আবার সোনালি আলো! by সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী ও মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাটের হালকা আঁশ; যা পাটকাঠির ডগায় বা গোড়ায় লেগে থাকে সেটাকে আঞ্চলিক ভাষায় ফেত্তুয়া বলে। ফেত্তুয়াকে মূল আঁশের উচ্ছিষ্ট বলা যেতে পারে, যা সাধারণত কৃষকরা কাজে লাগাতে পারেন না।
এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ২৬ বছর আগে সেই ফেত্তুয়ার কেজি ছিল চার কিংবা পাঁচ টাকা। দেখতাম ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে গ্রামের দোকান থেকে মুড়ির মোয়া কেনার জন্য পাটকাঠি থেকে ফেত্তুয়া সংগ্রহ করত। কিন্তু বহমান এই বৈরী সময়ে ফেত্তুয়া তো দূরের কথা, পাটের মূল আঁশের অবস্থাই অনেকটা শোচনীয়। পাটকেন্দ্রিক একটি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবাদে এবং সাম্প্রতিক একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল কর্তৃক আয়োজিত 'পাট ও পাটজাত দ্রব্যের সংকট ও সম্ভাবনা' শীর্ষক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার প্রাক্কালে অধ্যয়ন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৯.৯ শতাংশ (৩১৩.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছিল শুধু পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে আয়। ১৯৮১ সালে ছিল মোট রপ্তানি আয়ের ৬৮.৬ শতাংশ। কিন্তু ১৯৯১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মোট রপ্তানি আয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ। ১০ বছরের এই ব্যবধানে পাটের এই অপ্রত্যাশিত নিম্নগামী সূচকের জন্য মূলত দায়ী ১৯৮১ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে পাটের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক ফাইবারের আবির্ভাব। যেখানে ২০০১ সালে ছিল মোট রপ্তানি আয়ের ৪.৬ শতাংশ, কিন্তু ২০০৯ সালে এর সর্বনিম্ন অবস্থান দাঁড়ায় ২.৭ শতাংশ। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের এই অপার সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসলের শোচনীয়তার গাঢ় রহস্য কী শুধুই সিনথেটিক ফাইবার; নাকি অন্য কিছু? বিষয়টি নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে বৈকি।
তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল ৪.৫ শতাংশ; যা ২০০৯ সালের চেয়ে ১.৮ শতাংশ বেশি। ধারণা করা হয়, সরকার পাট ব্যবসায়ীদের সময়মতো অর্থায়ন করার কারণে ওই বছরই পাটের রপ্তানি আয় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমরা জানি, ১৯৯০ সালে সিনথেটিক ফাইবার ব্যাপক আকারে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করায় একচেটিয়া আধিপত্যে থাকা সোনালি আঁশের সোনালি কদর ক্রমেই কমতে থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাট উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং বিশ্বের অপরাপর রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বো একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু বিশ্বের বেশ কিছু দেশ উৎপাদন ও বিশ্ব বিপণনে বিগত বছরগুলোতে দক্ষ কৌশলী অবস্থান নেওয়ায় সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে না। যে কারণে বাংলাদেশ ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে উৎকৃষ্ট মানের পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে থাকলেও বর্তমানে তৃতীয় এবং ভারত দখল করে আছে প্রথম স্থান। ট্রেড ম্যাপ ডেটাবেইসের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে বিশ্বে মোট কাঁচা পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ৮৭.৪ শতাংশ ও ভারতের ২.১ শতাংশ এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ১০.৭ শতাংশ ও ভারতের ১৩.৪ শতাংশ। কিন্তু ২০০৯ সালে এসে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে মোট কাঁচা পাট রপ্তানির ৮৫.৭ শতাংশ দখল করতে পেরেছে এবং পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে পেরেছে মাত্র ৬.০ শতাংশ; যেখানে ভারতের অংশগ্রহণ ছিল পর্যায়ক্রমে ৩.৬ শতাংশ ও ৮.