চারদিক- বুড়িগঙ্গায় এক দিন by ফারুখ আহমেদ
এই নগরের প্রাণ একসময় ছিল বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নিয়ে অনেক স্মৃতি। সেই সব স্মৃতি আমাকে প্রবলভাবে তাড়িত করে! জন্মসূত্রে আমি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। নিজেকে বলি আদি ঢাকাইয়া। একটু বোঝার পর থেকেই বুড়িগঙ্গায় যাতায়াত। আমার নানিবাড়ি মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি।
সে সময় হেনা এক্সপ্রেস লঞ্চে চড়ে কিংবা রকেট স্টিমারে চেপে প্রায়ই নানিবাড়ি যেতাম। তখনকার বুড়িগঙ্গা আর তার জল ছিল প্রাণজুড়ানো। লঞ্চের পেছনে বসতাম। গাঙচিলেরা আমাদের লঞ্চের পেছন পেছন ছুটত। মাঝেমধ্যে একটি-দুটি বা একসঙ্গে অনেকগুলো শুশুক মাথা উঁচিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টুপ করে ডুব দিত। পালতোলা বড় বড় নৌকা সে সময় অহরহ চোখে পড়ত। আর বুড়িগঙ্গায় চলতে চলতে এসব আমাকে আচ্ছন্ন করত।
আজকের দিনে বুড়িগঙ্গায় এসব একবারেই দুর্লভ। আমার ছেলেবেলার বুড়িগঙ্গা নিয়ে কত যে মধুর স্মৃতি আছে! সময়-অসময় বা যখন-তখন চলে যেতাম বুড়িগঙ্গার জলে গোসল করতে। দিনভর দাপিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতাম। তখন এপার-ওপার মিলে বুড়িগঙ্গা ছিল বিশাল। বাজি ধরে বন্ধুরা এপার-ওপার করতাম। সামাদ লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়তাম বুড়িগঙ্গার জলে। কোরবানির ঈদে আরেক মজা। আমরা এলাকার সবাই ঈদের দিন ভোরবেলা প্রত্যেকে প্রত্যেকের গরু নিয়ে চলে যেতাম বুড়িগঙ্গায়। গোসল করাতাম, নিজেও গোসল সেরে তবেই বাড়ি ফিরতাম। সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। সেই বুড়িগঙ্গার এখন বেহাল অবস্থা। দূষণযুক্ত কালো ময়লা বা দুর্গন্ধময় পানির জন্য বুড়িগঙ্গার কত বদনাম, অবহেলা। কালের নিয়মে পরিবর্তন সবকিছুরই হবে। কিন্তু এত নোংরা হয়ে যাবে স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা, তা কখনো ভাবতে পারিনি। কত দিন লঞ্চে নানিবাড়ি যাই না। এখন আর বুড়িগঙ্গার জলে গোসল দূরে থাক, বেড়ানোও হয় না। তবু বর্ষায় বুড়িগঙ্গার নিজস্ব একটা রূপ থেকেই যায়। আর সেই রূপে চোখ জুড়াতে গত বর্ষায় একদিন চলে গিয়েছিলাম বুড়িগঙ্গায়। লালকুঠির পাশের শ্যামবাজার ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে চড়ে বসেছিলাম। রূপলাল বাবুর বাড়ির পাশ ধরে আমাদের কোষানৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সকাল থেকে। মেঘলা আবহাওয়ায় বুড়িগঙ্গা আমাকে সেই ফেলে আসা দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বর্ষায় দুই পাড়ের দূরত্ব বেড়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি তখন স্বচ্ছ, দুর্গন্ধমুক্ত। অনেক দিনের চেনা আগের সেই সুন্দর প্রবাহিত নদী বুড়িগঙ্গাকে আবার আপন মনে হলো। লালরঙা পালতোলা তিনটি নৌকা যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার হচ্ছে, একদল জেলে দেখলাম জাল ফেলে মাছ ধরছেন। জানতে চাইলাম, ভাই, মাছ পাওয়া যায়?
একজন জেলে বললেন, ‘পামু না ক্যান! পুঁটি, খইলশা, আর নলা; মইদ্যে মইদ্যে রুই মাছও পায়া যাই। নদীত নাও খুব বেশি। নাইলে মাছ ঠিকই পাইতাম!’
