জনশক্তি রপ্তানি- মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে নতুন স্বপ্ন by হাসান আহমেদ চৌধুরী
এ বছর বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত নিয়ে অনেক হতাশার মধ্যে বছরের শেষলগ্নে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আমাদের পুনঃপ্রবেশের সংবাদটি আনন্দ দায়ক। কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে যেসব সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তাতে আমাদের বেকার তারুণ-যুবসমাজ বড় আশায় বুক বেঁধেছে।
তরুণ-যুবসমাজ অধীরভাবে অপেক্ষা করছে কখন মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া শুরু হবে। নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে পুনঃপ্রবেশে যে আঁধার জমেছিল, তা সরতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে।
২ ডিসেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রেস বিফ্রিংয়ে জানানো হয়েছে, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শিগগিরই জনশক্তি রপ্তানি শুরু হবে। গত ২৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়। মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে সে দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ওই সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। ফলে দীর্ঘ চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ আবার তৈরি হয়েছে।
মালয়েশিয়াতে মূলত আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের যাওয়া শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে প্রথম পর্যায়ে ৫০০ শ্রমিক নেওয়া হয় কৃষি খামারে কাজের জন্য। এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে লোক নিয়োগ চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে। মালয়েশিয়া সে বছর ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান থেকেও একই প্রক্রিয়ায় শ্রমিক আমদানি শুরু করে। চুক্তির পর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতে মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ঘিরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। একপর্যায়ে মালয়েশিয়া শ্রমিক আমদানি থেকে বিরত থাকে। ২০০৬ সালে কলিং ভিসার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় আবার শ্রমিকদের যাওয়া শুরু হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এই শ্রমবাজার ঘিরে একধরনের নৈরাজ্যও শুরু হয়। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, অবৈধ অনুপ্রবেশ, কম বেতনে শ্রমিক নিয়োগ, দালাল সিন্ডিকেট চক্রের খবরদারি, একশ্রেণীর শ্রমিকের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যর্থতা, হাইকমিশনের খামখেয়ালিপনা, সরকারি কর্তৃপক্ষের নথিপত্রে নেই এমন শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ অনেক কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নিষিদ্ধঘোষিত হয় বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় তারা আর বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের শ্রমিক নেবে না। একই সঙ্গে আনডকুমেন্টেড শ্রমিকদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর কথাও বলা হয়। এসব ছাড়াও সেই সময় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও কিছু আনুষ্ঠানিক জটিলতা ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘সোর্স কান্ট্রি’ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি না পাওয়া। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষ অনুমতিতে সে সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হতো, ফলে তখন মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে একজন শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে লেভি প্রদানসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফার কারণে অভিবাসন ব্যয় ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে মালয়েশিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে এ বছরের গোড়ার দিকে দুই দেশের মধ্যে শ্রমিক আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা পুনরায় শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিষয়টির ওপর জোর দেন এবং নজরদারি রাখেন। গণমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। বছরের মাঝামাঝি মালয়েশিয়া থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের বৈদেশিক শ্রম বিভাগের পরিচালক হানিফ বিন ওমরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এই দলটি প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী, সচিব ও বিএমইটির পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে সময়ই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া এবং সোর্স কান্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দেশের শ্রম-দরজা আবার উন্মুক্ত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মালয়েশিয়ার সরকার ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, কৃষি, সেবা ও প্ল্যান্টেশন খাতে বেশি কর্মী নেবে।
কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে দেশের সব জেলা থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনগোষ্ঠীগত কোটা অনুযায়ী প্রতিটি জেলার কোটা নির্ধারণ করা হবে এবং আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় জেলা কোটা পূরণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই জেলার রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে যাবে। সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মী সঙ্গে সঙ্গেই রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ একটি কার্ড পাবেন। ওই কার্ডে কর্মীর বাছাইয়ের জন্য নির্ধারিত টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (টিটিসি) নাম, স্থান ও তারিখ উল্লেখ থাকবে। সারা বাংলাদেশের ১৩টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে এই বাছাই কার্যক্রম চলবে। কর্মী বাছাইয়ের সময় শারীরিক যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে। সেই সঙ্গে কর্মীর ছবিসহ আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে এবং শারীরিক সুস্থতার মেডিকেল পরীক্ষা করা হবে। মেডিকেল পরীক্ষার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) দেওয়া হয়েছে। নির্বাচিত কর্মীরা মালয়েশিয়া গিয়ে যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন এবং সে দেশের আইন সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকেন, সে লক্ষ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট টিটিসিতে ১০ দিনের পরিচিতিমূলক ধারণা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে মালয়েশিয়ার ভাষা, খাবার, সংসৃ্কতি, আইন ও কাজের ধরন সম্পর্কে কর্মীদের প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পথ আরও সুগম হোক, তা আমরা অবশ্যই চাই। জনশক্তি রপ্তানির কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, মালয়েশিয়ায় স্বল্প খরচে সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিতে একটা আনুষ্ঠানিক কাঠামো স্থির হয়ে যাওয়ার পর কঠোর নজরদারির মধ্যে সৎ বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও জনশক্তি রপ্তানিতে সুযোগ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, ডেমোগ্রেফিক ভিত্তিতে জেলা কোটা ঘোষণার চেয়ে দেশের যেসব এলাকা বেশি দারিদ্র্যপ্রবণ, যেমন, চরাঞ্চল, হাওর, সিডর-আইলা আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চলের তরুণ-যুবকদের ও দরিদ্র বিধবা পরিবারের সন্তানদের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের আরও বিকেন্দ্রীকরণ হবে বলে মনে হয়। একই সঙ্গে যদি কোনো পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে থাকেন, তাহলে সরকার ওই পরিবারের কোনো সন্তানকে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রাধান্য দেবে না।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে যে নতুন সূচনা হতে যাচ্ছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। সে দেশের শ্রমবাজারের দুয়ার বাংলাদেশের জন্য বহুদিন বন্ধ থাকার পর নতুনভাবে খুলে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশের দরিদ্র, কর্মসংস্থানের প্রকট অভাবে জর্জরিত যুবসমাজের সামনে বেকারত্ব ঘোঁচানো ও বৈদেশিক মুদ্রা উপর্জনের যে সুযোগ এসেছে, তা সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে হবে।
হাসান আহমেদ চৌধুরী: জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক।
kiৎondebate@gmail.com
২ ডিসেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রেস বিফ্রিংয়ে জানানো হয়েছে, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শিগগিরই জনশক্তি রপ্তানি শুরু হবে। গত ২৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়। মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে সে দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ওই সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। ফলে দীর্ঘ চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ আবার তৈরি হয়েছে।
মালয়েশিয়াতে মূলত আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের যাওয়া শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে প্রথম পর্যায়ে ৫০০ শ্রমিক নেওয়া হয় কৃষি খামারে কাজের জন্য। এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে লোক নিয়োগ চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে। মালয়েশিয়া সে বছর ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান থেকেও একই প্রক্রিয়ায় শ্রমিক আমদানি শুরু করে। চুক্তির পর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতে মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ঘিরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। একপর্যায়ে মালয়েশিয়া শ্রমিক আমদানি থেকে বিরত থাকে। ২০০৬ সালে কলিং ভিসার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় আবার শ্রমিকদের যাওয়া শুরু হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এই শ্রমবাজার ঘিরে একধরনের নৈরাজ্যও শুরু হয়। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, অবৈধ অনুপ্রবেশ, কম বেতনে শ্রমিক নিয়োগ, দালাল সিন্ডিকেট চক্রের খবরদারি, একশ্রেণীর শ্রমিকের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যর্থতা, হাইকমিশনের খামখেয়ালিপনা, সরকারি কর্তৃপক্ষের নথিপত্রে নেই এমন শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ অনেক কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নিষিদ্ধঘোষিত হয় বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় তারা আর বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের শ্রমিক নেবে না। একই সঙ্গে আনডকুমেন্টেড শ্রমিকদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর কথাও বলা হয়। এসব ছাড়াও সেই সময় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে আরও কিছু আনুষ্ঠানিক জটিলতা ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘সোর্স কান্ট্রি’ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি না পাওয়া। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষ অনুমতিতে সে সময় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো হতো, ফলে তখন মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে একজন শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে লেভি প্রদানসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফার কারণে অভিবাসন ব্যয় ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে মালয়েশিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে এ বছরের গোড়ার দিকে দুই দেশের মধ্যে শ্রমিক আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা পুনরায় শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিষয়টির ওপর জোর দেন এবং নজরদারি রাখেন। গণমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। বছরের মাঝামাঝি মালয়েশিয়া থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের বৈদেশিক শ্রম বিভাগের পরিচালক হানিফ বিন ওমরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এই দলটি প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী, সচিব ও বিএমইটির পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে সময়ই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া এবং সোর্স কান্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দেশের শ্রম-দরজা আবার উন্মুক্ত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মালয়েশিয়ার সরকার ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, কৃষি, সেবা ও প্ল্যান্টেশন খাতে বেশি কর্মী নেবে।
কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে দেশের সব জেলা থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনগোষ্ঠীগত কোটা অনুযায়ী প্রতিটি জেলার কোটা নির্ধারণ করা হবে এবং আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় জেলা কোটা পূরণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই জেলার রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে যাবে। সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মী সঙ্গে সঙ্গেই রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ একটি কার্ড পাবেন। ওই কার্ডে কর্মীর বাছাইয়ের জন্য নির্ধারিত টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (টিটিসি) নাম, স্থান ও তারিখ উল্লেখ থাকবে। সারা বাংলাদেশের ১৩টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে এই বাছাই কার্যক্রম চলবে। কর্মী বাছাইয়ের সময় শারীরিক যোগ্যতা ও দক্ষতা এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে। সেই সঙ্গে কর্মীর ছবিসহ আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে এবং শারীরিক সুস্থতার মেডিকেল পরীক্ষা করা হবে। মেডিকেল পরীক্ষার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) দেওয়া হয়েছে। নির্বাচিত কর্মীরা মালয়েশিয়া গিয়ে যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন এবং সে দেশের আইন সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকেন, সে লক্ষ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট টিটিসিতে ১০ দিনের পরিচিতিমূলক ধারণা প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এসবের মধ্যে মালয়েশিয়ার ভাষা, খাবার, সংসৃ্কতি, আইন ও কাজের ধরন সম্পর্কে কর্মীদের প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পথ আরও সুগম হোক, তা আমরা অবশ্যই চাই। জনশক্তি রপ্তানির কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, মালয়েশিয়ায় স্বল্প খরচে সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিতে একটা আনুষ্ঠানিক কাঠামো স্থির হয়ে যাওয়ার পর কঠোর নজরদারির মধ্যে সৎ বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও জনশক্তি রপ্তানিতে সুযোগ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, ডেমোগ্রেফিক ভিত্তিতে জেলা কোটা ঘোষণার চেয়ে দেশের যেসব এলাকা বেশি দারিদ্র্যপ্রবণ, যেমন, চরাঞ্চল, হাওর, সিডর-আইলা আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চলের তরুণ-যুবকদের ও দরিদ্র বিধবা পরিবারের সন্তানদের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের আরও বিকেন্দ্রীকরণ হবে বলে মনে হয়। একই সঙ্গে যদি কোনো পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে থাকেন, তাহলে সরকার ওই পরিবারের কোনো সন্তানকে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রাধান্য দেবে না।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে যে নতুন সূচনা হতে যাচ্ছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। সে দেশের শ্রমবাজারের দুয়ার বাংলাদেশের জন্য বহুদিন বন্ধ থাকার পর নতুনভাবে খুলে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশের দরিদ্র, কর্মসংস্থানের প্রকট অভাবে জর্জরিত যুবসমাজের সামনে বেকারত্ব ঘোঁচানো ও বৈদেশিক মুদ্রা উপর্জনের যে সুযোগ এসেছে, তা সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে হবে।
হাসান আহমেদ চৌধুরী: জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক।
kiৎondebate@gmail.com
No comments