ইজ প্রায়োর টু এসেন্স' বিশেস্নষণ করে এর অনত্মর্নিহিত মর্মের ভুল প্রয়োগটিকে মার্জিতভাবে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এতকাল পরে ইলিয়াসের সানি্নধ্যের প্রণোদনামূলক সেই ঘটনাটিকে স্মরণ করে আজও আমি রোমাঞ্চ অনুভব করি।
বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী লেখক জন্মেছিলেন ১২ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৩ সালে। মর্মানত্মিক হলেও সত্য যে, তাঁর অকালমৃতু্য হয়েছিল ৪ জানুযারি, ১৯৯৭ সালে। জন্মস্থান গাইবান্ধার গোটিয়া গ্রামে। পৈতৃক নিবাস ছিল বগুড়া শহরে। এই ণজন্মা লেখক জীবদ্দশায় লিখেছিলেন মাত্র চারটি গল্পগ্রন্থ ও দু'খানা উপন্যাস। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো ছিল অন্যঘরে অন্য স্বর, দুধভাতে উৎপাত, খোঁয়ারি ও দোজখের ওম। উপন্যাস দুটো ছিল চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা। তাঁর মৃতু্যর পর অপ্রকাশিত রচনাগুলো গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল। 'সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু' তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের নাম।
বাঙালী মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে ইলিয়াস আমৃতু্য আক্রমণ করেছেন নানাভাবে। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নানাভাবে বিশেস্নষণ করে দেখিয়েছেন। এই মধ্যবিত্ত সমাজ কি ভয়ঙ্কর প্রাণহীন, রক্তহীন, রম্নগ্ন, ফ্যাকাশে ও জনবিচ্ছিন্ন। তিনি সমর্থ ব্যক্তির সন্ধানে এই রম্নগ্ন সমাজে খনন চালিয়েছেন অভিজ্ঞ এক সমাজবিদের মতো। তাঁর সন্ধানী তৎপরতা যে ত্রেটিতে নিবদ্ধ ছিল, তার প্রধান উপকরণই ছিল মানবজীবন। তিনি তাঁর অভিনিবেশী অন্বেষায়, বীণের সুকঠিন শৈলীতে নতুন চোখে মানুষের সমাজের পুনর্নির্মাণের একটি পথ তৈরিতে মগ্ন থেকেছিলেন। তাঁর গল্পের কাহিনীতে মাঝে মাঝে এসে যায় মধ্যবিত্ত শহুরে কোন শিতি ভদ্র মানবচরিত্র। যে মানুষটির আপাত ভদ্রতার মুখোশটিকে তিনি সপাটে টান মেরে খুলে ফেলেন আসুরিক শক্তিতে। তাঁর জাতক্রোধ মধ্যবিত্ত মায়া, মোহ, কপট স্নেহ, পিছুটান, তরল আবেগ, এমন কী শরীরী যন্ত্রণাও। মধ্যবিত্তসংহারী ক্রোধ তিনি সংবরণ করেন না। একে আক্রমণ করেন, জর্জরিত করেন যাতে আমাদের চোখে ব্যক্তি হয়ে ওঠা বা না হয়ে ওঠার বিষয়টি স্পষ্টতই ধরা পড়ে।
তখন ল্য করা যায় তার ন্যাংটো উদোম ধান্দাবাজ ও লোভী বৈশিষ্ট্যগুলো। ধর্ম, অর্থ, সংস্কৃতি, মোসাহেবী, বাহাদুরী, ভাঁড়ামো, লাম্পট্য, কৃত্রিম নৈতিকতা সব একাকার হয়ে আছে এই তথাকথিত ভদ্র ও মেকি মানুষটির মধ্যে। ইলিয়াস তাঁর লেখনীতে এই ভদ্র ব্যক্তিটিকে কখনও কোন অনুরাগ দেখাননি। তিনি আমাদের প্রত্য করান যতসব অসঙ্গতিকে। ইলিয়াস আঙ্গুল দিয়ে দেখান 'এই মধ্যবিত্ত হলো দেশবাসীর প্রতি ঔপনিবেশিক শক্তির দেয়া উপহার। উপনিবেশের মানুষ একটু ছোটই হয়, তাকে খাটো করে রাখতে না পারলে শাসক টিকে থাকে কি করে? এই খাটো হয়ে থাকার অনুগত মধ্যবিত্ত সদা গদগদ। এই দেশের ইউরোপের প্রভুদের অনুসরণে উপনিবেশের জন্ম পঙ্গু 'ব্যক্তি' ভুগছে আরবদের ব্যক্তিসর্বস্বতার ব্যারামে। তাছাড়া আমাদের এই উপনিবেশের মধ্যবিত্তের নাবালক ও বামন সনত্মান শ্রীমান ব্যক্তি বাবু চলছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, তার খোঁড়ানোকে দেখা হচ্ছিল নাচের মহড়া বলে। তা তিরিশের দশকে শ্রীমান আছাড় খেয়ে পড়েই গেলেন। তাঁর কাপড়চোপড় আর কিছুই রইল না, রোগাপটকা গতরটা উদোম হয়ে গেল। আবিভর্ূত হলো ঢাল ও তলোয়ারবিহীন শ্রীযুক্ত নিধিরাম সর্দার ন্যায়রত্ন তর্কবাগীশ মহাশয়'।
এদেশের সমাজ বাসত্মবতা, তার অর্থনীতি, ভুয়োদশর্ী রাজনীতিসহ সমসত্ম পারিপাশ্বর্িকতা জুড়েই যেন লেখক কথিত সেই জন্মপঙ্গু ব্যক্তিটিরই প্রভাব ও প্রতিপত্তি আজও বিরাজমান। এদেশের রম্নগ্ন অবয়ী সমাজের চরিত্রের প্রবণতা, মূল্যবোধ, প্রবৃত্তি, বিকার, পাশবতা, নিষ্ঠুরতা, সাম্প্রদায়িকতা, তস্করতা ও ধর্মের নামে স্বেচ্ছাচার প্রভৃতির একাত্মতা ও বিসত্মার দেখে মনে হয় ইলিয়াস এই অনিবার্য য় বার বার আমাদের আঙ্গুল দিয়ে কেন দেখাতে চেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তিটি পুরস্কার হিসেবে বরেণ্য হবেন, পূজিত হবেন, প্রভাবিত করবেন, সে ব্যক্তি বাইরে যতই ভদ্র হোন না কেন, মুখোশের অনত্মরালে এর বদমাইস, লম্পট, নিষ্ঠুর, দাঙ্গাবাজ, আলবদর কী শিবসেনা না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বযুদ্ধোত্তর অতীত আমাদের উপহার দিয়েছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা। সে ব্যক্তিস্বাধীনতা কুসংসর্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পরবতর্ীকালে ব্যক্তিসর্বস্বতায় অধপতিত করে ব্যক্তিকে একটি নিঃসঙ্গ কুতকুতে চোখওয়ালা ঘিনঘিনে শরীরে গুটিয়ে এনে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব মহাসমারোহে পালন করেছে।
লেখক ইলিয়াস এই রম্নগ্ন ব্যক্তিটিকে আমাদের কাছে শনাক্ত ও পরিচিত করার দুঃসহ প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকে সৃষ্টির জন্য যে সমাজ প্রয়োজন তার জন্য আমাদের কতদিন প্রতীায় থাকতে হবে, কে জানে? যতদিন না এই শক্তি সঞ্চয়ী নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষেরা সচেতনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতা না অর্জন করছে, ততদিন আখতারম্নজ্জামান ইলিয়াস দ্রষ্টা হিসেবে, লেখক হিসেবে, সমাজবেত্তা হিসেবে আমাদের কাছে যে উপেতি থাকবেন, করম্নণা পাবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে? এ অবস্থায় খোয়াবনামা'র পোড়াদহের মাঠের সেই বহু শতকাল আগে বৈকুণ্ঠনাথের সেই স্বপ্নের মাঝে শেস্নাকের কথা মনে জাগে।
আমাদের অধিকাংশ গল্পই যখন এক অনতিক্রানত্ম সীমাবদ্ধতার ভেতর ডোবা জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, অধিকাংশ গল্পই যখন গতানুগতিক এক পানসে জীবনবোধের পাঁকের ভেতর পিচ্ছিল দেহটা নিয়ে স্বাদের ঘোলা জল আরও ঘোলা করছে, সে মুহূর্তে ইলিয়াসের গল্পগ্রন্থ 'দুধভাতে উৎপাত' মনস্ক পাঠককে জানান দিয়ে যায়, সৎ গল্প, প্রকৃত গল্প এখনও নির্মাণ করা যায় বৈকি। সে গল্পের বুৎপত্তি শিল্পের মতো, গভীর এক বোধ নিয়ে স্বঅসত্মিত্বের অভু্যদয় ঘটায়। ইলিয়াসের গল্প রম্য মেজাজে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো নয়। এ গল্পের মেজাজ যেন এক ধ্রম্নপদী চলচ্চিত্রের মতো। মন্থর। রম্ন। পাথুরে পথের মতো যার চড়াই উৎরাই। হাল্কাভাবে এ পথ অতিক্রম করা অসম্ভব প্রায়। কিংবা দুর্ভেদ্য অরণ্যের মতো বিশাল আর গভীর। অন্ধকারাচ্ছন্ন আর নিশ্ছিদ্র। এগুতে হলে নিজের মনোযোগকে দাঁড় করাতে হবে তী্ন ছুরির মতো। অন্ধকার বু্যহ ভেদ করতে পারলে অরণ্যের গভীরে বনে বাদাড়ে যে সৌন্দর্য, সবুজাভ যে দৃশ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে_ তাতে অনত্মত নিজের সেই রক্তাক্ত অভিযানকে সার্থক করে তোলার প েযথেষ্ট। ইলিয়াসের গল্প সেই অকৃত্রিম মনোযোগের গল্প। সেই অভিনিবিশের গল্প।
ইলিয়াসকে গল্পকাররূপে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার বোধ করি অপো রাখে না। নামবাচক প্রতিষ্ঠাই যদি একমাত্র ল্য বলে ধরা হয়, তাহলে প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অন্যঘরে অন্য স্বর'ই তাকে গল্পের ভুবনে সে স্থান করে দিতে পেরেছে। এর অব্যবহিত পরে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'খোঁয়ারি'র আত্মপ্রকাশ তাঁর সেই পরিচয়ের খ্যাতিকে বিসত্মৃত করেছে। বিকশিত করেছে। 'অন্যঘরে অন্য স্বর' বা খোঁয়ারির সেই এঁটো গন্ধ আজও নাকে এসে লাগে। ইলিয়াস রিয়ালিস্টিক গল্পের কথক। অথচ এ ধরনের সিরিয়াস গল্পের ভেতর, বাসত্মবতার জট যখন তুঙ্গে, ইলিয়াস কি আলতো করে সেখানে এক পোঁচ বঙ্কিমতার রং মাখিয়ে দেন। কৌতুকের কাঁটাগুলো, রঙের শলাকাগুলো থরে থরে সাজিয়ে দেন। ছোটগল্পের েেত্র এ ধরনের রীতি নজিরবিহীন। কখনও চোখে পড়েছে কি? মনে হয় না।
'দুধভাতে উৎপাত' এ কেমন নাম? এ যেন ভয়ঙ্কর খিদে পাওয়া মানুষের সম্মুখ থেকে ঝোলমাখা ভাত বা দুধ কলা মাখানো ভাতের থালাটা সরিয়ে রাখা। এ কোন ধরনের রসিকতা? যেন এক নির্মম নিষ্ঠুর শল্যবিদ মুমূষর্ু মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত-বিত অংশরোকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কেটে ফালা ফালা করে আবার আপন মনে জোড়া লাগাতে বসেছেন। ৮৬ পৃষ্ঠার এই সুদৃশ্য গল্পগ্রন্থের অবয়ব জুড়ে অনত্মভর্ুক্ত করেছেন মাত্র চারটি গল্প।
