পার্বত্য চট্টগ্রাম-শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? by আবু সাঈদ খান
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এক অনন্য ঘটনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামিয়েছিল।
সেদিন জনসংহতি নেতা জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন, আর শেখ হাসিনা তাকে দিয়েছিলেন একগুচ্ছ সাদা ফুল। সে দৃশ্য দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে অভিভূত করেছিল, আশার আলো জ্বেলেছিল। এ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, পাহাড়ে আর রক্তপাত হবে না, বারুদের গন্ধ বাতাস ভারি করবে না, বইবে শান্তির হাওয়া।
শান্তিচুক্তির ১৫ বছর পর সে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে? এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের তিন বছর পর বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। তারা চুক্তি বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়নি। শান্তিচুক্তি প্রশ্নে বিএনপি সরকারের অবস্থান ছিল নেতিবাচক। তবে চুক্তির ১৫ বছরের মধ্যে সাড়ে সাত বছর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করেছে। তা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে সামান্যই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় শাসন-প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটেনি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, রক্ষিত নয় এমন বন, পরিবেশ, স্থানীয় পর্যটন, জুমচাষ ইত্যাদি চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন না হওয়ায় জনমনে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। জুম্ম জনগোষ্ঠী তাদের বেদখল বাস্তুভিটা, ধানক্ষেত, বাগানবাগিচা ফেরত পাচ্ছে না। উল্টো নতুন প্রক্রিয়ায় পাহাড়িদের জমি জবরদখল চলছে। এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে ইকোপার্ক-পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণসহ নানা প্রকল্পে অস্থায়ীদের জমি ইজারা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে বিপুল জমি গ্রাস করা হচ্ছে। নিষ্পন্ন হচ্ছে না ভূমি সমস্যাও। 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ কমিশন আইন-২০০১' নিয়ে জুম্ম জনগোষ্ঠীর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এটি সংশোধনের ব্যাপারে সরকারও দ্বিমত করছে না। সর্বশেষ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আইনটির ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা এখনও সংসদে উত্থাপিত হয়নি। এমন কালক্ষেপণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারবঞ্চিত জনগণ ক্ষুব্ধ। পার্বত্য চুক্তির ১৫তম বার্ষিকীতে জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা বলেছেন, 'যে চুক্তি করা হয়েছিল, তা কি পাহাড়ি জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য? আমাদের অস্ত্র-বারুদ কেড়ে নেওয়ার জন্য?'
শান্তিচুক্তি যদি শান্তিবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র-বারুদ কেড়ে নেওয়ার কৌশল হয়, সেটি প্রতারণার শামিল। সরকার এমন অপকৌশল নিয়েছে তা ভাবতে চাই না। বরং বিশ্বাস করতে চাই যে, পার্বত্যাঞ্চলের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই শান্তিচুক্তি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, শান্তিচুক্তি নিয়ে মহলবিশেষের সমালোচনা রয়েছে। তা হলো_ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে যে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা, তা বাস্তবায়িত হলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। দুই. পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে কেন অধিক সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, একই দেশে কেন দুই বিধান থাকবে ইত্যাদি।
প্রথমত জানা দরকার, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার, যুব কল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্থানীয় পর্যটন এবং পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান। এমন ক্ষমতা এবং এর চেয়ে অধিক ক্ষমতা যুক্তরাজ্যের কাউন্টিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকারের রয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সব স্থানীয় সরকারকে অনুরূপ ক্ষমতায়ন করা হলে দেশের কল্যাণই হবে। বিকেন্দ্রীকরণ হলে প্রশাসন জনগণের নাগালের মধ্যে আসবে। নিশ্চিত হবে জবাবদিহি। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার বাস্তবতা ভিন্ন। এ কারণে আলাদা আইনের প্রয়োজনীয়তা ও রেওয়াজ পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারও আদিবাসী অধিকার সংরক্ষণ আইন করেছিল_ যেটি 'চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০' নামে পরিচিত। প্রতিবেশী ভারতেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার জন্য বিশেষ আইন রয়েছে, যাতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে। যারা এ বাস্তবতা না বুঝে সমালোচনা করছেন, তাদের বোঝানো সম্ভব। আর যারা জেনেশুনে সমালোচনা করছেন, তারা জ্ঞানপাপী। এ জ্ঞানপাপীদের ভূমিকা দেশের সংহতির জন্য ক্ষতিকর।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ এক ভাষা, এক জাতি বা এক ধর্মের দেশ নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শুধু মুসলমানের দেশ করার খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে 'বাঙালির রাষ্ট্র' বলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে এবং তাদের জোর করে বশীভূত করার পরিণতিও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত রূপ আমরা দেখেছি। এ দুই ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে শাসকশ্রেণী যদি বাংলাদেশকে বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র মনে করেন, তবে সেটি হবে মহাভুল। এ ভ্রান্ত রাজনীতির তাত্তি্বক ব্যাখ্যাও হাজির করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। এ ভ্রান্ত তত্ত্ব নীতিনির্ধারক থেকে প্রশাসকদের একাংশের মধ্যে সংক্রমিত। এর পুনরাবৃত্তি শুনেছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির মুখেও। তার ভাষায়_ বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তাহলে সমতলের সাঁওতাল, গারো, মুণ্ডা, রাজবংশীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠীকে কী বলব? তাদের কি আদিবাসীর পরিবর্তে বাঙালি বলা হবে, না উপজাতি বলে উপহাস করা হবে?
আদিবাসীর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশন ১০৭ (বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে) এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলে সেই জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয় তা হলো_ ক. সনাতনী জীবন পদ্ধতি; খ. প্রথা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য; গ. নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ঘ. অন্যরা প্রবেশের আগে কোনো বিশেষ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের নজির। এ ব্যাখ্যার আলোকে কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো নেই? তারা কি পাহাড়ে প্রথম বসতি গড়েনি? কী করে অগ্রাহ্য করা হবে উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল-মুণ্ডাদের কথা। যখন বিভিন্ন জনস্রোত একত্র হয়ে ভাষার পরিচয়ে বাঙালি হয়ে ওঠেনি, ইতিহাস তখনও মুণ্ডা-সাঁওতালদের উপস্থিতির কথা বলে।
দেশকে বহিরাগতদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে আদিবাসীদের অবদান কি খাটো করে দেখা যায়? মোগলসহ নানা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাকমারা লড়েছে, ইংরেজদের সঙ্গে সাহসী লড়াই করেছে মুণ্ডা-সাঁওতাল-গারোরা। সর্বশেষ আমরা বাঙালি-আদিবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, মানুষে মানুষে সৃষ্ট বৈষম্যের অবসানের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। সেই স্বাধীন দেশের সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষ কেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে?
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার পরিচয় অস্বীকার করে নয়, বরং দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে নাগরিক হিসেবে সব জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজ জরুরি। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জাতিসত্তার স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যে ভুল হয়েছিল, পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'আদিবাসী' শব্দটি সংযোজন করে সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়' সম্বোধন করে মহাজোট প্রকারান্তরে পুরনো ভুলটিই টিকিয়ে রেখেছে, যা আদিবাসীদের দুঃখ-কষ্ট কমায়নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে '৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেক্যুলার মানে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ নয়, একে হতে হবে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গনিরপেক্ষ। দেশে সব জাতির, সব ধর্মের, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সমমর্যাদার নাগরিক হবে। আর যারা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার হাত। উন্নয়নের ধারায় তাদের যুক্ত করতে নেওয়া দরকার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ। তাই অধিকার কেড়ে নয়, অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে. সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের কাছে টানতে হবে, তাদের মূলধারায় স্থান করে দিতে হবে।
পরিশেষে বলব, ১৫ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই সেখানে স্থায়ী শান্তির ভিত রচিত হতে পারে, অন্য কোনো পথে তা সম্ভব নয়। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, বর্তমান সরকারের হাতে কেবল সময় মাত্র এক বছর। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী এক বছরের মধ্যে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস, আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে এ পটভূমিতে তা কঠিন কিছু নয়। সরকার প্রতিশ্রুতি অনুসারে এগিয়ে যাবে, সেটিই শান্তিকামী মানুষের কাম্য।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
