দেশ এগিয়ে যাবে কিভাবে? by ড. মিল্টন বিশ্বাস
চলতি বছর (২০১২) রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কালো মেঘের প্রাদুর্ভাব দেখে যেকোনো দেশপ্রেমিক বাঙালি এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সহিংসতা আর কুখ্যাত সব যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে স্লোগান দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা কিংবা নিরীহ ব্যক্তির প্রাণনাশ- এসব
ঘটনা অব্যাহত থাকলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে বলে বারবার রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ মত ব্যক্ত করেছেন। তাহলে দেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে- এ ভাবনা এখন সবার। রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারা দেশের অগ্রগতির জন্য যে জরুরি- এ কথা এখন সাধারণ ও নিরক্ষর মানুষও বুঝতে পারে। তা ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা রক্ষার জন্য সরকারের ভালো কাজের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানানো এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করা বিরোধী দলের দায়িত্বরূপে গণ্য করা হয়। সেদিক থেকে সরকার ও বিরোধী দলের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মতো ভূমিকা জনতার কাছে প্রত্যাশিত হবে- এটাই স্বাভাবিক।
স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছরে পদাপর্ণ অর্থাৎ বয়সের মাপে আমাদের দেশ ধনী কিংবা গরিব হওয়ার বিষয়ে অথবা কত দূর এগিয়ে গেল, সে সম্পর্কে মূল্যায়নে খুব বেশি কঠোর হওয়ার দরকার নেই। কারণ ভারত অথবা মিসরের দুই হাজার বছরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস এবং স্বাধীনতার অনেক দিন অতিবাহিত হলেও তারা খুব বেশি এগিয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড মাত্র দেড় শ বছরে উন্নয়নের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা তাদের ধনী রাষ্ট্রের তকমা এনে দিয়েছে। আবার অনেক সময় রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অঢেল প্রাপ্তিকে নির্দেশ করে থাকেন; অথচ, যা একেবারে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে পরিগণিত। কারণ ক্ষুদ্র সীমানা আর ৮০ শতাংশ পার্বত্য ও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা নিয়ে জাপান বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি কিভাবে হয়েছে? সেখানে আবাদি জমি নেই বললেই চলে, পশুপালনের জন্য চারণভূমি কম, তবু শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল আমদানি করে বিশ্বব্যাপী তারা তাদের পণ্যসামগ্রী ছড়িয়ে দিয়েছে। কেবল নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা কি যথেষ্ট ছিল না? সুইজারল্যান্ডে নারিকেল গাছের প্রাচুর্য তাদের নেই, অথচ তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চকোলেট উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র দেশটিতে বছরের মাত্র চার মাস শস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী আবহাওয়া থাকে। অথচ তারাই দুগ্ধ উৎপাদনে বিশ্বের নন্দিত ও আদর্শ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। দেশটি শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বসবাসের সর্বোত্তম জায়গা হিসেবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে এখনো। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ধনী ও উন্নত দেশের তকমা লাগানো রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী-জ্ঞানী ব্যক্তিদের চেয়ে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিরা একেবারে পিছিয়ে নেই। বরং পেশাজীবীদের মধ্যে জ্ঞান-গরিমায় পার্থক্য কম। বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের আন্তসম্পর্কের মধ্য দিয়ে সেই দিকটিও আজ স্পষ্ট। উপরন্তু দেশের অগ্রগতিতে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমস্যাও মুখ্য নয়। বরং ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ অন্য দেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের শ্রম আদায় করে যেভাবে ধনী রাষ্ট্রের শীর্ষে পৌঁছেছে- সেই ধরনের ঘটনারও সম্মুখীন হতে হয়নি আমাদের গত ৪১ বছরে। তাহলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা কী? আসলে বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের মৌল পার্থক্য চেতনা ও আচরণের। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নিজের দেশের সম্পদ বিনষ্টিতে আমরা আনন্দ লাভ করি। মনে করি, দেশের সম্পদ আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি নামক দলের। আসলে এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। আজ বড় বেশি দরকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আত্মসচেতনতা, আর, যুবসমাজের ইতিহাসচেতনা। দেশকে এগিয়ে নিতে যুবসমাজকে যথার্থ পথনির্দেশনা দিতে হবে।
