রাজনীতি-ইতিহাসের নব-দর্জি by হিলাল ফয়েজী
আমরা জানি ইতিহাসের অনেক সমুদ্রের অনেক ঢেউ অনেক স্রোতের মধ্য দিয়ে আমরা পুনরায় আমাদের ক্ষতবিক্ষত-ধর্ষিত সংবিধানটিকে কিছুটা সুস্থ করে তোলার সুযোগ পেয়েছি। এটি যেন না হতে পারে, সেজন্য নানামুখী গভীর থেকে গভীরতর, হিংস্র থেকে হিংস্রতর ঘিরিঙ্গি চলছে।
আঘাত আসছে, আঘাত আসবেই। পৃথিবীতে বড় এবং মহান কিছু সহজে অর্জিত হয়নি
নোয়াখালী তার সর্বশেষ দলটির দুর্ভেদ্য দুর্গ, তবুও দলীয় মনোনয়ন পেয়েও ওই নবম জাতীয় সংসদে ঢোকার গণরায় পেলেন না চৌকস-চোশত ভূমি-ছাওয়ালটি। তাতে কী! এমন বাক্যবাগীশ ব্যক্তিত্ব সংসদের বাইরে থাকবেন, তা কেমন করে হয়! তার দলনেত্রী-দেশনেত্রী একাধিক আসনজেতা; দুর্ভেদ্য ও নিরাপদ আরেকটি দুর্গ বগুড়ায় নেত্রীরই ছেড়ে দেওয়া একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে পুনর্দলীয় মন এবং নয়ন পেয়ে বিজয়ী হলেন মওদুদ ব্যারিস্টার। তবুও বুঝি, মনে ভারি দুঃখ পুষে ধুঁকছেন দলটির অন্য বিজয়ী সদস্যদের মতোই ... সংসদ বর্জনের ফলে যে নিয়মিত বদন প্রদর্শন ও বচন উদগিরণে বড্ড খরাকাল! জনগণকে বাকচাতুরীর শিল্পকলায় সম্মোহিত করার ভালো মওকা যে ওই সংসদ অধিবেশনই। সম্প্রতি সাময়িকভাবে হলেও সে খরা কেটে কিঞ্চিৎ বর্ষণ হয়েছে। সংসদে তারা যোগদান করেছেন, বিরোধী নেত্রী প্রাণভরে বাধাহীন কথা বলেছেন। বোধগম্য কারণেই সাকাচৌ নেই। অতএব বিনা বাধায় স্বীয় নেত্রীর পাশের আসনটিতে শ্যেন, নাকি চাতকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার প্রতীক্ষা মিশন তার সফল হলো। নেত্রী একবেলার জন্য এসেই আর সংসদমুখো হননি, অতএব অঘোষিত সংসদীয় দলকাপ্তান মওদুদ ব্যারিস্টার নিজেই।
একসময়কার তরুণ প্রতিভাদীপ্ত মওদুদকে ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন বঙ্গবল্পুব্দ। সেই তরুণ এখন মেঘে মেঘে, রোদ-বৃষ্টিতে, বেলা হেলে সত্তর-উত্তরের তারুণ্যমাখা প্রবীণ। চলনে-বলনে, বদনে-বচনে, পোশাক-আশাক-আয়েশে সদা নিপাট ভদ্রতামণ্ডিত। বিশেষত বাচন-প্রকৌশল তার দারুণ। বোধকরি ভারতের বর্তমান ক্রিকেট কাপ্তান ধোনির চেয়েও কুল কুল ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা তার মস্তিষ্ক-মগজ। এতটুকু উত্তেজিত না হয়েও মহাউত্তেজক কথা বলায় বোধকরি একজন ভূমণ্ডলীয় তারকা-স্টার তিনি।
কলকাতা থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশের বিখ্যাত 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস_ এইচএমভি' প্রতিষ্ঠানের প্রতীকচিহ্ন যাদের চেনাজানা, তারা নিশ্চয়ই এ রসিকতাটিও শ্রবণ করেছেন, চতুষ্পদী সারমেয় শ্রোতা একটিই, দ্বিপদী কণ্ঠগায়ক প্রভু যে শত শত। তবে বঙ্গীয় পূর্ব অববাহিকায় রাজনীতির প্রান্তরে দ্বিপদী মানবপ্রাণীর প্রভু বদলানোর রেকর্ডও মন্দ নয়। আমাদের চোশত বাচনিক মেধাবী নক্ষত্র তারকাটি এ ক্ষেত্রে সফল অগ্রণী নায়কও বটেন! সকল প্রভুই তাকে আবার বেশ কদরও করেন। তার চিকনবুদ্ধি এবং কৌশলশুদ্ধির তুলনা নাকি নেই।
