বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা by শওকত হোসেন
বাংলাদেশের সামনে এখন তিনটি পথ। একটি হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। আরেক পথ ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাড়িয়ে যাওয়া। আর সর্বশেষ পথটি হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ কোন পথে যাবে?বিশ্বব্যাংক মনে করে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ সম্ভব। লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের মতামত নিয়ে লিখেছে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালে পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যাবে। এ দুটি বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে। স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে সর্বশেষ পূর্বাভাসটি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তা-ও আবার কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়, সরকার নিজেই।
ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি সংস্থা। তাদের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে, চার বছর পর পর নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য বৈশ্বিক অর্থনীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা। ১৮টি সরকারি ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কিন্তু শপথ নেওয়ার আগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বারাক ওবামা আবার নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর জন্য প্রকাশিত এবারের প্রতিবেদনটির নাম ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস ২০৩০: অলটারনেটিভ ওয়ার্ল্ডস’। অর্থাৎ ২০৩০ সালে সারা বিশ্বের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দেশগুলো এগিয়ে যাবে আর যুক্তরাষ্ট্র কী করবে—তারই বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। মূলত আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের বিশ্ব অর্থনীতির বিশ্লেষণই করা হয়েছে এতে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হবে চীন। বড় অর্থনীতির দেশ হবে ভারতও। ইউরোপ, জাপান ও রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতিগুলোর শ্লথগতি অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ, ব্রিকস দেশগুলোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) মধ্যে একটি ছাড়া সবাই অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে এর পরই রয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
২০০৫ সালে বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল ব্রিকসের ধারণা দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ব্রিকস ছাড়া তিনি সম্ভাবনাময় আরও ১১টি দেশের কথা বলেছিলেন। এ দেশগুলোর অর্থনীতিও এগিয়ে আসছে বলে তাদের বলা হয়েছিল ‘নেক্সট ইলেভেন’। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ নেক্সট ইলেভেন সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হয়েই থাকবে। তবে সামগ্রিকভাবে এশিয়া ছাড়িয়ে যাবে সবাইকে। বলা হয়েছে, ব্রিটেনের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে ১৫৫ বছর লেগেছিল, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছে ৩০ থেকে ৬০ বছর। অথচ অনেক বেশি জনসংখ্যা নিয়েও ভারত ও চীনের তা লাগছে ২০ বছর। বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বাড়লেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও কমবে। এখন দিনে এক ডলার ২৫ সেন্টের কম আয় করে—এমন মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি। আগামী ২০ বছরে এর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। আর বাড়বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। এখন বিশ্বে মধ্যবিত্ত আছে ১০০ কোটি, এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৩০০ কোটি। মধ্যবিত্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়বে এশিয়ায়। বিপুলসংখ্যক এ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাই বাড়াবে প্রবৃদ্ধি। সে সময় বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮৩০ কোটি, যা এখন ৭১০ কোটি।
এমনিতেই বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিস্ময় বা ধাঁধা বলা হয়। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, গড় আয়ু ৫০ থেকে ৬৫ হয়েছে। গণসাক্ষরতার হার দ্বিগুণ হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে কমে দেড় শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৭৩-৭৫ সময়েও বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। এমনকি ১৯৯০ সময় পর্যন্তও গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই প্রবৃদ্ধি এখন ৬ শতাংশের বেশি।
তবে সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতেই সবচেয়ে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। যেমন, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ, বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়নসচেতন এবং সুযোগ পেলে সংগতির মধ্যে নতুন যেকোনো উন্নয়ন ধারণা পেলেই তারা গ্রহণ করে। যেমন, শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে খাওয়ার স্যালাইন।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একাধিকবার লিখেছেন, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক সদানন্দ ধুম গত দুই বছরে তাঁর পত্রিকায় একাধিকবার লিখেছেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় একটি দেশ।
স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকেই বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়েছিল। তখন কোনো অবকাঠামো ছিল না, প্রতিষ্ঠানও ছিল না। বলা হতো, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের পরীক্ষাগার। অর্থাৎ, এ রকম পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় এখনো বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলা হয়। তবে অন্য অর্থে। প্রশ্ন করা হয়, সুশাসনের এত অনুপস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশে এত প্রবৃদ্ধি হলো কেমন করে? এ রকম প্রবৃদ্ধি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার উন্নতি না হলেও ধরে রাখা যাবে কি না, এ বিষয়ে বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলা হয়।
আরেকটি ক্ষেত্রেও বলা যায়। এত স্বল্প মাথাপিছু আয়ের দেশে এত দিন ধরে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক চর্চার নজির অন্য কোনো দেশে নেই। আশির দশকের শেষ দিকে অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রায়ণের জোয়ার বইছিল। কিন্তু সবাই তা ধরে রাখতে পারেনি। গণতন্ত্রের গুণগত মান যা-ই হোক, বাংলাদেশ ধরে রাখতে পেরেছে। এখানেই বাংলাদেশ আরেকটি পরীক্ষাগার। কারণ, এ রকম একটি স্বল্প আয়ের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ হাতে হাত রেখে চলতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কেননা, স্বল্প আয় ও সুশাসনের অভাব পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কারণেই এটি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যত এগিয়ে গেছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ততটা এগোতে পারেনি, অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের চাহিদাও তৈরি হয়। সুশাসনের চাহিদা তৈরি করে যদি ওই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলেই কেবল বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক শক্তির কথা বাইরে বলা হচ্ছে, সেই শক্তি কাজে লাগাতে পারবে। বাংলাদেশ নিয়ে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে, তা সফল হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যতগুলো এ ধরনের ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, তার সবগুলোতেই একটা কিন্তু আছে। সেটি হলো, বাংলাদেশ কি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে, যেখানে ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয়তা ও আস্থার জায়গা তৈরি হবে? কারণ, এটাই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান। কাজেই আমাদের যে অর্থনৈতিক শক্তি আছে, তার পরিচয় আমরা দিয়েছি। চ্যালেঞ্জটি হলো, তা ধরে রাখার মতো রাজনীতির চর্চা আমরা করতে পারব কি না।’
সব ধরনের গবেষণাতেই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হলো কৃষি। একসময় বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল দুর্ভিক্ষে জর্জরিত দেশ হিসেবে। এখন তা ইতিহাস। মঙ্গার মতো মৌসুমি খাদ্যাভাবও কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এর বাইরে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো ক্ষুদ্র উদ্যোগ, শ্রমশক্তি রপ্তানি ও তৈরি পোশাক খাত। তিন ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি এসেছে মূলত একে অন্যকে অনুসরণ করে। সুতরাং, প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে যেতে হলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাজার ও প্রযুক্তির উন্নয়ন দরকার। আবার আরও দক্ষ শ্রম রপ্তানি করতে পারলে প্রবাসী-আয় আরও বাড়বে।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের কম মজুরিই যদি আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার একমাত্র উপায় হয়, তাহলে তো সেই প্রবৃদ্ধি দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। এ ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে। কেননা, দারিদ্র্য দূর করাই তো প্রবৃদ্ধির আসল লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ নিয়ে সবার আশাবাদের আরেকটি বড় কারণ এর জনসংখ্যা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সুবিধা হলো, জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখানে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার তুলনায় আগামী দুই থেকে তিন দশকে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকবে। এখানে তরুণদের সংখ্যা বয়স্কদের তুলনায় অনেক দিন বেশি থাকবে। এটি একটি সুযোগ, যা একবারই আসে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে চীন ও ভারত। চীনের কর্মক্ষম মানুষ উৎপাদন খাতে বেশি কাজে লেগেছে, আর ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। এটাকে বলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। বিশ্বব্যাংক বলছে, জনসংখ্যার এ লভ্যাংশ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষকে কাজ দিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুযোগ কি কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ? মার্কিন ওই প্রতিবেদনে একটি খারাপ দৃশ্যকল্পেরও বর্ণনা আছে। সেটি হলো, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা পানি ও খাদ্য নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে। অস্থিতিশীলতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটে পড়বে। আর তাতে বিপদে পড়বে বাংলাদেশের মতো দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়া ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ মার্কিন জ্বালানি বিভাগের জন্য কাজ করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, মাথাপিছু ভূমির ব্যবহার, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর একটি তালিকাও তারা দেশটির প্রেসিডেন্টের জন্য তৈরি করেছে। বর্তমান তালিকায় এ রকম ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। আর ২০৩০ সালে বাংলাদেশ থাকবে ১৫তম অবস্থানে। সুতরাং বলা যায়, বিশ্বজুড়ে এত আশাবাদের মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিও কম নেই।
ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স কাউন্সিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি সংস্থা। তাদের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে, চার বছর পর পর নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য বৈশ্বিক অর্থনীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা। ১৮টি সরকারি ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কিন্তু শপথ নেওয়ার আগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। বারাক ওবামা আবার নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর জন্য প্রকাশিত এবারের প্রতিবেদনটির নাম ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস ২০৩০: অলটারনেটিভ ওয়ার্ল্ডস’। অর্থাৎ ২০৩০ সালে সারা বিশ্বের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দেশগুলো এগিয়ে যাবে আর যুক্তরাষ্ট্র কী করবে—তারই বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। মূলত আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের বিশ্ব অর্থনীতির বিশ্লেষণই করা হয়েছে এতে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হবে চীন। বড় অর্থনীতির দেশ হবে ভারতও। ইউরোপ, জাপান ও রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতিগুলোর শ্লথগতি অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ, ব্রিকস দেশগুলোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) মধ্যে একটি ছাড়া সবাই অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে এর পরই রয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
২০০৫ সালে বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল ব্রিকসের ধারণা দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ব্রিকস ছাড়া তিনি সম্ভাবনাময় আরও ১১টি দেশের কথা বলেছিলেন। এ দেশগুলোর অর্থনীতিও এগিয়ে আসছে বলে তাদের বলা হয়েছিল ‘নেক্সট ইলেভেন’। দেশগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ নেক্সট ইলেভেন সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিধর দেশ হয়েই থাকবে। তবে সামগ্রিকভাবে এশিয়া ছাড়িয়ে যাবে সবাইকে। বলা হয়েছে, ব্রিটেনের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে ১৫৫ বছর লেগেছিল, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছে ৩০ থেকে ৬০ বছর। অথচ অনেক বেশি জনসংখ্যা নিয়েও ভারত ও চীনের তা লাগছে ২০ বছর। বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বাড়লেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও কমবে। এখন দিনে এক ডলার ২৫ সেন্টের কম আয় করে—এমন মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি। আগামী ২০ বছরে এর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। আর বাড়বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। এখন বিশ্বে মধ্যবিত্ত আছে ১০০ কোটি, এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৩০০ কোটি। মধ্যবিত্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়বে এশিয়ায়। বিপুলসংখ্যক এ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাই বাড়াবে প্রবৃদ্ধি। সে সময় বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮৩০ কোটি, যা এখন ৭১০ কোটি।
এমনিতেই বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিস্ময় বা ধাঁধা বলা হয়। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, গড় আয়ু ৫০ থেকে ৬৫ হয়েছে। গণসাক্ষরতার হার দ্বিগুণ হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে কমে দেড় শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৭৩-৭৫ সময়েও বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। এমনকি ১৯৯০ সময় পর্যন্তও গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই প্রবৃদ্ধি এখন ৬ শতাংশের বেশি।
তবে সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতেই সবচেয়ে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। যেমন, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ, বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়নসচেতন এবং সুযোগ পেলে সংগতির মধ্যে নতুন যেকোনো উন্নয়ন ধারণা পেলেই তারা গ্রহণ করে। যেমন, শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে খাওয়ার স্যালাইন।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একাধিকবার লিখেছেন, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও ভালো। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক সদানন্দ ধুম গত দুই বছরে তাঁর পত্রিকায় একাধিকবার লিখেছেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় একটি দেশ।
স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকেই বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়েছিল। তখন কোনো অবকাঠামো ছিল না, প্রতিষ্ঠানও ছিল না। বলা হতো, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের পরীক্ষাগার। অর্থাৎ, এ রকম পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব।
বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় এখনো বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলা হয়। তবে অন্য অর্থে। প্রশ্ন করা হয়, সুশাসনের এত অনুপস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশে এত প্রবৃদ্ধি হলো কেমন করে? এ রকম প্রবৃদ্ধি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার উন্নতি না হলেও ধরে রাখা যাবে কি না, এ বিষয়ে বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলা হয়।
আরেকটি ক্ষেত্রেও বলা যায়। এত স্বল্প মাথাপিছু আয়ের দেশে এত দিন ধরে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক চর্চার নজির অন্য কোনো দেশে নেই। আশির দশকের শেষ দিকে অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রায়ণের জোয়ার বইছিল। কিন্তু সবাই তা ধরে রাখতে পারেনি। গণতন্ত্রের গুণগত মান যা-ই হোক, বাংলাদেশ ধরে রাখতে পেরেছে। এখানেই বাংলাদেশ আরেকটি পরীক্ষাগার। কারণ, এ রকম একটি স্বল্প আয়ের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ হাতে হাত রেখে চলতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কেননা, স্বল্প আয় ও সুশাসনের অভাব পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কারণেই এটি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যত এগিয়ে গেছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ততটা এগোতে পারেনি, অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের চাহিদাও তৈরি হয়। সুশাসনের চাহিদা তৈরি করে যদি ওই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলেই কেবল বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক শক্তির কথা বাইরে বলা হচ্ছে, সেই শক্তি কাজে লাগাতে পারবে। বাংলাদেশ নিয়ে যে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে, তা সফল হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যতগুলো এ ধরনের ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, তার সবগুলোতেই একটা কিন্তু আছে। সেটি হলো, বাংলাদেশ কি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে, যেখানে ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চয়তা ও আস্থার জায়গা তৈরি হবে? কারণ, এটাই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান। কাজেই আমাদের যে অর্থনৈতিক শক্তি আছে, তার পরিচয় আমরা দিয়েছি। চ্যালেঞ্জটি হলো, তা ধরে রাখার মতো রাজনীতির চর্চা আমরা করতে পারব কি না।’
সব ধরনের গবেষণাতেই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হলো কৃষি। একসময় বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল দুর্ভিক্ষে জর্জরিত দেশ হিসেবে। এখন তা ইতিহাস। মঙ্গার মতো মৌসুমি খাদ্যাভাবও কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এর বাইরে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো ক্ষুদ্র উদ্যোগ, শ্রমশক্তি রপ্তানি ও তৈরি পোশাক খাত। তিন ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি এসেছে মূলত একে অন্যকে অনুসরণ করে। সুতরাং, প্রবৃদ্ধির পরবর্তী ধাপে যেতে হলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাজার ও প্রযুক্তির উন্নয়ন দরকার। আবার আরও দক্ষ শ্রম রপ্তানি করতে পারলে প্রবাসী-আয় আরও বাড়বে।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের কম মজুরিই যদি আমাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার একমাত্র উপায় হয়, তাহলে তো সেই প্রবৃদ্ধি দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। এ ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে। কেননা, দারিদ্র্য দূর করাই তো প্রবৃদ্ধির আসল লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ নিয়ে সবার আশাবাদের আরেকটি বড় কারণ এর জনসংখ্যা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সুবিধা হলো, জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখানে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার তুলনায় আগামী দুই থেকে তিন দশকে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকবে। এখানে তরুণদের সংখ্যা বয়স্কদের তুলনায় অনেক দিন বেশি থাকবে। এটি একটি সুযোগ, যা একবারই আসে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে চীন ও ভারত। চীনের কর্মক্ষম মানুষ উৎপাদন খাতে বেশি কাজে লেগেছে, আর ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। এটাকে বলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। বিশ্বব্যাংক বলছে, জনসংখ্যার এ লভ্যাংশ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষকে কাজ দিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুযোগ কি কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ? মার্কিন ওই প্রতিবেদনে একটি খারাপ দৃশ্যকল্পেরও বর্ণনা আছে। সেটি হলো, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা পানি ও খাদ্য নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে। অস্থিতিশীলতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটে পড়বে। আর তাতে বিপদে পড়বে বাংলাদেশের মতো দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়া ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ মার্কিন জ্বালানি বিভাগের জন্য কাজ করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, মাথাপিছু ভূমির ব্যবহার, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর একটি তালিকাও তারা দেশটির প্রেসিডেন্টের জন্য তৈরি করেছে। বর্তমান তালিকায় এ রকম ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। আর ২০৩০ সালে বাংলাদেশ থাকবে ১৫তম অবস্থানে। সুতরাং বলা যায়, বিশ্বজুড়ে এত আশাবাদের মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিও কম নেই।
No comments