ইতিহাস আমাদের বর্তমানকে নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করে। আজকের সমাজ ও বিগতকালের সমাজের মধ্যে সংলাপ চলে ইতিহাসে। অতীতকে বর্তমান আলোতে বোধগম্য করতে হয়। অর্থাৎ বর্তমানকে বুঝতে হলে অতীতের আলো প্রয়োজন হয়। এই হিসেবে বর্তমান যুবসমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার চেতনা বারবার সামনে আনা দরকার। তারা যা করছে কিংবা ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে যেসব আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাকে মিডিয়ার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত না করে একটি পরিশীলিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার গড়ে তোলার সময় এসেছে স্বাধীনতার এই ৪২ বছরে। কারণ বর্তমান শিক্ষিত যুবসমাজকে টার্গেট করেছে মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাদের দলে ভেড়াতে চাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেককেই ভিড়িয়েছে। হিযবুত তাহ্রীর ও অন্যান্য জঙ্গিবাদে তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির নামের যে রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, সেখানে সম্পৃক্ত অনেক তরুণ। এ বছর ডিসেম্বরে সেই ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর হরতাল ও অবরোধে আমরা দেখেছি যুবসমাজকে নাশকতায় অংশগ্রহণ করতে। এই বিপথগামীকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাসের যে অর্থে প্রচার দরকার ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব সঠিকপথে যুবসমাজকে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্যই ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মৌলবাদী মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করে বিশ্বজিতের মতো নিরীহ যুবকের প্রাণ বিনষ্টিতে মেতে উঠেছে (?)। কিন্তু কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ কিংবা চট্টগ্রামের পটিয়ার বৌদ্ধ ও হিন্দু বসতি এবং উপাসনালয়ে হামলা হলে কেবল সেসব সম্প্রদায়ই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে- এ অভিযোগ দেশের বিশিষ্টজনরাই সামনে এনেছেন। ব্যাপক অর্থে নির্বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান একত্রে প্রতিবাদে নামেনি কেন? হিন্দু-বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হলে আগে সব সম্প্রদায়ের যুবসমাজ সোচ্চার হয়েছে, রাজপথে নেমেছে; কিন্তু সেই চিত্র পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস সে কথা বলে না।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের এক বছর পর এক সার্বিক সংগ্রামে মেতে উঠেছিলেন সেই সময়ের পূর্ব বাংলার যুবকরা। তাঁরা তাঁদের যৌবনকে ব্যয় করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায়। নিজের পরিচয়কে, নিজের স্বাধিকার চেতনাকে উজ্জীবিত করার সে প্রচেষ্টা ছিল সেই সময়ের যুবসমাজের কাছে স্বপ্ন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আর একুশে ফেব্রুয়ারি, আজ যা আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তা থেকেই বাঙালি নিজেকে চিনেছিল। পরাধীনতার যন্ত্রণা একদিন কুরে কুরে খেয়েছে যাদের, তারা রাজপথে নেমেছে, আর সেই পথই তাদের নিয়ে গেছে আলোর দিকে। সেই সময় থেকে চেতনার নানা মাত্রা স্ফুরিত হয়েছে। বাঙালির স্বাধিকার চেতনার জয়গান ছিল মধ্যবিত্তের ঘরে। সেই সময় নিম্নবর্গের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না এর তাৎপর্য। কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ অনেক জাতীয় নেতা- তাঁরাও ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দীর্ঘ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁদের গড়ে তুলতে হয়েছিল আমাদের একাত্তরের বিজয় মুহূর্তের প্রস্তুতি। এক বৃহৎ পটভূমি ও সময় পর্বে দাঁড়িয়ে সেই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মুক্তিকামী জনশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-গোষ্ঠীসহ সব বাঙালি ও বিদেশি বন্ধু জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ ও অবদানের মহিমার কথা। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব ছিল তখনকার বাস্তবতা। সেই সত্যকে মেনে নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের উচিত, এখনকার নিম্নবর্গকে গড়ে তোলা। নিম্নবর্গের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধির চেতনাকে অনুপ্রবিষ্ট করাতে হবে শিক্ষিত যুবসমাজকেই। আদর্শ নাগরিক হতে হলে ইতিহাসসচেতন হতে হবে। কেবল প্রযুক্তির ব্যবহারে স্মার্ট হলেই চলবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছরে পদাপর্ণ অর্থাৎ বয়সের মাপে আমাদের দেশ ধনী কিংবা গরিব হওয়ার বিষয়ে অথবা কত দূর এগিয়ে গেল, সে সম্পর্কে মূল্যায়নে খুব বেশি কঠোর হওয়ার দরকার নেই। কারণ ভারত অথবা মিসরের দুই হাজার বছরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস এবং স্বাধীনতার অনেক দিন অতিবাহিত হলেও তারা খুব বেশি এগিয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড মাত্র দেড় শ বছরে উন্নয়নের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা তাদের ধনী রাষ্ট্রের তকমা এনে দিয়েছে। আবার অনেক সময় রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অঢেল প্রাপ্তিকে নির্দেশ করে থাকেন; অথচ, যা একেবারে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে পরিগণিত। কারণ ক্ষুদ্র সীমানা আর ৮০ শতাংশ পার্বত্য ও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা নিয়ে জাপান বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি কিভাবে হয়েছে? সেখানে আবাদি জমি নেই বললেই চলে, পশুপালনের জন্য চারণভূমি কম, তবু শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল আমদানি করে বিশ্বব্যাপী তারা তাদের পণ্যসামগ্রী ছড়িয়ে দিয়েছে। কেবল নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা কি যথেষ্ট ছিল না? সুইজারল্যান্ডে নারিকেল গাছের প্রাচুর্য তাদের নেই, অথচ তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চকোলেট উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র দেশটিতে বছরের মাত্র চার মাস শস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী আবহাওয়া থাকে। অথচ তারাই দুগ্ধ উৎপাদনে বিশ্বের নন্দিত ও আদর্শ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। দেশটি শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বসবাসের সর্বোত্তম জায়গা হিসেবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে এখনো। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ধনী ও উন্নত দেশের তকমা লাগানো রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী-জ্ঞানী ব্যক্তিদের চেয়ে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিরা একেবারে পিছিয়ে নেই। বরং পেশাজীবীদের মধ্যে জ্ঞান-গরিমায় পার্থক্য কম। বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের আন্তসম্পর্কের মধ্য দিয়ে সেই দিকটিও আজ স্পষ্ট। উপরন্তু দেশের অগ্রগতিতে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমস্যাও মুখ্য নয়। বরং ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ অন্য দেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের শ্রম আদায় করে যেভাবে ধনী রাষ্ট্রের শীর্ষে পৌঁছেছে- সেই ধরনের ঘটনারও সম্মুখীন হতে হয়নি আমাদের গত ৪১ বছরে। তাহলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা কী? আসলে বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের মৌল পার্থক্য চেতনা ও আচরণের। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নিজের দেশের সম্পদ বিনষ্টিতে আমরা আনন্দ লাভ করি। মনে করি, দেশের সম্পদ আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি নামক দলের। আসলে এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। আজ বড় বেশি দরকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আত্মসচেতনতা, আর, যুবসমাজের ইতিহাসচেতনা। দেশকে এগিয়ে নিতে যুবসমাজকে যথার্থ পথনির্দেশনা দিতে হবে।