প্রথম গল্প মিলির হাতে স্টেনগান। অন্যান্য গল্পের তুলনায় একটু বড়। আমাদের দেশের সেই সবচেয়ে বড় রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর পটভূমিকে নির্বাচন করেছেন। চারদিকে শুধু অস্থিরতা আর অস্থিরতা। মূল্যবোধের সম্বিতটা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত। মধ্যবিত্ত পরিবারের অংশভাক হিসেবে মিলি সেই টলোমলো অসত্মিত্বেরই স্মারক। বড় ভাই রানা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যে স্টেনগানটা একদিন সে এক মহতী যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল, আজ সেটা সে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করে। সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য তার সেই অবৈধ প্রয়াস অব্যাহত থাকে। এমনি এক সময়ে আব্বাস পাগলার সঙ্গে মিলির সাাত ঘটে। বিগত জীবনের এই স্কুল শিক উন্মাদ। আব্বাস পাগলার দেহের নোংরা পোশাকের গন্ধ মিলির কাছে হালুইকরের দোকানের নর্দমার গন্ধের মতো লাগে। মিলি সেই ঘ্রাণ শোঁকে। আব্বাস পাগলা এই নৈরাজ্যের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের কথা বলে। একটামাত্র স্টেনগান পেলে এমনকি সে নৰত্রযুদ্ধও ঠেকাতে পারে। মিলির মতো এক তরম্নণীর এ জন্যই কি আব্বাস পাগলার প্রতি এই আসক্তি? এ অকারণ আকর্ষণ।
আব্বাস পাগলার আরোগ্যের পর মিলি রানার স্টেনগানটা তার হাতে তুলে দিলে অপ্রত্যাশিত যে ঘটনায় সে বিমূঢ় হয়ে ওঠে, 'আমি ভাল হয়ে গেছি।' আব্বাস পাগলার এই পরাজয় কি মিলির চোখে মানবিকতার পরাজয়?
'দুধভাতে উৎপাত'-এর েেত্র যে প্রসঙ্গটা উঁকি দেয়, তা হলো ইলিয়াস তাঁর চর্চার েেত্র, অভ্যাসের েেত্র যেন প্রচলিত একটা ফাঁক পূরণ করেছিলেন। ইলিয়াস যেন এই প্রথম পাঠককে চাষাভূষার নিঃস্ব জীবনের ছবি উপহার দিলেন। প্রবাদের মতো আমাদের হারানো সুবর্ণ গ্রামের কথা, কৃষকদের জীবন কাহিনী নিয়ে এই প্রথম যেন তিনি লিখলেন। এর আগে কি ইলিয়াস এদের নিয়ে কোন ছবি তৈরি করেছেন? মনে পড়ে না। জয়নাবের সাধের দুখভাতে ছাইচাপা পড়ার নির্মম ঘটনা তিনি মনে করিয়ে দিলেন। সেই কতদিন আগে খাওয়া দুধভাতের বাসি গন্ধ চোখা কঞ্চির মতো পেটে ঢুকে পাকস্থলীতে খোঁচাখুঁচি শুরম্ন করলে সে উঠে দাঁড়ায়।
'পায়ের নিচে জল' নদীর ভাঙ্গনের মুখে অসহায় মানুষের ছবি। তবুও তো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি এতটুকু খাটো করেননি। বর্গাদারের চাষের 'জমি বিক্রির কথা বলা আতিকের প েএখন অসম্ভব।' ভাঙ্গনের এ অবস্থায়ও ইলিয়াস তার কৌতুকের ভাষায় বঙ্কিমতায় শরবিদ্ধ করেন, 'আর খাবো না গো। নদী এহন জিরাবা নাগছে! বেশি খালে পরে নদীর হাগা ধরবো না?' নদীর উদরাময়ের সম্ভাবনায় সবাই খুব হাসে। এ গ্রন্থের শেষ গল্প 'দখল'। গ্রন্থনার দিক থেকে এ গল্পটি একটু ব্যতিক্রম। একটু যেন অভিনব। এ গল্পের শহীদ কাজী মোহাম্মদ মোবারক হোসেন একজন বিপস্নবী ছিলেন। স্বৈরাচারী পাকিসত্মানী সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারে মোবারক হোসেন নিহত হন। মোবারক হোসেনের বাবা মোয়াজ্জেম হাসেন জোতদার শোষক শ্রেণীর। ছেলের বাঁধানো কবরটার পাশে তিনি নিজের নাম লেখা কবরটা শূন্যে রাখেন। অভিপ্রায়, মৃতু্যর পরে তাকে যেন ছেলের পাশে কবর দেয়া হয়। বিপস্নবী মোবারকের ছেলে ইকবাল, বাপের সম্পত্তির দখল থেকে বঞ্চিত হয় শরিয়তের দোহাই দিয়ে। সেই গ্রামের ভূমিহীন মানুষদের বিরম্নদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয় রীবাহিনী। এমনি এক আন্দোলনের মুখে ইকবালের যে বোধোদয় হয়, 'ইকবাল লাফ দিয়ে বসে পড়ে শূন্য কবরের ওপর। _এত সোজা! মোয়াজ্জেম হোসেন ওর বিপস্নবী বাপের পাশে থাকবে এই শয়তান বুড়োটা? এই মানুষ মারা; ঠক ও শোষক শয়তান জোতদার এত সোজা। ইকবাল নিজের করবে বেশ জুৎ হয়ে বসল। বাপের যা কিছু আছে সে তো তারই প্রাপ্য! শূন্য কবরে লাশের মতো শুয়ে সে একটু একটু করে পা নাচায়। এবার মরলে এখানেই তার চিরকালের আসন হয়ে থাকবে চিরকাল।' এ এক আশ্চর্য দোলা জাগানো গল্প। উদ্বেল করা গল্প।
ইলিয়াস যেন বার বার বহমান জীবনস্রোতে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে এক দূর পালস্নার সাঁতারে নেমেছেন। কুশলী ক্রীড়াবিদের মতো তিনি আশিরপদ ভাসছেন, ভাসাচ্ছেন।
'দুধভাতে উৎপাত' গল্পকাররূপে ইলিয়াস এর মতার শিকড়কে আরও গভীরে ছড়িয়ে দিল। মনস্ক পাঠকের কাছে তার প্রতিষ্ঠার গোড়াকে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছে।
তবে একটা জিজ্ঞাসা থেকে যায়। ইলিয়াস তাঁর গল্পের কাঠামোকে কেন এত কঠিন করে তোলেন? যেন পাঠককে তার গল্পের শাঁস সহজ সরলভাবে ভোগ করতে দিতে তিনি নারাজ! তাঁর গল্পের গোলাপী নির্যাস পেতে হলে পাঠককে তার আঙ্গুলে কাঁটা বিঁধাতে হয়। ৰত-বিৰত হতে হয়। এই আঘাতের কিছুটা ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পাঠককে কিছুটা সরলভাবে এগুতে দেয়ার ব্যাপারে ইলিয়াসের এই কৃপণতার প্রতি তাই অনুযোগ জন্মায়। প্রকৃত গল্পের ৰেত্রে বন্ধুরতা, উচাটন সব কিছু স্বীকার করে নিয়েই এগুতে হয়। এজন্য অনিবার্যভাবে এক ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন। ইলিয়াস হয়ত সেই তত্ত্বই কারণে-অকারণে তাঁর গল্পের ব্যাপারে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
No comments