খাবারে ভেজাল- বাজারে মাছি, ক্রেতা খুশি by জাহিদ হায়দার
‘ঘরে হাঁড়ি ঠনঠনান্তি / মশা মাছি ভনভনান্তি’, ‘রেতে মশা দিনে মাছি / এই নিয়ে কলকাতায় আছি’ (কলকাতার জায়গায় ঢাকা পড়ুন) লিখেছিলেন বাংলা কবিতায় স্যাটারের গুরু কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। সময়ের নিয়মে অনেক সময় চলে গেছে।
অনেক কিছুর বেদনাদায়ক পরিবর্তন চারদিকে ‘ভনভনিয়ে’ ঘুরঘুর করছে, তার মধ্যে আমাদের মতো সাধারণ জনতা সকাল-সন্ধ্যা হাবুডুবু খাচ্ছি আর মনে করছি: কে খণ্ডাবে নিয়তি এই খাণ্ডবদাহনে।
মাছি মারা খুবই শক্ত কাজ। তার ‘ফাজিল চালাক’ ওড়াউড়ি মানুষকে বোঝায়, মানুষকে খুন করা সহজ হতে পারে, যেমন এই দেশে অহরহ হচ্ছে, কিন্তু আমাকে মারা কঠিন।
মাছির চোখ চারদিকে ঘুরতে পারে। গোয়েন্দা ও ভিভিআইপির রক্ষীদের প্রশিক্ষণের সময় নাকি বলা হয়, চোখের কাজ হবে মাছির চোখের মতো। পর্যবেক্ষণ ঠিক না হলে ফুলের তোড়ার মধ্যে বোমা চলে আসতে পারে। জগতের ভালোমন্দ সবকিছু থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা নেয় কজন!
‘ফরমালিনের তোড়ে মাছ ও ফলমূলের ধারে-কাছেও মাছি নেই। ফরমালিনমুক্ত মাছ ও ফলমূলে মাছি বসে, তার মানে ওগুলো পচবে। কী আর খাব, কোনো ফল কিনে এক মাস টেবিলে রাখুন, পচবে না। মাছ শক্ত, পচে না, কোন দেশে আছি?’ ‘কেন, বাংলাদেশে আছি।’ ক্রেতারা বাজারে মাছি দেখতে না পেয়ে আত্মীয় ও পড়শি-বন্ধুদের মুখ বেজার করে বলেন, ‘বাজারে কোনো মাছি নেই।’ যেন মহা মূল্যবান কিছু নেই।
মাছি শত রকমের অসুখ ছড়ায়। এই কথা জানার পরও আমরা চাইলাম বাজারে ফিরে আসুক মাছি। বাঙালি যে কত কিছু চায়! কত কিছুর মধ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে! আমরা বাজারে এখন মাছি দেখলে খুশি হই। ঘরে, খাবারে, হোটেলে মাছির ভনভনান্তি অসহ্য, বাজারে ভনভনান্তি ভালো লাগছে। (আফ্রিকায় এক রকম মাছি আছে, কামড়ালে চামড়ার নিচে ডিম জন্মায়, ডিম শরীরে ছড়িয়ে পড়ে; আর এক প্রকার মাছির কামড়ে গভীর ঘুমের অসুখ হয় এবং ঘুমের মধ্যে হয় মৃত্যু। যথাসময়ে চিকিৎসা না নিলে ডিমে আর ঘুমে নির্ঘাৎ মরণ।)
তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী? পচন দেখতে পাওয়াও সুখ? সমাজে পচন ধরা দেখতে পাওয়া কোনোভাবেই সুখের না। কিন্তু এই দেশের মানুষ কোনো কোনো খাদ্যের পচন দেখতে চায়। জীবন থাকলেই না পচন, জীবনের জীবনীশক্তি আগেই ওষুধ দিয়ে, কৌশল করে, শেষ করে দিলে জীবন পচবে কীভাবে? পচন হবে, যে খাবে তার। গত ২২ নভেম্বরের প্রথম আলোতে ছবি দেখলাম, কাঁচা টমেটো পাকাতে হরমোন ছিটানো হচ্ছে। হরমোন ২ পিপিএমের বেশি হলে শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চাষি ভাই যেভাবে টমেটোতে হরমোন দিচ্ছেন, মাত্রা কি ঠিক থাকছে? যদিও বলেছেন, মাত্রা ঠিক রাখা হচ্ছে। এই টমেটো নিয়মিত খেলে, লিঙ্গান্তর ঘটবে না তো?