ঠিকই বলেছেন জেলে, বুড়িগঙ্গায় নৌকা বর্ষায় অনেক বেশি। এত নৌকা যে নৌকায় না আবার জট লেগে পত্রিকার খবর হয়ে যায়—নৌকাজট! ভাবতে ভাবতে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলায় মনোযোগী হই। ইতিমধ্যে আমাদের নৌকা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর কাছে চলে এসেছে। আমরা এবার নদীর ওপার দিয়ে ফিরতি পথে চলি। এখানে এলাকাজুড়ে ডকইয়ার্ড। আর বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করা সব লঞ্চ দাঁড়িয়ে। এগুলোরা সময় হলে ঘাটে চলে যাবে। তারপর যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে। আমি এমভি টিপু নামের একটি লঞ্চ আসতে দেখে মাঝিকে প্রশ্ন করি, লঞ্চে যাত্রী কত হবে? মাঝির ত্বরিত জবাব, ‘৭০০-এর মতো।’ তারপর নিজে নিজেই বলে যান মাঝি, ‘এই লঞ্চেই ঈদের সময় চাইর-পাঁচ হাজার মানুষ উঠছিল।’
মাঝির হিসাবে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি আছে, কিন্তু ঈদের সময় এটা যে কতটা ভয়ংকর হয়ে যায়, সেটা তো প্রতিবছরই দেখি।
এর মধ্যে আমাদের নৌকা বাবুবাজার ঘাটের কাছে চলে এসেছে। এখানে নৌকা-লঞ্চ অনেক বেশি। জট লাগার যে কথা বলেছিলাম, ঠিক জট না হলেও এখানকার অবস্থা অনেকটা সে রকমই। এখানে তিনটি স্টিমার দাঁড়ানো। লেপচা আর এমভি মাসহুদ রয়েছে সেখানে। প্রচুর লোকজন নদী পারাপর হচ্ছে। এখানে নদীর দুই পাড়েই ময়লা-বর্জ্য পড়ার দৃশ্য মনটাকে বিষণ্ন করে তুলল। বিষণ্ন মন নিয়ে এবার ফিরে চলি। নৌকা থেকে নেমে মাঝির সব হিসাব চুকিয়ে সামনে সড়কপথে যানজটের মধ্যে পড়ি। এই শহরে আসলে আমাদের স্বস্তির জায়গা কোথায়, ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে ফিরে চলি!
এই শীতে মন আর বুড়িগঙ্গার দিকে যেতে চায় না। ভরা বর্ষায় নদীর যে রূপ দেখেছি, সেটা শীতকালে দেখতে পাব না। কেন শুধু শুধু মনকে বিষণ্ন করব?
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com
আজকের দিনে বুড়িগঙ্গায় এসব একবারেই দুর্লভ। আমার ছেলেবেলার বুড়িগঙ্গা নিয়ে কত যে মধুর স্মৃতি আছে! সময়-অসময় বা যখন-তখন চলে যেতাম বুড়িগঙ্গার জলে গোসল করতে। দিনভর দাপিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতাম। তখন এপার-ওপার মিলে বুড়িগঙ্গা ছিল বিশাল। বাজি ধরে বন্ধুরা এপার-ওপার করতাম। সামাদ লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়তাম বুড়িগঙ্গার জলে। কোরবানির ঈদে আরেক মজা। আমরা এলাকার সবাই ঈদের দিন ভোরবেলা প্রত্যেকে প্রত্যেকের গরু নিয়ে চলে যেতাম বুড়িগঙ্গায়। গোসল করাতাম, নিজেও গোসল সেরে তবেই বাড়ি ফিরতাম। সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। সেই বুড়িগঙ্গার এখন বেহাল অবস্থা। দূষণযুক্ত কালো ময়লা বা দুর্গন্ধময় পানির জন্য বুড়িগঙ্গার কত বদনাম, অবহেলা। কালের নিয়মে পরিবর্তন সবকিছুরই হবে। কিন্তু এত নোংরা হয়ে যাবে স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা, তা কখনো ভাবতে পারিনি। কত দিন লঞ্চে নানিবাড়ি যাই না। এখন আর বুড়িগঙ্গার জলে গোসল দূরে থাক, বেড়ানোও হয় না। তবু বর্ষায় বুড়িগঙ্গার নিজস্ব একটা রূপ থেকেই যায়। আর সেই রূপে চোখ জুড়াতে গত বর্ষায় একদিন চলে গিয়েছিলাম বুড়িগঙ্গায়। লালকুঠির পাশের শ্যামবাজার ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে চড়ে বসেছিলাম। রূপলাল বাবুর বাড়ির পাশ ধরে আমাদের কোষানৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল। সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সকাল থেকে। মেঘলা আবহাওয়ায় বুড়িগঙ্গা আমাকে সেই ফেলে আসা দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বর্ষায় দুই পাড়ের দূরত্ব বেড়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি তখন স্বচ্ছ, দুর্গন্ধমুক্ত। অনেক দিনের চেনা আগের সেই সুন্দর প্রবাহিত নদী বুড়িগঙ্গাকে আবার আপন মনে হলো। লালরঙা পালতোলা তিনটি নৌকা যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার হচ্ছে, একদল জেলে দেখলাম জাল ফেলে মাছ ধরছেন। জানতে চাইলাম, ভাই, মাছ পাওয়া যায়?
একজন জেলে বললেন, ‘পামু না ক্যান! পুঁটি, খইলশা, আর নলা; মইদ্যে মইদ্যে রুই মাছও পায়া যাই। নদীত নাও খুব বেশি। নাইলে মাছ ঠিকই পাইতাম!’
ঠিকই বলেছেন জেলে, বুড়িগঙ্গায় নৌকা বর্ষায় অনেক বেশি। এত নৌকা যে নৌকায় না আবার জট লেগে পত্রিকার খবর হয়ে যায়—নৌকাজট! ভাবতে ভাবতে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলায় মনোযোগী হই। ইতিমধ্যে আমাদের নৌকা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর কাছে চলে এসেছে। আমরা এবার নদীর ওপার দিয়ে ফিরতি পথে চলি। এখানে এলাকাজুড়ে ডকইয়ার্ড। আর বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করা সব লঞ্চ দাঁড়িয়ে। এগুলোরা সময় হলে ঘাটে চলে যাবে। তারপর যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে। আমি এমভি টিপু নামের একটি লঞ্চ আসতে দেখে মাঝিকে প্রশ্ন করি, লঞ্চে যাত্রী কত হবে? মাঝির ত্বরিত জবাব, ‘৭০০-এর মতো।’ তারপর নিজে নিজেই বলে যান মাঝি, ‘এই লঞ্চেই ঈদের সময় চাইর-পাঁচ হাজার মানুষ উঠছিল।’
মাঝির হিসাবে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি আছে, কিন্তু ঈদের সময় এটা যে কতটা ভয়ংকর হয়ে যায়, সেটা তো প্রতিবছরই দেখি।
এর মধ্যে আমাদের নৌকা বাবুবাজার ঘাটের কাছে চলে এসেছে। এখানে নৌকা-লঞ্চ অনেক বেশি। জট লাগার যে কথা বলেছিলাম, ঠিক জট না হলেও এখানকার অবস্থা অনেকটা সে রকমই। এখানে তিনটি স্টিমার দাঁড়ানো। লেপচা আর এমভি মাসহুদ রয়েছে সেখানে। প্রচুর লোকজন নদী পারাপর হচ্ছে। এখানে নদীর দুই পাড়েই ময়লা-বর্জ্য পড়ার দৃশ্য মনটাকে বিষণ্ন করে তুলল। বিষণ্ন মন নিয়ে এবার ফিরে চলি। নৌকা থেকে নেমে মাঝির সব হিসাব চুকিয়ে সামনে সড়কপথে যানজটের মধ্যে পড়ি। এই শহরে আসলে আমাদের স্বস্তির জায়গা কোথায়, ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে ফিরে চলি!
এই শীতে মন আর বুড়িগঙ্গার দিকে যেতে চায় না। ভরা বর্ষায় নদীর যে রূপ দেখেছি, সেটা শীতকালে দেখতে পাব না। কেন শুধু শুধু মনকে বিষণ্ন করব?
ফারুখ আহমেদ
farukh.ahmed@gmail.com
No comments