শুদ্ধতায় একটি নাম by কেয়া চৌধুরী
পড়ার ঘরটার ডানপাশের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো আব্বার সাদাকালো ছবিটা এতটাই জীবন্ত যে, মাঝে মধ্যে এটা ভুলে যাই। ২২ বছর হলো তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
মুুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা হিসেবে তৎকালীন হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী খান তার একটি লেখায় (২০০৮ সালে মানিক চৌধুরীর স্মরণিকায়) আব্বা সম্পর্কে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অনেক বীর পুরুষই যথাযথ স্থান পাননি। ইতিহাসে উপেক্ষিত এই মহানায়কদের একজন হবিগঞ্জের এক সময়ের অতি জনপ্রিয় নেতা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। তার কথা মনে হলেই আমার টমাস গ্রে'র বর্ণিত ারষষধমব যধসঢ়ফবহ-এর কথা মনে হয়। হবিগঞ্জে ছিল মানিক চৌধুরীর জন্মভূমি ও কর্মক্ষেত্র। অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন, ক্ষমতার লোভে নয়; দেশকে পরাধীনতার গ্গ্নানি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন।'
এসব কথা শুনে শুনে আমি তখনই নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছি, একটি অহঙ্কারের লেশ। আমি এমন বাবার সন্তান, যিনি সত্যিকার অর্থেই একজন শুদ্ধ মানুষ ছিলেন। আব্বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ্্্্্্্্উপস্থাপন করেছেন। তাই তার চরিত্রে প্রতিফলন ঘটেছে '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে তার বলিষ্ঠ কর্মকাণ্ডে ভেতর দিয়ে। হবিগঞ্জে মাতৃভাষার আন্দোলনে একজন আন্দোলনকারী হিসেবে কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে।
এভাবেই '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, বিশেষ করে শেখ মুজিবের ৬ দফাকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে তিনি ছুটে গেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে।
'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি হবিগঞ্জে তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে সফলভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হন। সাংগঠনিক ক্যারিশমার জন্যই '৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের গণপরিষদে ও '৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। মানিক চৌধুরীর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রচিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে (ওয়্যারলেসের মাধ্যমে) পাওয়া তারবার্তা যাকে এতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলা হয়, তা গ্রহণ করে হবিগঞ্জের অন্য নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে অবগত করে তিনি সম্মুখ সমরে প্রস্তুত হতে থাকেন। একটি দক্ষ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যে অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল তা বুঝতে পেরে তিনি হবিগঞ্জ সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে এগিয়ে যান এপ্রিলের প্রথম দিকে শেরপুরের সাদীপুর যুদ্ধে। মেজর জেনারেল সিআর দত্ত বীরউত্তমসহ অনেকের সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, আব্বা একজন সম্মুখ সমরের যোদ্ধা ছিলেন। তা ছাড়া ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরে সৈন্য, অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহসহ ভারতের খোয়াই ও কৈলাশহরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের কাজে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণেই তার এ বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এমএ রব মানিক চৌধুরীকে কমান্ড্যান্ট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে তার নির্বাচনী এলাকা মাধবপুর বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের মডেল হিসেবে নির্বাচিত হয়। যার জন্য তিনি '৭৪-এ বঙ্গবন্ধু কৃষিপদক পান। পরবর্তী সময় তিনি হবিগঞ্জ মহকুমার গভর্নর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কিন্তু '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজপথে মিছিলের উদ্যোগ নেওয়ার অপরাধে তাকে দীর্ঘকাল কারাবাসে রাখা হয়। যখন আমার বয়স আট মাস, তখন কুমিল্লা জেলে প্রথম আমাকে দেখেন আব্বা। মায়ের মুখে শুনেছি, কুমিল্লা জেলের বাগান থেকে আনা একটি লাল গোলাপ হাতে দিয়ে আব্বা আমার নাম রেখেছিলেন কেয়া। বাবাকে হারিয়ে বড় অসহায় মনে হয়। একজন সফল মানুষ হিসেবে ইতিহাস তাকে মূল্যায়িত করবে। বিশেষ করে সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই।
কেয়া চৌধুরী
kchowdhury71@gmail.com
এসব কথা শুনে শুনে আমি তখনই নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছি, একটি অহঙ্কারের লেশ। আমি এমন বাবার সন্তান, যিনি সত্যিকার অর্থেই একজন শুদ্ধ মানুষ ছিলেন। আব্বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে ্্্্্্্্উপস্থাপন করেছেন। তাই তার চরিত্রে প্রতিফলন ঘটেছে '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে তার বলিষ্ঠ কর্মকাণ্ডে ভেতর দিয়ে। হবিগঞ্জে মাতৃভাষার আন্দোলনে একজন আন্দোলনকারী হিসেবে কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে।
এভাবেই '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, বিশেষ করে শেখ মুজিবের ৬ দফাকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে তিনি ছুটে গেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে।
'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি হবিগঞ্জে তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে সফলভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হন। সাংগঠনিক ক্যারিশমার জন্যই '৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের গণপরিষদে ও '৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। মানিক চৌধুরীর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রচিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে (ওয়্যারলেসের মাধ্যমে) পাওয়া তারবার্তা যাকে এতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলা হয়, তা গ্রহণ করে হবিগঞ্জের অন্য নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে অবগত করে তিনি সম্মুখ সমরে প্রস্তুত হতে থাকেন। একটি দক্ষ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যে অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল তা বুঝতে পেরে তিনি হবিগঞ্জ সরকারি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে এগিয়ে যান এপ্রিলের প্রথম দিকে শেরপুরের সাদীপুর যুদ্ধে। মেজর জেনারেল সিআর দত্ত বীরউত্তমসহ অনেকের সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, আব্বা একজন সম্মুখ সমরের যোদ্ধা ছিলেন। তা ছাড়া ৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরে সৈন্য, অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহসহ ভারতের খোয়াই ও কৈলাশহরের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের কাজে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণেই তার এ বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এমএ রব মানিক চৌধুরীকে কমান্ড্যান্ট উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে তার নির্বাচনী এলাকা মাধবপুর বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের মডেল হিসেবে নির্বাচিত হয়। যার জন্য তিনি '৭৪-এ বঙ্গবন্ধু কৃষিপদক পান। পরবর্তী সময় তিনি হবিগঞ্জ মহকুমার গভর্নর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কিন্তু '৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজপথে মিছিলের উদ্যোগ নেওয়ার অপরাধে তাকে দীর্ঘকাল কারাবাসে রাখা হয়। যখন আমার বয়স আট মাস, তখন কুমিল্লা জেলে প্রথম আমাকে দেখেন আব্বা। মায়ের মুখে শুনেছি, কুমিল্লা জেলের বাগান থেকে আনা একটি লাল গোলাপ হাতে দিয়ে আব্বা আমার নাম রেখেছিলেন কেয়া। বাবাকে হারিয়ে বড় অসহায় মনে হয়। একজন সফল মানুষ হিসেবে ইতিহাস তাকে মূল্যায়িত করবে। বিশেষ করে সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই।
কেয়া চৌধুরী
kchowdhury71@gmail.com
No comments