মশা-মাছি নির্মূল করার দায়িত্ব যাঁদের, সেসব কাজ তাঁরা ঠিকমতো করেন না। তাঁরা অনেক টাকার কীটনাশক কেনেন। আসল কাজ, যে কারণে মাছি হয়, তা নির্মূল করতে তাঁরা অনাগ্রহী। মশা-মাছি উৎপাদন করতে যা যা দরকার, করা হয়। তাদের জন্মক্ষেত্র আবর্জনা, এই জিনিস না পুষলে অনেকের আয় সচল থাকে না। বহুজাতিকের ওষুধ কেনা বন্ধ হয়ে যাবে। রহস্যময় বাণিজ্য (!) আর হবে না।
কয়েক দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে ক্যানসার বিষয়ে একজন চিকিৎসক আলোচনা করছিলেন। তিনি জানালেন, ভারতের চিকিৎসকেরা আলোচনা করেছেন, ১০ বছর ধরে ক্যানসার-আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশ থেকে বেশি আসছে। ভারতীয় চিকিৎসকদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে ফরমালিন ও রং মেশানো খাবার বেশি খাওয়া। যখন পোলার আইসক্রিম বাংলাদেশে এরশাদের শাসনামলে বাজারজাত করা হলো, তখন একটা গুজব বের হয়েছিল, চেরনোবিলের ভয়াবহ সেই তেজস্ক্রিয়ার কবলে পড়া দুধেই তৈরি পোলার আইসক্রিম। সেই দুধ নিয়ে জাহাজ এসেছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। আমরা কী আনন্দে পোলার খেয়েছি তখন। যাদের ক্যানসার হচ্ছে ওই দুধও কি আরও একটা কারণ?
আমরা চেয়েছি বাজারে মাছি ফিরে আসুক। কী নিম্নমানের চাওয়া! কী দুর্লভ চাওয়া! মাছিকে বাজারে দেখতে পেলে আমরা খুশি হচ্ছি। সম্প্রতি ঢাকার কয়েকটি বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ক্রেতা মাছ বা ফল কিনে কোনো সন্দেহ করলে, বাজারে রাখা ফরমালিন পরীক্ষা-মেশিনে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। অনেকে বলেছেন, মাছ ও বিভিন্ন খাদ্য—তার মধ্যে ফলমূলও আছে—বাইরের দেশ থেকে যখন এই দেশে ঢুকবে, তখনই পরীক্ষা করা উচিত। ঠিকই বলছেন তাঁরা।
একটি ছোট অথচ আক্কেল নাড়িয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার সহকর্মী ক্যারোলিন ও আমি পূর্ব তিমুর থেকে ফিরছিলাম অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে। ও মেলবোর্নের মেয়ে। ওর পায়ে ছিল নোংরা কেটস। বিমানে একটি কাগজ দেওয়া হলো, তাতে ঘোষণা দিতে হবে কী কী খাবার আর নোংরা জিনিস তোমার কাছে আছে। আমি বাঙাল ভাবলাম, আমার হাতব্যাগে টোস্ট বিস্কুট আছে, ভাত ছাড়া বাঙালির আর খাবার কী? কাগজে টিক দিলাম, কোনো খাবার নেই। মালপত্র স্ক্যানিং মেশিন থেকে বেরোনোর পরেই এক দশাসই কুকুর আমাদের কাছে এল। শুঁকতে লাগল আমার ব্যাগ এবং ক্যারোলিনের কেটস। এবং তিনবার ঘেউ দিয়ে উঠল। কামড়ই কী খাই! কুকুরের বেল্ট ধরা লোকটি, অস্ট্রেলিয়ার টান মারা ইংলিশে (ওরা এইট-কে আইট) তার দেশের মেয়েকে অপমান করলেন: দেশের আইন ভুলে যাও কেন?’ বলে ওর হাতে লোকটি একটি পলিব্যাগ দিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। একটি পলিব্যাগে কেটস নিয়ে ফিরল ক্যারোলিন। কুকুর-কর্তা ব্যাগের মুখ খুলে স্প্রে করলেন। খুলতে হয়েছিল আমার ব্যাগ। বিস্কুট বের করে অফিসার বলেছিলেন, আশা করি তুমি ইংলিশ পড়তে পারো?’ ‘পারি’ শুনে বললেন, দেখোনি ফুড বিষয়ে কী লেখা, ৫০ ডলার ফাইন দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘আমার দেশ বাংলাদেশে ভাতকে আমরা মেইন ফুড বলি। ‘ওকে ব্যাংলাডেশ, নেক্সট টাইমে আশা করি ভুল করবে না।’ অফিসার কুকুর নিয়ে চলে গেলেন। অস্ট্রেলিয়ায় অন্য দেশের নোংরা আর বাজে খাবার ঢুকবে না।
এখন মালিবাগ, শান্তিনগর ও গুলশান বাজার ফরমালিনমুক্ত বাজার। আমি ভেবেছিলাম, ফরমালিনমুক্ত মাছ ও ফলমূলের দাম ফরমালিন যুগের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কিন্তু তা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং কিছু কমেছে। কয়েকজন ফল বিক্রেতা ও নিকারিকে দাম না বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এখন মাছ ধরেই বরফে ফেলছে, ফরমালিন দিয়ে স্টোরে রাখতে পারছে না, আমরাও সন্দেহ হলে আনি না। ধরা মাছ কয় দিন আর বরফে রাখবে? ফলে বিক্রি করে দাও, বিক্রিও বেশি হচ্ছে। মাছচাষিরা পানিতে অনেক দিন মাছ রাখতেও চায় না, পুঁজি তুলতে হবে না?’
ওই তিন বাজারের ক্রেতারা আপাতত খুশি। বাড়ির বউরাও নাকি বলছে: ভালো মাছ, কী লাল রক্ত! ভালো আপেল, আগের স্বাদ। মালিবাগ বাজারে এখন ফরমালিন, লবণ-পানিতে ডোবানো, চটকানো ঢ্যাঁড়সের লালছে লাগানো পিচ্ছিলতা মাছে নেই। মাছের ওপর মাছিরা আহ্লাদে বসছে। নিকারির সহকর্মী মাছি তাড়াচ্ছে। ফলে পচন ধরছে। সব পচন মন্দ নয়। বাজারে মাছির ভনভনান্তি ভালো লাগছে।
জাহিদ হায়দার: কবি, উন্নয়নকর্মী।
মাছি মারা খুবই শক্ত কাজ। তার ‘ফাজিল চালাক’ ওড়াউড়ি মানুষকে বোঝায়, মানুষকে খুন করা সহজ হতে পারে, যেমন এই দেশে অহরহ হচ্ছে, কিন্তু আমাকে মারা কঠিন।
মাছির চোখ চারদিকে ঘুরতে পারে। গোয়েন্দা ও ভিভিআইপির রক্ষীদের প্রশিক্ষণের সময় নাকি বলা হয়, চোখের কাজ হবে মাছির চোখের মতো। পর্যবেক্ষণ ঠিক না হলে ফুলের তোড়ার মধ্যে বোমা চলে আসতে পারে। জগতের ভালোমন্দ সবকিছু থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা নেয় কজন!
‘ফরমালিনের তোড়ে মাছ ও ফলমূলের ধারে-কাছেও মাছি নেই। ফরমালিনমুক্ত মাছ ও ফলমূলে মাছি বসে, তার মানে ওগুলো পচবে। কী আর খাব, কোনো ফল কিনে এক মাস টেবিলে রাখুন, পচবে না। মাছ শক্ত, পচে না, কোন দেশে আছি?’ ‘কেন, বাংলাদেশে আছি।’ ক্রেতারা বাজারে মাছি দেখতে না পেয়ে আত্মীয় ও পড়শি-বন্ধুদের মুখ বেজার করে বলেন, ‘বাজারে কোনো মাছি নেই।’ যেন মহা মূল্যবান কিছু নেই।
মাছি শত রকমের অসুখ ছড়ায়। এই কথা জানার পরও আমরা চাইলাম বাজারে ফিরে আসুক মাছি। বাঙালি যে কত কিছু চায়! কত কিছুর মধ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে! আমরা বাজারে এখন মাছি দেখলে খুশি হই। ঘরে, খাবারে, হোটেলে মাছির ভনভনান্তি অসহ্য, বাজারে ভনভনান্তি ভালো লাগছে। (আফ্রিকায় এক রকম মাছি আছে, কামড়ালে চামড়ার নিচে ডিম জন্মায়, ডিম শরীরে ছড়িয়ে পড়ে; আর এক প্রকার মাছির কামড়ে গভীর ঘুমের অসুখ হয় এবং ঘুমের মধ্যে হয় মৃত্যু। যথাসময়ে চিকিৎসা না নিলে ডিমে আর ঘুমে নির্ঘাৎ মরণ।)
তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী? পচন দেখতে পাওয়াও সুখ? সমাজে পচন ধরা দেখতে পাওয়া কোনোভাবেই সুখের না। কিন্তু এই দেশের মানুষ কোনো কোনো খাদ্যের পচন দেখতে চায়। জীবন থাকলেই না পচন, জীবনের জীবনীশক্তি আগেই ওষুধ দিয়ে, কৌশল করে, শেষ করে দিলে জীবন পচবে কীভাবে? পচন হবে, যে খাবে তার। গত ২২ নভেম্বরের প্রথম আলোতে ছবি দেখলাম, কাঁচা টমেটো পাকাতে হরমোন ছিটানো হচ্ছে। হরমোন ২ পিপিএমের বেশি হলে শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চাষি ভাই যেভাবে টমেটোতে হরমোন দিচ্ছেন, মাত্রা কি ঠিক থাকছে? যদিও বলেছেন, মাত্রা ঠিক রাখা হচ্ছে। এই টমেটো নিয়মিত খেলে, লিঙ্গান্তর ঘটবে না তো?
মশা-মাছি নির্মূল করার দায়িত্ব যাঁদের, সেসব কাজ তাঁরা ঠিকমতো করেন না। তাঁরা অনেক টাকার কীটনাশক কেনেন। আসল কাজ, যে কারণে মাছি হয়, তা নির্মূল করতে তাঁরা অনাগ্রহী। মশা-মাছি উৎপাদন করতে যা যা দরকার, করা হয়। তাদের জন্মক্ষেত্র আবর্জনা, এই জিনিস না পুষলে অনেকের আয় সচল থাকে না। বহুজাতিকের ওষুধ কেনা বন্ধ হয়ে যাবে। রহস্যময় বাণিজ্য (!) আর হবে না।
কয়েক দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে ক্যানসার বিষয়ে একজন চিকিৎসক আলোচনা করছিলেন। তিনি জানালেন, ভারতের চিকিৎসকেরা আলোচনা করেছেন, ১০ বছর ধরে ক্যানসার-আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশ থেকে বেশি আসছে। ভারতীয় চিকিৎসকদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে ফরমালিন ও রং মেশানো খাবার বেশি খাওয়া। যখন পোলার আইসক্রিম বাংলাদেশে এরশাদের শাসনামলে বাজারজাত করা হলো, তখন একটা গুজব বের হয়েছিল, চেরনোবিলের ভয়াবহ সেই তেজস্ক্রিয়ার কবলে পড়া দুধেই তৈরি পোলার আইসক্রিম। সেই দুধ নিয়ে জাহাজ এসেছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। আমরা কী আনন্দে পোলার খেয়েছি তখন। যাদের ক্যানসার হচ্ছে ওই দুধও কি আরও একটা কারণ?
আমরা চেয়েছি বাজারে মাছি ফিরে আসুক। কী নিম্নমানের চাওয়া! কী দুর্লভ চাওয়া! মাছিকে বাজারে দেখতে পেলে আমরা খুশি হচ্ছি। সম্প্রতি ঢাকার কয়েকটি বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ক্রেতা মাছ বা ফল কিনে কোনো সন্দেহ করলে, বাজারে রাখা ফরমালিন পরীক্ষা-মেশিনে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। অনেকে বলেছেন, মাছ ও বিভিন্ন খাদ্য—তার মধ্যে ফলমূলও আছে—বাইরের দেশ থেকে যখন এই দেশে ঢুকবে, তখনই পরীক্ষা করা উচিত। ঠিকই বলছেন তাঁরা।
একটি ছোট অথচ আক্কেল নাড়িয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার সহকর্মী ক্যারোলিন ও আমি পূর্ব তিমুর থেকে ফিরছিলাম অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে। ও মেলবোর্নের মেয়ে। ওর পায়ে ছিল নোংরা কেটস। বিমানে একটি কাগজ দেওয়া হলো, তাতে ঘোষণা দিতে হবে কী কী খাবার আর নোংরা জিনিস তোমার কাছে আছে। আমি বাঙাল ভাবলাম, আমার হাতব্যাগে টোস্ট বিস্কুট আছে, ভাত ছাড়া বাঙালির আর খাবার কী? কাগজে টিক দিলাম, কোনো খাবার নেই। মালপত্র স্ক্যানিং মেশিন থেকে বেরোনোর পরেই এক দশাসই কুকুর আমাদের কাছে এল। শুঁকতে লাগল আমার ব্যাগ এবং ক্যারোলিনের কেটস। এবং তিনবার ঘেউ দিয়ে উঠল। কামড়ই কী খাই! কুকুরের বেল্ট ধরা লোকটি, অস্ট্রেলিয়ার টান মারা ইংলিশে (ওরা এইট-কে আইট) তার দেশের মেয়েকে অপমান করলেন: দেশের আইন ভুলে যাও কেন?’ বলে ওর হাতে লোকটি একটি পলিব্যাগ দিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। একটি পলিব্যাগে কেটস নিয়ে ফিরল ক্যারোলিন। কুকুর-কর্তা ব্যাগের মুখ খুলে স্প্রে করলেন। খুলতে হয়েছিল আমার ব্যাগ। বিস্কুট বের করে অফিসার বলেছিলেন, আশা করি তুমি ইংলিশ পড়তে পারো?’ ‘পারি’ শুনে বললেন, দেখোনি ফুড বিষয়ে কী লেখা, ৫০ ডলার ফাইন দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘আমার দেশ বাংলাদেশে ভাতকে আমরা মেইন ফুড বলি। ‘ওকে ব্যাংলাডেশ, নেক্সট টাইমে আশা করি ভুল করবে না।’ অফিসার কুকুর নিয়ে চলে গেলেন। অস্ট্রেলিয়ায় অন্য দেশের নোংরা আর বাজে খাবার ঢুকবে না।
এখন মালিবাগ, শান্তিনগর ও গুলশান বাজার ফরমালিনমুক্ত বাজার। আমি ভেবেছিলাম, ফরমালিনমুক্ত মাছ ও ফলমূলের দাম ফরমালিন যুগের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কিন্তু তা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং কিছু কমেছে। কয়েকজন ফল বিক্রেতা ও নিকারিকে দাম না বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এখন মাছ ধরেই বরফে ফেলছে, ফরমালিন দিয়ে স্টোরে রাখতে পারছে না, আমরাও সন্দেহ হলে আনি না। ধরা মাছ কয় দিন আর বরফে রাখবে? ফলে বিক্রি করে দাও, বিক্রিও বেশি হচ্ছে। মাছচাষিরা পানিতে অনেক দিন মাছ রাখতেও চায় না, পুঁজি তুলতে হবে না?’
ওই তিন বাজারের ক্রেতারা আপাতত খুশি। বাড়ির বউরাও নাকি বলছে: ভালো মাছ, কী লাল রক্ত! ভালো আপেল, আগের স্বাদ। মালিবাগ বাজারে এখন ফরমালিন, লবণ-পানিতে ডোবানো, চটকানো ঢ্যাঁড়সের লালছে লাগানো পিচ্ছিলতা মাছে নেই। মাছের ওপর মাছিরা আহ্লাদে বসছে। নিকারির সহকর্মী মাছি তাড়াচ্ছে। ফলে পচন ধরছে। সব পচন মন্দ নয়। বাজারে মাছির ভনভনান্তি ভালো লাগছে।
জাহিদ হায়দার: কবি, উন্নয়নকর্মী।
No comments