নতুন বছর-বিজয়ের মাসের শেষ দিন by মো. আনোয়ার হোসেন
শুভ খ্রিস্টীয় বর্ষ ২০১৩। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ইংরেজি বর্ষ হিসেবে পরিচিত খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার ব্যবহার সর্বব্যাপী। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে ১ জানুয়ারির গুরুত্ব রয়েছে। এ হিসাবে বছরের শেষ দিন বা ৩১ ডিসেম্বরও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন বছর মানেই পহেলা বৈশাখ। তারা হৃদয়ের গভীর আবেগ ও উষ্ণতায় এ দিনটি উদযাপন করে থাকে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থল রমনা বটমূল থেকে প্রভাতে এ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় এবং মেগাসিটিরূপে পরিচিত হয়ে ওঠা ঢাকার সর্বত্র সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তা পালন করে। আর শুধু ঢাকাই-বা বলি কেন, গোটা বাংলাদেশই দিনভর মেতে থাকে উৎসবে। নারী-শিশু-বয়স্ক সবাই যেন এদিনে পথে নেমে আসে শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য। তাদের পরনে থাকে নতুন পোশাক। পহেলা বৈশাখের কেনাকাটার মাত্রাও এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলা নববর্ষ অন্যতম প্রধান মৌসুম হিসেবে বিবেচিত হয়।
জানুয়ারির প্রথম দিনে এমনটি ঘটে না। মূলত এলিট শ্রেণীভুক্তরাই ১ জানুয়ারি হাই-হ্যালো করে থাকে। হাল আমলে আরেকটি প্রবণতা থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু যেভাবে তা পালিত হয় তা আমাদের অনেককেই চিন্তিত করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য তৈরি করে শঙ্কা। এমনকি থার্টিফার্স্টের নাইট কীভাবে পার করবেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘি্নত হবে কি-না, তেমন উদ্বেগও সৃষ্টি করে। এদিন পালনকে কেন্দ্র করে যে আবহ তৈরি হয় তাতে প্রধানত মেতে ওঠে সচ্ছল জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকের আয়ের উৎসও প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের আয়োজনে হুজুক আছে, হৈ-হল্লা আছে। কিন্তু আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই।
বাংলাদেশের নাগরিকদের এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। আমরা যাকে অপসংস্কৃতি বলি, প্রগতির পথের অন্তরায় বলি_ এটা যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আমাদের যে কৃষক ও দিনমজুর ১৬ কোটি জনগণের প্রতিদিনের খাদ্যের জোগান দেয়, যে তৈরি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিক সাতসকালে কারখানায় হেঁটে যায় এবং সারাদিনের পরিশ্রম শেষে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে, যে জনগোষ্ঠী বিশ্বের নানা দেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে ডলার-ইউরো-পাউন্ডের রিজার্ভ মজবুত রাখে, তাদের জীবনধারা ও প্রত্যাশার সঙ্গে এসব একেবারেই বেমানান। আমাদের সচেতনভাবেই এ থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ষ বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে আমরা এ বিষয়টিই প্রধান বিবেচনায় নিয়েছি। গতকাল ৩১ ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের মাসের শেষ দিন। একাত্তরের এ মাসেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা এ মাসকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছি। শিক্ষক, ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরা এতে অংশ নিয়েছে। বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে ছিল একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসন স্কয়ারের কনসার্টে পরিবেশিত গানগুলোর পরিবেশন। আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং বব ডিলনকে। গোটা অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকালের একটি অনন্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে।
বিজয়ের মাসের শেষ দিনে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করার জন্য একটি বিশেষ আয়োজন রেখেছিলাম। আলাউদ্দিন নামের এই মুক্তিযোদ্ধা ১২ বছর ধরে আমাদের ক্যাম্পাসে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার এ মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য এক লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন এবং আমরা সেটা তার হাতে তুলে দিই। তিনি যেন আরেকটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন সে জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। তার মেয়েকে প্রশাসনের একটি পদে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত দশটি সংগঠনের শিল্পীদের বিজয়ের মাসের গান পরিবেশনও ছিল অনুষ্ঠানের অংশ। তাজরীন গার্মেন্টের ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডের শিকার হয়েছেন যেসব শ্রমিক তাদেরও আমরা স্মরণ করেছি। সবশেষে ছিল গেরিলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।
মোট কথা, বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল বিজয়ের মাসের শেষ দিনের আয়োজনে। থার্টিফার্স্ট নাইটের হুল্লোড়-মাতামাতির তাতে স্থান ছিল না। গত ২৪ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দলে দলে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নাম জানা ও নাম না জানা বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ পথ চলার সময় মহাসড়কে যাতে যানজট সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সবাই সতর্ক ছিলেন। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিকাশের জন্য এমনটিই প্রত্যাশিত।
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন :উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জানুয়ারির প্রথম দিনে এমনটি ঘটে না। মূলত এলিট শ্রেণীভুক্তরাই ১ জানুয়ারি হাই-হ্যালো করে থাকে। হাল আমলে আরেকটি প্রবণতা থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু যেভাবে তা পালিত হয় তা আমাদের অনেককেই চিন্তিত করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য তৈরি করে শঙ্কা। এমনকি থার্টিফার্স্টের নাইট কীভাবে পার করবেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘি্নত হবে কি-না, তেমন উদ্বেগও সৃষ্টি করে। এদিন পালনকে কেন্দ্র করে যে আবহ তৈরি হয় তাতে প্রধানত মেতে ওঠে সচ্ছল জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকের আয়ের উৎসও প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের আয়োজনে হুজুক আছে, হৈ-হল্লা আছে। কিন্তু আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই।
বাংলাদেশের নাগরিকদের এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। আমরা যাকে অপসংস্কৃতি বলি, প্রগতির পথের অন্তরায় বলি_ এটা যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আমাদের যে কৃষক ও দিনমজুর ১৬ কোটি জনগণের প্রতিদিনের খাদ্যের জোগান দেয়, যে তৈরি পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিক সাতসকালে কারখানায় হেঁটে যায় এবং সারাদিনের পরিশ্রম শেষে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে, যে জনগোষ্ঠী বিশ্বের নানা দেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে ডলার-ইউরো-পাউন্ডের রিজার্ভ মজবুত রাখে, তাদের জীবনধারা ও প্রত্যাশার সঙ্গে এসব একেবারেই বেমানান। আমাদের সচেতনভাবেই এ থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ষ বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে আমরা এ বিষয়টিই প্রধান বিবেচনায় নিয়েছি। গতকাল ৩১ ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের মাসের শেষ দিন। একাত্তরের এ মাসেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা এ মাসকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছি। শিক্ষক, ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরা এতে অংশ নিয়েছে। বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে ছিল একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসন স্কয়ারের কনসার্টে পরিবেশিত গানগুলোর পরিবেশন। আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং বব ডিলনকে। গোটা অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকালের একটি অনন্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে।
বিজয়ের মাসের শেষ দিনে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানিত করার জন্য একটি বিশেষ আয়োজন রেখেছিলাম। আলাউদ্দিন নামের এই মুক্তিযোদ্ধা ১২ বছর ধরে আমাদের ক্যাম্পাসে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার এ মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য এক লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন এবং আমরা সেটা তার হাতে তুলে দিই। তিনি যেন আরেকটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন সে জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। তার মেয়েকে প্রশাসনের একটি পদে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত দশটি সংগঠনের শিল্পীদের বিজয়ের মাসের গান পরিবেশনও ছিল অনুষ্ঠানের অংশ। তাজরীন গার্মেন্টের ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডের শিকার হয়েছেন যেসব শ্রমিক তাদেরও আমরা স্মরণ করেছি। সবশেষে ছিল গেরিলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।
মোট কথা, বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল বিজয়ের মাসের শেষ দিনের আয়োজনে। থার্টিফার্স্ট নাইটের হুল্লোড়-মাতামাতির তাতে স্থান ছিল না। গত ২৪ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দলে দলে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নাম জানা ও নাম না জানা বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ পথ চলার সময় মহাসড়কে যাতে যানজট সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সবাই সতর্ক ছিলেন। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতার বিকাশের জন্য এমনটিই প্রত্যাশিত।
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন :উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments