সাহিত্যে দুই দিকপালের বিদায় by মুস্তাফিজ শফি
সেদিন ১৯ জুলাই ২০১২, মঙ্গলবার। টাঙ্গাইলে আমাদের আনন্দ অনুষ্ঠানটি হঠাৎ করেই বিষণ্ণ তায় স্তব্ধ হয়ে গেল। বিলেত প্রবাসী কবি ফারুক আহমেদ রনির পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম সপরিবারে। সেখানেই রাতে খবর পেলাম নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।
জোৎস্না নয়, তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। আমরা দৌড়ে গিয়ে টিভির সামনে বসে পড়লাম। একে, ওকে ফোন করতে লাগলাম। কান্না আর হাহাকারের ধ্বনি সংক্রমিত হতে থাকল একজন থেকে অন্যজনে। কয়েকদিন আগে থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমাদের কাছে খারাপ নানা খবর আসছিল, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতিও ছিল, কিন্তু তারপরও সেদিন বার বার মনে হচ্ছিল প্রিয় লেখকের এভাবে চলে যেতে নেই। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নেমেছে যে ঘোর অন্ধকার তা কাটবে কবে; আমরা জানি না, আর কত বছর বা যুগ পরে বাংলা সাহিত্য আরেকজন হুমায়ূন পাবে।মাত্র তিন মাসের ব্যবধান। মোবাইল ফোনের ব্রেকিং নিউজ এলার্ট স্তব্ধ করে দিল মননশীল বাঙালীর হƒদয়। আমরা খবর পেলাম সে রাতেই নিদ্রা থেকে চিরনিদ্রায় চলে গেছেন বাংলা সাহিত্যের আরেক বরপুত্র, উভয় বাংলার জনপ্রিয় লেখক, কবি-কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হুমায়ূন আর সুনীল- দু’জনের মধ্যে অনেক মিল ছিল, ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। বাংলার পূর্ব-পশ্চিমকে আলোকিত করে রাখা সাহিত্যাকাশের এই দুই জ্বলজ্বলে তারকা মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। হঠাৎ করে কী এমন হয়ে গেল যে, দুই বন্ধুকে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে!
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রিয় লেখকদের তালিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম রাখতেন উপরের দিকে। আর সুনীলও হুমায়ূনকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বহু জায়গায়। হুমায়ূনের মৃত্যুর পরও বলেছেন একই কথা। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায় এই খবর যথাযথভাবে প্রকাশ না হওয়ায় আক্ষেপও করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে যে কী পরিমাণ ভালবাসতেন, সেটা আমরা জেনেছি তাঁরই একাধিক লেখায়। সুনীল ঢাকায় এলে হুমায়ূনের সঙ্গে আড্ডায় বসতেনই, এটা ছিল নির্ধারিত বিষয়। বাংলা গল্প-উপন্যাসের পাঠকরাও পছন্দ করত এই দু’জনকে। সাধারণ পাঠকদের কেউ এগিয়ে রাখত হুমায়ূনকে, কেউ সুনীলকে। তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে মননশীল সচেতন পাঠকরা সুনীলকে বরাবরই এগিয়ে রাখেন। দু’জনের সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা আমাদের আজকের বিষয় না হলেও একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করতেই হবে যে, কথিত সাহিত্য সমালোচকদের মুখে আমৃত্যু ‘অগভীর’ লেখক এই অভিযোগের বিরুদ্ধে লেখক হিসেবে রীতিমতো বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয়েছে হুমায়ূন আহমেদকে। তিনি ‘জনপ্রিয়’ তাই তাঁর লেখা পড়তে ভাবতে হয় না, তাঁর লেখা বেশিদিন টিকবে না এ ধরনের কথা বারবারই বলা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। অথচ সুনীলের ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ মাপের উপন্যাস নিয়ে সচেতন পাঠকরা যখন উৎফুল্ল, যখন সত্যজিৎ, বুদ্ধদেবের পর গৌতম ঘোষও সুনীলের উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত তখন কিন্তু বসে ছিলেন না হুমায়ূন আহমেদ। লিখেছেন ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘আগুনের পরশমণি’ কিংবা ‘বাদশাহ নামদার’। হুমায়ূন লিখেছেন তিন শ’রও অধিক গ্রন্থ। আগে থেকে মনের ভেতর কোন রাগ-অনুরাগ না রেখে নিবিষ্ট মনে তাঁর লেখা পাঠ করলে অবশ্যই দেখা মিলবে এমন এক লেখকের যিনি জীবন সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবেন, জীবনের অনিষ্ট খোঁজেন, মানুষের চরিত্রের আলো-অন্ধকার সম্পর্কে যার ধারণা স্পষ্ট, মানুষের জীবনযাপনকে যিনি অসীম মমতা ও ভালবাসায় নিজের কলমে ধারণ করেন।
হুমায়ূনের সঙ্গে আমার কোন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। তবে পেশাগত কারণে কয়েকবারই দেখা হয়েছে। একবার একসঙ্গে ঢাকার বাইরে গিয়েছি, তাঁর অনেক অনেক এ্যাসাইনমেন্ট কভার করেছি আর ছোট্ট একটি সাক্ষাতকার নিয়েছি পত্রিকার জন্য, এই তো। সুনীলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বুঝায়, তা ছিল না। কয়েকবারই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, অন্যদের আয়োজিত আড্ডায় মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়েছি। অংশগ্রহণের সাহস করিনি, একেবারে কনিষ্ঠজন হওয়ার কারণে। তবে ১৯৯৬ সালে এই কনিষ্ঠজনকেও একবার নিজের লেখালেখি ও সাহিত্য ভাবনা নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন সুনীল। ঘনিষ্ঠ থাকাটা বড় কথা নয়, প্রসঙ্গটি উত্থাপনের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের বয়সী যারা তাদের কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে দূরে থেকেও অন্যতম ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছিলেন এই দুই লেখক। তাঁরা লিখে গেছেন আর আমরা গোগ্রাসে পাঠ করেছি আর নিজেকে শাণিত করেছি, লেখার জন্য প্রস্তুত করেছি। তাঁদের দেখানো পথে চোখের সামনে সেই যে খোলে গেছে সাহিত্যের অপার জানালা, জানালার সামনে বিশাল মহাসিন্ধু, এখনও খোঁজে বেড়াচ্ছি তার অতল।
গলা উঁচু করে বড্ড বলতে ইচ্ছে করে সুনীল আমাদেরই লোক ছিলেন। আমাদের ফরিদপুরেই তাঁর জন্ম। তাঁর স্কুল শিক্ষক বাবা দেশভাগের আগেই ভারতে চলে যান। কিন্তু সুনীল তাঁর শৈশবের স্মৃতিমাখা দেশটাকে কখনও তিনি ছাড়তে পারেননি। ভুলতে পারেননি। সব সময়ই থাকতেন স্মৃতিতাড়িত। ছিলেন বাংলা ও বাঙালী অন্তপ্রাণ। কলকাতায় বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখতে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। ‘ক্যালকাটা’ থেকে ‘কলকাতা’ নামটিও কিন্তু তাঁরই অবদান। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় এসে এই লেখককে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এসে সাধারণ মানুষের যে ভালবাসা পাই তাতে অভিভূত হয়ে পড়ি। মনে হয়, আপনজনের মধ্যে এসে পড়েছি। সকলেই বলে কেন ফিরে যাচ্ছেন, আরও কিছুদিন থাকুন। থাকা হয় না নানা কারণে। একটা বিচ্ছেদের বেদনা নিয়ে ফিরে যেতে হয়।’ দীর্ঘ এই সাক্ষাতকারে নিজের কবিতাকে তিনি তাঁর জীবন থেকেই উঠে এসেছে বলে উল্লেখ করেন। তুমুল প্রেমের অনেক জনপ্রিয় কবিতার কবি সুনীলের মতে, ভাল কবিতা লিখতে হলে কবিকে বারবার প্রেমে পড়তে হয়।
বাংলাদেশের পাঠকরাও তাঁকে নানাভাবে টানত। সেই সাক্ষাতকারেই বলেছিলেন, ‘পাঠকরা মাঝে মাঝে এমন ভালবাসার পরিচয় দেয় যে, অভিভূত হয়ে যাই। এই বাংলাদেশ থেকে আকস্মিকভাবে কেউ কেউ আমাকে উপহার পাঠায়। যেমন আমি একটি মেয়ের কথা বলছিÑ ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকে। সে পোস্ট খামের মধ্যে ভরে আমার জন্যে একটা শাল পাঠিয়েছে, যা তার নিজের হাতের বোনা। এটা যখন আমি পরি তখন তার প্রীতির স্পর্শ পাই।’
এই হলেন আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পাদনা করেছেন কবিতাপত্র ‘কৃত্তিবাস’। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে এই ‘কৃত্তিবাস’ তরুণ কবিদের মুখপত্র হয়ে ওঠে। পত্রিকাটি বরাবরই বাংলা ভাষার তরুণ কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। বাংলাদেশের কয়েকজন কবি কৃত্তিবাস পুরস্কারও পেয়েছেন। ষাট দশকের শুরুতে কবিতা লেখার সূত্রেই সাহিত্যের ওপর পড়তে যান আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে বছরখানেক পড়াশোনা করে দেশে ফেরেন ‘কেবল বাংলা ভাষায় লিখবেন’ বলে। ১৯৬৬ সালে সুনীল লিখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। সাবলীল, অকপট, হাস্যময় এক তারুণ্যদীপ্ত জীবনের গল্পনির্ভর এই উপন্যাস সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটেই এক নতুন বাঁকের সূচনা ঘটায়। মধ্যরাতে কলকাতা দাপিয়ে বেড়ানো কয়েকজন যুবকের কাহিনী যেন ষাট দশকের উন্মূল তারুণ্যেরই প্রতিচ্ছবি; যারা জীবনকে তীব্রভাবে ভালবাসে; দু’হাতে জীবন উপভোগ করতে জানে। ‘আত্মপ্রকাশ’-এর মধ্য দিয়ে যথার্থই আত্মপ্রকাশ ঘটে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। তারপর তো লিখে গেছেন একের পর এক। নীললোহিত ও সনাতন পাঠক ছদ্মনামেও প্রচুর লিখেছেন। নীললোহিত নামে লিখতেন সাতাশ বছরের এক তরুণের বাউ-ুলে তারুণ্যের রচনা। আর সনাতন পাঠক নামে লিখতেন সাহিত্য সমালোচনা। জীবনকে ভালবেসেছিলেন সুনীল। জীবনকে তীব্র উদ্যাপনের কথাও তিনি নানাভাবে বলেছেন গল্পে-কবিতায়। তাই হয়ত কাউকে কষ্ট না দিয়ে খুব নিরিবিলি মধ্যরাতে একা তিনি চলে গেলেন। হয়ত হাসতে হাসতেই। কারণ, তিনি বলতেন, ‘জীবন মানে/ফুসফুস ভরা হাসি’।
কবি হিসেবে সুনীল ছিলেন অসাধারণ। আমাদের প্রথম জীবনে তাঁর কবিতা ছিল ভালবাসা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। আমাদের আচ্ছাদন করে রাখত তেত্রিশ বছর কেটে যাওয়া সেই যুবক, নিখিলেশের বেঁচে থাকা আর নীরার হাসি। প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর চলে যাওয়াকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবেÑ ‘সুনীলের আকস্মিক এই চলে যাওয়া যেন পাখির চোখে বালুকণারও অসামান্যতা দেখতে দেখতে চলে যাওয়া। যমুনার হাত ধরে স্বর্গের বাগানে এখন তাঁর ছোটোছুটির সময়। কী রকমভাবে বেঁচে ছিলেন তিনি, নতুন দিনের পাঠকরা এখন থেকে তা জানবেন শুধু তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে।’
সুনীল তাঁর সাহিত্যকে বারবার বদলে দিয়েছেন। বাঁক পরিবর্তন করেছেন। এটা যেমন তাঁর উপন্যাস গল্পে প্রযোজ্য তেমনি তাঁর কবিতাতেও প্রযোজ্য। কবিতার প্রসঙ্গটিও আমরা জানতে পারি শঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে। কেমন হতে পারে নতুন দিনের কবিতা, এ নিয়ে তরুণ সুনীলকে একবার চিঠি লিখেছিলেন তাঁর সদ্য-পাওয়া বন্ধু এ্যালেন গিনসবার্গ ষাটের দশকে। ‘হাউল’ দিয়ে জগত সংসার মাতিয়ে গিনসবার্গ তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতা-বারানসী, একাকার মিশে গেছেন ‘কৃত্তিবাস’-এর কবি দলের সঙ্গে। সেই সময়টায় তিনি লিখেছেন সুনীলকে, ‘যা কিছু তুমি অনুভব কর তাকে ঠিক-ঠিক বলে যাওয়াটাই হলো কবিতার কাজ, যেখানে থাকবে তোমার সমস্ত রকম স্বীকারোক্তি, সমস্ত রকম অসন্তোষ, সমন্ত রকম উচ্ছলতা। ‘কী তোমার হওয়াা উচিত’ সে দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না রেখে কবিতা আজ জানতে চায় তুমি ঠিক কেমন।’
শঙ্খ ঘোষ বলেন, নিজেরই মধ্য থেকে তেমন এক অভিমুখে এগোতে চাইছিলেন সুনীল, তবু গিনসবার্গের ওই চিঠিটি বোধ হয় সাহায্য করেছিল তাঁর শেষ দ্বিধাটুকু ভেঙে দিতে। ‘একা এবং কয়েকজন’-এর কবি তাই এক ঝটকায় এগিয়ে এলেন ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’-র বৃত্তান্তে। আর, এই বৃত্তান্ত শুধু যে তাঁর ওই একটিমাত্র বইয়েরই নাম হয়ে রইল তা নয়, এটাই হয়ে দাঁড়াল তাঁর সমস্ত কবিতার সাধারণ পরিচয়। তাঁর কবিতা, তাঁর বেঁচে থাকার ধারাবিবরণ। এমনই ভাবে সে বিবরণ তিনি বলে যান নতুন কালের ভাষায় যে অনেক পাঠকই তাতে দেখতে পান তাদেরও আত্মপ্রতিচ্ছবি, নিজে নিজে যা তারা দেখতে পাননি, হয়তবা দেখতে চাননি। এভাবে আত্মস্বীকারোক্তি দিয়েই সুনীল তৈরি করে তুলতে পেরেছিলেন বড় একটা পাঠকসমাজেরও স্বীকারোক্তি। আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, সেটা দেখতে গেলে কেবল যে আমিটুকুতেই আটকে থাকে মানুষ, তা কিন্তু নয়। আমার সেই বেঁচে থাকার মধ্যে আমার নিজস্ব দৈনন্দিন যেমন আছে, তেমনি তো আছে আমার চারপাশের মানুষজনও, চারপাশের পৃথিবীও। সেও তো আমি-রই অভিজ্ঞতা, আমার বেঁচে থাকারই। তখনই ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে ধাবমান উড়োজাহাজের মধ্যে নিজেরই ক্ষুধাকাতর চিৎকারের পাশাপাশি জেগে উঠতে পারে গোটা জগতের বুভুক্ষুরা, তখনই দেখা যায় ‘পেছনে জ্বলন্ত ইউরোপ, সামনে ভস্মসাত কালো প্রাচ্য দেশ।’ তখনই চে গুয়েভারার মৃত্যু এসে অপরাধী করে দিতে পারে আমাকে, তখনই পথের পাশে বসে থাকা অবহেলিতাকে দেখে কারও মনে পড়ে যেতে পারে আপন দাই মাকে, স্বভূমির জন্য আবেগভরা ভালবাসায় তখনই বলা যায় ‘যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব/ আমি বিষ পান করে মরে যাব’, কেননা বিষণœœ আলোর এই বাংলাদেশের ভূমি ছেড়ে কোথায় আমি যাব।
সুনীল কবিতায় যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাতে একটু একটু করে মুছে আসে কবিতার সঙ্গে গদ্যজগতের দূরত্ব। এই দূরত্বটাকে একেবারে সরিয়ে দেয়াই ছিল তাঁর কবিজীবনের প্রধান এক কাজ। ষাটের দশকেই তিনি বলছিলেন, নতুন কবিতার পথসন্ধানের কথা। বলছিলেন তখন : লিরিকের পথ আর আমাদের পথ নয়, ভিন্ন এক গদ্যপন্থায় চলবে আজ কবিতা। অন্তত তাঁর নিজের কবিতা সেই পথ ধরে চলতে চেয়েছে তখন থেকে অতিরহস্যের মায়াজাল ছেড়ে দিয়ে।
আবার আসি হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে। সুনীল যাকে নিজেরও ওপরে রাখতেন জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে সেই হুমায়ূনও সুনীলের মতো বাজিমাত করেছিলেন প্রথম উপন্যাসেই। হুমায়ূন তাঁর ‘নন্দিত নরকে’র মাধ্যমেই জানিয়ে দিয়েছিলেনÑ নায়ক মাত্রই ‘মহামানব’ গোত্রের নয়; সেও পাপ-তাপে পণ্যে একাকার মানুষ। শুধু ভিলেন হবে সকল কুকর্মের হোতাÑ এ রকম সরল চলতি ধারণায় তিনি শুরু থেকেই বিশ^াস স্থাপন করেননি। হুমায়ূনের চরিত্রেরা ‘মানুষ’, ভাল-মন্দের মিশেলেই ‘মানুষ’। তাই তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নন্দিত নরকে’র মন্টুকে খুন করে ফাঁসিতে যেতে হয়।
প্রায় ৪০ বছর আগে হুমায়ূনের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। কথাশিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার আগেই নন্দিত নরকের সেই শুরুতে তাঁর কলমে আমরা পেয়েছিলাম অন্যরকম এক কবিতায়িত উচ্চারণÑ ‘দিতে পারো এক শ’ ফানুশ এনে/আজন্ম সলজ্জ সাধ/আকাশে কিছু ফানুশ উড়াই...।’ রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দÑ বাংলার কবিদের নতুন করে ধারণ করেছিলেন তিনি। আবিষ্কার করেছিলেন কবিতার মতোই গতিশীল এক গদ্যভাষা। হাছন রাজা, উকিল মুন্সিদের মতো গীতিকবিদের সৃষ্টি সম্ভারও নতুন মাত্রা পায় তার হাত ধরে। হুমায়ূন নিজেও লিখেছেন অসাধারণ কিছু গান।
আমাদের পরিচিত জগতটার পাশাপাশি লেখালেখি দিয়ে রীতিমতো ভিন্ন আরেক ভুবন নির্মাণ করেন তিনি। সে জগতের ভাষা ভিন্ন, তাঁর চরিত্রগুলোর মধ্যকার যোগাযোগও অন্যরকম। আমাদের পরিচিত বিষয়-আসয় এবং অভিজ্ঞতাগুলোকে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। অদ্ভুদ এক জাদুময়তায় বাঁধা সে জগতের সবকিছু। মোহগ্রস্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ পড়েছে হুমায়ূনকে, তাঁর চিত্রিত চরিত্রগুলোকে। কখনও কখনও হয়ত এই মোহ কেটে যেতে সময় লাগেনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাঁর লেখা জীবনব্যাপী গভীর বিশ্বাসও সৃষ্টি করেছে কারও কারও মনে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুনভাবে তিনি উপস্থাপন করে গেছেন পাঠকদের সামনে।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের নতুন যুগটাই যেন শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের মাধ্যমে। জনপ্রিয়তার নতুন ভিন্ন এক মাত্রা, নতুন এক উদাহরণ হয়ে আছেন তিনি। তিনি দেখিয়ে গেছেন, কিভাবে পাঠক তৈরি করতে হয়। এই অভূতপূর্ব ক্ষমতা সবার থাকে না। নাটক চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তার এমন অবিস্মরণীয় ইতিহাসও তাঁর আগে সৃষ্টি করতে পারেনি কেউ। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রে নিজের মতো একটা পৃথিবী বানিয়ে, অদৃশ্য এক বাঁশি বাজিয়ে লোক গল্পের সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সবাইকে সেদিকে ধাবিত করতেন তিনি। আর তাইতো আমরা দেখি তাঁর মৃত্যুর পর এদেশের পত্রিকাগুলো কিভাবে মগ্ন হয়ে থাকে। কিভাবে টানা কয়েকদিন দৈনিকগুলোর প্রধান শিরোনাম দখল করে থাকেন তিনি। তাঁর ক্ষমতার নানামুখী মাত্রা আমরা দেখেছি। তাঁর ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে না হয় সেজন্য মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। একটি চরিত্র গণমানুষের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, এটা হুমায়ূনের কাছ থেকেই শিখতে হয়।
তিনি সমাজকে অবলোকন করেছেন; প্রভাবিতও করেছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে। তাঁর লেখার এক বিরাট প্রভাব রয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। আজকের তরুণ-তরুণীরা যেভাবে বাঁচতে চায়, যেভাবে জীবনকে দেখতে চায়, জীবনের পথে চলতে চায়, তাদের উচ্চারণ, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কজ্ঞান এসবের ওপরই হুমায়ূনের একটা প্রভাব আছে। কত বিচিত্র দিকে ধাবিত ছিল তাঁর সৃজনশীল মন।
তারপরও বলতে হয়, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বেদনার বরপুত্র। দু’হাতে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গেছেন কিন্তু সচেতন পাঠকের কাছে নিজের মূল্যায়নটা সঠিকভাবে দেখে যেতে পারেনি। তাঁর লেখার গুণপনা সম্পর্কে এদেশের মোটামুটি শিক্ষিত জন থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের লেখক-বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত সবাই কমবেশি জানেন না, এমন নয়। কিন্তু তারপরও মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস আবেগ আমরা দেখি ততটা কিন্তু তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা দেখি না। শুধু কিছু প্রবীণ লেখক দায়সারাভাবে হুমায়ূনের কিছু সাহিত্যকর্মকে স্বীকার করেছেন খ-িতভাবে। আর নতুন বা তরুণ লেখকরাও হুমায়ূনকে অস্বীকার করতেই যেন বেশি ব্যস্ত। আমরা রবীন্দ্র যুগের কথা জানি। শুধু তিরিশের কবিরা নন, আজকের আলোচনার সুনীলও তাঁর শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেছিলেন। এটা কিন্তু হয়েছিল ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে, নতুন আরেকটা ধারা নির্মাণের লক্ষ্যে। জানি না হুমায়ূনকে নিয়েও সেরকম কিছু হচ্ছে কি না। আমার বিশ^াস, কালের বিচারে রবীন্দ্রনাথ যেমন টিকে আছেন তেমনি হুমায়ূনও থাকবেন।
মৃত্যু এক অমোঘ নিয়তির নাম। খুব অল্পদিনের ব্যবধানে সেই নিয়তির সামনেই থেমে যেতে হলো বাংলা সাহিত্যের দুই প্রবাদপ্রতীম লেখককে। এখন আর শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কে নয়, তাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের লেখা ও সৃষ্টি সম্ভারে। লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরতে একের পর এক কিশোর তরুণ উঠে আসবে এই বাংলায়। একের পর এক নতুন পাঠকের জন্ম হবে। আর সাহিত্যের অপার জগতে তাদের আহ্বান জানাতেই থাকবেন আমাদের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বছর থেকে বছর, যুগ থেকে যুগ।
No comments