অবশ্য বলা হয়ে থাকে, বিগত চারদলীয় জোট আমলে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর কিরিঞ্চি আইডিয়াটি মওদুদ-ই-মগজের। ওই কাণ্ডটির তাকবিন্দু ছিলেন একজন সুনির্দিষ্ট আদর্শবান্ধব প্রধান বিচারপতি, যেন তিনি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারেন। তার দেশনেত্রী এই বুদ্ধির গ্যাঁড়াকলে পড়েই রাজনীতিতে সে সময় নাকি 'ক্যাচকি মাইর' ভক্ষণ করেছিলেন। তবুও কদর কমে না চালচলনে, ভঙ্গিমা-মহিমায়, ধবধবে-চকচকে এই স্টার নক্ষত্রের। প্রায় প্রতিদিন তিনি এক প্রকার সুশীল-সুশীল নির্দোষ বলন-বচন উদগিরণ করেন মিডিয়া সমক্ষে দলীয় প্রবীণ মুখপাত্রের মতো করে। চিবিয়ে চিবিয়ে, মনভোলানো সুস্বাদু জারক রস মিশিয়ে।
অতিসম্প্রতি তিনি ইতিহাসের 'নব-দর্জি'র ভূমিকা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আমরা জানি ইতিহাসের অনেক সমুদ্রের অনেক ঢেউ অনেক স্রোতের মধ্য দিয়ে আমরা পুনরায় আমাদের ক্ষতবিক্ষত-ধর্ষিত সংবিধানটিকে কিছুটা সুস্থ করে তোলার সুযোগ পেয়েছি। এটি যেন না হতে পারে, সেজন্য নানামুখী গভীর থেকে গভীরতর, হিংস্র থেকে হিংস্রতর ঘিরিঙ্গি চলছে। বাজারে নেমেছে প্রচুর এবং অঢেল মাল এবং জল এবং ইত্যাদি! আঘাত আসছে, আঘাত আসবেই। পৃথিবীতে বড় এবং মহান কিছু সহজে অর্জিত হয়নি। সংবিধান ক্ষতবিক্ষতকারীদের সামাজিক শক্তি ও ভিত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী। সেই সাঙাতদের একজন হলেন আমাদের জে.প.লে (জেনারেল পদলেহনকারী) মওদুদ ব্যরিস্টার। জিয়া এবং এরশাদ আমলে সেনাদুর্গের কৃত্রিম মদদে মওদুদ-ই ক্ষমতা নিয়মিত মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় সহজেই উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। এখন তিনি বিশেষ বিশেষ মহলে দারুণ প্রয়োজনীয়। মহান আইনজ্ঞ সংসদে বলে দিলেন, দেশে এখন সংবিধান নেই। তাহলে ওই সংসদ ভবনটিতে ভ্রাতঃ আপনি ঢুকিলেন কোন অধিকার বলে?
এসব অনেক কথাই বলা যায়। ওসবে আইনপণ্ডিতজির কিছুই আসে যায় না। এরশাদের দলে থেকে তিনি জিয়ার দলকে মন্ত্রণা দেন, জিয়ার দলে থেকে এরশাদের পানে তোপ দাগেন। দুই জেনারেলের আমলেই অবশ্য সিভিল রাজনীতির মুণ্ডুপাত করার আসল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এতটুকু গড়িমসি কখনোই করেননি। বিংশ শতাব্দীর অন্তিম দশকে একবার ভায়ার দলবদল-ভোলবদল ভোজবাজির সময় ব্যাপারটিকে 'মৌ-দুধের' কারবার বলে একান্ত তোপ ও ক্ষোভের মুখে পড়েছিলাম। বলেছিলাম তখন, হয়তোবা ওনার নিকটস্য নিকট গুরুজন-আত্মীয় বেঁচে থাকলে নতুন করে লিখতেন_ 'এইখানে তোর নীতির কবর/জালিম গাছের তলে'! তারপর এই কত বছরে সেই জালিম গাছ আরও কত পত্রপল্লবিত হয়েছে, সেই কবর কি বিরাট সৌধে পরিণত হয়েছে!
সেই তিনি এখন স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মাপজোখের দর্জির কাজটি হাতে নিয়েছেন। ধ্বস্তবিধ্বস্ত সংবিধানটিকে চলনসই করে তোলার জন্য যে আয়োজন চলছে, তাতে 'স্বাধীনতার ঘোষক' ইস্যুটি নিয়ে কথা উঠেছে। সেনাদুর্গের ঔরসে জন্ম দেওয়া দলটি একদিন হঠাৎ করে জেনারেল জিয়াকে যেন আসমান থেকে মরণোত্তর 'স্বাধীনতার ঘোষক' শিরোপা পরিয়ে দিল। পৃথিবীতে যার যতটুকু ভূমিকা, যতটুকু অবদান, তার প্রকৃত নির্মোহ ঐতিহাসিক মাপজোখের মধ্য দিয়েই মানুষ সুসভ্য হয়ে ওঠে। জেনারেল জিয়া তার রচিত 'একটি জাতির পুনর্জন্ম' লেখায় যা বলেছেন, মওদুদ সাহেব তা নিশ্চয়ই পাঠ করেছেন। ভাষাসংগ্রামের সূচনা থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজ থেকে বাঙালি বধের অস্ত্র নামানোর দায়িত্ব পালনের পর্ব পর্যন্ত যে ব্যক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামে শরিক হননি, হওয়ার সুযোগ ঘটেনি, পরদিন ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি আচানক 'স্বাধীনতার ঘোষক' হয়ে যাওয়ার বেওয়াকুফি দাবি তো নিজেও করেননি। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র মুক্ত থাকার সুবিধায় প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায়ের স্বল্প কয়েকদিনে যে কয়েকজন সেখান থেকে উদ্দীপনামূলক আহ্বানপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তদানীন্তন মেজর জিয়া সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। সে সময়ে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার কণ্ঠের আহ্বান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এহেন আহ্বান-ঘোষণা প্রদানের সহস্র ঘটনা বাংলার সহস্র স্থানে ঘটেছিল। ২৫ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টের নিকটে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরিতে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম আমরা তদানীন্তন নাখালবাসীরা, পাকিস্তানি হার্মাদ বাহিনীর তোপের মুখে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণের সময় আমরাও সমস্বরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলাম। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে জিয়া 'উই রিভোল্ট' বলেছিলেন, তার বেশ কয়েকদিন আগেই যে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের সেনাঘাঁটিতে মেজর শফিউল্লা প্রকৃত 'রিভোল্ট' ঘটিয়ে দিয়েছেন। সারাদেশে লাখ লাখ সামরিকভাবে অনভিজ্ঞ মেহনতি-মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশেষত একাত্তরের গোটা মার্চজুড়ে সাহসের যে ঝড় তুলেছিল, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বে যে অসম সাহস দেখিয়েছিল, তার প্রকৃত যাচাই-বাছাই হলে তো বীরশ্রেষ্ঠ-উত্তম-বিক্রম-প্রতীকের নবহিসাব প্রয়োজন। সেসব তো অনেক দূরের কথা।
খোদ বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে মওদুদের সকল দল এবং সহযোগীরা যেভাবে অসম্মানিত, অবমানিত করেছে, সেই অপরাধও ক্ষমাহীন। এই আইনের বিবেক মহারাজগোষ্ঠী মহানায়ক নিধনের নৃশংস ঘটনাটির বিচারের পথ অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য যত প্রকার হীন-নীচ-বর্বরতা প্রদর্শন করেছে, তার বয়ানও রুচিতে বাধে। এই আইনসাধুর দেশও দলনেত্রী কাদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসটিকে হঠাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে নিজের 'জন্মদিন' ঘোষণা করে দিয়ে প্রতি বছর বীভৎস রসের জন্মবার্ষিকী পালন করে আসছেন জানি না। এত ছোটমাপের কাজে নিজেকে দশকের পর দশক যুক্ত রেখে হায় ইতিহাসের 'নব-দর্জি'র ভূমিকা পালনকারী হে ব্যারিস্টার সাহেব, আপনাকে বড় বড় বুলির উৎপাদক হতে দেখে বোধ করি 'লজ্জা' শব্দটিও লজ্জিত হয়ে যায়।
সেই আপনি বলছেন... বঙ্গবন্ধু এতই বড়মাপের লোক যে, তাকে সংবিধানে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বলা হলে তিনি 'ছোট' হয়ে যাবেন! মওদুদ ব্যারিস্টার সাহেব, বাংলা ভাষার পুরনো প্রবচনগুলো কেন সৃষ্টি হয়েছিল, তা আপনাদের মতো বচনতারকাদের দেখলেই বুঝতে পারি। ওই যে 'মাছের মার পুত্রশোক' কিংবা 'কুম্ভীরাশ্রু' প্রভৃতি তো আপনাদের পরিপাটি পোশাকেরই নব নব মনোহর অলঙ্কার। যে লোকটির সময়োচিত অসম সাহসী ভূমিকা আপনাদের মতো প্রাদেশিক আইনতারকাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের 'প্রধানমন্ত্রী' পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ এনে দিল, তার পূর্ণ আকারের ছবি ঘরে রেখে কৃতজ্ঞতায় তো প্রতিদিন আপনাদের ওই ছবিতে কদমবুসি করার কথা। বিপরীতে অকৃতজ্ঞতা এবং কৃতঘ্নতার জঘন্য পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রজনককে কতভাবে বেইজ্জতি করা যায় তার কোনটাইবা আপনারা বাদ রেখেছেন জনাবে আলাবৃন্দ! ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মানবজাতির গণসংগ্রামের শ্রেষ্ঠ ভাষণে সাহস এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মহত্তম ঘটনার পটভূমিতে অন্য যে কাউকে 'ঘোষক' সাজানোর মতো ইতিহাস-মস্করা কাকে আর বলে!
এই মস্করাবাজদের নিয়ে অবশ্য দেশে আন্তর্জাতিক মানের একটি বড়সড় 'জ্ঞাপা-ভ' বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যায়, মওদুদ সাহেব হতে পারেন যার যোগ্যতম প্রতিষ্ঠাতা-উপাচার্য। সুপ্রিয় পাঠক, বোঝা গেলো না, 'জ্ঞাপা-ভ' মানে হচ্ছে যে 'জ্ঞানপাপ-ভণ্ডামী'। এ বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকলস্কর অবশ্য এদেশের ডান-বাম-মধ্য কোনো অঞ্চলেই কম মিলবে না।
হিলাল ফয়েজী : কলাম লেখক
নোয়াখালী তার সর্বশেষ দলটির দুর্ভেদ্য দুর্গ, তবুও দলীয় মনোনয়ন পেয়েও ওই নবম জাতীয় সংসদে ঢোকার গণরায় পেলেন না চৌকস-চোশত ভূমি-ছাওয়ালটি। তাতে কী! এমন বাক্যবাগীশ ব্যক্তিত্ব সংসদের বাইরে থাকবেন, তা কেমন করে হয়! তার দলনেত্রী-দেশনেত্রী একাধিক আসনজেতা; দুর্ভেদ্য ও নিরাপদ আরেকটি দুর্গ বগুড়ায় নেত্রীরই ছেড়ে দেওয়া একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে পুনর্দলীয় মন এবং নয়ন পেয়ে বিজয়ী হলেন মওদুদ ব্যারিস্টার। তবুও বুঝি, মনে ভারি দুঃখ পুষে ধুঁকছেন দলটির অন্য বিজয়ী সদস্যদের মতোই ... সংসদ বর্জনের ফলে যে নিয়মিত বদন প্রদর্শন ও বচন উদগিরণে বড্ড খরাকাল! জনগণকে বাকচাতুরীর শিল্পকলায় সম্মোহিত করার ভালো মওকা যে ওই সংসদ অধিবেশনই। সম্প্রতি সাময়িকভাবে হলেও সে খরা কেটে কিঞ্চিৎ বর্ষণ হয়েছে। সংসদে তারা যোগদান করেছেন, বিরোধী নেত্রী প্রাণভরে বাধাহীন কথা বলেছেন। বোধগম্য কারণেই সাকাচৌ নেই। অতএব বিনা বাধায় স্বীয় নেত্রীর পাশের আসনটিতে শ্যেন, নাকি চাতকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার প্রতীক্ষা মিশন তার সফল হলো। নেত্রী একবেলার জন্য এসেই আর সংসদমুখো হননি, অতএব অঘোষিত সংসদীয় দলকাপ্তান মওদুদ ব্যারিস্টার নিজেই।
একসময়কার তরুণ প্রতিভাদীপ্ত মওদুদকে ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন বঙ্গবল্পুব্দ। সেই তরুণ এখন মেঘে মেঘে, রোদ-বৃষ্টিতে, বেলা হেলে সত্তর-উত্তরের তারুণ্যমাখা প্রবীণ। চলনে-বলনে, বদনে-বচনে, পোশাক-আশাক-আয়েশে সদা নিপাট ভদ্রতামণ্ডিত। বিশেষত বাচন-প্রকৌশল তার দারুণ। বোধকরি ভারতের বর্তমান ক্রিকেট কাপ্তান ধোনির চেয়েও কুল কুল ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা তার মস্তিষ্ক-মগজ। এতটুকু উত্তেজিত না হয়েও মহাউত্তেজক কথা বলায় বোধকরি একজন ভূমণ্ডলীয় তারকা-স্টার তিনি।
কলকাতা থেকে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশের বিখ্যাত 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস_ এইচএমভি' প্রতিষ্ঠানের প্রতীকচিহ্ন যাদের চেনাজানা, তারা নিশ্চয়ই এ রসিকতাটিও শ্রবণ করেছেন, চতুষ্পদী সারমেয় শ্রোতা একটিই, দ্বিপদী কণ্ঠগায়ক প্রভু যে শত শত। তবে বঙ্গীয় পূর্ব অববাহিকায় রাজনীতির প্রান্তরে দ্বিপদী মানবপ্রাণীর প্রভু বদলানোর রেকর্ডও মন্দ নয়। আমাদের চোশত বাচনিক মেধাবী নক্ষত্র তারকাটি এ ক্ষেত্রে সফল অগ্রণী নায়কও বটেন! সকল প্রভুই তাকে আবার বেশ কদরও করেন। তার চিকনবুদ্ধি এবং কৌশলশুদ্ধির তুলনা নাকি নেই।
অবশ্য বলা হয়ে থাকে, বিগত চারদলীয় জোট আমলে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর কিরিঞ্চি আইডিয়াটি মওদুদ-ই-মগজের। ওই কাণ্ডটির তাকবিন্দু ছিলেন একজন সুনির্দিষ্ট আদর্শবান্ধব প্রধান বিচারপতি, যেন তিনি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারেন। তার দেশনেত্রী এই বুদ্ধির গ্যাঁড়াকলে পড়েই রাজনীতিতে সে সময় নাকি 'ক্যাচকি মাইর' ভক্ষণ করেছিলেন। তবুও কদর কমে না চালচলনে, ভঙ্গিমা-মহিমায়, ধবধবে-চকচকে এই স্টার নক্ষত্রের। প্রায় প্রতিদিন তিনি এক প্রকার সুশীল-সুশীল নির্দোষ বলন-বচন উদগিরণ করেন মিডিয়া সমক্ষে দলীয় প্রবীণ মুখপাত্রের মতো করে। চিবিয়ে চিবিয়ে, মনভোলানো সুস্বাদু জারক রস মিশিয়ে।
অতিসম্প্রতি তিনি ইতিহাসের 'নব-দর্জি'র ভূমিকা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আমরা জানি ইতিহাসের অনেক সমুদ্রের অনেক ঢেউ অনেক স্রোতের মধ্য দিয়ে আমরা পুনরায় আমাদের ক্ষতবিক্ষত-ধর্ষিত সংবিধানটিকে কিছুটা সুস্থ করে তোলার সুযোগ পেয়েছি। এটি যেন না হতে পারে, সেজন্য নানামুখী গভীর থেকে গভীরতর, হিংস্র থেকে হিংস্রতর ঘিরিঙ্গি চলছে। বাজারে নেমেছে প্রচুর এবং অঢেল মাল এবং জল এবং ইত্যাদি! আঘাত আসছে, আঘাত আসবেই। পৃথিবীতে বড় এবং মহান কিছু সহজে অর্জিত হয়নি। সংবিধান ক্ষতবিক্ষতকারীদের সামাজিক শক্তি ও ভিত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী। সেই সাঙাতদের একজন হলেন আমাদের জে.প.লে (জেনারেল পদলেহনকারী) মওদুদ ব্যরিস্টার। জিয়া এবং এরশাদ আমলে সেনাদুর্গের কৃত্রিম মদদে মওদুদ-ই ক্ষমতা নিয়মিত মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় সহজেই উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। এখন তিনি বিশেষ বিশেষ মহলে দারুণ প্রয়োজনীয়। মহান আইনজ্ঞ সংসদে বলে দিলেন, দেশে এখন সংবিধান নেই। তাহলে ওই সংসদ ভবনটিতে ভ্রাতঃ আপনি ঢুকিলেন কোন অধিকার বলে?
এসব অনেক কথাই বলা যায়। ওসবে আইনপণ্ডিতজির কিছুই আসে যায় না। এরশাদের দলে থেকে তিনি জিয়ার দলকে মন্ত্রণা দেন, জিয়ার দলে থেকে এরশাদের পানে তোপ দাগেন। দুই জেনারেলের আমলেই অবশ্য সিভিল রাজনীতির মুণ্ডুপাত করার আসল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এতটুকু গড়িমসি কখনোই করেননি। বিংশ শতাব্দীর অন্তিম দশকে একবার ভায়ার দলবদল-ভোলবদল ভোজবাজির সময় ব্যাপারটিকে 'মৌ-দুধের' কারবার বলে একান্ত তোপ ও ক্ষোভের মুখে পড়েছিলাম। বলেছিলাম তখন, হয়তোবা ওনার নিকটস্য নিকট গুরুজন-আত্মীয় বেঁচে থাকলে নতুন করে লিখতেন_ 'এইখানে তোর নীতির কবর/জালিম গাছের তলে'! তারপর এই কত বছরে সেই জালিম গাছ আরও কত পত্রপল্লবিত হয়েছে, সেই কবর কি বিরাট সৌধে পরিণত হয়েছে!
সেই তিনি এখন স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে মাপজোখের দর্জির কাজটি হাতে নিয়েছেন। ধ্বস্তবিধ্বস্ত সংবিধানটিকে চলনসই করে তোলার জন্য যে আয়োজন চলছে, তাতে 'স্বাধীনতার ঘোষক' ইস্যুটি নিয়ে কথা উঠেছে। সেনাদুর্গের ঔরসে জন্ম দেওয়া দলটি একদিন হঠাৎ করে জেনারেল জিয়াকে যেন আসমান থেকে মরণোত্তর 'স্বাধীনতার ঘোষক' শিরোপা পরিয়ে দিল। পৃথিবীতে যার যতটুকু ভূমিকা, যতটুকু অবদান, তার প্রকৃত নির্মোহ ঐতিহাসিক মাপজোখের মধ্য দিয়েই মানুষ সুসভ্য হয়ে ওঠে। জেনারেল জিয়া তার রচিত 'একটি জাতির পুনর্জন্ম' লেখায় যা বলেছেন, মওদুদ সাহেব তা নিশ্চয়ই পাঠ করেছেন। ভাষাসংগ্রামের সূচনা থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজ থেকে বাঙালি বধের অস্ত্র নামানোর দায়িত্ব পালনের পর্ব পর্যন্ত যে ব্যক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামে শরিক হননি, হওয়ার সুযোগ ঘটেনি, পরদিন ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি আচানক 'স্বাধীনতার ঘোষক' হয়ে যাওয়ার বেওয়াকুফি দাবি তো নিজেও করেননি। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র মুক্ত থাকার সুবিধায় প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায়ের স্বল্প কয়েকদিনে যে কয়েকজন সেখান থেকে উদ্দীপনামূলক আহ্বানপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তদানীন্তন মেজর জিয়া সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। সে সময়ে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার কণ্ঠের আহ্বান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এহেন আহ্বান-ঘোষণা প্রদানের সহস্র ঘটনা বাংলার সহস্র স্থানে ঘটেছিল। ২৫ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টের নিকটে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরিতে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম আমরা তদানীন্তন নাখালবাসীরা, পাকিস্তানি হার্মাদ বাহিনীর তোপের মুখে টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণের সময় আমরাও সমস্বরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলাম। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে জিয়া 'উই রিভোল্ট' বলেছিলেন, তার বেশ কয়েকদিন আগেই যে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরের সেনাঘাঁটিতে মেজর শফিউল্লা প্রকৃত 'রিভোল্ট' ঘটিয়ে দিয়েছেন। সারাদেশে লাখ লাখ সামরিকভাবে অনভিজ্ঞ মেহনতি-মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশেষত একাত্তরের গোটা মার্চজুড়ে সাহসের যে ঝড় তুলেছিল, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বে যে অসম সাহস দেখিয়েছিল, তার প্রকৃত যাচাই-বাছাই হলে তো বীরশ্রেষ্ঠ-উত্তম-বিক্রম-প্রতীকের নবহিসাব প্রয়োজন। সেসব তো অনেক দূরের কথা।
খোদ বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে মওদুদের সকল দল এবং সহযোগীরা যেভাবে অসম্মানিত, অবমানিত করেছে, সেই অপরাধও ক্ষমাহীন। এই আইনের বিবেক মহারাজগোষ্ঠী মহানায়ক নিধনের নৃশংস ঘটনাটির বিচারের পথ অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য যত প্রকার হীন-নীচ-বর্বরতা প্রদর্শন করেছে, তার বয়ানও রুচিতে বাধে। এই আইনসাধুর দেশও দলনেত্রী কাদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসটিকে হঠাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে নিজের 'জন্মদিন' ঘোষণা করে দিয়ে প্রতি বছর বীভৎস রসের জন্মবার্ষিকী পালন করে আসছেন জানি না। এত ছোটমাপের কাজে নিজেকে দশকের পর দশক যুক্ত রেখে হায় ইতিহাসের 'নব-দর্জি'র ভূমিকা পালনকারী হে ব্যারিস্টার সাহেব, আপনাকে বড় বড় বুলির উৎপাদক হতে দেখে বোধ করি 'লজ্জা' শব্দটিও লজ্জিত হয়ে যায়।
সেই আপনি বলছেন... বঙ্গবন্ধু এতই বড়মাপের লোক যে, তাকে সংবিধানে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বলা হলে তিনি 'ছোট' হয়ে যাবেন! মওদুদ ব্যারিস্টার সাহেব, বাংলা ভাষার পুরনো প্রবচনগুলো কেন সৃষ্টি হয়েছিল, তা আপনাদের মতো বচনতারকাদের দেখলেই বুঝতে পারি। ওই যে 'মাছের মার পুত্রশোক' কিংবা 'কুম্ভীরাশ্রু' প্রভৃতি তো আপনাদের পরিপাটি পোশাকেরই নব নব মনোহর অলঙ্কার। যে লোকটির সময়োচিত অসম সাহসী ভূমিকা আপনাদের মতো প্রাদেশিক আইনতারকাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের 'প্রধানমন্ত্রী' পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ এনে দিল, তার পূর্ণ আকারের ছবি ঘরে রেখে কৃতজ্ঞতায় তো প্রতিদিন আপনাদের ওই ছবিতে কদমবুসি করার কথা। বিপরীতে অকৃতজ্ঞতা এবং কৃতঘ্নতার জঘন্য পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রজনককে কতভাবে বেইজ্জতি করা যায় তার কোনটাইবা আপনারা বাদ রেখেছেন জনাবে আলাবৃন্দ! ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে মানবজাতির গণসংগ্রামের শ্রেষ্ঠ ভাষণে সাহস এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মহত্তম ঘটনার পটভূমিতে অন্য যে কাউকে 'ঘোষক' সাজানোর মতো ইতিহাস-মস্করা কাকে আর বলে!
এই মস্করাবাজদের নিয়ে অবশ্য দেশে আন্তর্জাতিক মানের একটি বড়সড় 'জ্ঞাপা-ভ' বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যায়, মওদুদ সাহেব হতে পারেন যার যোগ্যতম প্রতিষ্ঠাতা-উপাচার্য। সুপ্রিয় পাঠক, বোঝা গেলো না, 'জ্ঞাপা-ভ' মানে হচ্ছে যে 'জ্ঞানপাপ-ভণ্ডামী'। এ বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকলস্কর অবশ্য এদেশের ডান-বাম-মধ্য কোনো অঞ্চলেই কম মিলবে না।
হিলাল ফয়েজী : কলাম লেখক
No comments