চারদিক- নিরঞ্জনের নাও by মৃত্যুঞ্জয় রায়
ঘাটে অনেকগুলো নৌকা বাঁধা। নৌকাগুলো যেমন অন্য রকম, নদীটাও অন্য রকম। এ নৌকার নাম প্যাসেঞ্জারি নাও। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নামে সবাই এ নৌকা চেনে। আর নদীর নাম সাঙ্গু। দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে নদীটি বয়ে চলেছে। নদীর দুই পাড়ে বিস্তীর্ণ বালুর চর।
তীর ধরে পাহাড়ের ঢালে যত দূর চোখ যায়, কেবল তামাকের খেত। মাঝির নাম নিরঞ্জন। নিরঞ্জন জলদাস। আমরা চারজন খুব সকালেই বান্দরবান থেকে এই ঘাটে এসে পৌঁছেছি। যাব রুমা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে। এই নদীতে নৌকা করেই এ ঘাট থেকে যেতে হবে রুমা বাজার ঘাটে।
ডাচ নাগরিক হেইন, তাঁর থাই স্ত্রী মিস নক, ইউএনডিপির রঞ্জন আর আমি। এই চারজন চড়ে বসলাম নিরঞ্জনের নাওয়ে। একটা বাঁশের লগি ঠেলে নিরঞ্জন মাঝি নাও ছেড়ে দিলেন রুমা বাজারের উদ্দেশে। নতুন জায়গা, সঙ্গে বিদেশি। তাই জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ প্রহরী দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নৌকার পেছনে পেছনে এগিয়ে আসছেন। আকাশ দেখছি। আকাশে সামরিক কপ্টার। নিরঞ্জন মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী?’
নিরঞ্জন মাঝিও তাঁর দৃষ্টি ওপরে তুলে দেখলেন হেলিকপ্টারটিকে। পাহাড়ের খুব বেশি ওপর দিয়ে যাচ্ছে না। বললেন, ‘পাহাড়ে মিলিটারি ক্যাম্পে রসদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। মনে হয় থানচি বা আরও দুর্গম কোনো ক্যাম্পে যাবে। আগের দিন হলে নাহয় ঘোড়া-গাধা বা খচ্চরের পিঠে করে এসব রসদ নিয়ে যাওয়া হতো। এখন আর তা সম্ভব না।’ ঘড়ঘড় শব্দ করে একেবারে মাথার ওপর দিয়ে কপ্টারটি উড়ে চলে গেল।
নিচে স্বচ্ছসলিলা সাঙ্গু, ওপরে স্বচ্ছ নীলাকাশ। জলের ভেতর দিয়ে নদীর পাথুরে তলাটা দেখা যায়। নদীর মধ্যে মাঝে মাঝে কোথাও পাথর উঁচিয়ে আছে। নদীর দুই পাড়ে উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। নানা রকম বুনো গাছে ঢেকে আছে পাহাড়ের গা। কোনো কোনো গাছে অজস্র বুনো ফুল ফুটেছে। তিরতির করে বয়ে চলেছে নিরঞ্জনের নাও। আমরা সবাই বান্দরবানের কুমারী নিসর্গ উপভোগ করতে করতে চলেছি রুমা বাজারের দিকে।
চলতে চলতে কথায় কথায় এরই মধ্যে ভাব হয়ে গেছে নিরঞ্জনের সঙ্গে। মাঝবয়সী লোক, বেশ লম্বা। জানতে চাইলেন, আমরা আজই আবার রুমা থেকে ফিরব কি না?
জবাবে না বলে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনার নামের সঙ্গে জলদাস পদবি কেন? এই নামে বান্দরবানে তো কোনো উপজাতি নেই। আপনারা তাহলে কী?’
‘না, আমরা তো উপজাতি না, বাঙালি। জাতে কৈবর্ত্য। কৈবর্ত্য বোঝেন?’
‘হুঁ, জেলে। তার মানে আপনার পেশা মাছ ধরা?’
‘বলতে পারেন। সাঙ্গু এই শীতের সময় শুকনা। তবে কোথাও কোথাও কিছুটা গভীর। সেখানে যেটুকু জল আছে, তার ভেতর মাছ এসে জমে। আমরা সাঙ্গু নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করি। বর্ষা এলেই জলে ভরে ফুলে ওঠে। স্রোতও অনেক বেশি হয়। তখন মাছ ধরা কঠিন। তবে এখন বান্দরবানে অনেকে বেড়াতে আসে, রুমা বাজার হয়ে বগা লেক বেড়াতে যায়। সেসব লোককে আমরা পারাপার করে বেশ ভালোই আয় করি। জনপ্রতি ভাড়া নিই মাত্র ২০ টাকা। বগা লেকে গেছেন কখনো? না গেলে উনাদের অবশ্যই সেখানে নিয়ে যাবেন। ভারি সুন্দর সে জায়গা।’
‘তাই নাকি? কীভাবে যাব?’
‘চান্দের গাড়িতে।’
‘সে আবার কী?’
‘জিপ গাড়ি। কদিন ওই গাড়িতে হেলপারিও করছি। বাড়ি থেকে প্রথম বান্দরবানে আসি সাঙ্গুতে মাছ ধরতে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে ওই কাজ করতাম। এখন নাও বাই।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘আসল বাড়ি চিটাগাংয়ের কেরানীহাট। এখানে এসেছি ২৮-২৯ বছর হলো। সাঙ্গুর ওপর ব্রিজ হচ্ছে। ওটা হলে হয়তো এই প্যাসেঞ্জারি নাওটা বেচতে হবে।’
নিরঞ্জনের কথার মাঝে মনে হলো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললেন, ‘উপজাতিরা কেউ সাধারণত এই নাওয়ে চড়ে না। ওরা এই ঘাট থেকে নদীর পাড় ধরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হেঁটে যায়। খুব হাঁটতে পারে ওরা।’
‘তাই নাকি?’
‘দেখতেই তো পারছেন।’ সত্যিই আদিবাসী অনেক মেয়ে ও পুরুষ পিঠে অনেক বোঝা নিয়েও কেমন তামাক, চীনাবাদাম আর মিষ্টি আলুর খেতের আল ধরে দিব্যি হেঁটে চলেছে। রুমা বাজারের আজ হাট। সেই হাটে যাচ্ছে বেচাকেনা করতে। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল, নদীর বাঁক ঘুরতেই দূরে দৃষ্টিতে পড়ল রুমা বাজার ঘাটকে। নদীর মধ্যে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি আর বাঁশের ভেলা তৈরি করে সেগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন লোক। নদীর কোথাও কোaথাও হাঁটুজল।
নিরঞ্জনের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেরিয়ে এল বান্দরবানের প্রত্যন্ত উপজেলায় তাদের স্থানান্তরের নানা কাহিনি। নিরঞ্জন বলে যেতে লাগলেন, তাঁরা যে সময় এখানে এসেছেন, সে সময় বাঙালি পরিবারের বসবাস ছিল খুবই কম। এখন সে সময়ের তুলনায় বাঙালি বেড়ে গেছে ৮ থেকে ১০ গুণ। পাশাপাশি তারা বসবাস করছে, তেমন অশান্তিও নেই। চটিগাই বড়ুয়াদের সংখ্যা মনে হয় বেশি। বাঙালিরা মূলত রুমা বাজার এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্যই বসত গেড়েছে। এখন অনেকেই কৃষিকাজ ও মাছ ধরার কাজ করছে, বন থেকে কাঠ কাটার কাজও করছে। উপজাতিরা দা-ছুরি বানাতে পারে না। তাই রুমা বাজারে কামারের দোকানও বসিয়েছে বাঙালিরা। কথা সব ফুরানোর আগেই রঞ্জন নিরঞ্জনকে ইশারা করল নাও ভেড়াতে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়a
ডাচ নাগরিক হেইন, তাঁর থাই স্ত্রী মিস নক, ইউএনডিপির রঞ্জন আর আমি। এই চারজন চড়ে বসলাম নিরঞ্জনের নাওয়ে। একটা বাঁশের লগি ঠেলে নিরঞ্জন মাঝি নাও ছেড়ে দিলেন রুমা বাজারের উদ্দেশে। নতুন জায়গা, সঙ্গে বিদেশি। তাই জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ প্রহরী দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নৌকার পেছনে পেছনে এগিয়ে আসছেন। আকাশ দেখছি। আকাশে সামরিক কপ্টার। নিরঞ্জন মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী?’
নিরঞ্জন মাঝিও তাঁর দৃষ্টি ওপরে তুলে দেখলেন হেলিকপ্টারটিকে। পাহাড়ের খুব বেশি ওপর দিয়ে যাচ্ছে না। বললেন, ‘পাহাড়ে মিলিটারি ক্যাম্পে রসদ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। মনে হয় থানচি বা আরও দুর্গম কোনো ক্যাম্পে যাবে। আগের দিন হলে নাহয় ঘোড়া-গাধা বা খচ্চরের পিঠে করে এসব রসদ নিয়ে যাওয়া হতো। এখন আর তা সম্ভব না।’ ঘড়ঘড় শব্দ করে একেবারে মাথার ওপর দিয়ে কপ্টারটি উড়ে চলে গেল।
নিচে স্বচ্ছসলিলা সাঙ্গু, ওপরে স্বচ্ছ নীলাকাশ। জলের ভেতর দিয়ে নদীর পাথুরে তলাটা দেখা যায়। নদীর মধ্যে মাঝে মাঝে কোথাও পাথর উঁচিয়ে আছে। নদীর দুই পাড়ে উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। নানা রকম বুনো গাছে ঢেকে আছে পাহাড়ের গা। কোনো কোনো গাছে অজস্র বুনো ফুল ফুটেছে। তিরতির করে বয়ে চলেছে নিরঞ্জনের নাও। আমরা সবাই বান্দরবানের কুমারী নিসর্গ উপভোগ করতে করতে চলেছি রুমা বাজারের দিকে।
চলতে চলতে কথায় কথায় এরই মধ্যে ভাব হয়ে গেছে নিরঞ্জনের সঙ্গে। মাঝবয়সী লোক, বেশ লম্বা। জানতে চাইলেন, আমরা আজই আবার রুমা থেকে ফিরব কি না?
জবাবে না বলে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, আপনার নামের সঙ্গে জলদাস পদবি কেন? এই নামে বান্দরবানে তো কোনো উপজাতি নেই। আপনারা তাহলে কী?’
‘না, আমরা তো উপজাতি না, বাঙালি। জাতে কৈবর্ত্য। কৈবর্ত্য বোঝেন?’
‘হুঁ, জেলে। তার মানে আপনার পেশা মাছ ধরা?’
‘বলতে পারেন। সাঙ্গু এই শীতের সময় শুকনা। তবে কোথাও কোথাও কিছুটা গভীর। সেখানে যেটুকু জল আছে, তার ভেতর মাছ এসে জমে। আমরা সাঙ্গু নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করি। বর্ষা এলেই জলে ভরে ফুলে ওঠে। স্রোতও অনেক বেশি হয়। তখন মাছ ধরা কঠিন। তবে এখন বান্দরবানে অনেকে বেড়াতে আসে, রুমা বাজার হয়ে বগা লেক বেড়াতে যায়। সেসব লোককে আমরা পারাপার করে বেশ ভালোই আয় করি। জনপ্রতি ভাড়া নিই মাত্র ২০ টাকা। বগা লেকে গেছেন কখনো? না গেলে উনাদের অবশ্যই সেখানে নিয়ে যাবেন। ভারি সুন্দর সে জায়গা।’
‘তাই নাকি? কীভাবে যাব?’
‘চান্দের গাড়িতে।’
‘সে আবার কী?’
‘জিপ গাড়ি। কদিন ওই গাড়িতে হেলপারিও করছি। বাড়ি থেকে প্রথম বান্দরবানে আসি সাঙ্গুতে মাছ ধরতে। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে ওই কাজ করতাম। এখন নাও বাই।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘আসল বাড়ি চিটাগাংয়ের কেরানীহাট। এখানে এসেছি ২৮-২৯ বছর হলো। সাঙ্গুর ওপর ব্রিজ হচ্ছে। ওটা হলে হয়তো এই প্যাসেঞ্জারি নাওটা বেচতে হবে।’
নিরঞ্জনের কথার মাঝে মনে হলো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললেন, ‘উপজাতিরা কেউ সাধারণত এই নাওয়ে চড়ে না। ওরা এই ঘাট থেকে নদীর পাড় ধরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হেঁটে যায়। খুব হাঁটতে পারে ওরা।’
‘তাই নাকি?’
‘দেখতেই তো পারছেন।’ সত্যিই আদিবাসী অনেক মেয়ে ও পুরুষ পিঠে অনেক বোঝা নিয়েও কেমন তামাক, চীনাবাদাম আর মিষ্টি আলুর খেতের আল ধরে দিব্যি হেঁটে চলেছে। রুমা বাজারের আজ হাট। সেই হাটে যাচ্ছে বেচাকেনা করতে। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল, নদীর বাঁক ঘুরতেই দূরে দৃষ্টিতে পড়ল রুমা বাজার ঘাটকে। নদীর মধ্যে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি আর বাঁশের ভেলা তৈরি করে সেগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন লোক। নদীর কোথাও কোaথাও হাঁটুজল।
নিরঞ্জনের সঙ্গে গল্প করতে করতে বেরিয়ে এল বান্দরবানের প্রত্যন্ত উপজেলায় তাদের স্থানান্তরের নানা কাহিনি। নিরঞ্জন বলে যেতে লাগলেন, তাঁরা যে সময় এখানে এসেছেন, সে সময় বাঙালি পরিবারের বসবাস ছিল খুবই কম। এখন সে সময়ের তুলনায় বাঙালি বেড়ে গেছে ৮ থেকে ১০ গুণ। পাশাপাশি তারা বসবাস করছে, তেমন অশান্তিও নেই। চটিগাই বড়ুয়াদের সংখ্যা মনে হয় বেশি। বাঙালিরা মূলত রুমা বাজার এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্যই বসত গেড়েছে। এখন অনেকেই কৃষিকাজ ও মাছ ধরার কাজ করছে, বন থেকে কাঠ কাটার কাজও করছে। উপজাতিরা দা-ছুরি বানাতে পারে না। তাই রুমা বাজারে কামারের দোকানও বসিয়েছে বাঙালিরা। কথা সব ফুরানোর আগেই রঞ্জন নিরঞ্জনকে ইশারা করল নাও ভেড়াতে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়a
No comments