শান্তিচুক্তির ১৫ বছর পর সে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে? এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের তিন বছর পর বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। তারা চুক্তি বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়নি। শান্তিচুক্তি প্রশ্নে বিএনপি সরকারের অবস্থান ছিল নেতিবাচক। তবে চুক্তির ১৫ বছরের মধ্যে সাড়ে সাত বছর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করেছে। তা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে সামান্যই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় শাসন-প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটেনি। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, রক্ষিত নয় এমন বন, পরিবেশ, স্থানীয় পর্যটন, জুমচাষ ইত্যাদি চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন না হওয়ায় জনমনে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। জুম্ম জনগোষ্ঠী তাদের বেদখল বাস্তুভিটা, ধানক্ষেত, বাগানবাগিচা ফেরত পাচ্ছে না। উল্টো নতুন প্রক্রিয়ায় পাহাড়িদের জমি জবরদখল চলছে। এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামে ইকোপার্ক-পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণসহ নানা প্রকল্পে অস্থায়ীদের জমি ইজারা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে বিপুল জমি গ্রাস করা হচ্ছে। নিষ্পন্ন হচ্ছে না ভূমি সমস্যাও। 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ কমিশন আইন-২০০১' নিয়ে জুম্ম জনগোষ্ঠীর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এটি সংশোধনের ব্যাপারে সরকারও দ্বিমত করছে না। সর্বশেষ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আইনটির ১৩ দফা সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তা এখনও সংসদে উত্থাপিত হয়নি। এমন কালক্ষেপণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারবঞ্চিত জনগণ ক্ষুব্ধ। পার্বত্য চুক্তির ১৫তম বার্ষিকীতে জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা বলেছেন, 'যে চুক্তি করা হয়েছিল, তা কি পাহাড়ি জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য? আমাদের অস্ত্র-বারুদ কেড়ে নেওয়ার জন্য?'
শান্তিচুক্তি যদি শান্তিবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র-বারুদ কেড়ে নেওয়ার কৌশল হয়, সেটি প্রতারণার শামিল। সরকার এমন অপকৌশল নিয়েছে তা ভাবতে চাই না। বরং বিশ্বাস করতে চাই যে, পার্বত্যাঞ্চলের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই শান্তিচুক্তি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, শান্তিচুক্তি নিয়ে মহলবিশেষের সমালোচনা রয়েছে। তা হলো_ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে যে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা, তা বাস্তবায়িত হলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। দুই. পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে কেন অধিক সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, একই দেশে কেন দুই বিধান থাকবে ইত্যাদি।
প্রথমত জানা দরকার, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার, যুব কল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্থানীয় পর্যটন এবং পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান। এমন ক্ষমতা এবং এর চেয়ে অধিক ক্ষমতা যুক্তরাজ্যের কাউন্টিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকারের রয়েছে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সব স্থানীয় সরকারকে অনুরূপ ক্ষমতায়ন করা হলে দেশের কল্যাণই হবে। বিকেন্দ্রীকরণ হলে প্রশাসন জনগণের নাগালের মধ্যে আসবে। নিশ্চিত হবে জবাবদিহি। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার বাস্তবতা ভিন্ন। এ কারণে আলাদা আইনের প্রয়োজনীয়তা ও রেওয়াজ পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারও আদিবাসী অধিকার সংরক্ষণ আইন করেছিল_ যেটি 'চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন ১৯০০' নামে পরিচিত। প্রতিবেশী ভারতেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার জন্য বিশেষ আইন রয়েছে, যাতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে। যারা এ বাস্তবতা না বুঝে সমালোচনা করছেন, তাদের বোঝানো সম্ভব। আর যারা জেনেশুনে সমালোচনা করছেন, তারা জ্ঞানপাপী। এ জ্ঞানপাপীদের ভূমিকা দেশের সংহতির জন্য ক্ষতিকর।