বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৮৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম বিক্রমী মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২১-২৩ মার্চ তিনি ঝিনাইদহে কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীর (বেসামরিক কর্মকর্তা) সঙ্গে মিলিত হন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন যদি সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত হয় তবে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
২৫ মার্চ রাতেই তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জনগণের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তিনি দুটি চিঠি লিখে পাঠান ভারতে। একটি মেহেরপুর সীমান্তসংলগ্ন নদীয়া জেলার ডিসিকে। এর অনুলিপি দেন বিএসএফের স্থানীয় অধিনায়ককে (সিও)। দ্বিতীয় চিঠি ভারতের জনগণকে উদ্দেশ করে। দুটি চিঠিতেই ছিল তাঁর স্বাক্ষর ও সরকারি সিলমোহর। দ্বিতীয় চিঠিটি ২৭ মার্চ অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর চিঠি পেয়ে নদীয়া জেলার ডিসি ও বিএসএফের অধিনায়ক (কর্নেল চক্রবর্তী) সাড়া দেন। তাঁদের আমন্ত্রণে ২৯ মার্চ তিনি ভারতের বেতাই বিওপিতে যান। তাঁরা বাংলাদেশের দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বিএসএফের একটি ছোট দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এর পর তাঁরা আলোচনা করেন।
পরদিন ৩০ মার্চ তিনি চুয়াডাঙ্গা যান। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁদের তিনি ও ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) মাহবুবউদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রতিরোধযুদ্ধকালে সক্রিয় যুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ৩০ মার্চ মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সার্বিক নেতৃত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধারা কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে (তখন বৈদ্যনাথতলা) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিরাপদ বেসামরিক দায়িত্বের বদলে সশস্ত্র যুদ্ধেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই সাংগঠনিক রূপ পায়। এ সময় সেক্টর গঠিত হয়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি বেনাপোল সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বেনাপোল সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল বেনাপোল ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে যশোর জেলার কেশবপুর পর্যন্ত। এর উত্তরে ছিল ঝিকরগাছা এবং দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ইনফ্রেন্টি ব্রিগেডের ২২ এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) এই এলাকায় প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। এই এলাকায় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় বেনাপোল সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে পুটখালীর যুদ্ধ অন্যতম।
(১২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের কাঁঠালবাগান ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের ভেতরে এসে পুটখালীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। তখন তুমুল যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত পুটখালীর যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬৪।
তৌফিক-ই-ইলাহী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম শাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী, মা সুফিয়া চৌধুরী। স্ত্রী আসমা চৌধুরী। তাঁদের দুই মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
২৫ মার্চ রাতেই তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জনগণের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৬ মার্চ তিনি দুটি চিঠি লিখে পাঠান ভারতে। একটি মেহেরপুর সীমান্তসংলগ্ন নদীয়া জেলার ডিসিকে। এর অনুলিপি দেন বিএসএফের স্থানীয় অধিনায়ককে (সিও)। দ্বিতীয় চিঠি ভারতের জনগণকে উদ্দেশ করে। দুটি চিঠিতেই ছিল তাঁর স্বাক্ষর ও সরকারি সিলমোহর। দ্বিতীয় চিঠিটি ২৭ মার্চ অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর চিঠি পেয়ে নদীয়া জেলার ডিসি ও বিএসএফের অধিনায়ক (কর্নেল চক্রবর্তী) সাড়া দেন। তাঁদের আমন্ত্রণে ২৯ মার্চ তিনি ভারতের বেতাই বিওপিতে যান। তাঁরা বাংলাদেশের দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বিএসএফের একটি ছোট দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এর পর তাঁরা আলোচনা করেন।
পরদিন ৩০ মার্চ তিনি চুয়াডাঙ্গা যান। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইংয়ের বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহের খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁদের তিনি ও ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) মাহবুবউদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চ্যাংখালী চেকপোস্টে নিয়ে যান।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রতিরোধযুদ্ধকালে সক্রিয় যুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ৩০ মার্চ মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সার্বিক নেতৃত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধারা কুষ্টিয়া আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে (তখন বৈদ্যনাথতলা) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিরাপদ বেসামরিক দায়িত্বের বদলে সশস্ত্র যুদ্ধেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তাঁকে মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই সাংগঠনিক রূপ পায়। এ সময় সেক্টর গঠিত হয়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি বেনাপোল সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বেনাপোল সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল বেনাপোল ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে যশোর জেলার কেশবপুর পর্যন্ত। এর উত্তরে ছিল ঝিকরগাছা এবং দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ইনফ্রেন্টি ব্রিগেডের ২২ এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) এই এলাকায় প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। এই এলাকায় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচালনায় বেনাপোল সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য অপারেশন করেন। তাঁর সার্বিক নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে পুটখালীর যুদ্ধ অন্যতম।
(১২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের কাঁঠালবাগান ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের ভেতরে এসে পুটখালীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। তখন তুমুল যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত পুটখালীর যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬৪।
তৌফিক-ই-ইলাহী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম শাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী, মা সুফিয়া চৌধুরী। স্ত্রী আসমা চৌধুরী। তাঁদের দুই মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments