দেশি পণ্যের তথ্যভান্ডার গড়ে তুলছেন বিপাশা by রুহিনা তাসকিন
একদিন সকালবেলা পত্রিকা হাতে নিয়ে বিপাশা মতিনের মাথায় হাত। আমাদের জামদানির পেটেন্ট নাকি চলে যাচ্ছে ভারতের হাতে। ‘ঢাকাই জামদানি আমি আর পরতে পারব না? মোটা টাকার কর দিয়ে কিনতে হবে আমার নিজেরই দেশের পণ্য?’ এমন সব প্রশ্ন ঘুরছিল বিপাশার মাথায়।
পত্রিকা পড়েই বিপাশা জানলেন, এ নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে পাসের অপেক্ষায় পড়ে আছে একটি আইন। সেটার কী হলো, জানতে বিপাশা ও কয়েক বন্ধু মিলে চলে গেলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ে। আগে থেকে বলা-কওয়া নেই। পরিচিতও কেউ নেই। সাহস করে একেবারে মন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে বসলেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসেছে শুনে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া না করেননি। তাঁরা জানতে পারলেন, সেই আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে জনমত যাচাইয়ের জন্য। বিপাশা ও তাঁর বন্ধুরা প্রকাশ করলেন তাঁদের গভীর সংশয়। এ দেশে যাঁরা জামদানি তৈরি করেন বা পরেন, তাঁদের কজনই বা ওয়েবসাইট দেখেন? কতটুকুই বা প্রচারণা চালানো হয়েছে এই আইন সম্পর্কে?
১১ অক্টোবর ২০১২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ সংগঠনের পক্ষ থেকে বিপাশা ও তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত এক সভায় শিল্পমন্ত্রী জানালেন, আইনটি দ্রুত সংসদে তোলা হবে। আইনটি সংসদে তোলার পর মন্ত্রী জানালেন, ২৬ এপ্রিল ২০১৩-তে এ আইন সংসদে পাস হবে। আর তার পরপরই ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের কাছে বাংলাদেশ যাবে জামদানির জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন বা জিআই পাওয়ার চ্যালেঞ্জ জানাতে।
এর কয়েক বছর আগের কথা। বাবা এম এ মতিন ভুঁইয়ার পিছু পিছু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে ঢুকে পড়লেন আট ভাইবোন। জোর দাবি তাঁদের, ‘আমাদের মাকে এখানে ভর্তি করাতেই হবে।’ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়া হয়ে ওঠেনি রাশেদা মতিনের। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তির তারিখ তখন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে কর্তৃপক্ষ না করতে পারেনি। ভর্তি হয়ে গেলেন তাঁদের মা। এ বছরই তিনি পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক।
এই আমাদের বিপাশা মতিন। চট্টগ্রামের মেয়ে, ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ সংগঠনের মহাসচিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছেন। পড়াশোনা, নাচ, বিতর্ক এসব নিয়েই দিন কাটছিল তাঁর। একটা সময়ে মনে হলো আশপাশের মানুষগুলো দেশ নিয়ে এতটা নেতিবাচক কেন? ‘বিদেশ চলে যাব, বাংলাদেশের কিচ্ছু হবে না—এসব কথাই শুনতাম চারপাশে। আরে দেশে যদি এতই সমস্যা, তাহলে তুমি সমাধান করছ না কেন?’ প্রশ্ন বিপাশার। তাঁর কয়েকজন বন্ধুরও এই একই মত। তাঁরা সবাই মিলে ভাবলেন, কিছু একটা করা যাক। এভাবেই শুরু ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ বা ‘বি-কিউব’-এর। তাঁদের স্লোগান, ‘উই আর বাংলাদেশ’, ‘আমরা বাংলাদেশ’। সেটা ২০১০ সালের কথা।
তাঁদের প্রথম কাজ ‘দ্য উইল’। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার ২০ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু। পড়াশোনার পর এই ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। বিপাশা বলেন, ‘তখনো আমরা ঠিক ভাবিনি, এরপর কী করব? ওদের শিক্ষকদের পাশাপাশি আমরাও ওদের পড়ানো শুরু করি। প্রায় সবাই বেশ ভালো ফল করে। একটি ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ রাইফেলস পাবলিক স্কুলে প্রথম হয়ে ক্লাস টেনে ওঠে। অথচ কোনো দিন সে প্রথম হওয়ার দৌড়েই ছিল না।’
২০১১ সালে এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজয় দিবস পালন করে বি-কিউব। সেদিন এতিমখানার একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তোমরা কিন্তু যেও না। তোমরাই আমাদের মা-বাবা, আমাদের বন্ধু। সে কথা শুনে আমরা সবাই শপথ করি, যা কিছুই হোক না কেন, এ প্রকল্প আমরা চালিয়ে যাবই।’
বি-কিউব এখন শুরু করেছে একটি কমিউনিটি ব্র্যান্ডিং প্রতিযোগিতা। বিপাশা বলেন, ‘দেশের ৭০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে এটি। নিজ নিজ এলাকার নিজস্ব পণ্য—যেমন বগুড়ার দই বা কুমিল্লার খাদি ইত্যাদির ইতিহাস কী, কারা তা তৈরি করেন, এমন নানা তথ্য নিয়ে ধারণা দেবে শিক্ষার্থীরা। এভাবে সারা দেশ পাওয়া অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ পণ্যের তথ্য সংগ্রহ করে আমরা একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করব। সেই পণ্যগুলোর জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ।’ ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’-এর ফেসবুক পাতায় এ সম্পর্কে রয়েছে বিস্তারিত তথ্য।
বিপাশা মতিন ডিন’স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন সম্মান পর্যায়ে। ‘এবার প্রথম থেকে তৃতীয় হয়ে গেছি।’ একটু চিন্তার ভাঁজ বিপাশার মুখে। ‘ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই। বাবা চট্টগ্রামে একটি কলেজের শিক্ষক। তাঁর মতোই হতে চাই।’ বললেন তিনি। শিক্ষক হতে না পারলে কী হবেন, তা-ও ঠিক করে রেখেছেন তিনি, ‘প্রথম বিকল্প হলো বিসিএস দিয়ে পুলিশে চাকরি করা। তা না হলে নিজেই একটি কনসালটেন্সি ফার্ম করব।’ বাণিজ্য বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মতো ব্যাংক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চান না তিনি। ‘তাহলে আর দেশের জন্য কী করা হলো।’ বলেন বিপাশা।
বি-কিউবের নেতৃত্ব বিপাশা একসময় ছেড়ে দিতে চান নতুনদের হাতে। তবে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি আজীবন এর সঙ্গেই থাকবেন।
১১ অক্টোবর ২০১২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ সংগঠনের পক্ষ থেকে বিপাশা ও তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত এক সভায় শিল্পমন্ত্রী জানালেন, আইনটি দ্রুত সংসদে তোলা হবে। আইনটি সংসদে তোলার পর মন্ত্রী জানালেন, ২৬ এপ্রিল ২০১৩-তে এ আইন সংসদে পাস হবে। আর তার পরপরই ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের কাছে বাংলাদেশ যাবে জামদানির জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন বা জিআই পাওয়ার চ্যালেঞ্জ জানাতে।
এর কয়েক বছর আগের কথা। বাবা এম এ মতিন ভুঁইয়ার পিছু পিছু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে ঢুকে পড়লেন আট ভাইবোন। জোর দাবি তাঁদের, ‘আমাদের মাকে এখানে ভর্তি করাতেই হবে।’ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়া হয়ে ওঠেনি রাশেদা মতিনের। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তির তারিখ তখন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে কর্তৃপক্ষ না করতে পারেনি। ভর্তি হয়ে গেলেন তাঁদের মা। এ বছরই তিনি পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক।
এই আমাদের বিপাশা মতিন। চট্টগ্রামের মেয়ে, ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ সংগঠনের মহাসচিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছেন। পড়াশোনা, নাচ, বিতর্ক এসব নিয়েই দিন কাটছিল তাঁর। একটা সময়ে মনে হলো আশপাশের মানুষগুলো দেশ নিয়ে এতটা নেতিবাচক কেন? ‘বিদেশ চলে যাব, বাংলাদেশের কিচ্ছু হবে না—এসব কথাই শুনতাম চারপাশে। আরে দেশে যদি এতই সমস্যা, তাহলে তুমি সমাধান করছ না কেন?’ প্রশ্ন বিপাশার। তাঁর কয়েকজন বন্ধুরও এই একই মত। তাঁরা সবাই মিলে ভাবলেন, কিছু একটা করা যাক। এভাবেই শুরু ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’ বা ‘বি-কিউব’-এর। তাঁদের স্লোগান, ‘উই আর বাংলাদেশ’, ‘আমরা বাংলাদেশ’। সেটা ২০১০ সালের কথা।
তাঁদের প্রথম কাজ ‘দ্য উইল’। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার ২০ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু। পড়াশোনার পর এই ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। বিপাশা বলেন, ‘তখনো আমরা ঠিক ভাবিনি, এরপর কী করব? ওদের শিক্ষকদের পাশাপাশি আমরাও ওদের পড়ানো শুরু করি। প্রায় সবাই বেশ ভালো ফল করে। একটি ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ রাইফেলস পাবলিক স্কুলে প্রথম হয়ে ক্লাস টেনে ওঠে। অথচ কোনো দিন সে প্রথম হওয়ার দৌড়েই ছিল না।’
২০১১ সালে এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজয় দিবস পালন করে বি-কিউব। সেদিন এতিমখানার একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তোমরা কিন্তু যেও না। তোমরাই আমাদের মা-বাবা, আমাদের বন্ধু। সে কথা শুনে আমরা সবাই শপথ করি, যা কিছুই হোক না কেন, এ প্রকল্প আমরা চালিয়ে যাবই।’
বি-কিউব এখন শুরু করেছে একটি কমিউনিটি ব্র্যান্ডিং প্রতিযোগিতা। বিপাশা বলেন, ‘দেশের ৭০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে এটি। নিজ নিজ এলাকার নিজস্ব পণ্য—যেমন বগুড়ার দই বা কুমিল্লার খাদি ইত্যাদির ইতিহাস কী, কারা তা তৈরি করেন, এমন নানা তথ্য নিয়ে ধারণা দেবে শিক্ষার্থীরা। এভাবে সারা দেশ পাওয়া অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ পণ্যের তথ্য সংগ্রহ করে আমরা একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করব। সেই পণ্যগুলোর জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ।’ ‘বিল্ড বেটার বাংলাদেশ’-এর ফেসবুক পাতায় এ সম্পর্কে রয়েছে বিস্তারিত তথ্য।
বিপাশা মতিন ডিন’স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন সম্মান পর্যায়ে। ‘এবার প্রথম থেকে তৃতীয় হয়ে গেছি।’ একটু চিন্তার ভাঁজ বিপাশার মুখে। ‘ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই। বাবা চট্টগ্রামে একটি কলেজের শিক্ষক। তাঁর মতোই হতে চাই।’ বললেন তিনি। শিক্ষক হতে না পারলে কী হবেন, তা-ও ঠিক করে রেখেছেন তিনি, ‘প্রথম বিকল্প হলো বিসিএস দিয়ে পুলিশে চাকরি করা। তা না হলে নিজেই একটি কনসালটেন্সি ফার্ম করব।’ বাণিজ্য বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মতো ব্যাংক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চান না তিনি। ‘তাহলে আর দেশের জন্য কী করা হলো।’ বলেন বিপাশা।
বি-কিউবের নেতৃত্ব বিপাশা একসময় ছেড়ে দিতে চান নতুনদের হাতে। তবে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি আজীবন এর সঙ্গেই থাকবেন।
No comments