মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-ভ্যানের চাকা যে আর ঘোরে না ওয়াদুদের by নাসরুল আনোয়ার
বছর দশেক আগে ঝড়ে একমাত্র বসতঘরটি পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওয়াদুদের। বাঁশ-খুঁটি জোগাড় করতে না পারায় মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থাকা দুটি চালার নিচেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাঁকে প্রায় তিন মাস বসবাস করতে হয়। পরে অবশ্য তাঁর ছোট ভাই ঘরটি দাঁড় করানোর জন্য দুটি বাঁশ কিনে দেন।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌর শহরের মধ্য ভাগলপুরে সেই বাড়িতেই থাকেন ওয়াদুদ। আসলে তাঁর নিজের কোনো বসতভিটা নেই। ঘরটি ছোট ভাইয়ের জায়গায়। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৩ শতাংশ বাড়ির মধ্যে কয়েক দফায় ছয় শতাংশের মতো বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু ক্রেতা কৌশলে সবটাই লিখে নিয়েছেন বলে ওয়াদুদের অভিযোগ।
৬৫ বছর বয়সী আব্দুল ওয়াদুদ ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বয়সের ভারে আর অসুস্থতায় ভ্যান চালাতে এখন কষ্ট হয় তাঁর। পেটের দায়ে দিনমজুরিও করেন। মাঝেমধ্যে করেন ইট ভাঙার কাজ। ঘরে তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও চার মেয়ে। দুই ছেলেও দিনমজুর। ওদের আলাদা সংসার। নিজেরাই ঠিকমতো খেতে পায় না, মা-বাবাকে কী দেবে! ছোট ছেলে পড়ে স্কুলে। এক মেয়েও স্কুলে যায়। ঠিকমতো খাবারই জোটে না, তার ওপর এদের লেখাপড়ার খরচ- এ যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
২০০৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আব্দুল ওয়াদুদকে প্রথমবারের মতো সংবর্ধনা দেয় স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা 'পরু'। নগদ দেড় হাজার টাকা দিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের বাজিতপুর শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল সংস্থাটি। ওয়াদুদ জানান, ওই অ্যাকাউন্টে আরো দেড় হাজার টাকা তিনি জমিয়েছিলেন। কিন্তু নিরুপায় হয়ে সব টাকা তুলে নিয়েছেন। তিনি আরো জানান, ভ্যান চালিয়ে, দিনমজুরি করে কটা ভাত হয়তো জোটে, মাছ-তরকারি কেনার সুযোগ থাকে না। তাঁর ভাষ্য, 'খালি ভাত কি আর পেটে যায়?' তিন মাস পরপর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। ওই টাকা চলে যায় চিকিৎসার পেছনে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াদুদ বলেন, 'দ্যাশের লাইগ্যা যুদ্ধে গেছি। কুনু কিছু পাইবার আশা করি নাই। ভাবছি, দ্যাশ স্বাধীন হইলে শান্তি আইব। সবে মিইল্যা সুখে থাকুম। কিয়ের মধ্যে কী!' আব্দুল ওয়াদুদ জানান, হানাদার বাহিনী দেদার লুটপাট করছিল। নিধন করছিল অসহায় নারী-পুরুষদের। বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছিল। নারীদের ওপর চালাচ্ছিল পাশবিক নির্যাতন। যখন খুশি এর খাসি বা ওর গরু জবাই করে খেত। এসব দেখে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এলাকার যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন। নোয়াপাড়ার বামপন্থী নেতা আনিসুর রহমান যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন। সে সময়ের তরুণ প্রভাষক ইয়াকুব মিয়াও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। চন্দ্রগ্রামের কাশেম আলী ভারতে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরেছেন। তাঁর পরামর্শে নান্দিনার সালাহউদ্দিন কচি, মধ্য ভাগলপুরের আনু, আক্কাস, চন্দ্রগ্রামের রফিকসহ পাঁচ-ছয়জন গোপনে বৈঠক করে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আব্দুল ওয়াদুদ ওই সময় কেবল বিয়ে করেছেন। বিয়ের সাত দিনের মাথায় স্ত্রীকে ফেলে রেখেই ভারতের উদ্দেশে পাড়ি জমান। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী অঞ্চলের প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
স্মৃতি অনেকটা লোপ পেয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে আব্দুল ওয়াদুদ জানান, দেশে ফিরে কয়েকটি অপারেশনে তিনি অংশ নেন। তাঁর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন পিউরীর মুক্তিযোদ্ধা রমিজ মিয়া আর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন ওই গ্রামের শামসু মিয়া। কালিয়াচাপড়া সুগার মিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আছে জেনে ওয়াদুদসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা মিল এলাকায় হানা দেন। টের পেয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা পালিয়ে যায়।
ওই দিন পাকিস্তানি হানাদারদের খোঁজে আরো কয়েকটি গ্রামে তাঁরা অভিযান চালান। পরে সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের হোস্টেলে পালিয়ে থাকা এক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন তাঁরা। ২৭ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা বাজিতপুরকে শত্রুমুক্ত করেন।
আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, 'আমরা রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতি করিও না। শেখের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ডাকেই যুদ্ধে গেছি।'
স্বামী মুক্তিযোদ্ধা- এ নিয়ে গর্বিত স্ত্রী রেহানা বেগম। তবে আশঙ্কাও রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, 'হায়াত-মউত সব আল্লাহর হাতে। ছেরার বাপ মইরা গেলেগা আমরার কী দশা অইব আল্লাঅই জানে। কই যাইয়াম, কী করুম, কেমনে চলুম কইতাম পারি না।'
সহযোদ্ধারাও আব্দুল ওয়াদুদের বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নূরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আব্দুল ওয়াদুদের মতো মুক্তিযোদ্ধা যে কষ্ট করছেন তা বর্ণনাতীত। আমরা তাঁর জন্য কিছু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। নতুন কোনো অনুদান পেলে তাঁর নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'
৬৫ বছর বয়সী আব্দুল ওয়াদুদ ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে বয়সের ভারে আর অসুস্থতায় ভ্যান চালাতে এখন কষ্ট হয় তাঁর। পেটের দায়ে দিনমজুরিও করেন। মাঝেমধ্যে করেন ইট ভাঙার কাজ। ঘরে তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও চার মেয়ে। দুই ছেলেও দিনমজুর। ওদের আলাদা সংসার। নিজেরাই ঠিকমতো খেতে পায় না, মা-বাবাকে কী দেবে! ছোট ছেলে পড়ে স্কুলে। এক মেয়েও স্কুলে যায়। ঠিকমতো খাবারই জোটে না, তার ওপর এদের লেখাপড়ার খরচ- এ যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
২০০৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আব্দুল ওয়াদুদকে প্রথমবারের মতো সংবর্ধনা দেয় স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা 'পরু'। নগদ দেড় হাজার টাকা দিয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের বাজিতপুর শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল সংস্থাটি। ওয়াদুদ জানান, ওই অ্যাকাউন্টে আরো দেড় হাজার টাকা তিনি জমিয়েছিলেন। কিন্তু নিরুপায় হয়ে সব টাকা তুলে নিয়েছেন। তিনি আরো জানান, ভ্যান চালিয়ে, দিনমজুরি করে কটা ভাত হয়তো জোটে, মাছ-তরকারি কেনার সুযোগ থাকে না। তাঁর ভাষ্য, 'খালি ভাত কি আর পেটে যায়?' তিন মাস পরপর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। ওই টাকা চলে যায় চিকিৎসার পেছনে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াদুদ বলেন, 'দ্যাশের লাইগ্যা যুদ্ধে গেছি। কুনু কিছু পাইবার আশা করি নাই। ভাবছি, দ্যাশ স্বাধীন হইলে শান্তি আইব। সবে মিইল্যা সুখে থাকুম। কিয়ের মধ্যে কী!' আব্দুল ওয়াদুদ জানান, হানাদার বাহিনী দেদার লুটপাট করছিল। নিধন করছিল অসহায় নারী-পুরুষদের। বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছিল। নারীদের ওপর চালাচ্ছিল পাশবিক নির্যাতন। যখন খুশি এর খাসি বা ওর গরু জবাই করে খেত। এসব দেখে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এলাকার যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন। নোয়াপাড়ার বামপন্থী নেতা আনিসুর রহমান যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন। সে সময়ের তরুণ প্রভাষক ইয়াকুব মিয়াও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। চন্দ্রগ্রামের কাশেম আলী ভারতে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরেছেন। তাঁর পরামর্শে নান্দিনার সালাহউদ্দিন কচি, মধ্য ভাগলপুরের আনু, আক্কাস, চন্দ্রগ্রামের রফিকসহ পাঁচ-ছয়জন গোপনে বৈঠক করে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আব্দুল ওয়াদুদ ওই সময় কেবল বিয়ে করেছেন। বিয়ের সাত দিনের মাথায় স্ত্রীকে ফেলে রেখেই ভারতের উদ্দেশে পাড়ি জমান। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী অঞ্চলের প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
স্মৃতি অনেকটা লোপ পেয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে আব্দুল ওয়াদুদ জানান, দেশে ফিরে কয়েকটি অপারেশনে তিনি অংশ নেন। তাঁর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন পিউরীর মুক্তিযোদ্ধা রমিজ মিয়া আর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন ওই গ্রামের শামসু মিয়া। কালিয়াচাপড়া সুগার মিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আছে জেনে ওয়াদুদসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা মিল এলাকায় হানা দেন। টের পেয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা পালিয়ে যায়।
ওই দিন পাকিস্তানি হানাদারদের খোঁজে আরো কয়েকটি গ্রামে তাঁরা অভিযান চালান। পরে সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের হোস্টেলে পালিয়ে থাকা এক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন তাঁরা। ২৭ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা বাজিতপুরকে শত্রুমুক্ত করেন।
আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, 'আমরা রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতি করিও না। শেখের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ডাকেই যুদ্ধে গেছি।'
স্বামী মুক্তিযোদ্ধা- এ নিয়ে গর্বিত স্ত্রী রেহানা বেগম। তবে আশঙ্কাও রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, 'হায়াত-মউত সব আল্লাহর হাতে। ছেরার বাপ মইরা গেলেগা আমরার কী দশা অইব আল্লাঅই জানে। কই যাইয়াম, কী করুম, কেমনে চলুম কইতাম পারি না।'
সহযোদ্ধারাও আব্দুল ওয়াদুদের বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নূরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আব্দুল ওয়াদুদের মতো মুক্তিযোদ্ধা যে কষ্ট করছেন তা বর্ণনাতীত। আমরা তাঁর জন্য কিছু করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। নতুন কোনো অনুদান পেলে তাঁর নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'
No comments