ইতিহাস আমাদের বর্তমানকে নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করে। আজকের সমাজ ও বিগতকালের সমাজের মধ্যে সংলাপ চলে ইতিহাসে। অতীতকে বর্তমান আলোতে বোধগম্য করতে হয়। অর্থাৎ বর্তমানকে বুঝতে হলে অতীতের আলো প্রয়োজন হয়। এই হিসেবে বর্তমান যুবসমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার চেতনা বারবার সামনে আনা দরকার। তারা যা করছে কিংবা ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে যেসব আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাকে মিডিয়ার মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত না করে একটি পরিশীলিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার গড়ে তোলার সময় এসেছে স্বাধীনতার এই ৪২ বছরে। কারণ বর্তমান শিক্ষিত যুবসমাজকে টার্গেট করেছে মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাদের দলে ভেড়াতে চাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেককেই ভিড়িয়েছে। হিযবুত তাহ্রীর ও অন্যান্য জঙ্গিবাদে তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির নামের যে রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, সেখানে সম্পৃক্ত অনেক তরুণ। এ বছর ডিসেম্বরে সেই ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর হরতাল ও অবরোধে আমরা দেখেছি যুবসমাজকে নাশকতায় অংশগ্রহণ করতে। এই বিপথগামীকে উদ্ধার করার জন্য আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাসের যে অর্থে প্রচার দরকার ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব সঠিকপথে যুবসমাজকে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্যই ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মৌলবাদী মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করে বিশ্বজিতের মতো নিরীহ যুবকের প্রাণ বিনষ্টিতে মেতে উঠেছে (?)। কিন্তু কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ কিংবা চট্টগ্রামের পটিয়ার বৌদ্ধ ও হিন্দু বসতি এবং উপাসনালয়ে হামলা হলে কেবল সেসব সম্প্রদায়ই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে- এ অভিযোগ দেশের বিশিষ্টজনরাই সামনে এনেছেন। ব্যাপক অর্থে নির্বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান একত্রে প্রতিবাদে নামেনি কেন? হিন্দু-বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হলে আগে সব সম্প্রদায়ের যুবসমাজ সোচ্চার হয়েছে, রাজপথে নেমেছে; কিন্তু সেই চিত্র পরিবর্তন হয়েছে বর্তমানে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস সে কথা বলে না।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের এক বছর পর এক সার্বিক সংগ্রামে মেতে উঠেছিলেন সেই সময়ের পূর্ব বাংলার যুবকরা। তাঁরা তাঁদের যৌবনকে ব্যয় করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায়। নিজের পরিচয়কে, নিজের স্বাধিকার চেতনাকে উজ্জীবিত করার সে প্রচেষ্টা ছিল সেই সময়ের যুবসমাজের কাছে স্বপ্ন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আর একুশে ফেব্রুয়ারি, আজ যা আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তা থেকেই বাঙালি নিজেকে চিনেছিল। পরাধীনতার যন্ত্রণা একদিন কুরে কুরে খেয়েছে যাদের, তারা রাজপথে নেমেছে, আর সেই পথই তাদের নিয়ে গেছে আলোর দিকে। সেই সময় থেকে চেতনার নানা মাত্রা স্ফুরিত হয়েছে। বাঙালির স্বাধিকার চেতনার জয়গান ছিল মধ্যবিত্তের ঘরে। সেই সময় নিম্নবর্গের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না এর তাৎপর্য। কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ অনেক জাতীয় নেতা- তাঁরাও ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দীর্ঘ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁদের গড়ে তুলতে হয়েছিল আমাদের একাত্তরের বিজয় মুহূর্তের প্রস্তুতি। এক বৃহৎ পটভূমি ও সময় পর্বে দাঁড়িয়ে সেই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মুক্তিকামী জনশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-গোষ্ঠীসহ সব বাঙালি ও বিদেশি বন্ধু জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ ও অবদানের মহিমার কথা। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব ছিল তখনকার বাস্তবতা। সেই সত্যকে মেনে নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের উচিত, এখনকার নিম্নবর্গকে গড়ে তোলা। নিম্নবর্গের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধির চেতনাকে অনুপ্রবিষ্ট করাতে হবে শিক্ষিত যুবসমাজকেই। আদর্শ নাগরিক হতে হলে ইতিহাসসচেতন হতে হবে। কেবল প্রযুক্তির ব্যবহারে স্মার্ট হলেই চলবে না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments