সামাজিক অবক্ষয় :নতুন করে ভাবুন by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

স্বাভাবিক নিয়মে অন্য দিনগুলোর মতো গত শুক্রবারকেও বরণ করে গোটা দুনিয়া। কিন্তু আমেরিকার অধিবাসীরা দিনের সূর্যকে বিদায় জানায় শোকে মুহ্যমান হয়ে। অন্যান্য দিনের মতোই গত শুক্রবারের সকাল ছিল শান্ত ও শীতল। কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুরা এসেছিল তাদের প্রিয় স্কুলে।
হঠাৎ সেখানে উদ্ধত বন্দুক হাতে হানা দেয় নির্দয় পাষাণ এক খুনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এই নারকীয় ও পৈশাচিক হামলায় প্রাণহানি ঘটে আমেরিকার কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউন শহরের স্যান্ডিহুক এলিমেন্টারি স্কুলের ২০ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২৮ জনের। ২৮টি তরতাজা প্রাণ সংহারের পর ২০ বছর বয়সী ঘাতক এডাম লানজা আত্মহত্যা করে। অনেকে অবশ্য বলছে, এডাম পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। খবরে প্রকাশ, এডাম স্কুলের শিক্ষার্থীদের গুলি করার আগে মাকে হত্যা করে বাসায়। তার মা ওই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।
মর্মান্তিক এ ঘটনায় স্তম্ভিত ও বেদনাহত আমেরিকাসহ গোটা বিশ্ব। স্কুলের শিশুদের হত্যার খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে অভিজাত ও ধনবানদের শহর বলে পরিচিত নিউটাউন। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শহরের অন্য সব স্কুল। শোকাহত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ঘটনার পরপরই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, 'আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। নিহত শিশুদের মা-বাবা, ভাইবোন ও স্বজনদের কথা ভেবে আমরা ব্যথিত।'
উল্লেখ্য, নিউটাউনের পৈশাচিক এ হত্যাযজ্ঞ স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘটনা হলেও আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই ধরনের ৬৩টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে জানা যায়। এ ছাড়া আমেরিকার বাইরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এ ধরনের অমানুষিক ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, এ অব্যাহত সহিংসতা কিসের ইঙ্গিত? অনেকেই সামাজিক অবক্ষয়কে এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘাতক হত্যাকাণ্ডের পর নিহত হওয়ায় হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ জানা যাচ্ছে না। আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। প্রকাশিত খবরে যত দূর জানা গেছে, এডামের সঙ্গে তার আপন বড় ভাইয়ের গত দুই বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না। আর মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, মাকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই সেটা অনুধাবন করা যায়। মূলত সে ছিল একটা অরক্ষিত ভঙ্গুর পরিবারের সদস্য। ২০০৮ সালে তার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, কোনো ঘটনা কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না।
আততায়ী এডাম যে চূড়ান্ত মানসিক বিকৃতিতে ভুগছিল, তা ঘটনা থেকেই প্রমাণিত। সঙ্গত কারণেই মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহলে প্রশ্ন উঠেছে মার্কিন সমাজের অবক্ষয়ী চরিত্র সম্পর্কে। বিশ্ব ধনতন্ত্রের তথাকথিত 'স্বর্গ' একটি হিংসাশ্রয়ী, পণ্যশাসিত ও অমানবিক সমাজ গড়ে তুলছে এবং এ হামলা তারই প্রতিফলন বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্য, সামাজিক অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, হতাশা এবং মানসিক বৈকল্য এ ধরনের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
মার্কিন লেখক অ্যামস্টার এ ঘটনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, 'আমাদের সমাজ অন্তর্নিহিত হিংসা ও নৃশংসতার সমাজ, ব্যক্তির শোষণ থেকে অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত। আবার বলতে হচ্ছে দায়ী মিডিয়া, করপোরেট মুনাফালোভীদের বাড়াবাড়ি। যারা সবকিছুর ওপর সম্পদকে ঠাঁই দেয়। ফলে আমাদের জীবনে গভীর বিচ্ছিন্নতা এবং শূন্যতা তৈরি হয়েছে।' মার্কিন সমাজে একদিকে যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, তেমনি রয়েছে বেকারত্বও। অন্যদিকে শিশু-কিশোরদের যত্ন করার মতো সংস্কৃতি ক্রমেই বিলীয়মান। এরই চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিভিন্ন স্থানে বন্দুক নিয়ে হামলার মতো ঘটনায়।
সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, এটা ভোগবাদী সমাজের একটি খণ্ডিত চিত্র ও পরিণতি মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সমাজ সাধারণভাবে ভোগসর্বস্ব সমাজ। সম্পদের প্রাচুর্য এবং ভোগসামগ্রীর সহজলভ্যতা মার্কিন সমাজে ভোগবাদী প্রবণতাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, ভোগই হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের প্রধান লক্ষ্য। যে নীতি-নৈতিকতা মানুষের মধ্যে সংযম, সৌহার্দ্য, পরোপকারিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদির জন্ম দেয়_ সেই নীতি-নৈতিকতার চর্চা মার্কিন সমাজ থেকে ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। যে উন্নত আদর্শ ও চেতনা মানুষকে স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত রাখে, পরকালীন জবাবদিহিতার বিষয়ে সচেতন করে, সেই আদর্শ ও চেতনার অনুশীলন-অনুশাসনের অভাব মার্কিন সমাজকে দ্রুত অবনতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সম্পদ, প্রাচুর্য ও খ্যাতির লালসা সেখানকার জনগণকে শান্তি, নিরাপত্তা, সম্প্রীতি_ কোনো কিছুই দিতে পারছে না। এটা মার্কিন সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সমাজকে, পরিবারকে প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃতের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হলে অবশ্যই সেখানকার রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতা, সমাজ নেতা ও মনোবিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে হবে। দুনিয়াপ্রীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। উন্নত আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতার চর্চা-অনুশীলন বাড়ানোর কার্যকর ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। পারিবারিক বন্ধনকে গতিশীল করতে হবে।
উল্লেখ করা দরকার, আমাদের সমাজেও ক্ষমতার লড়াই, হানাহানি ও সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা চলছে। পশ্চিমা সমাজের নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই আমাদেরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাসহ নীতি-নৈতিকতার চর্চা জোরদার করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এমন বাণী সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই সম্ভব হবে, সামাজিক এই অবক্ষয় দূর করার।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.