যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ- এবার কি কিছু হবে? by সুমন কায়সার
কানেটিকাটের স্যান্ডি হুক স্কুলের হত্যাযজ্ঞ বিমূঢ় করে দিয়েছে মার্কিন দেশের মানুষকে। দলমত-নির্বিশেষে অস্ত্র অধিকারের পক্ষে-বিপক্ষে সবাই হতবিহ্বল। দেশটিতে মাঝেমধ্যে কেউ না কেউ আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিদ্যালয়, বিপণিবিতান বা অন্য কোনো জনসমাগমের স্থানে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে।
এ ধরনের ঘটনা তাই মোটেই নতুন নয়। তবে কানেটিকাটের ঘটনাটির সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো দিক হচ্ছে নিহতদের বয়স। ২৭ জনের মধ্যে ২০ জনেরই বয়স ছয় থেকে সাত! মূলত এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে মার্কিন রাজনীতিতে স্পর্শকাতর হিসেবেই চিহ্নিত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ইস্যুটি।
স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনার অন্যতম বড় কারণ অস্ত্রের সহজলভ্যতা। কিন্তু দেশটির সব লোক এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁরা জানান, অস্ত্র নয়, এ জন্য দায়ী ব্যবহারকারী মানুষটি। আবার বিপক্ষে যাঁরা, তাঁরা এ কথাকে অর্থহীন বলে উড়িয়ে দেন। তবে একেকটি ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে অনেকবারই আলোচনার ঝড় ওঠে। আবার প্রচারমাধ্যম শান্ত হলে ধীরে ধীরে সব মহলের উত্তেজনাই থিতিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি বাড়ানোর উদ্যোগ আর এগোয় না। কারণ, বিষয়টি স্পর্শকাতরের পাশাপাশি জটিলও। তবে অনেকে বলছেন, স্যান্ডি হুকের ঘটনার ভয়াবহতা হয়তো কিছু একটা করতে বাধ্য করবে নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। রাতারাতি হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায় একটা নতুন ‘অর্থপূর্ণ উদ্যোগের’ পথে প্রথম পদক্ষেপটি পড়বে। ওবামা আগ্নেয়াস্ত্র-সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবিলার লক্ষ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী জানুয়ারির মধ্যেই তাঁদের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এটি অতীতের মতোই কেবল মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
কেন অস্ত্রের ছড়াছড়ি: ‘স্মল আর্মস সার্ভের’ হিসাবে ২০০৭ সালে প্রতি ১০০ মার্কিন নাগরিকের হাতে ৮৮ দশমিক ৮টি অস্ত্র ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা তুলনামূলকভাবে বেশ সহজ। এ বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি না থাকার বিষয়টি বুঝতে হলে মার্কিন মানসের একটি বিশেষ দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সাধারণভাবে মনে করে, অস্ত্রের মালিকানা থাকা তাদের অধিকার। শুধু ক্রীড়াবিষয়ক উদ্দেশ্য বা শিকারের জন্য নয়, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও অস্ত্র রাখা চাই। দেশের সংবিধানেই এ অধিকারের স্বীকৃতি আছে। আগ্নেয়াস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অবস্থা এক দিনে হয়নি। দেশটির ইতিহাসের একটা বড় অংশজুড়েই ‘সীমানার ওপারের’ দুর্গম, বৈরী ভূখণ্ডে নতুন বসতি গড়া চলেছে। সেখানে ভাগ্যান্বেষী মানুষের বড় বন্ধু ছিল বন্দুক। সংবিধানে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে অস্ত্র রাখার প্রবণতা ও ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি জোরালো। যেমন লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রত্যেকের বন্দুক আছে। অনেকেরই শিকারের অভ্যাস আছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও অস্ত্র দরকার বলে মনে করা হয়। অনেক এলাকায় থানা অনেক দূরে থাকে। পুলিশ আসতে অনেক সময় লেগে যায়। পল্লি অঞ্চলে খামারের ভেড়া বা গরুকে বিষাক্ত সাপ বা কায়োটির হাত থেকে বাঁচাতেও বন্দুক কাজে লাগে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে এসবের প্রয়োজন নেই। সে কারণে শহরে তুলনামূলকভাবে অনেক কম লোক আগ্নেয়াস্ত্র রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় নগরে তাই অস্ত্র দেখলেই গুন্ডা-বদমাশের কথা মনে পড়ে বেশির ভাগ লোকের। অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের শহুরে মানুষের কাছে একটা ভয়ের বিষয়।