৫ শতাংশ। মজার বিষয় হচ্ছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ যেখানে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে মোট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ২৮৩.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ভারত বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট আমদানি করে এবং সেই কাঁচা পাট থেকে পাটজাত দ্রব্য তৈরি করে বিশ্ববাজার থেকে মোট আয় করে ৩৯৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অতিরিক্ত আয় বাংলাদেশের কাঁচা পাট থেকে ভারত করতে পারলে আমরা পারছি না কেন? আরো অবাক করা বিষয় হলো, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীন বিশ্ববাজারে কোনো ধরনের কাঁচা পাট রপ্তানি না করেও শুধু পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে ২৭২৯.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু কোনো নির্দিষ্ট বছরের চিত্র নয়, এ রকম চিত্র বিগত প্রায় সব বছরের। এখানে সহজে অনুমেয় যে কাঁচা পাট রপ্তানির চেয়ে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে তুলনামূলকভাবে ভারত এবং চীন বাংলাদেশ থেকে অধিকতর লাভবান হচ্ছে। কিন্তু অতীব অনুতাপের বিষয়, বাংলাদেশ সোনালি আঁশের মাধ্যমে সেই সোনালি অর্থ উপার্জন করতে পারছে না। তথ্যমতে, বিশ্বেবাজারে ওভেন ফ্রেবিক্স ও কার্পেট রপ্তানিতে চীন, পাট ফ্রেবিকসে ভারত এবং চট ও ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রথম স্থান দখল করে আছে। পাটজাতীয় অপরাপর পণ্যে বাংলাদেশ না পারার মূলত কারণ দুটি- ১. পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের অভাব, ২. আধুনিক বিপণন নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক ট্রেড প্র্যাকটিস সম্পর্কে অবগত না থাকা। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের বাজার দখল করতে না পারার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো- পাট-ধান দাম অনুপাত কম। এ কারণে কৃষকরা নিরুৎসাহী হয়ে তুলনামূলকভাবে অনুর্বর জমিতে পাট চাষ করে, যে কারণে জমিতে পাটের উৎপাদনশীলতা কম হয় এবং এর ফলস্বরূপ কৃষকের মুনাফা কম হয়। বিজ্ঞরা পাটের এ রকম অবস্থাকে 'পাট পাপ চক্র' (Jute Vicious Cycles) বলে অভিহিত করেছেন। তা ছাড়া বিপণন কৌশল হিসেবে সম্মিলিতভাবে বিশ্বব্যাপী পাটজাত পণ্য 'পরিবেশবান্ধব' পণ্য এ স্লোগানটিকে শক্তিশালী প্রসার ক্যাম্পেইন করতে না পারা, ব্যবহারকারীদের ব্যবহারগত কারিগরি সহযোগিতার অভাব, পণ্য উন্নয়ন ও অভিযোজনে বাস্তবভিত্তিক গবেষণা না করা এবং সম্ভাব্য নতুন বাজার অনুসন্ধান না করাকে দায়ী করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাতীয় দ্রব্যের বাজার হারানোর জন্য পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে দক্ষতার অভাবকে বেশি দায়ী করছেন। জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য 'রপ্তানি ঝুড়িতে' আছে মাত্র আট প্রকারের পণ্য; যা বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশের পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্য সমাবেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান সত্যিই হাস্যকর।
তবে আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বে ক্রমাগত প্রাকৃতিক বির্পযয়, স্বাস্থ্যগত হুমকি ও জনসাধারণের মধ্যে পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে পরিবেশবাদী আন্দোলন জোরদার হওয়ার কারণে সিনথেটিক ফাইবারের প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে 'সবুজ অর্থনীতির' নতুন ধারণা এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আরো বেশি বেগবান করছে। ইতিমধ্যে সান ফ্রানসিস্কোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানকার জনসাধারণ পলিথিনের পরিবর্তে পাটের তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহরগুলো এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তারাও বিষয়টি নিয়ে জোরালোভাবে চিন্তা করছে। এই সম্ভাবনা বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বাজার যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, থাইল্যান্ড