মিরপুরের সাতকাহন-অনন্ত সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
দৈনিক সমকালের একটি বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ জনপদ মিরপুরের সমস্যাবলি প্রকাশিত হয়েছে সাত পর্বে। সংক্ষেপে যদি প্রকাশ করতে হয় তবে এ প্রতিবেদনগুলোকে বলতে হবে 'মিরপুর সমগ্র'।
৭০ বর্গকিলোমিটারের বিস্তীর্ণ একটি জনপদে নানা শ্রেণী-পেশার ৩৩ লাখ মানুষের জীবনকথার সমস্যা-সম্ভাবনা প্রকাশ করা কঠিন বটে। কিন্তু যে কেউ এ প্রতিবেদনগুলো থেকে স্পষ্টভাবে মিরপুরের সমস্যাবলি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাবেন। এক অর্থে এ সমস্যা শুধু মিরপুরের নয়, সমগ্র ঢাকারও। রাজধানী শহরে মিরপুর বোধহয় সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ জনবসতি। এখানে যেমন উচ্চবিত্তের মানুষের জন্য বিশেষায়িত আবাসিক এলাকা আছে, তেমনি মধ্যবিত্তের জন্য অপরিকল্পিত আবাসন আর নিম্নবিত্তের জন্য বস্তির সংস্থানও আছে। এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একটি সত্য সকলেই স্বীকার করেন, মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয়তম এ এলাকাটি এখন একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। সীমিত আয়ের পছন্দের এ এলাকায় জনবসতি যত ঘন তত সুযোগ-সুবিধা নেই। রাস্তায় বেরিয়ে কাজে যাওয়া মিরপুরের মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এবং ফেরাও। প্রতিদিন শহরের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যে বিপুল ভিড় জমে সে ভিড়ের অধিকাংশ মানুষ মিরপুরের। মানুষের চাহিদা আছে, যাত্রীর আধিক্য আছে_ তবু মিরপুরে চালু হতে পারছে না আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা। প্রভাবশালীদের দাপট, সিন্ডিকেট এর বড় কারণ। শুধু পরিবহন সমস্যাই নয়, জনবসতির তুলনায় রাস্তা কম এ অঞ্চলে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টার জ্যামে আটকে পড়ে থাকতে হয় গাড়িগুলোকে। আছে গ্যাস, পানি বিদ্যুতের শোচনীয় সমস্যাও। নাগরিক জীবনের এ সমস্যাগুলোর পাশাপাশি আছে মাদক, সন্ত্রাস, ছিনতাই, নিরাপত্তাহীনতাসহ আরও নানা সমস্যার দীর্ঘ তালিকা। সমকালের বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে মিরপুরের যেসব সমস্যা উঠে এসেছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এখানকার কিছু সমস্যা সার্বিক। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা সার্বিকভাবেই জাতীয় সমস্যায় পরিণত। বিশেষ অঞ্চল হিসেবে মিরপুর এক্ষেত্রে হয়তো কখনও কখনও অবহেলিত। কিন্তু সার্বিকভাবে সমস্যাটি সমাধান জাতীয় উদ্যোগের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। আবার কিছু সমস্যা শুধু মিরপুর নয় পুরো ঢাকার জন্যই বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মাদক, সন্ত্রাস, ছিনতাই, নিরাপত্তাহীনতা, জলাবদ্ধতার মতো সমস্যাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অনেক অঞ্চলেই বস্তি বা অপরাধীদের আখড়া নিরাপদ আশ্রয়স্থল আছে। মিরপুরের বিশেষত্ব হলো, এখানে অপরাধকেন্দ্রগুলো জনবসতির অত্যন্ত নিকটবর্তী। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য হলো_ অবিলম্বে অপরাধ ও মাদকের কেন্দ্রগুলোর মূলোৎপাটন করা। এক্ষেত্রে সরকার ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছাও জরুরি। আবার জলাবদ্ধতার সমস্যা ঢাকার অনেক অঞ্চলেই মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। মিরপুরের যে জলাবদ্ধতার সমস্যা আছে ক্ষেত্রবিশেষে তা প্রকট। অনেক সময় রাজপথে জলাবদ্ধতা চলাফেরার ক্ষেত্রে বড় সংকট তৈরি করে। সমস্যাবলির মধ্যে মিরপুরের জন্য বিশেষ যেসব সমস্যা আছে তার মধ্যে পরিবহন সমস্যা, জ্যাম, উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে অবহেলা বিশেষভাবে আলোচ্য। অপেক্ষাকৃত নিম্নআয়ের মানুষের আধিক্য বলে মিরপুর উন্নয়ন পরিকল্পনায় অনেক সময় অবহেলিত থাকে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। বিশেষত রাস্তা নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, রাস্তার আকার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় মিরপুরের যানবাহন জ্যামে আটকে থাকে। মিরপুরবাসীকে অসহনীয় এ জ্যাম থেকে মুক্ত করতে অবশ্যই রাস্তার উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি, বাস বা পাবলিক পরিবহনের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে তা সমাধান করতে হলে এক্ষেত্রে যে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা রয়েছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। খবরে জানা যাচ্ছে, নতুন ও আধুনিক পরিবহন সার্ভিস চালু করার ক্ষেত্রেও এগুলো বড় বাধা। স্থানীয় সন্ত্রাসী বা প্রভাবশালী মহলের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে এক্ষেত্রে গতি আনতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ দরকার। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে জনপ্রিয় এ জনপদটি যদি কোনোভাবে অবহেলিত থাকে, তবে তা প্রত্যাশিত নয়। আমরা মনে করি, মিরপুরের সমস্যা অন্তহীন এবং এর অধিকাংশই সমাধানযোগ্য। সমকালের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে যদি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা উদ্যোগী হন তবে সমাধান আসবে।
No comments