২০১৩ ॥ যা চাই তা জেনেবুঝেই চাইছি by মাসুদা ভাট্টি
বছরের শেষদিকে এসে সংবাদপত্রগুলো সাধারণত বছরকার আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে বিশদ সংবাদ-বিশ্লেষণ প্রকাশ করে থাকে। সালতামামি নামের এই আয়োজনটি সব দেশেই মোটামুটি একই রকম। স্বাভাবিকভাবেই এই আয়োজনে ভালমন্দের মিশেল থাকে।
কারণ, পৃথিবীর কোথাও বছরজুড়ে কেবলমাত্র খারাপ ঘটনাই ঘটে না, ইতিবাচকও অনেক কিছুই ঘটে। সুতরাং বস্তুনিষ্ঠতার দায় থেকেই পত্র-পত্রিকা সালতামামি প্রকাশেও ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু কিছু পত্রিকার ক্ষেত্রে বিষয়টি দেখতে পাই ভিন্ন রকম। সপ্তাহ ধরে তারা ২০১২ সালের আলোচিত ঘটনাবলী ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণসহ যে তথ্য প্রকাশ করছে তা দেখে যে কেউই ভাবতে পারেন যে, বাংলাদেশে আসলে ভাল কিছুই হয়নি। বাংলাদেশে কেবলই হত্যা, ধর্ষণ, কালোবাজারি, দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে; এর বাইরে কিছুই হয়নি। অথচ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, গবেষক, বিশ্লেষকগণ বলেন ভিন্ন কথা। এসব পত্রিকার সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং আজকের লেখায়, ২০১৩ সালকে আমি কেমন দেখতে চাই তা নিয়েই কথা বলব। এর মধ্যে আমি এই বিষয়টিও যুক্ত করতে চাই যে, কেবল সমালোচনা বা নেতিবাচক উচ্চারণই নয়, মাঝে মাঝে ইতিবাচক প্রশংসাও মানুষকে শুধরানোর ক্ষেত্রে খুব কাজে আসে। পশ্চিমের একটি সাধারণ ধারণা হচ্ছে, কারো সমালোচনা করার আগে তার প্রশংসা দিয়ে শুরু করা গেলে কাউকে আঘাত না দিয়েও অতি কার্যকরভাবে সমালোচনা করা সম্ভব। সমালোচনার উদ্দেশ্য যদি হয় সঠিকপথে ফিরিয়ে আনা তাহলে তার শুরুটা ইতিবাচক বার্তা দিয়েই হওয়া উচিত; যাতে এটা মনে না হয় যে, সমালোচনাকারী কেবল সমালোচনার জন্যই দাঁড়িয়েছেন, তার হাতের সমালোচনার তীর প্রথমেই শেষ করে ফেললে শেষ পর্যন্ত সমালোচনা পর্যবশিত হয় নিন্দায়। আমার মনে হয়, বিষয়টি আমাদের সকলেরই ভেবে দেখা উচিত।
একটি অনুষ্ঠানে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলাম প্রশ্নটির, কেমন দেখতে চাই বাংলাদেশকে? প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে বিশাল আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে সে সুযোগ নেই। তবে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যা বলা উচিত বলে আমি মনে করি, আজকে তাই-ই পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছি। এটি কেবল যে ২০১৩ সালের চাওয়া তা নয়, বরং আগামী যে কোন নতুন বছরের শুরুতে লেখাটি হুবহু ছেপে দেয়া যেতে পারে। কারণ এই চাওয়া সর্বকালের এবং সর্বজনীন বলেও আমি বিশ্বাস করি। পাঠকই বিচার করুন, চাওয়াগুলো কি খুব বেশি কিছু কি না।
রাজনীতি নিয়ে অরাজনীতি বন্ধ হোক
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ধরনের ব্যর্থতার কারণে রাজনৈতিক সিস্টেম নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এতদিন এই প্রশ্ন সমাজের কিছু মানুষের মুখে উচ্চারিত হলেও এখন প্রশ্নটি ক্রমশ ব্যাপ্তি পাচ্ছে সাধারণ্যেও। এই লক্ষণ ভাল নয়। ভাল নয় এ কারণে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব মানুষের ভেতর থেকেই তৈরি হয়, এবং তা যতটা সৎ ও যোগ্য মানুষের ভেতর থেকে হয় ততটাই মঙ্গলকর। কিন্তু রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তোলার প্রকল্প যেন বাংলাদেশে সত্যিই বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে বিষয়টি দিন দিন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে সৎ ও যোগ্য মানুষের জন্য। অথচ এ রকমটি চলতে থাকলে অতি অল্প সময়কালের মধ্যেই আমরা এমন এক নীতিশূন্য রাজনীতি চর্চার ফাঁদে আটকা পড়ব যা থেকে উদ্ধারের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। পশ্চিমে ইতোমধ্যেই মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে, যে কারণে জাতীয় নির্বাচনেও উপস্থিতির সংখ্যা এখন মাত্র ৩৫-৪০%। বাংলাদেশ এখনও সে অবস্থায় পৌঁছেনি, এখানেই আশার কথা। আমরা যদি ভোটের দিন নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করি তাহলে নিজেকেও ভোটপ্রার্থী হিসেবে যোগ্য করে তোলার চেষ্টা থেকে কেন সরিয়ে নেব? আমার মনে হয়, এখানেই রাজনীতির আসল গুরুত্বটি নিহিত। ২০১৩ সালেই আমরা পেতে যাচ্ছি আরেকটি জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন যেন কোনভাবেই অরাজনৈতিক কোন পক্ষের হাতে না যায়; সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যেন আমরা যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে আনতে পারি, সে আশাই ধারণ করি। এখানে বলার মূল কথাটি হচ্ছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও সফল একটি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক, সমুন্নত থাকুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের মতো কোন শিখ-ীর হাতে নয়, পাঁচ বছর দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষে ফলাফল মেনে নিয়ে সরকার কিংবা বিরোধী দলে থেকে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখুক।
নিরাপদ হোক মানুষের জীবন
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নরসিংদীর একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু এ রকম করুণ মৃত্যুর শিকার বাংলাদেশে বোধ করি সবচেয়ে বেশি হয়। আলোচিত কোন ব্যক্তির এ রকম দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেই কেবল তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে, নচেৎ এ নিয়ে তেমন কোন কথাই শোনা যায় না। অথচ কোন মৃত্যুই যে স্বাভাবিক নয়, একথা আমাদের অজানা নয়। পৃথিবীতে একটি দিনও যদি কাউকে বেশি বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটাই স্বাভাবিকতা, সেটাই স্বার্থকতা। কিন্তু এদেশে আমাদের নিজেদের অবহেলা, অসতর্কতা আর কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, নিস্পৃহতা এবং সিস্টেমের অপব্যবহারের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা, যার মধ্যে আমরা সন্ত্রাসকেও যুক্ত করতে পারি। অর্থাৎ যেসব ঘটনাকে আমরা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, খানিকটা সচেতনতায়, একটুখানি সচেষ্ট হলেই সেসব যাতে না ঘটে সে আশাটুকু তো করাই যায়, তাই না? রাষ্ট্র যদি মানুষকে কেবল এই নিশ্চয়তাটুকু দিতে পারে তাহলে রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা খুব দ্রুতই ফিরে আসবে। এখন আসলে সেই আস্থার জায়গাটি এতটাই ঠুন্কো এবং নড়বড়ে যে, তা উল্লেখের কোন অর্থ হয় না। আমার মনে হয় সেই আস্থার জায়গাটিই এখন ফিরিয়ে আনাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেউই যেন অভুক্ত না থাকে
এক্ষণে বাংলাদেশের সাফল্য সত্যিই অভূতপূর্ব। একথা সত্যি যে, মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও এই চিত্রটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভুক্ত ও নিরন্ন মানুষের সংখ্যা এ দেশে উল্লেখযোগ্য ছিল। খাদ্য ঘাট্তি ছিল বছরের নৈমিত্তিক সমালোচনার অন্যতম। কিন্তু ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে এটুকুই কেবল বলা যায় যে, এখনকার গণমাধ্যমে এই অভুক্ত মানুষের খবর আর পাওয়া যায় না। বাস্তব গবেষণায় হয়ত আসল সত্য উঠে আসবে কিন্তু পত্র-পত্রিকা এ ব্যাপারে যেহেতু নীরব সেহেতু ধরেই নেয়া যায় যে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথাটি সত্য। কিন্তু খাদ্যমূল্য বেশ চড়া একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে। হতে পারে উচ্চ ফলনমূল্য, আন্তর্জাতিক বাজার এবং অন্যান্য কিছু বাধা রয়েছে খাদ্যমূল্য না কমানোর ক্ষেত্রে, কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালকগণ এই বিষয়গুলো ভেবে কার্যকর পথ বের করে খাদ্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের ভেতর রাখতে পারেন না, মেধায় এমন দেউলিয়া তাদের ভাবতে আমরা কেউই চাই না; বরং আমরা চাই যে, ক্ষমতাসীনরা মানুষের এই মৌলিক চাহিদার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্বসহকারে দেখে এর সমাধানে ব্রতী হবেন। এখনকার দাবি কেবল অভুক্ত না রাখা নয়, এখনকার দাবি খাদ্যদ্রব্যকে সহজলভ্য, সুলভ এবং স্বাস্থ্যগতভাবে নিরাপদ রাখা। যা খাই বা খেতে চাই তা যেন সহজে পাই, সস্তায় পাই এবং তা যেন হয় স্বাস্থ্যকর। খুব বেশি চাওয়া হলো কি?
শিক্ষা অধিকার নয়, বাধ্যতামূলকভাবে পেতে চাই
পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত হলে মনের ক্ষুধা মেটানোর দাবি উঠতেই পারে, কিন্তু এ ধারণা পুরনো। এখনকার কথা হচ্ছে, শিক্ষা কেবল মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য নয় বরং সভ্যতার প্রয়োজনেই দেশের জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার দায়ভার সরকারের। রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, রাষ্ট্রকে আধুনিক করে তুলতে এবং মানুষকে যোগ্য করে তুলতে হলে শিক্ষার গুরুত্বটা উপলব্ধি করেই রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য, কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য কথাটির আসলে কোনই সুনির্দিষ্ট মাত্রা নেই। এ কারণেই চাওয়াটাও এক্ষেত্রে উন্মুক্ত। কতটুকু শিক্ষাপ্রাপ্তি মানুষকে আলোকিত করবে বা যোগ্য করে তুলবে তা ভেবে নয়, বরং শিক্ষাকে সর্বজনীন ও সহজলভ্য করে তোলার দায়িত্বটুকু রাষ্ট্র নিতে পারলে বাকিটুকু তো আমাদের নিজেদের ওপরই নির্ভর করছে।
তালিকা আরও দীর্ঘ করা যেত। কিন্তু চাওয়ার তো আসলে কোন শেষ নেই। এ কথা তো সত্যি যে, কয়েকটি মৌলিক ক্ষেত্রে যদি প্রাপ্তিযোগ নিশ্চিত হয় তাহলে বাকিগুলো এমনিতেই কাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। প্রতিমাশিল্পী যদি খড়, মাটি আর রঙ হাতে পান তাহলে ভাস্কর্য গড়ার বাকি সব উপকরণ একটু চেষ্টা করলেই জোগাড় করে নিতে পারেন এবং নিয়ে একটি ভাস্কর্য দাঁড়ও করিয়ে ফেলেন। রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে সম্পর্কটাও তেমনই। রাষ্ট্র জনগণকে বাঁচিয়ে রাখবে বেঁচে থাকার সব স্বাভাবিক উপকরণকে সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করে দিয়ে, বাকিটুকু জনগণই ঠিক করে নেবে তারা কিভাবে বাঁচতে চায় তার ভিত্তিতে। সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব রাষ্ট্রের, গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের- সম্পর্কটা এখানে দ্বিপাক্ষিক, আর যে কোন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মতো দেয়া-নেয়া এক্ষেত্রেও সমানে সমান। যে রাষ্ট্র ও জনগণ এই দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক সফলভাবে বজায় রাখতে পেরেছে বা পারছে তারাই সফল রাষ্ট্র; যারা পারেনি বা পারবে না তারাই ব্যর্থ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের জনগণের ভেতর যেন এই দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়, সেটাই মূলত চাওয়া। এই চাওয়াকে খুব বেশি বিস্তারিত করে বলার কিছুই নেই।
সকলে ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইল।
ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর, সোমবার। ২০১২।
লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ
masuda.bhatti@gmail.com
No comments