আইন কেন বদলায় না: যুক্তরাষ্ট্রে কড়া অস্ত্র আইনের ব্যাপারে সাম্প্রতিক বছরে জনসমর্থন পড়তির দিকে। তবে সার্বিকভাবে সহিংস ঘটনার হারও কমেছে এ সময়ে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ জানান, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যেই যুক্তিতর্ক থাকে কম, আর তাতে কাজ হয় আরও কম।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালক জেমস জ্যাকবস উল্লেখ করেছেন, কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি ও রাজনৈতিক মহল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষের লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিনি জানান, ২০ বছরে নীতিগত বিষয়ে যা যা করা হয়েছে, তার সবকিছুরই ঝোঁক ছিল বন্দুকের মালিকদের অধিকারের দিকে।
মুখ ফুটে কেউ না বললেও অস্ত্রনির্মাতা কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা যে একটি প্রভাবশালী পক্ষ, তা ভুলে গেলে চলবে না।
কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন রিপাবলিকানরা। তাঁদের সঙ্গে অস্ত্র অধিকারের পক্ষের বিরাট শক্তি ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। অ্যাসল্ট রাইফেলের ওপর জাতীয় পর্যায়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তার মেয়াদ ২০০৪ সালে শেষ হয়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশই তা আর নবায়ন করেননি।
১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় পড়ার কথা মনে করিয়ে দেন ডিউক ইউনিভার্সিটির ক্রিস্টিন গস। তা দেখেই কংগ্রেস নির্বাচনে মধ্য ও বাম প্রার্থীরা এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। ক্রিস্টিন গস বলেন, ডেমোক্র্যাটদের মনে এ ধারণা হয়েছে যে এ ইস্যু নিয়ে কথা বললে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।
হয়তো এ কারণেই ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মোটেই প্রাধান্য পায়নি। শুধু তিনটি বিতর্কের একটিতে ওবামাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, অ্যাসল্ট অস্ত্র নিষিদ্ধের উদ্যোগকে সমর্থন করবেন। ওই পর্যন্তই। সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেবেন বলে জানাননি। সত্যি বলতে, ওবামা কড়াকড়ির পক্ষের লোক হলেও এবারই প্রথম সুনির্দিষ্ট উদ্যোগের কথা বলছেন। স্যান্ডি হুক ঘটনার পর তৈরি হওয়া জনমতের জোয়ারে ভর করে। এটাই বাস্তবতা।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি: অস্ত্রবিরোধী শিবিরের দৃঢ়বিশ্বাস, আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হলে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ কমে যাবে। এর বিরোধীরা আবার নরওয়ের উদাহরণ দেন। সে দেশের অস্ত্র আইন বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনগুলোর অন্যতম। কিন্তু সেই আইন অ্যান্ডার্স ব্রেইভিককে শান্তির নীড় হিসেবে পরিচিত দেশটিতে নরক নামিয়ে আনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। খারাপ লোক বা মানসিক রোগীদের পক্ষে আইন এড়িয়ে গিয়ে এ ধরনের কাণ্ড ঘটানো সম্ভব। আবার বৈধ অস্ত্রের মালিকেরা সমাজের ভালোও করতে পারেন। কিছুদিন আগে ফ্লোরিডায় দুজন দুর্বৃত্ত ডাকাতি করে পালানোর সময় তাদের গুলি করে আহত করেন এক বৃদ্ধ। দেশজুড়ে হিরো হয়ে যান তিনি।
২০১১ সালে নিরপেক্ষ সংগঠন পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জনমত জরিপে দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একজন ব্যক্তির মতামত কী হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে তার জাতিগত পরিচয় ও বসবাসের এলাকার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করার প্রবণতা অনেক বেশি। কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের বিরোধিতা করার কারণ আছে। তারা সংখ্যায় কম হলেও আগ্নেয়াস্ত্র-সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিমের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সমর্থন বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহরের অনেকগুলোই উপকূল ঘেঁষে। দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিম অঞ্চলে গ্রামাঞ্চল বেশি।
অস্ত্র রাখার অধিকারের পক্ষের লোকজন বলেন, নতুন আইন নয়, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার ওপরই বেশি জোর দেওয়া উচিত।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ জেমস জ্যাকবস এ ব্যাপারে একমত। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা যতটা না অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সমস্যা, তার চেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
আইন সংশোধনের উদ্যোগ: স্যান্ডি হুক স্কুলের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা জাতীয় পর্যায়ে আইন আরও কঠিন করার তাগিদ দিয়েছেন। তাঁদের একজন হলেন ওই ঘটনার শিকার কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ড্যান ম্যালয়। অন্যজন সিনেটর ডায়ান ফাইনস্টাইন। ড্যান মালয় বলছেন, তাঁর অঙ্গরাজ্যে ইতিমধ্যেই অ্যাসল্ট আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এমন আইন না থাকায় কানেটিকাটে ওই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষকে গভর্নর মনে করিয়ে দিয়েছেন, অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে লোকে হরিণ শিকার করে না। একসঙ্গে কয়েকজন মানুষ মারতেই বরং তার দরকার বেশি। নিউ টাউনের স্যান্ডি হুক স্কুলের হত্যাকারী অ্যাডাম ল্যানজার ব্যবহার করা প্রধান অস্ত্রটি ছিল একটি আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল।
সিনেটর ডায়ান ফাইনস্টাইন জানান, জানুয়ারিতে কংগ্রেস অধিবেশনে বসলেই তিনি সাধারণ মানুষের অ্যাসল্ট অস্ত্র কেনা নিষিদ্ধ করে একটি বিল তুলবেন।
শেষ কথা: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধ্যাপক ও পলিটিকস অব গান কন্ট্রোল বইয়ের লেখক রবার্ট স্পিৎজার মনে করেন, নতুন আইন প্রণয়ন অসম্ভব না হলেও খুব সহজ হবে না। ওবামা চাইলেও পদ্ধতিগত অনেক বাধা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে। মার্কিন পদ্ধতিটা এমনই যে বেশির ভাগ অস্ত্র-সংক্রান্ত আইনকানুনই করে অঙ্গরাজ্যের সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার নয়। মার্কিন মান বিচার করলে কানেটিকাটের বর্তমান আইনই তুলনামূলকভাবে কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহিংসতা কমাতে হলে আইনের ফাঁকফোকরও বন্ধ করতে হবে। যেমন ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্বাক্ষরিত ব্র্যাডি অ্যাক্টে অস্ত্র কিনতে আগ্রহীদের অতীতে অপরাধ করার ঘটনা বা কখনো মানসিক অসুখ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ৪০ শতাংশ অস্ত্র বিক্রিই এ আইনের আওতায় আসে না। কারণ, তা হয় সাধারণ মানুষের পরস্পরের মধ্যে। এর মধ্যে পড়ে অস্ত্র প্রদর্শনী বা ইন্টারনেটে বিক্রি হওয়া অস্ত্রও। অপরাধ বা মানসিক অসুখের তত্ত্বতালাশ করা হলেও তা সব সময় শতভাগ নিখুঁত হয় না।
২০০৭ সালে প্রতি ১০০ মার্কিন নাগরিকের হাতে ৮৮ দশমিক ৮টি অস্ত্র ছিল
অস্ত্রের পক্ষের শক্তিশালী সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) সদস্য ৪০ লাখের বেশি
প্রতি এক লাখ মানুষে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহতের সংখ্যা: যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ২, কানাডা ১ দশমিক ৬, অস্ট্রেলিয়া ১ দশমিক শূন্য, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস শূন্য দশমিক ১ (সূত্র জাতিসংঘ)
১৯৮২ সাল থেকে গত জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রজনিত হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে ৬২টি। ব্যবহূত ১৩৯টি অস্ত্রের ৪ ভাগের ৩ ভাগই বৈধ। এর মধ্যে ৬০টির বেশি ছিল আধা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল-রিভলভার। অ্যাসল্ট অস্ত্র ছিল ৩০টির বেশি
২০১২ সালেই সহিংসতার সংখ্যা ১৩টি
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও বিভিন্ন বার্তা সংস্থা
স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনার অন্যতম বড় কারণ অস্ত্রের সহজলভ্যতা। কিন্তু দেশটির সব লোক এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁরা জানান, অস্ত্র নয়, এ জন্য দায়ী ব্যবহারকারী মানুষটি। আবার বিপক্ষে যাঁরা, তাঁরা এ কথাকে অর্থহীন বলে উড়িয়ে দেন। তবে একেকটি ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে অনেকবারই আলোচনার ঝড় ওঠে। আবার প্রচারমাধ্যম শান্ত হলে ধীরে ধীরে সব মহলের উত্তেজনাই থিতিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি বাড়ানোর উদ্যোগ আর এগোয় না। কারণ, বিষয়টি স্পর্শকাতরের পাশাপাশি জটিলও। তবে অনেকে বলছেন, স্যান্ডি হুকের ঘটনার ভয়াবহতা হয়তো কিছু একটা করতে বাধ্য করবে নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। রাতারাতি হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায় একটা নতুন ‘অর্থপূর্ণ উদ্যোগের’ পথে প্রথম পদক্ষেপটি পড়বে। ওবামা আগ্নেয়াস্ত্র-সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবিলার লক্ষ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী জানুয়ারির মধ্যেই তাঁদের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু করার উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এটি অতীতের মতোই কেবল মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
কেন অস্ত্রের ছড়াছড়ি: ‘স্মল আর্মস সার্ভের’ হিসাবে ২০০৭ সালে প্রতি ১০০ মার্কিন নাগরিকের হাতে ৮৮ দশমিক ৮টি অস্ত্র ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা তুলনামূলকভাবে বেশ সহজ। এ বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি না থাকার বিষয়টি বুঝতে হলে মার্কিন মানসের একটি বিশেষ দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সাধারণভাবে মনে করে, অস্ত্রের মালিকানা থাকা তাদের অধিকার। শুধু ক্রীড়াবিষয়ক উদ্দেশ্য বা শিকারের জন্য নয়, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও অস্ত্র রাখা চাই। দেশের সংবিধানেই এ অধিকারের স্বীকৃতি আছে। আগ্নেয়াস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অবস্থা এক দিনে হয়নি। দেশটির ইতিহাসের একটা বড় অংশজুড়েই ‘সীমানার ওপারের’ দুর্গম, বৈরী ভূখণ্ডে নতুন বসতি গড়া চলেছে। সেখানে ভাগ্যান্বেষী মানুষের বড় বন্ধু ছিল বন্দুক। সংবিধানে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে অস্ত্র রাখার প্রবণতা ও ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি জোরালো। যেমন লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রত্যেকের বন্দুক আছে। অনেকেরই শিকারের অভ্যাস আছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও অস্ত্র দরকার বলে মনে করা হয়। অনেক এলাকায় থানা অনেক দূরে থাকে। পুলিশ আসতে অনেক সময় লেগে যায়। পল্লি অঞ্চলে খামারের ভেড়া বা গরুকে বিষাক্ত সাপ বা কায়োটির হাত থেকে বাঁচাতেও বন্দুক কাজে লাগে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে এসবের প্রয়োজন নেই। সে কারণে শহরে তুলনামূলকভাবে অনেক কম লোক আগ্নেয়াস্ত্র রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় নগরে তাই অস্ত্র দেখলেই গুন্ডা-বদমাশের কথা মনে পড়ে বেশির ভাগ লোকের। অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের শহুরে মানুষের কাছে একটা ভয়ের বিষয়।
আইন কেন বদলায় না: যুক্তরাষ্ট্রে কড়া অস্ত্র আইনের ব্যাপারে সাম্প্রতিক বছরে জনসমর্থন পড়তির দিকে। তবে সার্বিকভাবে সহিংস ঘটনার হারও কমেছে এ সময়ে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ জানান, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যেই যুক্তিতর্ক থাকে কম, আর তাতে কাজ হয় আরও কম।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালক জেমস জ্যাকবস উল্লেখ করেছেন, কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি ও রাজনৈতিক মহল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষের লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিনি জানান, ২০ বছরে নীতিগত বিষয়ে যা যা করা হয়েছে, তার সবকিছুরই ঝোঁক ছিল বন্দুকের মালিকদের অধিকারের দিকে।
মুখ ফুটে কেউ না বললেও অস্ত্রনির্মাতা কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা যে একটি প্রভাবশালী পক্ষ, তা ভুলে গেলে চলবে না।
কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন রিপাবলিকানরা। তাঁদের সঙ্গে অস্ত্র অধিকারের পক্ষের বিরাট শক্তি ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। অ্যাসল্ট রাইফেলের ওপর জাতীয় পর্যায়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তার মেয়াদ ২০০৪ সালে শেষ হয়। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশই তা আর নবায়ন করেননি।
১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় পড়ার কথা মনে করিয়ে দেন ডিউক ইউনিভার্সিটির ক্রিস্টিন গস। তা দেখেই কংগ্রেস নির্বাচনে মধ্য ও বাম প্রার্থীরা এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। ক্রিস্টিন গস বলেন, ডেমোক্র্যাটদের মনে এ ধারণা হয়েছে যে এ ইস্যু নিয়ে কথা বললে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।
হয়তো এ কারণেই ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মোটেই প্রাধান্য পায়নি। শুধু তিনটি বিতর্কের একটিতে ওবামাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, অ্যাসল্ট অস্ত্র নিষিদ্ধের উদ্যোগকে সমর্থন করবেন। ওই পর্যন্তই। সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেবেন বলে জানাননি। সত্যি বলতে, ওবামা কড়াকড়ির পক্ষের লোক হলেও এবারই প্রথম সুনির্দিষ্ট উদ্যোগের কথা বলছেন। স্যান্ডি হুক ঘটনার পর তৈরি হওয়া জনমতের জোয়ারে ভর করে। এটাই বাস্তবতা।
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি: অস্ত্রবিরোধী শিবিরের দৃঢ়বিশ্বাস, আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হলে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ কমে যাবে। এর বিরোধীরা আবার নরওয়ের উদাহরণ দেন। সে দেশের অস্ত্র আইন বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনগুলোর অন্যতম। কিন্তু সেই আইন অ্যান্ডার্স ব্রেইভিককে শান্তির নীড় হিসেবে পরিচিত দেশটিতে নরক নামিয়ে আনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। খারাপ লোক বা মানসিক রোগীদের পক্ষে আইন এড়িয়ে গিয়ে এ ধরনের কাণ্ড ঘটানো সম্ভব। আবার বৈধ অস্ত্রের মালিকেরা সমাজের ভালোও করতে পারেন। কিছুদিন আগে ফ্লোরিডায় দুজন দুর্বৃত্ত ডাকাতি করে পালানোর সময় তাদের গুলি করে আহত করেন এক বৃদ্ধ। দেশজুড়ে হিরো হয়ে যান তিনি।
২০১১ সালে নিরপেক্ষ সংগঠন পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জনমত জরিপে দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে একজন ব্যক্তির মতামত কী হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে তার জাতিগত পরিচয় ও বসবাসের এলাকার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করার প্রবণতা অনেক বেশি। কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকদের বিরোধিতা করার কারণ আছে। তারা সংখ্যায় কম হলেও আগ্নেয়াস্ত্র-সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিমের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সমর্থন বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহরের অনেকগুলোই উপকূল ঘেঁষে। দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিম অঞ্চলে গ্রামাঞ্চল বেশি।
অস্ত্র রাখার অধিকারের পক্ষের লোকজন বলেন, নতুন আইন নয়, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার ওপরই বেশি জোর দেওয়া উচিত।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ জেমস জ্যাকবস এ ব্যাপারে একমত। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা যতটা না অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সমস্যা, তার চেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
আইন সংশোধনের উদ্যোগ: স্যান্ডি হুক স্কুলের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা জাতীয় পর্যায়ে আইন আরও কঠিন করার তাগিদ দিয়েছেন। তাঁদের একজন হলেন ওই ঘটনার শিকার কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ড্যান ম্যালয়। অন্যজন সিনেটর ডায়ান ফাইনস্টাইন। ড্যান মালয় বলছেন, তাঁর অঙ্গরাজ্যে ইতিমধ্যেই অ্যাসল্ট আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এমন আইন না থাকায় কানেটিকাটে ওই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষকে গভর্নর মনে করিয়ে দিয়েছেন, অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে লোকে হরিণ শিকার করে না। একসঙ্গে কয়েকজন মানুষ মারতেই বরং তার দরকার বেশি। নিউ টাউনের স্যান্ডি হুক স্কুলের হত্যাকারী অ্যাডাম ল্যানজার ব্যবহার করা প্রধান অস্ত্রটি ছিল একটি আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল।
সিনেটর ডায়ান ফাইনস্টাইন জানান, জানুয়ারিতে কংগ্রেস অধিবেশনে বসলেই তিনি সাধারণ মানুষের অ্যাসল্ট অস্ত্র কেনা নিষিদ্ধ করে একটি বিল তুলবেন।
শেষ কথা: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধ্যাপক ও পলিটিকস অব গান কন্ট্রোল বইয়ের লেখক রবার্ট স্পিৎজার মনে করেন, নতুন আইন প্রণয়ন অসম্ভব না হলেও খুব সহজ হবে না। ওবামা চাইলেও পদ্ধতিগত অনেক বাধা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে। মার্কিন পদ্ধতিটা এমনই যে বেশির ভাগ অস্ত্র-সংক্রান্ত আইনকানুনই করে অঙ্গরাজ্যের সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার নয়। মার্কিন মান বিচার করলে কানেটিকাটের বর্তমান আইনই তুলনামূলকভাবে কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সহিংসতা কমাতে হলে আইনের ফাঁকফোকরও বন্ধ করতে হবে। যেমন ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্বাক্ষরিত ব্র্যাডি অ্যাক্টে অস্ত্র কিনতে আগ্রহীদের অতীতে অপরাধ করার ঘটনা বা কখনো মানসিক অসুখ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ৪০ শতাংশ অস্ত্র বিক্রিই এ আইনের আওতায় আসে না। কারণ, তা হয় সাধারণ মানুষের পরস্পরের মধ্যে। এর মধ্যে পড়ে অস্ত্র প্রদর্শনী বা ইন্টারনেটে বিক্রি হওয়া অস্ত্রও। অপরাধ বা মানসিক অসুখের তত্ত্বতালাশ করা হলেও তা সব সময় শতভাগ নিখুঁত হয় না।
২০০৭ সালে প্রতি ১০০ মার্কিন নাগরিকের হাতে ৮৮ দশমিক ৮টি অস্ত্র ছিল
অস্ত্রের পক্ষের শক্তিশালী সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) সদস্য ৪০ লাখের বেশি
প্রতি এক লাখ মানুষে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহতের সংখ্যা: যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ২, কানাডা ১ দশমিক ৬, অস্ট্রেলিয়া ১ দশমিক শূন্য, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস শূন্য দশমিক ১ (সূত্র জাতিসংঘ)
১৯৮২ সাল থেকে গত জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রজনিত হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে ৬২টি। ব্যবহূত ১৩৯টি অস্ত্রের ৪ ভাগের ৩ ভাগই বৈধ। এর মধ্যে ৬০টির বেশি ছিল আধা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল-রিভলভার। অ্যাসল্ট অস্ত্র ছিল ৩০টির বেশি
২০১২ সালেই সহিংসতার সংখ্যা ১৩টি
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও বিভিন্ন বার্তা সংস্থা
No comments