জনপদে প্রেম : কবি দিলওয়ার by আহমদ সিরাজ
বাংলাদেশের অন্যতম কবি প্রতিভা দিলওয়ার যে অর্থে আমরা কবিদের বিবেচনা করে থাকি, সে অর্থে কবি দিলওয়ার ভিন্ন। তিনি মানুষের কবি, জনতার কবি; কিন্তু তিনি যেভাবে কবি হয়ে উঠেছেন, তা নাগরিক-অনাগরিক কবিদের মধ্যে খোঁজ মিলে না।
কবিতার হিসাব যারা রাখেন, তাদের কাছে কবি দিলওয়ার পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত। কবি দিলওয়ারকে এসব চিহ্ন বর্ণে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি তার লেখালেখির ক্ষেত্রে এসব মাপকাঠি দ্বারা কখনও চালিত হন না। এসব ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক হলেন কি-না তার হিসাব কষে ভাবেন না।
দিলওয়ার তার জন্মের পর লেখালেখির জগতে প্রবেশের সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। তিনি জন্মের ঠিকানায় বাংলাদেশের নাগরিক হলেও তা নিবিড় ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের আয়নায় তার লেখালেখি জগতে তাবৎ পৃথিবীর মানুষ উঠে এসেছে। তিনি যেখানেই অবস্থান করেন, তিনি সমগ্রের ভেতরে থাকেন। তিনি একক হয়েও বিশ্বজনীন। এই কবি ১৯৮২ সাল থেকে কমলগঞ্জের মানুষের সঙ্গেও একাত্ম ও নিবিড় হয়ে আছেন।
তিনি কমবেশি ত্রিশ বছর ধরে কমলগঞ্জে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকানায় এলেও এই ঠিকানাই তার একান্ত শেষ ঠিকানা হয়নি। তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন কমলগঞ্জের আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে, গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় ইত্যাদিতে। তেমনি স্কুল-কলেজ, ক্লাব, সংগঠন, মসজিদ-মন্দিরসহ নানা প্রতিষ্ঠানে যেখানে মানুষের বিচরণ আছে, তিনি চলে গেছেন অবলীলায়। এসব বিচরণে মানুষের কাছে সময় দিতে কোনো হিসাব করেননি_ মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান দিতে গিয়ে কোনো ক্লান্তিবোধ করেননি। তার মতো এমন ক্লান্তিহীন দরদ অধুনা-বিদ্বান কবিদের সঙ্গে মেলা ভার। তারা এসব আমলে নিতে পারেন না।
এই কবি ১৯৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর পৌষের শীতার্ত রাতে কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের লাঘাটা নদীর পাড়ে দরিদ্র শব্দকরদের দেখতে যান। শীতের রাতে তাদের টুকরো টুকরো নাড়ার ঘরে ঢুকে আলাপ করেন। তিনি কবি; শব্দকরদের নিঃসীম যন্ত্রণায় তিনিও সব্যসাচী হয়ে ওঠেন। তিনি শব্দকরদের নিষ্ঠুর জীবনধারা দেখে দ্রোহী হয়ে ওঠেন। এ সময় নদী পারের এক শব্দকর 'দয়াল' বলে ওঠেন, মানুষ না হয়ে পাখি হয়ে উঠতে পারলে ভালো হতো। দয়াল এখন নেই।
এই কবি দিলওয়ার কমলগঞ্জের ৯টি ইউনিয়নেই পরিভ্রমণ করেছেন কেবল কবিতার তীর সন্ধানেই নয়, জনতার জীবন সন্ধানে, তখন কত শত মানুষের সঙ্গে তার প্রাণের কথা হয়েছে তার কোনো রেকর্ড নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো তার কোনো একান্ত সচিব থাকলে লক্ষ্য পৃষ্ঠার কথামালা তৈরি হয়ে যেত। তিনি কমলগঞ্জের গ্রাম শ্রীনাথপুর, ঘোষপুর, কালীপুর, মঙ্গলপুর, রামেশ্বরপুর, বারামপুর, যোগিবিল, তিলকপুর, কুমড়াকাঁপন, জালালিয়া, নছরতপুর, বালিটেকী, আদমপুর, ছনগাঁও, কোনাগাঁও, খুশালপুর, বৃন্দাবনপুর, পতনঊষার, রহিমপুর, সিদ্ধেশ্বরপুর, শমসেরনগর, ভানুগাছ, রামপুর, গোবর্ধনপুর, মুন্সীবাজার, মাধবপুর প্রভৃতি গ্রামগুলোতে স্মৃতির চিহ্ন পড়ে আছে।
কবি দিলওয়ার বড় কবি_ তার চেয়েও সত্য যে, তিনি মানুষকে ফেরেশতার চেয়েও মূল্য দিয়েছেন, সম্মান করেছেন। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে অকল্পনীয়ভাবে নিখাদ হয়ে উঠেছেন। যারা কবি-সাহিত্যিক তাদের কাছে মানুষ বিবেচ্য হলেও কবিতার অলঙ্কার নির্মাণই তাদের মোহিত করে। এ জন্য কবিরা অনেক ক্ষেত্রে নারী ও প্রকৃতিকে ভাবনার সঙ্গী করেছেন তার সৃষ্টির স্বার্থে। দিলওয়ার এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি কবিতার শরীর হিসেবে প্রতীক, অলঙ্কার ছন্দ, উপমা ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমকালীন কোনো বিদ্বান কবি থেকেও পিছিয়ে নেই। তার কবিতায় নারী ও প্রকৃতি অমলিন মানব-মানবী হয়ে উঠেছেন।
সনেটসিদ্ধ কবি দিলওয়ার শক্তিশালী একজন কবি হয়েও মানুষের কাছে মোমের চেয়েও নরম ও দরদি। মানুষের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসায় কোনো টোকা দেওয়া যাবে না_ এ ক্ষেত্রে তার বিকল্প কেবল তিনি।
তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, পুরাণ, মিথ কাহিনী কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়েছেন; কিন্তু তিনি জীবনের শেষ বেদনায় দাঁড়িয়ে একজন গ্রহের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেন না। এই কবিকে কমলগঞ্জের মানুষ বছরের পর বছর বিরতিহীনভাবে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পেয়েছে, তাই তিনি উচ্চারণ করতে ভোলেন না_ কমলগঞ্জ তার দ্বিতীয় সত্তা।
আজ ১ জানুয়ারি কবি দিলওয়ারের ৭৭তম জন্মদিনে তাকে সম্মান জানাই।
আহমদ সিরাজ : লেখক, গবেষক
দিলওয়ার তার জন্মের পর লেখালেখির জগতে প্রবেশের সঙ্গে বিশ্ব প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। তিনি জন্মের ঠিকানায় বাংলাদেশের নাগরিক হলেও তা নিবিড় ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের আয়নায় তার লেখালেখি জগতে তাবৎ পৃথিবীর মানুষ উঠে এসেছে। তিনি যেখানেই অবস্থান করেন, তিনি সমগ্রের ভেতরে থাকেন। তিনি একক হয়েও বিশ্বজনীন। এই কবি ১৯৮২ সাল থেকে কমলগঞ্জের মানুষের সঙ্গেও একাত্ম ও নিবিড় হয়ে আছেন।
তিনি কমবেশি ত্রিশ বছর ধরে কমলগঞ্জে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকানায় এলেও এই ঠিকানাই তার একান্ত শেষ ঠিকানা হয়নি। তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন কমলগঞ্জের আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে, গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় ইত্যাদিতে। তেমনি স্কুল-কলেজ, ক্লাব, সংগঠন, মসজিদ-মন্দিরসহ নানা প্রতিষ্ঠানে যেখানে মানুষের বিচরণ আছে, তিনি চলে গেছেন অবলীলায়। এসব বিচরণে মানুষের কাছে সময় দিতে কোনো হিসাব করেননি_ মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান দিতে গিয়ে কোনো ক্লান্তিবোধ করেননি। তার মতো এমন ক্লান্তিহীন দরদ অধুনা-বিদ্বান কবিদের সঙ্গে মেলা ভার। তারা এসব আমলে নিতে পারেন না।
এই কবি ১৯৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর পৌষের শীতার্ত রাতে কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের লাঘাটা নদীর পাড়ে দরিদ্র শব্দকরদের দেখতে যান। শীতের রাতে তাদের টুকরো টুকরো নাড়ার ঘরে ঢুকে আলাপ করেন। তিনি কবি; শব্দকরদের নিঃসীম যন্ত্রণায় তিনিও সব্যসাচী হয়ে ওঠেন। তিনি শব্দকরদের নিষ্ঠুর জীবনধারা দেখে দ্রোহী হয়ে ওঠেন। এ সময় নদী পারের এক শব্দকর 'দয়াল' বলে ওঠেন, মানুষ না হয়ে পাখি হয়ে উঠতে পারলে ভালো হতো। দয়াল এখন নেই।
এই কবি দিলওয়ার কমলগঞ্জের ৯টি ইউনিয়নেই পরিভ্রমণ করেছেন কেবল কবিতার তীর সন্ধানেই নয়, জনতার জীবন সন্ধানে, তখন কত শত মানুষের সঙ্গে তার প্রাণের কথা হয়েছে তার কোনো রেকর্ড নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো তার কোনো একান্ত সচিব থাকলে লক্ষ্য পৃষ্ঠার কথামালা তৈরি হয়ে যেত। তিনি কমলগঞ্জের গ্রাম শ্রীনাথপুর, ঘোষপুর, কালীপুর, মঙ্গলপুর, রামেশ্বরপুর, বারামপুর, যোগিবিল, তিলকপুর, কুমড়াকাঁপন, জালালিয়া, নছরতপুর, বালিটেকী, আদমপুর, ছনগাঁও, কোনাগাঁও, খুশালপুর, বৃন্দাবনপুর, পতনঊষার, রহিমপুর, সিদ্ধেশ্বরপুর, শমসেরনগর, ভানুগাছ, রামপুর, গোবর্ধনপুর, মুন্সীবাজার, মাধবপুর প্রভৃতি গ্রামগুলোতে স্মৃতির চিহ্ন পড়ে আছে।
কবি দিলওয়ার বড় কবি_ তার চেয়েও সত্য যে, তিনি মানুষকে ফেরেশতার চেয়েও মূল্য দিয়েছেন, সম্মান করেছেন। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে অকল্পনীয়ভাবে নিখাদ হয়ে উঠেছেন। যারা কবি-সাহিত্যিক তাদের কাছে মানুষ বিবেচ্য হলেও কবিতার অলঙ্কার নির্মাণই তাদের মোহিত করে। এ জন্য কবিরা অনেক ক্ষেত্রে নারী ও প্রকৃতিকে ভাবনার সঙ্গী করেছেন তার সৃষ্টির স্বার্থে। দিলওয়ার এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি কবিতার শরীর হিসেবে প্রতীক, অলঙ্কার ছন্দ, উপমা ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমকালীন কোনো বিদ্বান কবি থেকেও পিছিয়ে নেই। তার কবিতায় নারী ও প্রকৃতি অমলিন মানব-মানবী হয়ে উঠেছেন।
সনেটসিদ্ধ কবি দিলওয়ার শক্তিশালী একজন কবি হয়েও মানুষের কাছে মোমের চেয়েও নরম ও দরদি। মানুষের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসায় কোনো টোকা দেওয়া যাবে না_ এ ক্ষেত্রে তার বিকল্প কেবল তিনি।
তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, পুরাণ, মিথ কাহিনী কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়েছেন; কিন্তু তিনি জীবনের শেষ বেদনায় দাঁড়িয়ে একজন গ্রহের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেন না। এই কবিকে কমলগঞ্জের মানুষ বছরের পর বছর বিরতিহীনভাবে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পেয়েছে, তাই তিনি উচ্চারণ করতে ভোলেন না_ কমলগঞ্জ তার দ্বিতীয় সত্তা।
আজ ১ জানুয়ারি কবি দিলওয়ারের ৭৭তম জন্মদিনে তাকে সম্মান জানাই।
আহমদ সিরাজ : লেখক, গবেষক
No comments