গণতন্ত্রের উত্তরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা by এম এ মালেক
পৃথিবীর যে কোনো দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণার মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এর তীব্রতা অনেক বেশি। তাই উন্নয়নশীল দেশের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে।
এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণেই একটি রাজনৈতিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রতি জনগণের আনুগত্য ও বিশ্বাস কীভাবে সৃষ্টি হবে, এর শিকড় কীভাবে দৃঢ় ও স্থির এবং মজবুত হবে তা সম্পর্কে তারা স্পষ্ট ধারণার উপনীত হতে পারে না। যার ফলে জনগণের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, বিশ্বাস ভিন্নখাতে প্রভাবান্বিত হয়। এর জন্য প্রকৃত মূল্যবোধ কীভাবে সৃষ্টি হবে সে বিষয়েও তারা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন না। সে ঐকমত্যের অভাবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণ রাজনৈতিক তীব্র সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত হয় এবং জাতির জাতীয়তাবাদ হয় ক্ষতবিক্ষত। এমন একটি সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মহাসঙ্কটের আবর্তে ধূম্রজালের সৃষ্টি করছে, যা আমাদের রাজনীতিকদের দ্বারা রাজনৈতিক দর্শনগত মতভেদেরই ফসল। এর প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থির হয়ে উঠেনি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত হয়ে পড়ে। তাতে করে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। তাই এখানকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সুষ্ঠু নীতিতে অগ্রসর না হয়ে রাজনীতিকদের শান্ত করতে সব ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে জনগণ রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতিকদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে; যার ফলে এদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সফল উত্তরণ ঘটেনি ও তা কার্যকারিতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যায় না। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বার বার হোঁচট খাচ্ছে। এ জন্য দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সফল উত্তরণ ও কার্যকর করার জন্য জনগণের ইচ্ছা ব্যক্ত করার প্রত্যয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমাদের রাজনীতিকদের একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আবশ্যক। এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী হবে? দেশের জনগণের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ কী হবে? তার দিকে দৃষ্টি দেয়া রাজনীতিকদের আবশ্যক কর্তব্য। তাহলেই জনগণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবে এবং এখানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। প্রথমত, আমাদের নিজস্ব সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণায় উপনীত হওয়া আবশ্যক, যার আলোকে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুষ্ঠুতা ও সুস্থতার মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছার পথ সুগম করবে।রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী?
এ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সংজ্ঞা বা মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন কতগুলো ওরিয়েনটেশনের সমষ্টি যথা—অনুভূতি, আচরণ, মূল্যবোধ, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা ইত্যাদি। মোটকথা রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি যোগ্য প্রত্যয় ব্যবস্থা, যার প্রয়োগে জনগণ তার গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ক্ষমতার শেয়ার ভোগ করতে থাকবে এবং যার কোনো ত্রুটি হলে মানুষ আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লব করে। আবহমানকাল ধরে যে সত্যের ব্যাকুলতায়, সামষ্টিক মানুষের অধিকার, আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির চেতনায় আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লবের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে যায়। এ বিপ্লব যদি সফল হয় তবে মানব চরিত্রের অদৃশ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরায়ত লড়াই হয় নির্ভুল সত্য। আবার লড়াইয়ের সপক্ষে সত্য পক্ষের শক্তি চক্রান্তকারী অসত্য পক্ষের তুলনায় বেশি হওয়ার পরও যদি বিপ্লব ব্যর্থ হয়, তবে তা অর্জিত জ্ঞানে সত্য হলেও ইতিহাসের অলংঘনীয় নিয়ম বলে তা মুক্তিহীন যুক্তিতে নির্ভুল সত্যে পরিণত হয় না। আর চক্রান্ত যদি সত্য পক্ষের কাছে পরাজিত হয় তার বাস্তবতা মেনে না নেয়ার কোনো পথই খোলা থাকে না। তাই সমকালের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধারিত মৌলনীতি, দৃষ্টিভঙ্গি সেই সত্যের কথাই বলে। তাই যুক্তির পথে মুক্তির কথা যারা বলেন এবং তাতে সমাজকে দেয় যে গতি, তাতেই সমাজ প্রগতি এগিয়ে যায়। মানুষের প্রগতির উত্স পঞ্চেন্দ্রীয় অনুভূতিতন্ত্রের আরোহিত, যা কিছু মস্তিষ্কে ধারণ করে তাই বহুমুখী জ্ঞান। এ জ্ঞানার্জনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু সৃষ্টি তা যুক্তির মধ্যে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট হয়। নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আলোকে যা কিছু তা থেকেই মানবসভ্যতা অগ্রসর হয়েছে। রাজনৈতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি অবশ্যই কৃষ্টিকে প্রভাবান্বিত করেছে। যেমন গরু বা ঘোড়া দিয়ে চাষাবাদের জায়গা আজ দখল করে নিচ্ছে কলের লাঙ্গল। পাল তোলা বা গুণ টানা নৌকায় আজ যুক্ত হয়েছে যন্ত্র। ঢাল-তলোয়ারের জায়গা দখল করে নিয়েছে মিজাইল টেকনোলজি। এমনিভাবে যদিও সভ্যতা বদলে দিচ্ছে বিশ্ব কৃষ্টির পরিমণ্ডল, এর পরও প্রতিটি মানবগোষ্ঠীর থাকবে তাদের নিজস্ব সক্রিয়তা এবং পার্থক্য। বস্তুত নিজস্ব সক্রিয়তা এবং এ ভিন্নতাই হচ্ছে কৃষ্টির স্বরূপ। ব্রিটিশ কালচার, আমেরিকান কালচার, ফরাসি কালচার, রোমান কালচার বা ইজিপশিয়ান কালচারের মতো আমাদেরও রয়েছে একটি নিজস্ব কালচার। বৃহত্তর বাঙালি কৃষ্টির গা-বেয়ে বেড়ে ওঠা সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা ও মুরং ইত্যাদি আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠীর কৃষ্টি ঐতিহ্য আর বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের জাতীয় কৃষ্টিকে দিয়েছে এক বিপুল বৈচিত্র্য। আর এ বৈচিত্র্যের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং জাতিসত্তার স্বরূপ। পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশ’ আটানব্বই বর্গমাইলের এই সবুজ ভূখণ্ডে বাঙালি ছাড়াও আরও ১৬টি স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠীর বা উপজাতির ওপর বাঙালিত্ব চাপিয়ে দেয়াটা হবে মানবাধিকার লংঘন। আর সে কারণেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদটা হচ্ছে ব্যাপক গ্রহণীয় বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক ও কৃষ্টির দিক থেকেও অখণ্ডনীয়। আজ যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তারা কেবল মানবাধিকারকেই লংঘন করছে না বরং তারা বাংলাদেশের এই বহুমুখী কৃষ্টির বর্ণাঢ্যতাকেও মূল উত্পাটিত করে এবং এক সংকীর্ণ জাতিসত্তার কথাই প্রচার করছেন। স্বাধীনতা-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠী ও উপজাতীয়দের বাঙালি হয়ে যেতে বললেন, মূলত সেদিন থেকেই চাকমা বিদ্রোহের সূত্রপাত। বিচ্ছেদ নয়, মিলনই যদি আমাদের জাতিসত্তা এবং কৃষ্টির অহঙ্কার হয়ে থাকে তাহলে বাঙালি নয়, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনার মধ্যেই আমরা খুঁজে পাব আমাদের কৃষ্টির স্বরূপ এবং যার বহিঃপ্রকাশ থাকবে অভিনবও।
লেখক : সভাপতি, জাসাস
No comments