সব অবিশ্বাস-বিদ্বেষ ভুলে by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশ তিস্তা, সুরমা, কর্ণফুলী, গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনার অববাহিকায় ২০ ডিগ্রি ৩৪ ইঞ্চি ও ২৬ ডিগ্রি ৩৮ ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রি ০১ ইঞ্চি ও ৯২ ডিগ্রি ৪১ ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত। আদি প্রাচীন প্রস্তর যুগে প্রায় ১০ লাখ বছর আগে বাংলাদেশের উঁচু মাটিতে আদমসন্তানের পদধূলি পড়েছিল।
তিন হাজার বছর আগে রঙিন ধূসর মৃৎপাত্র ও লোহার ব্যবহার পশ্চিম থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসে। সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত কৃষ্ণ এবং রক্তিম মৃৎপাত্র উদ্ধারের ফলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কৃষ্ণ এবং রক্তিম সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো। দিনাজপুর-বগুড়া-মালদহ ও চব্বিশ পরগনা-মেদিনীপুরে প্রাপ্ত উত্তরাঞ্চলীয় কালো রং পালিশ করা মৃৎপাত্র থেকে অনুমিত হয়, মৌর্য যুগের সূচনাপর্বে বা তার কিছু আগে পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গে একটি কৃষি সংস্কৃতি ধীরগতিতে উত্তরে পুরনো কুশি এবং পূর্বে করতোয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
ভাষা বা জাতির সঙ্গে দেশ যোগ করে বহু দেশের নাম দেওয়া হয়েছে, আমরা 'বাংলা'র সঙ্গে 'দেশ' যোগ করেছি। সরকারি জাতীয় দলিলে এই নামকরণ হয়েছে ১৯৭১-এ। বেসরকারিভাবে এই নামের চল আরো একটু পুরনো।
আমাদের আনুগত্য, মমত্ব ও সহমর্মিতা পরিবার, কৌম, ধর্ম ও বৃত্তি অতিক্রম করে জাতির কোঠায় পৌঁছেছে অতি ধীরে। আমরা এখনো বাঙালি নামের বানান ঠিক করতে পারিনি। পাড়া-গ্রাম-জেলা ছাড়িয়ে রাঢ়-বরেন্দ্র বঙ্গ পার হয়ে রাষ্ট্র-চেতনায় পৌঁছুতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের পুরো আদল, তার চোখ-কান-মুখ সব প্রতীচ্য থেকে আগত। আক্ষরিক অর্থে গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত গণতন্ত্র হচ্ছে demos-এর kratos অর্থাৎ জনগণের শাসন। গ্রিসে গণতন্ত্র বলতে জনগণের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ শাসন বোঝাত। যেসব নগররাষ্ট্রে এই গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে, সেসব রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কদাচিৎ ১০ হাজারের বেশি ছিল। নারী ও দাসের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। নাগরিকরা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারত; আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ ও আইনের বিচারের ক্ষেত্রে এখতিয়ার বা ক্ষমতার কোনো ফারাক ছিল না। এই গ্রিক ঐতিহ্য অতি স্বল্পকাল স্থায়ী ছিল।
জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের দেশে নির্বাচনের যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তা কাজ চালানোর জন্য খারাপ নয়। সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে যে বিধান দেওয়া হয়েছে, তা যথার্থভাবে পালন করলে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কঠিন হয় না। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের কথাটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সেই কর্তব্য সম্পর্কে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা বা ঔদাসীন্য নির্বাচন কমিশনকে পঙ্গু করে দেয় এবং একটা শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কঠিন হয়ে পড়ে। নির্বাচনে কে জিতবে বা হারবে- ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সেই দুর্ভাবনা না করে প্রধান নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কর্তব্যচ্যুতিকে সাহস ও কঠোরতার সঙ্গে মোকাবিলা করা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করার অন্য কোনো উপায় নেই।
সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে 'গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২', নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালা প্রণীত হয়।
রাষ্ট্রপতি যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন, সেটিও বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং এই নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সারা দেশের জন্য একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদ গ্রহণ করেন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনীতি ক্রমেই একটি সাংঘর্ষিক অবস্থানে এসে দাঁড়ায়।
২০০৭-০৮ সালে প্রায় দুই বছর ধরে অনির্বাচিত, জরুরি অবস্থার মধ্যে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বারবার মন্তব্য করে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্বাচনী আইন সংস্কার ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের আগে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়।
অবশেষে সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
যাঁর নামে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন এবং যে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের তদারক করেন, তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যথাসময়ে এসব হত্যার বিচার হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জনের কারণে তা সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়। সংসদের পরিবর্তে রাজপথে সব সমস্যার ফয়সালা করার চেষ্টা করা হয়। ভাবাবেগে আত্মগর্বের অতিরঞ্জন এবং নেতাদের স্তাবকতা আমাদের কোনো সাহায্য করেনি।
গত এক দশকে দেশে এক দশমিক আট শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও গড়ে পাঁচ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। প্রশাসন যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বীয়কর্মে আত্মতুষ্ট, তাতে অনুমান করা কঠিন যে অদূর ভবিষ্যতে দেশ অস্থিরতা কাটিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে স্বীয় বলে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
যেখানে সংবিধানের সমালোচনার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখানে আপত্তিকর বা অপ্রিয় কথা অনাপত্তিকর বা অপ্রিয় করে বলাতে ঝুঁকি রয়েছে। দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হয়েছে। গণতন্ত্রের গুরুত্ব বা তার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন গৌণ থেকে গৌণতর হয়েছে। যেসব সাংবিধানিক পদ বা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নাতীত অবস্থানে থাকা বা রাখা উচিত ছিল, সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
১৯৯৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযম এক 'দাওয়াত অভিযানে' বলেন, 'জামায়াত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না। এটি ভারত থেকে আমদানীকৃত আদর্শ। প্রধানমন্ত্রী এখনো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, যা রীতিমতো সংবিধানবিরোধী।' কথাটা সত্য নয়। আদর্শটি ভারত থেকে আমদানি করা নয়; বরং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়ে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সেকুলারিজমের বাংলা অসাম্প্রদায়িকতা হয়তো সঠিক ছিল, বিশেষ করে সংবিধানে যখন ইসলামকে 'রাষ্ট্রধর্ম' বলা হয়েছে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির ব্যাপক প্রকোপ নানা কারণে। মুক্তবাণিজ্য ও বৈশ্য আবহাওয়ায় স্বার্থের সংঘাত বা বিব্রতবোধ বলে কিছু নেই। যে শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করেন, তিনি কোচিং পড়াতে বা কোচিং সেন্টার খুলতে পারেন। এমন সংঘাতময় বা বিবেক দংশনকারী ব্যাপার প্রশাসনের যেকোনো বিভাগে ঘটতে পারে, ঘটতে পারে ব্যাংক ব্যবসায় বা ওকালতি বা ডাক্তারি পেশায়ও। উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে যেসব দেশে বিদগ্ধ চৌর্যের বিকাশ ঘটেছে অদক্ষ প্রশাসনের জন্য, আমাদের পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অজ্ঞানতা, অদক্ষতার সঙ্গে দুর্নীতি যোগ হলে এ সবই দ্রুত মুনাফা অর্জনের বড় ক্ষেত্র হয়ে দেখা দেয়। ভিওআইপি, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কয়েকটি মোবাইল কম্পানি আগ বাড়িয়ে এসে জানাশোনার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা জরিমানা জমা দেয়। ট্রুথ কমিশনের সুযোগ নিয়ে বহু কোটি টাকা নিয়মিত করা হয়। সংবাদপত্রে মোবাইল ফোন কম্পানির দরাজহস্তে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্যই কি এ পর্যন্ত দেশের নানা দুর্নীতির ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী খবর দেওয়া হলেও মোবাইল ফোন কম্পানির ব্যাপারে তেমন বড় কোনো দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায়নি?
গ্রামীণ এলাকায় যেমন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রবল হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে শহরাঞ্চলে। মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ লোক আয়-বৈষম্যের কারণে দুর্দশাগ্রস্ত। মোট জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ ভোগ করে মাত্র ৫ শতাংশ লোক।
গত ৪০ বছরে দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের অস্বাভাবিকভাবে প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশে যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা আগামীবারও ক্ষমতায় থাকতে চান। আর যাঁরা ক্ষমতায় নেই তাঁরা ক্ষমতাসীনদের এক দণ্ড শান্তিতে না থাকতে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যে কড়ির প্রয়োজন, তা যেখান থেকে পাওয়া যায় বা জোগাড় করতে পারা যায়, সে সম্পর্কে কারো মনে কোনো দ্বিধা নেই।
আমরা অর্ধদিবস, পূর্ণদিবস ও লাগাতার- সব ধরনের হরতালের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ইংরেজরা করমর্দন আবিষ্কার করে; কিন্তু ফরাসিরা তা প্র্যাকটিস করে। হরতাল, যা কর্মকাণ্ডের তাল হরণ করে, গুজরাটিরা আবিষ্কার করলেও বাংলাভাষীরা বড় উদ্যমের সঙ্গে তার অনুশীলন করে এসেছে। লাগাতার হরতাল আমাদের আবিষ্কার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং স্বাধীনতার পরেও হরতালের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। সেনাপ্রশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮২-১৯৯১ সালে হরতালের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং নির্বাচিত সরকার আমলে তার প্রাদুর্ভাব ঘটে।
বাঙালিদের ঘরকুনো স্বভাবের একটা খ্যাতি ছিল। সেই বাঙালি এখন ভদ্রাসন বিক্রি করেই বিদেশে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ১৯৮০ সাল থেকে কর্মের সন্ধানে আমাদের বিদেশ যাত্রার শুরু। ওই বছর মাত্র ৩৮ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত ছিল। এখন প্রায় ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি কর্তৃক প্রেরিত অর্থ বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ ও আমদানি ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থনীতিকদের মতে, যারা পোশাক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তার ৮০ শতাংশই বাইরে চলে যায়; অথচ তারাই নানাবিধ অজুহাতে সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আমরা ভালোবাসি; কিন্তু তাদের মঙ্গলের জন্য আমরা যথেষ্ট যত্ন নিই না।
২০০৮ সালের নির্বাচন আমাদের জন্য সম্পূর্ণই এক নতুন অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধীকরণ, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ নানা কারণে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে মামলা দায়ের ও প্রত্যাহার হরহামেশা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আবার কোর্টে এক দিনের জন্যও হাজির না হয়ে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমাও পেয়েছে।
আত্মশাসনের জন্য মাতৃভাষায় সংবিধান রচনা বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবের ব্যাপার। সেই গৌরব ক্ষুণ্ন করেছে আইনি বুদ্ধিতে সংবিধানের ইংরেজি পাঠেরও বিধান রেখে। সেই বোঝা আমরা আজও বহন করছি এবং মাতৃভাষায় আইনচর্চা ব্যাহত করছি। আমাদের সংবিধানের সমালোচনা করে বলা হয়েছে এটা দলিল লেখকদের মতো একটা টুকলিফাইয়িং দলিল। আইনের শাসনবিরোধী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বেশ কিছু আইনকে এখানে সুরক্ষা দেওয়া হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে কিছু কিছু আইন রহিত করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও একদলীয় শাসনব্যবস্থার জন্য প্রণীত চতুর্থ সংশোধনীর বৈধতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের বিসমিল্লাহ ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম রেখে।
সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের শিরোনাম হলো- 'গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ'। আর ৩৫ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হলো- 'বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ'। এই দুই অনুচ্ছেদ বহুবার লঙ্ঘিত হয়েছে গত ৪০ বছরে।
২০০৩ সালে যৌথ বাহিনী দায়মুক্তি আইন পাস করে বলা হয় যে ২০০২-এর অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর হাতে যত লোক নিহত, আহত, পঙ্গু হোক না কেন বা কারো সম্পদ বা অন্য যেকোনো ক্ষতি হোক না কেন, তার জন্য কোনো বিচার হবে না। তখন দেশে 'নির্বাচিত' সরকার ছিল; কিন্তু সংবিধান হয়ে পড়ে মূল্যহীন, অর্থহীন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা অংশ এখন জড়িয়ে পড়েছে এক নৃশংস ও দুর্ধর্ষ অপরাধচক্রে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লে আইনের শাসন ব্যাহত হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ যেসব ভয়াবহ ঘটনা-দুর্ঘটনার শিকার হয় যে অনেকের মনে আশঙ্কা হয়েছিল, দেশটি বাঁচে কি না। এক বড় দুর্ভিক্ষ, তিনটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান, প্রায় ৩০টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং চারটি ভয়াবহ বন্যায় হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক অভিহিত নিতল ঝুড়িটা এক হতাশাব্যঞ্জক অস্তিত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই দেশ এখন উন্নয়নের একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। মানবকল্যাণের প্রতিটি সূচকে চার দশকে দেশটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।
শিশু ও মায়ের অকালমৃত্যুর সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। দ্বিগুণ ধনী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চেয়ে এখানে মানুষ চার বছর বেশি বাঁচে। গত ১০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে জীবন-প্রত্যাশা ৫৯ বছরে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধীর ছিল এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল সামান্য; কিন্তু সামাজিক উন্নয়নে দেশ এগিয়ে গিয়েছে। নগর-রাষ্ট্র বাদ দিলে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। আর দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চল বহু দূরে অবস্থিত নয়। নৌপথ হ্রাস পেলেও স্থলপথ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দেশের সংস্কৃতি সামাজিক পরিবর্তনের তেমন বিরোধিতা করে না। ধর্মপালনে, খাদ্যাভ্যাসে এবং নতুনকে গ্রহণ করতে; সে চাষের বীজ, সার বা সেচব্যবস্থা হোক- বাংলাদেশের লোক সাদরে গ্রহণ করে।
দেশটি নারীকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছে। জোর-জবরদস্তি করে নয়, স্বেচ্ছায় এখানকার মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণের সুবিধা গ্রহণ করেছে। গৃহে নারীর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবারের সংখ্যা তারই অধিক্ষেত্র। মসলিনের বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পাঁচজনের মধ্যে চারজনই নারী। ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তনের দেশে ঋণগ্রহণ ও তার ব্যবস্থাপনায় পরিবারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নারী। শিশুদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে স্বীকৃতমতে শ্রেয়। সরকারের অদক্ষতা অনেকখানি পুষিয়ে দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাহায্য সংস্থা হিসেবে শুরু করে বর্তমানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রথম দুই দশকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। ১৯৯০ সালের পর তা ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যে দারিদ্র্যসীমা ২০০০ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ, তা এক দশকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রবৃদ্ধির তুলনায় এখানে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৭৫ সালে যেখানে নারীর প্রজনন ক্ষমতা ছিল ৬.৩-এ, ১৯৯৪ সালে তা নেমে আসে ৩.৪-এ। গত ৪০ বছরে ধানের চাষ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর রপ্তানি করার মতো কিছু উদ্বৃত্ত ছিল। আমনের পরিবর্তে বোরো চাষের ফলে ফসলহানির আশঙ্কা কমেছে। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে বিশ্বে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তিনবার এবং দেশে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে দুইবার। ভরসার কথা, দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়নি।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং মান ও নিরাপত্তা- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের ১০৫টি দেশের সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, বাংলাদেশ ৩৪ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে রয়েছে ৮১তম অবস্থানে। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের নিচে। বাংলাদেশের তিনটি শক্তির জায়গা- পুষ্টিমান, কৃষি উৎপাদনের নিশ্চয়তা ও কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা। দুর্বলতা হচ্ছে- কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারের বরাদ্দের স্বল্পতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের অদক্ষতা।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার সরকারি ব্যয়ের ২১-১৬ যে বরাদ্দ দিয়েছিল, সেটা আমাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শিক্ষা বরাদ্দ। শিক্ষা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সঠিক নয় বিধায় প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ২০১৪ সালে দেশ নিরক্ষরতামুক্ত হবে না। প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম পাঁচটি দেশের কাতারে। বয়স্ক নিরক্ষরতার সংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে। আমাদের শিক্ষানীতিতে এত রদবদল হয়েছে যে কোনো সুপারিশ সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সেদিকে সরকার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেনি। বিশ্বের কোনো দেশে প্রাথমিক স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেমনটা রয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের মধ্যে তিন ধরনের সমাজ গড়ে উঠছে- কিন্ডারগার্টেনের ইংরেজিপ্রেমিক সমাজ, মূলধারায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সমাজ এবং মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিন্নমূল সমাজ।
শিক্ষার মান মোটেই ঈর্ষণীয় নয়। মাত্র ৬০ শতাংশ শিশু-কিশোর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা শেষ করতে পারে। ১১ বছরের কিশোরদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ মানসম্পন্ন সাক্ষরতা ও সংখ্যা শিক্ষা অর্জন করেছে।
২০০৯ সালের ২ এপ্রিল এক সংবাদে প্রকাশ, আগের নামে ফিরে যাচ্ছে দেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। পুলিশের লোগো নৌকা জোট সরকার উঠিয়ে দেয়। মহাজোট সরকার তা ফিরিয়ে এনেছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নাম বদলের পালায় কত কোটি টাকা ব্যয় হলো এবং ডিজিটাল দেশ নির্মাণ কতখানি ব্যাহত হলো, তার একটা হিসাব জানতে পারলে লোকে উপকৃত হবে।
দেশের অভ্যন্তরে প্রশাসনে অদক্ষতা ও দুর্নীতি, অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ব্যাপকতা এবং শ্রেণীবৈষম্যের প্রকট প্রসার ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক আইনের নির্দ্বিধায় লঙ্ঘন এবং অসংকোচ বরখেলাপের প্রভাবে আমাদের সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। নিছক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের তাগিদে আত্মরক্ষার চেতনায় মানুষ স্বীয় ক্ষমতায়নে ও উন্নতিকল্পে মোড় ফেরাতে বদ্ধপরিকর হলে সে হবে এক বড় আশার কথা।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী অঙ্গীকার ও ভিশন-২১ বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন সমাবেশে প্রায় ১৮৫টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৭০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক অগ্রগতির তালিকায় বাংলাদেশ চীন, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের পরই পঞ্চম স্থানে। আমেরিকা, চীন ও ভারতের কাছে বাজার বিনিয়োগ ও বন্ধুত্বের জন্য বাংলাদেশ এক আকর্ষণীয় দেশ। অভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলীয়ান হলে পররাষ্ট্র বিষয়ে আমরা আরো কার্যক্ষম ভূমিকা রাখতে পারতাম।
সাধারণত বেশির ভাগ দেশে পররাষ্ট্র বিষয়ে একটা মতৈক্য দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে রাজনৈতিক দ্বৈধ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি- উভয় ক্ষেত্রে নিদারুণভাবে বিদ্যমান। ৪০ বছরের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি- উভয় ক্ষেত্রে আমরা আমাদের রাষ্ট্রনীতিগুলো তেমনভাবে নির্দিষ্ট করিনি।
দেশে আজ নির্বাহী প্রধান এক নিরঙ্কুশ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। উপদেষ্টা ও প্রশাসক নিয়োগ করে এবং চুক্তিমাফিক আমলা নিয়োগের ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে নির্বাহী প্রধানকেন্দ্রিক প্রশাসন গড়ে উঠেছে, সেই প্রশাসনের নায়েব-গোমস্তাকে নবাবের মর্যাদা দেওয়া গেলেও তাঁদের জবাবদিহি জনগণের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে।
ব্রিটিশ আমলে যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছিল, সে ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের নির্বাহী প্রধান দেশে প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে তাঁবে রেখে যাচ্ছে।
৪০ বছরের ইতিহাসকে কেউ কেউ রক্তের উত্তরাধিকার বলেছেন। ক্রমাগত সংঘর্ষের পর ১৯৯০ সালে সংবিধানের ধারাবাহিকতা নামে মাত্র রক্ষা করে অনানুষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটে। আবার সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার ধর্মঘট ও রক্তপাতের পর ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধিষ্ঠিত হয়। আবার ২০০৭ সালে লাঠি-বৈঠা নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও রক্তপাতের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের বেশি থেকে সাধারণ নির্বাচনের তদারকি করে। আমি অন্যত্র বলেছি, কোনো আত্মমর্যাদাশীল জাতি এমন পদ্ধতি অনুসরণ করবে না। কিন্তু পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ যদি বড়ই অসহনীয় হয়, দেশের প্রশাসনে যদি বিপজ্জনক দলীয়করণ হয় এবং সাংবিধানিকভাবে উচ্চক্ষমতাশালী স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তখন সব আত্মাভিমানের কথা ভুলে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য কোনো একটা ফর্মুলা উদ্ভাবন ও অনুসরণ করে আমাদের এই অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের কালস্রোত পার হতে হবে।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রধান উপদেষ্টা
ভাষা বা জাতির সঙ্গে দেশ যোগ করে বহু দেশের নাম দেওয়া হয়েছে, আমরা 'বাংলা'র সঙ্গে 'দেশ' যোগ করেছি। সরকারি জাতীয় দলিলে এই নামকরণ হয়েছে ১৯৭১-এ। বেসরকারিভাবে এই নামের চল আরো একটু পুরনো।
আমাদের আনুগত্য, মমত্ব ও সহমর্মিতা পরিবার, কৌম, ধর্ম ও বৃত্তি অতিক্রম করে জাতির কোঠায় পৌঁছেছে অতি ধীরে। আমরা এখনো বাঙালি নামের বানান ঠিক করতে পারিনি। পাড়া-গ্রাম-জেলা ছাড়িয়ে রাঢ়-বরেন্দ্র বঙ্গ পার হয়ে রাষ্ট্র-চেতনায় পৌঁছুতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের পুরো আদল, তার চোখ-কান-মুখ সব প্রতীচ্য থেকে আগত। আক্ষরিক অর্থে গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত গণতন্ত্র হচ্ছে demos-এর kratos অর্থাৎ জনগণের শাসন। গ্রিসে গণতন্ত্র বলতে জনগণের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ শাসন বোঝাত। যেসব নগররাষ্ট্রে এই গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে, সেসব রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কদাচিৎ ১০ হাজারের বেশি ছিল। নারী ও দাসের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। নাগরিকরা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারত; আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ ও আইনের বিচারের ক্ষেত্রে এখতিয়ার বা ক্ষমতার কোনো ফারাক ছিল না। এই গ্রিক ঐতিহ্য অতি স্বল্পকাল স্থায়ী ছিল।
জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের দেশে নির্বাচনের যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তা কাজ চালানোর জন্য খারাপ নয়। সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে যে বিধান দেওয়া হয়েছে, তা যথার্থভাবে পালন করলে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কঠিন হয় না। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের কথাটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সেই কর্তব্য সম্পর্কে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা বা ঔদাসীন্য নির্বাচন কমিশনকে পঙ্গু করে দেয় এবং একটা শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কঠিন হয়ে পড়ে। নির্বাচনে কে জিতবে বা হারবে- ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সেই দুর্ভাবনা না করে প্রধান নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কর্তব্যচ্যুতিকে সাহস ও কঠোরতার সঙ্গে মোকাবিলা করা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করার অন্য কোনো উপায় নেই।
সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে 'গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২', নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালা প্রণীত হয়।
রাষ্ট্রপতি যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন, সেটিও বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং এই নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সারা দেশের জন্য একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদ গ্রহণ করেন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনীতি ক্রমেই একটি সাংঘর্ষিক অবস্থানে এসে দাঁড়ায়।
২০০৭-০৮ সালে প্রায় দুই বছর ধরে অনির্বাচিত, জরুরি অবস্থার মধ্যে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বারবার মন্তব্য করে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্বাচনী আইন সংস্কার ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের আগে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়।
অবশেষে সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
যাঁর নামে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন এবং যে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের তদারক করেন, তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যথাসময়ে এসব হত্যার বিচার হয়নি। সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জনের কারণে তা সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়। সংসদের পরিবর্তে রাজপথে সব সমস্যার ফয়সালা করার চেষ্টা করা হয়। ভাবাবেগে আত্মগর্বের অতিরঞ্জন এবং নেতাদের স্তাবকতা আমাদের কোনো সাহায্য করেনি।
গত এক দশকে দেশে এক দশমিক আট শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও গড়ে পাঁচ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। প্রশাসন যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বীয়কর্মে আত্মতুষ্ট, তাতে অনুমান করা কঠিন যে অদূর ভবিষ্যতে দেশ অস্থিরতা কাটিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে স্বীয় বলে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
যেখানে সংবিধানের সমালোচনার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখানে আপত্তিকর বা অপ্রিয় কথা অনাপত্তিকর বা অপ্রিয় করে বলাতে ঝুঁকি রয়েছে। দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হয়েছে। গণতন্ত্রের গুরুত্ব বা তার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন গৌণ থেকে গৌণতর হয়েছে। যেসব সাংবিধানিক পদ বা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নাতীত অবস্থানে থাকা বা রাখা উচিত ছিল, সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
১৯৯৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযম এক 'দাওয়াত অভিযানে' বলেন, 'জামায়াত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না। এটি ভারত থেকে আমদানীকৃত আদর্শ। প্রধানমন্ত্রী এখনো ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, যা রীতিমতো সংবিধানবিরোধী।' কথাটা সত্য নয়। আদর্শটি ভারত থেকে আমদানি করা নয়; বরং বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়ে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সেকুলারিজমের বাংলা অসাম্প্রদায়িকতা হয়তো সঠিক ছিল, বিশেষ করে সংবিধানে যখন ইসলামকে 'রাষ্ট্রধর্ম' বলা হয়েছে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির ব্যাপক প্রকোপ নানা কারণে। মুক্তবাণিজ্য ও বৈশ্য আবহাওয়ায় স্বার্থের সংঘাত বা বিব্রতবোধ বলে কিছু নেই। যে শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করেন, তিনি কোচিং পড়াতে বা কোচিং সেন্টার খুলতে পারেন। এমন সংঘাতময় বা বিবেক দংশনকারী ব্যাপার প্রশাসনের যেকোনো বিভাগে ঘটতে পারে, ঘটতে পারে ব্যাংক ব্যবসায় বা ওকালতি বা ডাক্তারি পেশায়ও। উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে যেসব দেশে বিদগ্ধ চৌর্যের বিকাশ ঘটেছে অদক্ষ প্রশাসনের জন্য, আমাদের পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অজ্ঞানতা, অদক্ষতার সঙ্গে দুর্নীতি যোগ হলে এ সবই দ্রুত মুনাফা অর্জনের বড় ক্ষেত্র হয়ে দেখা দেয়। ভিওআইপি, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবসা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কয়েকটি মোবাইল কম্পানি আগ বাড়িয়ে এসে জানাশোনার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা জরিমানা জমা দেয়। ট্রুথ কমিশনের সুযোগ নিয়ে বহু কোটি টাকা নিয়মিত করা হয়। সংবাদপত্রে মোবাইল ফোন কম্পানির দরাজহস্তে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্যই কি এ পর্যন্ত দেশের নানা দুর্নীতির ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী খবর দেওয়া হলেও মোবাইল ফোন কম্পানির ব্যাপারে তেমন বড় কোনো দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায়নি?
গ্রামীণ এলাকায় যেমন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রবল হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে শহরাঞ্চলে। মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ লোক আয়-বৈষম্যের কারণে দুর্দশাগ্রস্ত। মোট জাতীয় সম্পদের ৪৫ শতাংশ ভোগ করে মাত্র ৫ শতাংশ লোক।
গত ৪০ বছরে দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের অস্বাভাবিকভাবে প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশে যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁরা আগামীবারও ক্ষমতায় থাকতে চান। আর যাঁরা ক্ষমতায় নেই তাঁরা ক্ষমতাসীনদের এক দণ্ড শান্তিতে না থাকতে দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যে কড়ির প্রয়োজন, তা যেখান থেকে পাওয়া যায় বা জোগাড় করতে পারা যায়, সে সম্পর্কে কারো মনে কোনো দ্বিধা নেই।
আমরা অর্ধদিবস, পূর্ণদিবস ও লাগাতার- সব ধরনের হরতালের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ইংরেজরা করমর্দন আবিষ্কার করে; কিন্তু ফরাসিরা তা প্র্যাকটিস করে। হরতাল, যা কর্মকাণ্ডের তাল হরণ করে, গুজরাটিরা আবিষ্কার করলেও বাংলাভাষীরা বড় উদ্যমের সঙ্গে তার অনুশীলন করে এসেছে। লাগাতার হরতাল আমাদের আবিষ্কার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং স্বাধীনতার পরেও হরতালের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। সেনাপ্রশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮২-১৯৯১ সালে হরতালের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং নির্বাচিত সরকার আমলে তার প্রাদুর্ভাব ঘটে।
বাঙালিদের ঘরকুনো স্বভাবের একটা খ্যাতি ছিল। সেই বাঙালি এখন ভদ্রাসন বিক্রি করেই বিদেশে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। ১৯৮০ সাল থেকে কর্মের সন্ধানে আমাদের বিদেশ যাত্রার শুরু। ওই বছর মাত্র ৩৮ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত ছিল। এখন প্রায় ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি কর্তৃক প্রেরিত অর্থ বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ ও আমদানি ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থনীতিকদের মতে, যারা পোশাক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তার ৮০ শতাংশই বাইরে চলে যায়; অথচ তারাই নানাবিধ অজুহাতে সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আমরা ভালোবাসি; কিন্তু তাদের মঙ্গলের জন্য আমরা যথেষ্ট যত্ন নিই না।
২০০৮ সালের নির্বাচন আমাদের জন্য সম্পূর্ণই এক নতুন অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধীকরণ, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ নানা কারণে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে মামলা দায়ের ও প্রত্যাহার হরহামেশা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আবার কোর্টে এক দিনের জন্যও হাজির না হয়ে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমাও পেয়েছে।
আত্মশাসনের জন্য মাতৃভাষায় সংবিধান রচনা বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবের ব্যাপার। সেই গৌরব ক্ষুণ্ন করেছে আইনি বুদ্ধিতে সংবিধানের ইংরেজি পাঠেরও বিধান রেখে। সেই বোঝা আমরা আজও বহন করছি এবং মাতৃভাষায় আইনচর্চা ব্যাহত করছি। আমাদের সংবিধানের সমালোচনা করে বলা হয়েছে এটা দলিল লেখকদের মতো একটা টুকলিফাইয়িং দলিল। আইনের শাসনবিরোধী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বেশ কিছু আইনকে এখানে সুরক্ষা দেওয়া হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে কিছু কিছু আইন রহিত করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও একদলীয় শাসনব্যবস্থার জন্য প্রণীত চতুর্থ সংশোধনীর বৈধতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের বিসমিল্লাহ ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম রেখে।
সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের শিরোনাম হলো- 'গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ'। আর ৩৫ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হলো- 'বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ'। এই দুই অনুচ্ছেদ বহুবার লঙ্ঘিত হয়েছে গত ৪০ বছরে।
২০০৩ সালে যৌথ বাহিনী দায়মুক্তি আইন পাস করে বলা হয় যে ২০০২-এর অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর হাতে যত লোক নিহত, আহত, পঙ্গু হোক না কেন বা কারো সম্পদ বা অন্য যেকোনো ক্ষতি হোক না কেন, তার জন্য কোনো বিচার হবে না। তখন দেশে 'নির্বাচিত' সরকার ছিল; কিন্তু সংবিধান হয়ে পড়ে মূল্যহীন, অর্থহীন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা অংশ এখন জড়িয়ে পড়েছে এক নৃশংস ও দুর্ধর্ষ অপরাধচক্রে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লে আইনের শাসন ব্যাহত হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ যেসব ভয়াবহ ঘটনা-দুর্ঘটনার শিকার হয় যে অনেকের মনে আশঙ্কা হয়েছিল, দেশটি বাঁচে কি না। এক বড় দুর্ভিক্ষ, তিনটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান, প্রায় ৩০টি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং চারটি ভয়াবহ বন্যায় হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক অভিহিত নিতল ঝুড়িটা এক হতাশাব্যঞ্জক অস্তিত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই দেশ এখন উন্নয়নের একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। মানবকল্যাণের প্রতিটি সূচকে চার দশকে দেশটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।
শিশু ও মায়ের অকালমৃত্যুর সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। দ্বিগুণ ধনী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চেয়ে এখানে মানুষ চার বছর বেশি বাঁচে। গত ১০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে জীবন-প্রত্যাশা ৫৯ বছরে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধীর ছিল এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল সামান্য; কিন্তু সামাজিক উন্নয়নে দেশ এগিয়ে গিয়েছে। নগর-রাষ্ট্র বাদ দিলে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। আর দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চল বহু দূরে অবস্থিত নয়। নৌপথ হ্রাস পেলেও স্থলপথ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দেশের সংস্কৃতি সামাজিক পরিবর্তনের তেমন বিরোধিতা করে না। ধর্মপালনে, খাদ্যাভ্যাসে এবং নতুনকে গ্রহণ করতে; সে চাষের বীজ, সার বা সেচব্যবস্থা হোক- বাংলাদেশের লোক সাদরে গ্রহণ করে।
দেশটি নারীকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছে। জোর-জবরদস্তি করে নয়, স্বেচ্ছায় এখানকার মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণের সুবিধা গ্রহণ করেছে। গৃহে নারীর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবারের সংখ্যা তারই অধিক্ষেত্র। মসলিনের বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পাঁচজনের মধ্যে চারজনই নারী। ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তনের দেশে ঋণগ্রহণ ও তার ব্যবস্থাপনায় পরিবারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নারী। শিশুদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে স্বীকৃতমতে শ্রেয়। সরকারের অদক্ষতা অনেকখানি পুষিয়ে দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাহায্য সংস্থা হিসেবে শুরু করে বর্তমানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রথম দুই দশকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। ১৯৯০ সালের পর তা ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যে দারিদ্র্যসীমা ২০০০ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ, তা এক দশকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রবৃদ্ধির তুলনায় এখানে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৭৫ সালে যেখানে নারীর প্রজনন ক্ষমতা ছিল ৬.৩-এ, ১৯৯৪ সালে তা নেমে আসে ৩.৪-এ। গত ৪০ বছরে ধানের চাষ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর রপ্তানি করার মতো কিছু উদ্বৃত্ত ছিল। আমনের পরিবর্তে বোরো চাষের ফলে ফসলহানির আশঙ্কা কমেছে। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে বিশ্বে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তিনবার এবং দেশে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে দুইবার। ভরসার কথা, দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়নি।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং মান ও নিরাপত্তা- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে বিশ্বের ১০৫টি দেশের সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, বাংলাদেশ ৩৪ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে রয়েছে ৮১তম অবস্থানে। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানের নিচে। বাংলাদেশের তিনটি শক্তির জায়গা- পুষ্টিমান, কৃষি উৎপাদনের নিশ্চয়তা ও কৃষকদের ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা। দুর্বলতা হচ্ছে- কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারের বরাদ্দের স্বল্পতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের অদক্ষতা।