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ এক ভাষা, এক জাতি বা এক ধর্মের দেশ নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শুধু মুসলমানের দেশ করার খেসারত আমাদের দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে 'বাঙালির রাষ্ট্র' বলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে এবং তাদের জোর করে বশীভূত করার পরিণতিও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত রূপ আমরা দেখেছি। এ দুই ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে শাসকশ্রেণী যদি বাংলাদেশকে বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র মনে করেন, তবে সেটি হবে মহাভুল। এ ভ্রান্ত রাজনীতির তাত্তি্বক ব্যাখ্যাও হাজির করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। এ ভ্রান্ত তত্ত্ব নীতিনির্ধারক থেকে প্রশাসকদের একাংশের মধ্যে সংক্রমিত। এর পুনরাবৃত্তি শুনেছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির মুখেও। তার ভাষায়_ বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তাহলে সমতলের সাঁওতাল, গারো, মুণ্ডা, রাজবংশীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠীকে কী বলব? তাদের কি আদিবাসীর পরিবর্তে বাঙালি বলা হবে, না উপজাতি বলে উপহাস করা হবে?
আদিবাসীর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশন ১০৭ (বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে) এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলে সেই জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয় তা হলো_ ক. সনাতনী জীবন পদ্ধতি; খ. প্রথা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য; গ. নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ঘ. অন্যরা প্রবেশের আগে কোনো বিশেষ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের নজির। এ ব্যাখ্যার আলোকে কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো নেই? তারা কি পাহাড়ে প্রথম বসতি গড়েনি? কী করে অগ্রাহ্য করা হবে উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল-মুণ্ডাদের কথা। যখন বিভিন্ন জনস্রোত একত্র হয়ে ভাষার পরিচয়ে বাঙালি হয়ে ওঠেনি, ইতিহাস তখনও মুণ্ডা-সাঁওতালদের উপস্থিতির কথা বলে।
দেশকে বহিরাগতদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে আদিবাসীদের অবদান কি খাটো করে দেখা যায়? মোগলসহ নানা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাকমারা লড়েছে, ইংরেজদের সঙ্গে সাহসী লড়াই করেছে মুণ্ডা-সাঁওতাল-গারোরা। সর্বশেষ আমরা বাঙালি-আদিবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, মানুষে মানুষে সৃষ্ট বৈষম্যের অবসানের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। সেই স্বাধীন দেশের সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষ কেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে?
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার পরিচয় অস্বীকার করে নয়, বরং দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে নাগরিক হিসেবে সব জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজ জরুরি। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জাতিসত্তার স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যে ভুল হয়েছিল, পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'আদিবাসী' শব্দটি সংযোজন করে সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়' সম্বোধন করে মহাজোট প্রকারান্তরে পুরনো ভুলটিই টিকিয়ে রেখেছে, যা আদিবাসীদের দুঃখ-কষ্ট কমায়নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে '৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেক্যুলার মানে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ নয়, একে হতে হবে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গনিরপেক্ষ। দেশে সব জাতির, সব ধর্মের, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সমমর্যাদার নাগরিক হবে। আর যারা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার হাত। উন্নয়নের ধারায় তাদের যুক্ত করতে নেওয়া দরকার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ। তাই অধিকার কেড়ে নয়, অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে. সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের কাছে টানতে হবে, তাদের মূলধারায় স্থান করে দিতে হবে।
পরিশেষে বলব, ১৫ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই সেখানে স্থায়ী শান্তির ভিত রচিত হতে পারে, অন্য কোনো পথে তা সম্ভব নয়। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, বর্তমান সরকারের হাতে কেবল সময় মাত্র এক বছর। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী এক বছরের মধ্যে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস, আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে এ পটভূমিতে তা কঠিন কিছু নয়। সরকার প্রতিশ্রুতি অনুসারে এগিয়ে যাবে, সেটিই শান্তিকামী মানুষের কাম্য।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments