সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অপপ্রচার by অনিরুদ্ধ আহমেদ
সম্প্রতি একটি অভিনব ই-মেইল পেলাম, যেখানে সুদানে ইসলামী নেতাদের এক সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বাংলাদেশে ইসলামপন্থি নেতাদের ওপর কথিত নির্যাতন ও অবিচার বন্ধের নাকি দাবি জানানো হয়েছে। পরে ওই একই রকম খবর পড়েছি ঢাকার একটি জামায়াতপন্থি পত্রিকায়ও।
এসব কথিত ইসলামী নেতারা যারা কোনো দিনই বাংলাদেশের দুর্দিনে-দুর্যোগে এগিয়ে আসেননি, পল্গাবনে-ঝঞ্ঝায় মানবিক সাহায্যের হাত যারা কখনোই বাড়িয়ে দেননি, তারা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেন না। যে দেশে ৮৫ শতাংশ মানুষই মুসলমান, যেখানে জুমার নামাজে মানুষের তিলধারণের জায়গা হয় না, সে দেশে জনগণ দ্বারা অবাধ ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার যে ইসলামপন্থি নেতাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে সে কথা যারা বিশ্বাস করে কিংবা এ সম্পর্কে অপপ্রচার চালায় তারা বোকার স্বর্গেই বাস করে বটে। বিস্ময়কর ব্যাপার এও যে কেবল সুদান সম্মেলনে নয়, খোদ বাংলাদেশে বাস করছেন এমন একজন সেদিন উত্তর বাংলার একটি জেলা থেকে জানালেন যে, দাড়ি-টুপিওয়ালাদের প্রতি সরকারের বিশেষ শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে। তার কথার মধ্যে সামান্যতম সত্যতা থাকলে বাংলাদেশের মসজিদগুলো উজাড় হয়ে যেত। কিন্তু এমনটি ঘটা যে কখনোই সম্ভব নয় এবং এই অপপ্রচার যে কেবলই ধর্মপ্রাণ মানুষকে উস্কানি দেওয়ার নামান্তর সে কথা আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। অনেকেই সম্ভবত জানেন না, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মাচারী মুসলমান। কিন্তু তার পিতার মতোই তিনি ধর্মকে রাজনীতির কাজে ব্যবহার করতে রাজি নন এবং বাংলাদেশের জন্মই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপরীতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে। ধর্মের উগ্রতা দিয়ে বাঙালিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তাকে শাসন ও শোষণ করার যে ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি একাত্তর পর্যন্ত, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তার পুনরাবৃত্তি চায় না কখনোই। সবারই জানা কথা যে, ইসলামপন্থি হিসেবে কোনো নেতার ওপরই নির্যাতন চালানো হয়নি, হচ্ছে না।
দুই. যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে যারা এখন বিচারের সম্মুখীন এবং জাতি যখন এই ন্যায়বিচারের মাধ্যমে কলঙ্কমোচনের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে কিছু লোককে বোকা বানানোর যে প্রয়াস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে নেওয়া হচ্ছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই ক্ষতিকর। মুক্তিযুদ্ধের পর এ ধরনের গুজব বারবার রটানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে। গোলাম আযম এবং তার সহচররা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন। বঙ্গবন্ধু কোনো ধর্মের বিরুদ্ধেই যাননি; বারবার বলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়, সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং রাজনীতির বাদ-প্রতিবাদ থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসকে পৃথক করে দেখা। অথচ ইসলামের ধ্বজাধারী একদল রাজনীতিক সেই পাকিস্তান আমল থেকে আজ অবধি বাংলাদেশে ইসলামকে বিপন্ন দেখতে পান।
সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের যে সন্ত্রাস ও সহিংসতা হতচকিত করেছে সবাইকে সেটিও এক অভিনব ঘটনা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হন যারা, বিশ্বে কোথাও তাদের মুক্তির দাবিতে কেউই কস্মিনকালেও কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। কারণ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিশ্বব্যাপী ঘৃণার উদ্রেক করে। এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করাও সমান অপরাধ। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি ঘটনা, ঠিক তেমনটিই হচ্ছে বাংলাদেশে। এক তাণ্ডবলীলা চলছে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম যারা লাঠিসোটা হাতে পুলিশকে প্রহার করছে, কিংবা ছিনিয়ে নিচ্ছে পুলিশের রাইফেল, তাদের কারও বয়স চলি্লশের ঊধর্ে্ব নয়, অর্থাৎ তারা কেউই নিজেরা যুদ্ধাপরাধী নয়, জেলে বন্দিরা তাদের সমবয়সী বন্ধুও নয়। নিতান্তই দলীয় আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে, দলের বোঝা বলে যারা পরিগণিত, সেই বোঝা বহন করতে এরা চাইছে কেন? এদের এই মারমুখী অবস্থার সামনে পুলিশের অসহায়ত্বও দেখার মতো। সুতরাং বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে মৌলবাদী এসব তরুণ কী মহড়া দিচ্ছে নতুন করে আরও আক্রমণ চালানোর? সম্ভবত তাই।
এর কারণ হিসেবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তরুণদের মধ্যে ইসলামী উগ্রপন্থা ও মৌলবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা ধর্মের ধুয়া তুলে যে কোনো অন্যায় কাজকে আপাতদৃষ্টিতে এক ধরনের ন্যায্যতা প্রদানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যে আত্মঘাতী তৎপরতা চালাচ্ছে তাকে ধর্মের লেবাস পরিয়ে যৌক্তিকতা প্রদানের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করানোর যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তার পেছনে এই ধর্মের ভ্রান্ত জিগির তোলা হচ্ছে।
তিন. ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরব ও ইসলামী দেশগুলো ন্যক্কারজনক নীরবতা কিংবা মিনমিনে প্রতিবাদের বিপরীতে বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন হওয়ার যে কাল্পনিক চিত্র নিয়ে তারা প্রতিবাদ করেন, সেটি বোধ করি সংগঠন হিসেবে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদের সহায়তায় কিছু না বুঝে-শুনে তাদের এগিয়ে আসাটা হাস্যকর প্রয়াস কেবল। সে জন্যই যখন শুনি যে জাতিসংঘ ভবনের সামনে জামায়াতিরা জমায়েত হয়ে বাংলাদেশে ইসলামী নেতাদের মুক্তির দাবি করছেন, তখন বিস্মিত বোধ করি এ কথা ভেবে যে, মানুষ হত্যা তো দূরের কথা, যে কোনো প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বিশ্বসভার সোচ্চার হওয়ার কথা, এরই দ্বারপ্রান্তে ঘাতকদের সমর্থনে সমাবেশ হলো। অনুমান করছি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই পূর্ণতা লাভ করবে, ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষিপ্ত কেবল নয়, সংগঠিত হামলা চালানোর চেষ্টা করবে এই মহল।
তবে যতই হাস্যকর প্রয়াস হোক না কেন, এই বিষয়ে সরকারকে অনেক বেশি তৎপর এবং সক্রিয় হতে হবে। কেবল রি-অ্যাক্টিভ হওয়াই যথেষ্ট নয়, এখনই প্রো-অ্যাক্টিভ হওয়ার প্রয়োজন আছে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে দেশকে ১৯৭১ সালের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করবে একদল লোক। সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ-বিভেদের সুযোগে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরাজিত শক্তি। রাষ্ট্রীয় এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সরকারের জন্য দরকারি কাজ হচ্ছে সংযম রক্ষা করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দেওয়া।
চার. তবে এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল বিশেষত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা আরও পরিষ্কার হতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু আদর্শিক দিক দিয়ে তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের পাশে দাঁড়াতেই হবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঐতিহাসিক কিন্তু জেনারেল জিয়া যে কারণে জামায়াতকে কাছে টেনেছিলেন বিএনপির প্রায় প্রতিষ্ঠালগ্নে সেই প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটেছে। দেশে এখন সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে না। আমরা জানি, রাজনৈতিক কারণে যারা এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্তর্ভুক্ত তাদের অনেকেই জামায়াতের কারণেই জোট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এদের অন্যতম হচ্ছেন অলি আহমেদ। আবার ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী এবং এমন অনেকে আরও রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী, কিন্তু জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক নন। জামায়াত যদি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দায় বহন করতে চায়, তাহলে বিএনপির উচিত হবে জামায়াতকে পরিত্যাগ করা। তা না হলে বাংলাদেশে বিএনপি রাজনৈতিক আত্মঘাতী হবে। যুদ্ধাপরাধ সমর্থনের অভিযোগে বিএনপি কি অভিযুক্ত হতে চাইবে না চাইবে সেটা এখনই বিএনপিকে স্থির করতে হবে। যে কোনো অজুহাতে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করলে সেটি বিএনপির রাজনীতির ওপর যে প্রতিকূল ছায়াপাত করবে সেই বিপদ সম্পর্কে এখনই বিএনপিকে সতর্ক হতে হবে। নইলে ইতিহাস বিএনপিকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন বিএনপির জন্য হবে এক আত্মঘাতী, যেমনটি হয়েছিল তারেক রহমানের অর্বাচীন উচ্চারণে যে বিএনপি এবং জামায়াত একই ঘরের অধিবাসী।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
দুই. যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে যারা এখন বিচারের সম্মুখীন এবং জাতি যখন এই ন্যায়বিচারের মাধ্যমে কলঙ্কমোচনের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে কিছু লোককে বোকা বানানোর যে প্রয়াস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে নেওয়া হচ্ছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য খুবই ক্ষতিকর। মুক্তিযুদ্ধের পর এ ধরনের গুজব বারবার রটানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে। গোলাম আযম এবং তার সহচররা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন। বঙ্গবন্ধু কোনো ধর্মের বিরুদ্ধেই যাননি; বারবার বলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়, সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং রাজনীতির বাদ-প্রতিবাদ থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসকে পৃথক করে দেখা। অথচ ইসলামের ধ্বজাধারী একদল রাজনীতিক সেই পাকিস্তান আমল থেকে আজ অবধি বাংলাদেশে ইসলামকে বিপন্ন দেখতে পান।
সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের যে সন্ত্রাস ও সহিংসতা হতচকিত করেছে সবাইকে সেটিও এক অভিনব ঘটনা। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হন যারা, বিশ্বে কোথাও তাদের মুক্তির দাবিতে কেউই কস্মিনকালেও কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। কারণ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিশ্বব্যাপী ঘৃণার উদ্রেক করে। এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করাও সমান অপরাধ। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি ঘটনা, ঠিক তেমনটিই হচ্ছে বাংলাদেশে। এক তাণ্ডবলীলা চলছে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম যারা লাঠিসোটা হাতে পুলিশকে প্রহার করছে, কিংবা ছিনিয়ে নিচ্ছে পুলিশের রাইফেল, তাদের কারও বয়স চলি্লশের ঊধর্ে্ব নয়, অর্থাৎ তারা কেউই নিজেরা যুদ্ধাপরাধী নয়, জেলে বন্দিরা তাদের সমবয়সী বন্ধুও নয়। নিতান্তই দলীয় আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে, দলের বোঝা বলে যারা পরিগণিত, সেই বোঝা বহন করতে এরা চাইছে কেন? এদের এই মারমুখী অবস্থার সামনে পুলিশের অসহায়ত্বও দেখার মতো। সুতরাং বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে মৌলবাদী এসব তরুণ কী মহড়া দিচ্ছে নতুন করে আরও আক্রমণ চালানোর? সম্ভবত তাই।
এর কারণ হিসেবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তরুণদের মধ্যে ইসলামী উগ্রপন্থা ও মৌলবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা ধর্মের ধুয়া তুলে যে কোনো অন্যায় কাজকে আপাতদৃষ্টিতে এক ধরনের ন্যায্যতা প্রদানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যে আত্মঘাতী তৎপরতা চালাচ্ছে তাকে ধর্মের লেবাস পরিয়ে যৌক্তিকতা প্রদানের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করানোর যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তার পেছনে এই ধর্মের ভ্রান্ত জিগির তোলা হচ্ছে।
তিন. ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরব ও ইসলামী দেশগুলো ন্যক্কারজনক নীরবতা কিংবা মিনমিনে প্রতিবাদের বিপরীতে বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন হওয়ার যে কাল্পনিক চিত্র নিয়ে তারা প্রতিবাদ করেন, সেটি বোধ করি সংগঠন হিসেবে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদের সহায়তায় কিছু না বুঝে-শুনে তাদের এগিয়ে আসাটা হাস্যকর প্রয়াস কেবল। সে জন্যই যখন শুনি যে জাতিসংঘ ভবনের সামনে জামায়াতিরা জমায়েত হয়ে বাংলাদেশে ইসলামী নেতাদের মুক্তির দাবি করছেন, তখন বিস্মিত বোধ করি এ কথা ভেবে যে, মানুষ হত্যা তো দূরের কথা, যে কোনো প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বিশ্বসভার সোচ্চার হওয়ার কথা, এরই দ্বারপ্রান্তে ঘাতকদের সমর্থনে সমাবেশ হলো। অনুমান করছি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই পূর্ণতা লাভ করবে, ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষিপ্ত কেবল নয়, সংগঠিত হামলা চালানোর চেষ্টা করবে এই মহল।
তবে যতই হাস্যকর প্রয়াস হোক না কেন, এই বিষয়ে সরকারকে অনেক বেশি তৎপর এবং সক্রিয় হতে হবে। কেবল রি-অ্যাক্টিভ হওয়াই যথেষ্ট নয়, এখনই প্রো-অ্যাক্টিভ হওয়ার প্রয়োজন আছে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে দেশকে ১৯৭১ সালের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করবে একদল লোক। সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদ-বিভেদের সুযোগে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরাজিত শক্তি। রাষ্ট্রীয় এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সরকারের জন্য দরকারি কাজ হচ্ছে সংযম রক্ষা করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দেওয়া।
চার. তবে এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল বিশেষত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা আরও পরিষ্কার হতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু আদর্শিক দিক দিয়ে তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের পাশে দাঁড়াতেই হবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঐতিহাসিক কিন্তু জেনারেল জিয়া যে কারণে জামায়াতকে কাছে টেনেছিলেন বিএনপির প্রায় প্রতিষ্ঠালগ্নে সেই প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটেছে। দেশে এখন সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে না। আমরা জানি, রাজনৈতিক কারণে যারা এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্তর্ভুক্ত তাদের অনেকেই জামায়াতের কারণেই জোট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এদের অন্যতম হচ্ছেন অলি আহমেদ। আবার ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী এবং এমন অনেকে আরও রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী, কিন্তু জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক নন। জামায়াত যদি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দায় বহন করতে চায়, তাহলে বিএনপির উচিত হবে জামায়াতকে পরিত্যাগ করা। তা না হলে বাংলাদেশে বিএনপি রাজনৈতিক আত্মঘাতী হবে। যুদ্ধাপরাধ সমর্থনের অভিযোগে বিএনপি কি অভিযুক্ত হতে চাইবে না চাইবে সেটা এখনই বিএনপিকে স্থির করতে হবে। যে কোনো অজুহাতে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করলে সেটি বিএনপির রাজনীতির ওপর যে প্রতিকূল ছায়াপাত করবে সেই বিপদ সম্পর্কে এখনই বিএনপিকে সতর্ক হতে হবে। নইলে ইতিহাস বিএনপিকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন বিএনপির জন্য হবে এক আত্মঘাতী, যেমনটি হয়েছিল তারেক রহমানের অর্বাচীন উচ্চারণে যে বিএনপি এবং জামায়াত একই ঘরের অধিবাসী।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
No comments