বিচারপতির কম্পিউটার ও ই-মেইল হ্যাকিং by বিকাশ দত্ত

২০১২ সাল বিচারাঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে ড. আহম্মেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপে কথোপকথন ও ইমেইল হ্যাকিং করা। পরবর্তীতে অপরাধমূলক এ হ্যাকিংয়ের বিষয়বস্তু দৈনিক আমার দেশের ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা। এ ছাড়া ২০১২ সালে উচ্চ আদালত ছিল ঘটনাবহুল।
গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় ঘোষণাসহ বেশ কিছু মামলার শুনানি। অর্থাৎ বিদায়ী বছর ছিল আলোচিত মামলার বিচারের বিষয়। চাঞ্চল্যকর উচ্চ আদালতগুলোর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকা-ের বিচার, সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছিল তা বাতিল। সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলাই বর্তমান সরকারের আমলে সুপ্রীমকোর্ট নিষ্পত্তি করেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরই নয় সারাদেশের আলোচিত বিষয় ছিল সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও ইমেইল হ্যাকিং করা। হ্যাকিং করাটা অপরাধ। আর সেই অপরাধের বিষয়টি জেনেও দৈনিক আমার দেশ সেই কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ১৩ ডিসেম্বর প্রিন্ট মিডিয়াসহ সকল মিডিয়াতে প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিত অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই গুরুত্বপূর্ণ আদেশটি প্রদান করে। এর আগে দ্য ইকোনমোস্টিস্টের একটি ফোনের মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম বিষয়টি বুঝতে পারেন তাঁর কম্পিউটার হ্যাকিং করা হয়েছে।
কম্পিউটার হ্যাকিং হবার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বচ্ছতা রাখতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্র এর আগে ২৮ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক একেএম জহির আহমদ পদত্যাগ করেন। তিনি তার শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে আইন মন্ত্রণালয়ে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধ বিচারে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ জহির আহমদ। এ সময় ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্য ছিলেন এটিএম ফজলে কবীর। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৬ ধারার বলে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। বিচার প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট নতুন আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২২ মার্চ। এই্ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন প্রথম ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর।
২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল মীর কাশেম আলী ও এটিএম আজাহারকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ ও ২ এ ১৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা গুলো ট্রাইব্যুনালের আইন মেনে দ্রুত শুনানি চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
হাইকোর্ট
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যূনালের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও গুরুত্বপুর্ন ঘটনা ঘটেছে। আপীল বিভাগ ১৬ অক্টোবর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া আপীল বিভাগের ৭৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক পুর্নাঙ্গ রায ১৬ অক্টোবর রায়ে সই করেন আপীল বিভাগের সাতজন বিচারপতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর ফলে কোন অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার প্রধান হতে পারবে না। এ রায়ের ফলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর কার্যকারিতা আর থাকল।
এর আগে ২০১১ সালের ১১ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংঘর্ষিক ও বাতিল বলে ঘোষনা করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে ৭ সদস্যবিশিষ্ট আপীল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে।
দেশের উচ্চ আদালতের ২০১২ সাল ছিল আলোচিত ঘটনা। সারাবছরেই কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে হাইকোর্টসহ সুপ্রীমকোর্টে। হাইকোর্টের আদেশেই দীর্ঘ দিন সড়ক ভবনের অধীনে সম্পত্তি ফিরে পেয়েছে। তারেক কোকোর বিরুদ্ধে মামলা, একইভাবে ২০১২ সালে হাইকোর্টে বেশ কিছু জনস্বার্থে রুল জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনায় সকল ধর্মের উপাশনালয়ে নিরাপত্তার নির্দেশ। বিচার বিভাগে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ। জয়নাল হাজারীর অস্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল বন্ধে রিট। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিএনপি সাংসদ এমএ হাশেম ও মোসাদ্দেক হোসেন ফালুর মামলা বাতিল।
ঢাকা শহরে ফুটপাথে জনগণের স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করতে ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের নির্দেশ। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের আর্থিক অনিয়মের মামলাটি বাতিলের আবেদন খরিজ। বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলায় স্থায়ী জামিন। জোট সরকারের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা। আদালত অবমাননার অভিযোগে সাবেক ভিসি এরশাদুল বারীর বিরুদ্ধে রুল। ‘তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসবে’ একটি চ্যানেলে এমন কথা বলায় অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে তলব। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত স্থাপনে কোন ধরনের কার্যক্রম না চালানোর নির্দেশ। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করে ইতিহাস বিকৃত ও তথ্য বিভ্রাট করায় বইয়ের লেখক, প্রকাশক ও দুই সম্পাদকসহ ৫ জনকে তলব। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুকামনা মামলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ রুহুল আমিন খন্দকারকে ৬ মাসের কারাদ-।
এ ছাড়া জেল হত্যা মামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, ফৌজদারী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মনিটরিং সেল গঠন, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দায়েরকৃত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কমিটি গঠন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, অধঃস্তন আদালত পর্যায়ে আদালত ও পদ সৃজন। এ ছাড়াও নিবন্ধন অধিদফতর জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিডিউট, বিনিয়োগ প্রকল্পসহ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কতিপয় উচ্ছ্ঙ্খৃল ও বিপথগামী বিডিআর (বর্তমানে বিজেপি) সদস্য স্মরণাতীতকালের ভয়াবহতম বিদ্রোহ করে। উক্ত বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তা হত্যাকা-সহ অপরাপর অপরাধ সংঘটিত হয়। এই বিচার কাজের জন্য বিশেষ আদালত গটন করা হয়। বর্তমান সরকারের সময় পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকা-ের প্রেক্ষিতে উক্ত ঘটনায় সাথে জড়িত বিডিআরদের কোন আইনে বিচার হবে সে বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেফারেন্স পাঠানো হলে সুপ্রীমকোর্টের মতামত অনুযায়ী পিলখানায় নৃশংস হত্যাকা-ের বিচার প্রচলিত আইনে বিডিআর বিদ্রোহ মামলার বিচার শেষ।
উদীচী হত্যাকা-
উদীচী হত্যাকা- মামলাটি চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ হামলা হিসেবে সরকার বিবেচনা করেছে। উক্ত হত্যাকা- সম্পর্কিত নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ থেকে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্র্র্ট বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। উক্ত আপীল দুটি বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
জেলহত্যা মামলা
বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি দুর্ভাগ্য ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হলো জাতীয় বীর চার নেতাকে কতিপয় নরপশু ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জেলের মধ্যে আটক অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ ৩৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন হয়নি। জাতিকে সেই অভিশাপ থেকে আজও মুক্তি করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় চার নেতা হত্যা তথা জেলহত্যা মামলার বিচারের দাবিটি সকল জনগন ও সমেয়র দাবি । মামলাটি এখন আপীল বিভাগে রয়েছে। ১১ ডিসেম্বর থেকে আপীল বিভাগে জেল হত্যা মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। পরবর্তী দিন রয়েছে ১৫ জানুযারি। এর আগে ৩১ অক্টোবর তেরো হাজার চারশত তিরানব্বই দিন এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের অনুমতি পাওয়ার ছয়শত উনষাট দিন পর আলোচিত জেল হত্যা মামলায় আপীলের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। পরদিন তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে পলাতক আসামি রিসালদার (ক্যাপ্টেন) মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মোঃ আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়।
এর পর ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি মারফত আলী শাহ ও আবুল হাশেম মৃধাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের। এ ছাড়া চারজন যাবজ্জীবন কারাদ- থেকে অব্যাহতি পান। অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদ- বহাল থাকে। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগে লিভ টু আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। পৃথক পাঁচটি লিভ টু আপীল করা হয়। ২০১০ সালের ৪ নবেম্বর আপীল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য আরজি জানায়। জেল হত্যা মামলায় হাইকোর্টে অব্যাহতি পাওয়া চারজন কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজার (অব) বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.