সংসদ বর্জনে বিরোধী দলের রেকর্ড গড়ার বছর by নাজনীন আখতার
সংসদ-আদালতের এখতিয়ার, পুঁজিবাজার, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, টিআইবির প্রতিবেদন ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ইস্যুতে উত্তপ্ত সংসদ গত তিন বছরের ধারাবাহিকতায় গত বছরও বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
সংসদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৮২ কার্যদিবস বর্জন করে রেকর্ড গড়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল। এর আগে কোন বিরোধী দলের এতদিন সংসদের বাইরে থাকার নজির নেই। তবে অধিবেশনের অধিকাংশ সময় বিরোধী দল না থাকলেও সর্বোচ্চ আদালত ও সংসদের এখতিয়ার, টিআইবির প্রতিবেদন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পুঁজিবাজার, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে বিতর্ক সংসদে কম উত্তাপ ছড়ায়নি। এর মধ্যে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্যের অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্যের কারণে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ।
বিরোধী দলের সংসদ বর্জন
নবম জাতীয় সংসদে মোট ১৫টি অধিবেশনে ৩৩৭ কার্যদিবস পর্যন্ত সংসদ অধিবেশনের বৈঠক চলেছে। এর মধ্যে গত বছর ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫তম অধিবেশনে মোট ৮৩ কার্যদিবস সংসদের বৈঠক চলেছে। ওই ৮৩ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ৪ কার্যদিবস উপস্থিত ছিল বিএনপি। আর বিএনপি চেয়ারপার্সন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১ কার্যদিবস। এছাড়া ৩৩৭ কার্যদিবসের মধ্যে ২৮২ কার্যদিবস বিএনপি অনুপস্থিত থেকেছে। বিরোধীদলীয় নেতা মাত্র ৭ কার্যদিবস অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য মতে, দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তনের পর ৫ম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ১৩৫ কার্যদিবস সংসদের বাইরে ছিল। ওই সংসদের কার্যদিবস ছিল ২৬৫। ৭ম সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২১৯ কার্যদিবসের মধ্যে ১৬৩ কার্যদিবস সংসদ বাইরে ছিল। আর ৮ম সংসদের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী সংসদ বর্জন করে ২২৩ কার্যদিবস। ওই সংসদের মোট কার্যদিবস ছিলো ৩৭৩।
সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের ৩য় বর্ষপূর্তিতে ১২তম অধিবেশন শুরু হয়। তিন দফায় মুলতবি দিয়ে এ অধিবেশন শেষ হয় ২৯ মার্চ। এ অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ৩৪। দীর্ঘ বিরতির পর সংসদ সদস্য পদ রক্ষার খাতিরে ১৮ মার্চ সংসদে যোগ দেয় বিএনপি ও চারদলীয় জোটের শরিক সংসদ সদস্যরা। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া যোগ দেন ২০ মার্চ। ওইদিন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ দুই সংসদ সদস্যের অনুপস্থিতি ৮৩ কার্যদিবস পেরিয়ে গিয়েছিল। সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্পীকারের অনুমতি ছাড়া টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ চলে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ওই দিন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি আর যোগ দেননি কোন অধিবেশনে। ওই অধিবেশনে বিএনপির অন্যান্য সদস্যরা শেষ দিন ২৯ মার্চ পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ দেন। তাদের উপস্থিতি ছিল ৪ কার্যদিবস। এরপর বছরের বাকি তিন অধিবেশনে যোগ দেয়নি বিএনপি।
সংসদ সচিবালয় জানায়, প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে গত ২৭ মে শুরু হয় বাজেট অধিবেশন। যেটি ছিল সংসদের ১৩তম অধিবেশন। ৭ জুন বর্তমান মহাজোট সরকারের চতুর্থ এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২১৩ জন সংসদ সদস্য ৪৬ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বক্তব্যের পর গত ২৮ জুন ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়। অধিবেশন শেষ হয় ৮ জুলাই। এ অধিবেশনের মোট কার্যদিবস ছিল ২৯।
এরপর ১৪তম ও সর্বশেষ ১৫তম অধিবেশন ছিল সংক্ষিপ্ত। দুটি অধিবেশনেরই মেয়াদ ছিল মাত্র ১০ কার্যদিবস করে। ১৪তম অধিবেশন শুরু হয় ৪ সেপ্টেম্বর এবং শেষ হয় ১৯ সেপ্টেম্বর। ১৫তম অধিবেশন শুরু হয় ১৪ নবেম্বর এবং শেষ হয় ২৯ নবেম্বর।
সংসদ বনাম উচ্চ আদালত এবং অধ্যাপক সায়ীদ
এ বছর বিরোধী দল যে কয়দিন অধিবেশনে ছিল সেই কয়দিনই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। রাজনৈতিক ওইসব বক্তব্য সংসদের জন্য অভাবিত কিছু নয়। তবে উচ্চ আদালত ও অধ্যাপক সায়ীদকে নিয়ে বিতর্ক গত বছরের সংসদের আলোচিত বিতর্কে পরিণত হয়। ২৯ মে সড়ক ভবন বিষয়ে আদালতের রায় নিয়ে সংসদে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করেন সংসদ সদস্যরা। স্পীকারও এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেন। পরে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি স্পীকারকে কটাক্ষ করে কিছু মন্তব্য করলে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবিতে সংসদে ঝড় তোলেন মহাজোটের সদস্যরা। ১৮ জুন স্পীকার তাঁর রুলিংয়ের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের দাবি নাকচ করে দিয়ে বিষয়টির সন্তোষজনক সমাধানের দায়িত্ব দেন প্রধান বিচারপতির কাছে। পরবর্তীতে ওই রুলিংয়ের বিষয়ে আদালতের রায় নিয়ে ৪ সেপ্টেম্বর ১৪তম অধিবেশনের শুরুর দিনই আবার উত্তপ্ত হয় সংসদ। আদালত স্পীকারের রুলিংকে এখতিয়ার বহির্ভূত বলে মন্তব্য করে।
বিশ্ব সাহিত্যে কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাজেট অধিবেশন কয়েকজন সংসদ সদস্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানান। পরে প্রমাণিত হয় একটি গণমাধ্যমে আবু সায়ীদের ওই বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। আর বিষয়টি খতিয়ে না দেখেই ওই ভুল রিপোর্ট নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্য আবু সায়ীদের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করলে স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ সংসদের পক্ষ থেকে আবু সায়ীদের প্রতি দুঃখপ্রকাশ করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে দেয়া সকল অসংসদীয় কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জের নির্দেশ দেন। এছাড়া এই সংসদে প্রথমবারের মতো একজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। বাজেট অধিবেশনে ওই সংসদ সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করেন স্পীকার। ৮ জুলাই স্পীকার গাজীপুর-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের পদত্যাগ করার বিষয়টি সংসদকে অবহিত করেন।
এদিকে পুঁজিবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়েও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সংসদ অধিবেশন। দুটি বিষয় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদ সদস্যদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন। ‘৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্যরা দুর্নীতি, অনিয়ম, হত্যার সঙ্গে জড়িত’ উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) দেয়া প্রতিবেদন নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্যরা। সর্বশেষ ১৫তম অধিবেশনে গত ১৯ নবেম্বর সংসদ সদস্যরা টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটিতে টিআইবিকে ডাকা হোক। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হোক কিসের ভিত্তিতে তারা ঢালাওভাবে এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করে। এছাড়া টিআইবির কার্যক্রম বাংলাদেশ থেকে বন্ধের পাশাপাশি তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানানো হয়। এ বিষয়ে স্পীকারের রুলিং চাওয়া হলে তিনি সিনিয়র সংসদ সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা ও পারিতোষিক করের আওতায় আনতে পৃথক পৃথক বিল পাসসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয় এ বছরের চারটি অধিবেশনে। মোট ৪৯টি বিল পাস হয়েছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় এবং প্রশাসকের দায়িত্বকাল ৯০ দিনের পরিবর্তে ১৮০দিন করা, হিন্দু ধর্মের বিবাহ নিবন্ধন বিল, মূসক বিল, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত দুটি বিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে আপীলের সময় কমানো সংক্রান্ত বিল রয়েছে।
No comments