ও ঘানায় বিকশিত হবে এবং আরো কিছু নতুন বাজার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশি পাটের পুরনো ঐতিহ্য পুনরুত্থানের জন্য আরো বিষয় যেমন ঋণ বিতরণ নীতিমালা, কৃষক প্রণোদনা, পাটকেন্দ্রিক দক্ষতার আধুনিকায়ন, নতুন বিপণন কৌশল নির্ধারণ, পাটকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিশ্বে অপরাপর দেশে ট্যারিফ সুবিধা গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়া এবং সর্বোপরি পাটকেন্দ্রিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পাটের জিনগত আবিষ্কারকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানো। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অচিরেই বিশ্বব্যাপী আবার সোনালি আঁশের সোনালি আলো ঠিকরে পড়বে এবং সীমিত হয়ে আসবে সিনথেটিক ফাইবারের বহুরূপী ব্যবহার। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই এ উদ্যোগ আজ খুব বেশি প্রয়োজন।
লেখকদ্বয় : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, পারি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট
তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল ৪.৫ শতাংশ; যা ২০০৯ সালের চেয়ে ১.৮ শতাংশ বেশি। ধারণা করা হয়, সরকার পাট ব্যবসায়ীদের সময়মতো অর্থায়ন করার কারণে ওই বছরই পাটের রপ্তানি আয় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমরা জানি, ১৯৯০ সালে সিনথেটিক ফাইবার ব্যাপক আকারে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করায় একচেটিয়া আধিপত্যে থাকা সোনালি আঁশের সোনালি কদর ক্রমেই কমতে থাকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাট উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং বিশ্বের অপরাপর রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বো একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু বিশ্বের বেশ কিছু দেশ উৎপাদন ও বিশ্ব বিপণনে বিগত বছরগুলোতে দক্ষ কৌশলী অবস্থান নেওয়ায় সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে না। যে কারণে বাংলাদেশ ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে উৎকৃষ্ট মানের পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে থাকলেও বর্তমানে তৃতীয় এবং ভারত দখল করে আছে প্রথম স্থান। ট্রেড ম্যাপ ডেটাবেইসের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে বিশ্বে মোট কাঁচা পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ৮৭.৪ শতাংশ ও ভারতের ২.১ শতাংশ এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ১০.৭ শতাংশ ও ভারতের ১৩.৪ শতাংশ। কিন্তু ২০০৯ সালে এসে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে মোট কাঁচা পাট রপ্তানির ৮৫.৭ শতাংশ দখল করতে পেরেছে এবং পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে পেরেছে মাত্র ৬.০ শতাংশ; যেখানে ভারতের অংশগ্রহণ ছিল পর্যায়ক্রমে ৩.৬ শতাংশ ও ৮.৫ শতাংশ। মজার বিষয় হচ্ছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ যেখানে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে মোট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ২৮৩.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ভারত বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট আমদানি করে এবং সেই কাঁচা পাট থেকে পাটজাত দ্রব্য তৈরি করে বিশ্ববাজার থেকে মোট আয় করে ৩৯৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অতিরিক্ত আয় বাংলাদেশের কাঁচা পাট থেকে ভারত করতে পারলে আমরা পারছি না কেন? আরো অবাক করা বিষয় হলো, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীন বিশ্ববাজারে কোনো ধরনের কাঁচা পাট রপ্তানি না করেও শুধু পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে ২৭২৯.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু কোনো নির্দিষ্ট বছরের চিত্র নয়, এ রকম চিত্র বিগত প্রায় সব বছরের। এখানে সহজে অনুমেয় যে কাঁচা পাট রপ্তানির চেয়ে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে তুলনামূলকভাবে ভারত এবং চীন বাংলাদেশ থেকে অধিকতর লাভবান হচ্ছে। কিন্তু অতীব অনুতাপের বিষয়, বাংলাদেশ সোনালি আঁশের মাধ্যমে সেই সোনালি অর্থ উপার্জন করতে পারছে না। তথ্যমতে, বিশ্বেবাজারে ওভেন ফ্রেবিক্স ও কার্পেট রপ্তানিতে চীন, পাট ফ্রেবিকসে ভারত এবং চট ও ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রথম স্থান দখল করে আছে। পাটজাতীয় অপরাপর পণ্যে বাংলাদেশ না পারার মূলত কারণ দুটি- ১. পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের অভাব, ২. আধুনিক বিপণন নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক ট্রেড প্র্যাকটিস সম্পর্কে অবগত না থাকা। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের বাজার দখল করতে না পারার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো- পাট-ধান দাম অনুপাত কম। এ কারণে কৃষকরা নিরুৎসাহী হয়ে তুলনামূলকভাবে অনুর্বর জমিতে পাট চাষ করে, যে কারণে জমিতে পাটের উৎপাদনশীলতা কম হয় এবং এর ফলস্বরূপ কৃষকের মুনাফা কম হয়। বিজ্ঞরা পাটের এ রকম অবস্থাকে 'পাট পাপ চক্র' (Jute Vicious Cycles) বলে অভিহিত করেছেন। তা ছাড়া বিপণন কৌশল হিসেবে সম্মিলিতভাবে বিশ্বব্যাপী পাটজাত পণ্য 'পরিবেশবান্ধব' পণ্য এ স্লোগানটিকে শক্তিশালী প্রসার ক্যাম্পেইন করতে না পারা, ব্যবহারকারীদের ব্যবহারগত কারিগরি সহযোগিতার অভাব, পণ্য উন্নয়ন ও অভিযোজনে বাস্তবভিত্তিক গবেষণা না করা এবং সম্ভাব্য নতুন বাজার অনুসন্ধান না করাকে দায়ী করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাতীয় দ্রব্যের বাজার হারানোর জন্য পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে দক্ষতার অভাবকে বেশি দায়ী করছেন। জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য 'রপ্তানি ঝুড়িতে' আছে মাত্র আট প্রকারের পণ্য; যা বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশের পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্য সমাবেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান সত্যিই হাস্যকর।
তবে আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বে ক্রমাগত প্রাকৃতিক বির্পযয়, স্বাস্থ্যগত হুমকি ও জনসাধারণের মধ্যে পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে পরিবেশবাদী আন্দোলন জোরদার হওয়ার কারণে সিনথেটিক ফাইবারের প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে 'সবুজ অর্থনীতির' নতুন ধারণা এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আরো বেশি বেগবান করছে। ইতিমধ্যে সান ফ্রানসিস্কোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানকার জনসাধারণ পলিথিনের পরিবর্তে পাটের তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহরগুলো এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তারাও বিষয়টি নিয়ে জোরালোভাবে চিন্তা করছে। এই সম্ভাবনা বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বাজার যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, থাইল্যান্ড ও ঘানায় বিকশিত হবে এবং আরো কিছু নতুন বাজার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশি পাটের পুরনো ঐতিহ্য পুনরুত্থানের জন্য আরো বিষয় যেমন ঋণ বিতরণ নীতিমালা, কৃষক প্রণোদনা, পাটকেন্দ্রিক দক্ষতার আধুনিকায়ন, নতুন বিপণন কৌশল নির্ধারণ, পাটকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিশ্বে অপরাপর দেশে ট্যারিফ সুবিধা গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়া এবং সর্বোপরি পাটকেন্দ্রিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পাটের জিনগত আবিষ্কারকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানো। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অচিরেই বিশ্বব্যাপী আবার সোনালি আঁশের সোনালি আলো ঠিকরে পড়বে এবং সীমিত হয়ে আসবে সিনথেটিক ফাইবারের বহুরূপী ব্যবহার। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই এ উদ্যোগ আজ খুব বেশি প্রয়োজন।
লেখকদ্বয় : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী, পারি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট
No comments