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার সরকারি ব্যয়ের ২১-১৬ যে বরাদ্দ দিয়েছিল, সেটা আমাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শিক্ষা বরাদ্দ। শিক্ষা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সঠিক নয় বিধায় প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ২০১৪ সালে দেশ নিরক্ষরতামুক্ত হবে না। প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম পাঁচটি দেশের কাতারে। বয়স্ক নিরক্ষরতার সংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে। আমাদের শিক্ষানীতিতে এত রদবদল হয়েছে যে কোনো সুপারিশ সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সেদিকে সরকার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেনি। বিশ্বের কোনো দেশে প্রাথমিক স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেমনটা রয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের মধ্যে তিন ধরনের সমাজ গড়ে উঠছে- কিন্ডারগার্টেনের ইংরেজিপ্রেমিক সমাজ, মূলধারায় শিক্ষাপ্রাপ্ত সমাজ এবং মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিন্নমূল সমাজ।
শিক্ষার মান মোটেই ঈর্ষণীয় নয়। মাত্র ৬০ শতাংশ শিশু-কিশোর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা শেষ করতে পারে। ১১ বছরের কিশোরদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ মানসম্পন্ন সাক্ষরতা ও সংখ্যা শিক্ষা অর্জন করেছে।
২০০৯ সালের ২ এপ্রিল এক সংবাদে প্রকাশ, আগের নামে ফিরে যাচ্ছে দেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। পুলিশের লোগো নৌকা জোট সরকার উঠিয়ে দেয়। মহাজোট সরকার তা ফিরিয়ে এনেছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নাম বদলের পালায় কত কোটি টাকা ব্যয় হলো এবং ডিজিটাল দেশ নির্মাণ কতখানি ব্যাহত হলো, তার একটা হিসাব জানতে পারলে লোকে উপকৃত হবে।
দেশের অভ্যন্তরে প্রশাসনে অদক্ষতা ও দুর্নীতি, অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ব্যাপকতা এবং শ্রেণীবৈষম্যের প্রকট প্রসার ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক আইনের নির্দ্বিধায় লঙ্ঘন এবং অসংকোচ বরখেলাপের প্রভাবে আমাদের সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। নিছক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের তাগিদে আত্মরক্ষার চেতনায় মানুষ স্বীয় ক্ষমতায়নে ও উন্নতিকল্পে মোড় ফেরাতে বদ্ধপরিকর হলে সে হবে এক বড় আশার কথা।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী অঙ্গীকার ও ভিশন-২১ বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন সমাবেশে প্রায় ১৮৫টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৭০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক অগ্রগতির তালিকায় বাংলাদেশ চীন, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের পরই পঞ্চম স্থানে। আমেরিকা, চীন ও ভারতের কাছে বাজার বিনিয়োগ ও বন্ধুত্বের জন্য বাংলাদেশ এক আকর্ষণীয় দেশ। অভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলীয়ান হলে পররাষ্ট্র বিষয়ে আমরা আরো কার্যক্ষম ভূমিকা রাখতে পারতাম।
সাধারণত বেশির ভাগ দেশে পররাষ্ট্র বিষয়ে একটা মতৈক্য দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে রাজনৈতিক দ্বৈধ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি- উভয় ক্ষেত্রে নিদারুণভাবে বিদ্যমান। ৪০ বছরের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি- উভয় ক্ষেত্রে আমরা আমাদের রাষ্ট্রনীতিগুলো তেমনভাবে নির্দিষ্ট করিনি।
দেশে আজ নির্বাহী প্রধান এক নিরঙ্কুশ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। উপদেষ্টা ও প্রশাসক নিয়োগ করে এবং চুক্তিমাফিক আমলা নিয়োগের ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে নির্বাহী প্রধানকেন্দ্রিক প্রশাসন গড়ে উঠেছে, সেই প্রশাসনের নায়েব-গোমস্তাকে নবাবের মর্যাদা দেওয়া গেলেও তাঁদের জবাবদিহি জনগণের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে।
ব্রিটিশ আমলে যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছিল, সে ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো উন্নতি হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের নির্বাহী প্রধান দেশে প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে তাঁবে রেখে যাচ্ছে।
৪০ বছরের ইতিহাসকে কেউ কেউ রক্তের উত্তরাধিকার বলেছেন। ক্রমাগত সংঘর্ষের পর ১৯৯০ সালে সংবিধানের ধারাবাহিকতা নামে মাত্র রক্ষা করে অনানুষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটে। আবার সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার ধর্মঘট ও রক্তপাতের পর ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধিষ্ঠিত হয়। আবার ২০০৭ সালে লাঠি-বৈঠা নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ও রক্তপাতের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের বেশি থেকে সাধারণ নির্বাচনের তদারকি করে। আমি অন্যত্র বলেছি, কোনো আত্মমর্যাদাশীল জাতি এমন পদ্ধতি অনুসরণ করবে না। কিন্তু পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ যদি বড়ই অসহনীয় হয়, দেশের প্রশাসনে যদি বিপজ্জনক দলীয়করণ হয় এবং সাংবিধানিকভাবে উচ্চক্ষমতাশালী স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তখন সব আত্মাভিমানের কথা ভুলে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য কোনো একটা ফর্মুলা উদ্ভাবন ও অনুসরণ করে আমাদের এই অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের কালস্রোত পার হতে হবে।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
প্রধান উপদেষ্টা
No comments